প্রতিভা সরকার
প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক, সমাজকর্মী
প্রায়ই ভাবি মোদিজির রাগের একটা নির্দিষ্ট ছক আছে, আর সেই ছকের একেবারে শীর্ষবিন্দুতে বসে আছে এদেশের মুক্তমনা লড়াকু মেয়েরা। তারা সঙ্ঘীদের ফর্মুলামাফিক সুশীলা নয়, পিতৃতন্ত্রের ফতোয়া মেনে চলাই তাদের জীবনে সব নয়। শারীরিক লাঞ্ছনার জুজু দেখিয়ে, অসম্মানের ভয় দেখিয়ে, প্রচলিত ধারণার দোহাই দিয়ে তাদের খাঁচায় পুরে রাখা যায় না। যেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বিভেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেখানেই অংশগ্রহণে এরা প্রথম সারিতে। শারীরিক পারিবারিক বাধা পেরিয়ে, সামাজিক অনুশাসনকে তুচ্ছ করে চলে এদের জয়যাত্রা। শুধু আজ নয়, সেই কবেকার ব্রিটিশ আগ্রাসনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল এই মেয়েরা, প্রয়োজনে স্বাধীনতা আন্দোলনের রাশ হাতে নিতেও তারা পিছপা হয়নি। অতএব মোদি অ্যান্ড কোং-এর রাগ হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে এবং সেই রাগের বশে এই মেয়েদের ওপর নামিয়ে আনা নিপীড়নও স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে যে ভয় দেখানো যায়নি, আরও অনেকের সঙ্গে আজকের সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, গৌরী লঙ্কেশ, সফুরা জারগার, মাসরাত জাহারা, দিশা রবি, নাতাশা নারোয়াল এবং সদ্যপ্রয়াত আসমত জামিল অহরহ তার প্রমাণ যুগিয়ে চলেছেন।
শেষের জন মাত্র সাত আটজন গৃহবধূকে নিয়ে একদিন জেদ ধরে বসে পড়েছিলেন পার্ক সার্কাস ময়দানে। তাঁর নিজের কথায়, দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধে। এনআরসি আর সিএএ মানি না, মানছি না, এই শ্লোগানে গলা মিলিয়ে সেই জমায়েত ফুলেফেঁপে উঠল অল্পদিনে, সুদূর বাঁকুড়া পুরুলিয়া থেকেও বন্যার মতো মানুষ ধেয়ে এলে প্রজাতন্ত্র দিবসে পার্ক সার্কাস চেহারা নিল জনসমুদ্রের। লক্ষাধিক মানুষ গর্জে উঠল, কালা কানুন বাতিল করো। দিল্লির শাহিনবাগের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম এই আন্দোলনের মূল সংগঠক ছিলেন আসমত জামিল, এক সংখ্যালঘু পরিবারের বধূ এবং জননী।
আসমতের কথা মনে হতেই ফিরে এল সেই দিনটি যেদিন প্রথম যাই পার্কসার্কাস ধর্নাস্থলে। যেখানে গিয়ে বসলাম সেখানে ঘোমটা-হিজাব, সব মিলেমিশে আজাদির শ্লোগানে ফেটে পড়ছে থেকে থেকে— আতঙ্কবাদ সে আজাদি, ছুয়াছুঁত সে আজাদি। আশেপাশে সমস্ত মুখই নারী। পুরুষেরা বেশিরভাগই ভলান্টিয়ার, দর্শক-শ্রোতা বা পর্যবেক্ষক। অবাঞ্ছিত কোনও ঘটনা ঘটে যায় পাছে, তাদের দৃষ্টি তাই সদা সতর্ক।
পাভেল এসে বলল, প্রতিভাদি, আসমতদির সঙ্গে দেখা না করে যেও না। উনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে এখানে মেয়েদের সংগঠিত করেছেন।
একটু এগিয়েই দেখা মিলল। কথা বলতে বলতে আসমতের গলা ভেঙে গেছে, কপালে এই শীতেও ঘাম চকচক করছে, তবু কী উজ্জ্বল মুখ! অপরিসীম পরিশ্রমের পর সে তখুনি বসতে যাচ্ছিল একটা প্লাস্টিক চেয়ারে, স্বাভাবিক ভদ্রতায় আবার উঠে দাঁড়িয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল। পার্কসার্কাসের ঘিঞ্জি এলাকা নড়বড়ে শরীর নিয়ে সে চষে বেড়িয়েছে। সঙ্গীসাথীদের নিয়ে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেছে। প্রেস সামলেছে, প্রশাসন সামলেছে, সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে। কারও কারও নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত ক্ষমতা থাকে, মানুষ তাকে আপন ভাবে, অকুণ্ঠ হয় তার কাছে। আসমতের ব্যক্তিত্ব ছিল সেইরকম।
এই যে এখানে এত মেয়ে জড়ো হয়েছে দিদি, এরা সবাই খুব খুব সাধারণ। কিন্তু এরা প্রতিজ্ঞা করেছে এসপার কি ওসপার। চালাকি কী কেউ বোঝে না! এনার্সির জোরে মুসলমানকে বে-ঘর করবে, বিদেশি নাম দেবে, তারপর দেশছাড়া করবে। সিএএ-তে যে শরণার্থী হয়ে আবেদন করবে সেটুকু চান্সও দেবে না। মুসলমানের ওপর এত রাগ কেন বলতে পারেন!
