কমরেড মইদুল মিদ্যার মৃত্যু: একটি গণতান্ত্রিক বীভৎস মজা

সোহম দাস

 


গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, লোকশিল্প-গবেষক

 

 

 

প্রতিটা সকাল আসলে একরকমই হয়। প্রত্যয়ী, অমলিন, সুন্দর। এমনকি, যে সকালে মৃত্যুর খবর আসে, সেই সকালও আসলে জন্মের সময়ে তেমনই সুন্দর থাকে। তারপর হঠাৎ এক নিদারুণ ব্যস্ততা শুরু হয়। সকাল-শরীরকে জোর করে বেআব্রু করার ব্যস্ততা। সেই আব্রুহরণ সমাধা হলে তার কোলে আমরা সাজিয়ে দিই মৃত্যুর উপহার। সে মৃত্যুর বিষ সারা দিনের আহত শরীরকে আরও একটু করে করে পচনের দিকে ঠেলতে থাকে। সে পচনেই দিব্যি অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া আমাদের।

আজকের সকালেও একটা গলিত মৃত্যুসংবাদ এসেছিল। আরও এক অকালমৃত্যুর নির্ঘণ্ট। সে মৃত্যু বেদনাদায়ক। সেখানে হারানোর যন্ত্রণার বিদীর্ণতা স্তব্ধ করে দেহমন। নীরব হই। তবু সে সংবাদ একটা ঝাঁকুনি নিয়ে আসে। একটা অবস্থানগত প্রতিরোধ। ক্রমশ পচে যাওয়ার বহমানতায় অভ্যস্ত হওয়ার যে বিগলিত ধারা, ঠিক তার উল্টো স্রোতের এক প্রবহমান অবস্থান। সে স্রোতের কোনও অন্তিম বিন্দুর নিশ্চয়তা নেই। সে স্রোত জায়েজ। কালের দাবী মেনেই সে স্রোত আসে, ঢেউ তুলে এগিয়ে আসে। সেই ঢেউ-মিছিলের সামনে থাকা জলকণাটির বুকে তীব্র আঘাত নেমে আসতে পারে, সেই আশ্বাস নিয়েই সে এগিয়ে আসে শব্দ তুলে। জোরালো গম-গম শব্দ। সেই শব্দেরই শাস্তি, মৃত্যু।

কলকাতায় সেই শব্দ শোনা গেল। প্রেমদিবসের তিনদিন আগে প্রেমশহরের রাস্তা চিরে একটা ঢেউ উঠল। অসংখ্য ছাত্র-যুবার সঙ্ঘবদ্ধ পদস্রোত দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল মসনদের দিকে। তারা জবাব চায়। আমি সেদিন বাঁকুড়ায়। যে বয়সের ছাত্রছাত্রী কিংবা যুবক-যুবতীর ভিড়ে আড়াল পড়েছিল রাজপথ, তারা কেউ আমার চেয়ে বয়সে ছোট, কেউ সমবয়সী, কেউ সামান্য বড়। তারা নিজেদের দাবি নিয়ে অকুতোভয়ে শাসকের রক্তচক্ষুকে সোজাসুজি প্রশ্ন করতে রাস্তায় নেমে গেল, কাঁদানে গ্যাসের শেলের ঝাঁঝ তাদের চোখ ঝাপসা করে দিল, লাঠি খেয়ে মাথা ফেটে যাওয়ার পরেও স্লোগানের সুরের তেজ আরও বাড়ল, অথচ আমি সেই একই বয়স এবং শ্রেণিবৃত্তের মাঝে অবস্থান করেও দূর এক মফঃস্বলের আপাত নিরাপদ বলয়ে কাজের সুবিধায় এসবের আঁচ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম।

এ এক দারুণ মজা।

কাজের কথা বলছিলাম। কাজ ছিল লোকশিল্প নিয়ে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেই অন্তরঙ্গ জীবন, উদয়াস্ত পরিশ্রমকে তুলে ধরার ফরমাশ। লোকশিল্প বললেই আজকাল অবশ্য অন্য দৃশ্য। সেখানে শিকড় খোঁজার বালাই নেই, শুধু ব্র্যান্ডিং গড়ে তোলার রাজনীতি আছে। অভিনব ‘ঝিনচ্যাকত্ব’। শিল্প করে খাওয়া মানুষগুলোর দোষ দেখি না। তাঁদের রুজি-রোজগারের চিন্তা তাঁদেরকেই করতে হয়। অতএব, সেখানে নিয়মিত রোজগারের জোগানটুকুই তাঁদের দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশংসা করিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মধ্যবিত্তের শরীর-মন অবশ্য মিস্টিক গণ-সম্মোহনের চাকর। আমরাও সেই শ্রেণিতেই পড়ে এসেছি বরাবর। ‘আহা, তবু তো কিছু সুরাহা হয়েছে ওদের। এটুকু মানতেই হবে, এদের জন্য অনেক কাজ হয়েছে।’

কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যা যেদিন পুলিশের মার খেয়ে কলকাতার রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল, আমি সেদিন বাঁকুড়ায়। ওর জেলায়। ও সেদিন আমার শহরে। আমি যে কাজে গিয়েছিলাম, সেই কাজ ছিল সরকারি নির্দেশিকার। ভালো জায়গায় থাকা-খাওয়ার নিরাপত্তা আমার সুনিশ্চিত ছিল। গোটা সফরে একটি পয়সাও আমায় দিতে হয়নি। আমার সুবিধাগত অবস্থানের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে মইদুল মিদ্যা কলকাতায় এসেছিল। সুবিধার দাবি করতে নয়, কাজের দাবি করতে। মইদুল টোটো চালাত। লোকে বলছে, সে শিক্ষিত ছিল, শিক্ষিত হয