ওড়নার প্রান্ত দিয়ে পরিশ্রান্ত কপাল মোছে আসমত, তারপর বলে,
হিন্দুরাই কি রেহাই পাবে বলুন আপনি! অসমে তো বারো লক্ষই হিন্দু। সবাইকে শরণার্থী স্ট্যটাস দিতে পারবে? পিলভিতের খবর শুনেছেন তো?
আমার হাতে হাত জড়িয়েই সে বলে,
এত ভেদভাবের কোনও দরকার ছিল? আমরা তো কতকাল থেকে পাশাপাশি আছি। এই দেশকে দুজনেই নিজের বলে জেনেছি। আজ সব উল্টে যাবে দিদি? তা আমরা মেয়েরাই হতে দেব না। কিছুতেই না।
আসমতের বড় বড় চোখদুটোতে তখন প্রতিজ্ঞার কাঠিন্য আর জীবনের ঔজ্জ্বল্য মাখামাখি। তখনও সে এমন অসুস্থ নয় যে হুইলচেয়ার ছাড়া তার নড়াচড়া বন্ধ।
দেখে এসেছি আসমতেরা অদম্য। এতদিন পাশের মসজিদের একটিমাত্র টয়লেট ব্যবহার করছেন এত মহিলারা। সহনাগরিকেরা পাঠাচ্ছেন জলের বোতল, টুকিটাকি খাবার। মনে হল, আসমতকে বলি হ্যান্ডমাইকটা পাল্টাবার কথা। ওতে যেটুকু শব্দ হয় তা প্রায়ই হারিয়ে যায় সমুদ্রগর্জনের মতো স্লোগানে, তাই বোধহয় ওঁর গলা এত ভাঙা। কিন্তু বড় সঙ্কোচ হল কোনওরকম সাহায্যের কথা বলতে। এত প্রতিবন্ধকতা যারা দুহাতে ঠেলে সরাতে পারছে, বাকিটুকু তারা নিজেরাই করতে পারবে।
ফেরার সময় আধো অন্ধকারে বিশাল এবং ‘কুখ্যাত’ পার্কসার্কাস ময়দানের সবটুকু বিস্তার একা হেঁটে পার হতে সেদিন একটুও ভয় লাগেনি। আন্দোলনস্থলের থেকে ভেসে আসা একটা সদর্থক উষ্ণ অনুভূতি ঐ কুয়াশার মতোই এ তল্লাটকে যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিল। নিজেকেই নিজে বলছিলাম আসতে হবে, আবার আসতে হবেই। আসমতের টানে, আন্দোলনের টানে ফিরে আসতে হবে।
সে ফেরা হল না। কারণ করোনার দাপট। কারণ মৃত্যুর রাহাজানি। কিডনির অসুখে যারা ভুগছে তাদের কত সাবধানে থাকতে হয়, কত নিয়ম মানতে হয় সবাই জানে। আসমত এই সবকে তুচ্ছ করেছিল, জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য বানিয়েছিল। এমনকি একমাস আগেও মহানগরের পথে তাকে দেখা গেছে মিছিলের পুরোভাগে। হুইলচেয়ারে বসে আছে সে, দুহাতে তুলে ধরা পোস্টারে লেখা জয় কিসান। আসমত মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত সমস্ত দানবীয় কালাকানুনের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই জারি রাখতে হবে। সে চলে গেলেও তার স্থান শূন্য থাকবে না। নতুন কেউ আসবে, পতন অভ্যুদয়ের মাঝখান দিয়ে গেছে যে বন্ধুর পন্থা তাতে চলবার মতো যাত্রীর অভাব কোনওকালেই হবে না।
ভিডিও সৌজন্য: মিতালি
আসমত জামিল একেবারে ঠিক ভেবেছিল। দিকে দিকে সব প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে এগিয়ে আসছে দিশা, সাফুরা, নদীপ, নাতাশারা। নিপীড়ন আর অত্যাচারের মাঝখানে আশা জাগানো সব কিরণমালা।
চিরসারথির আসন কখনও শূন্য থাকে!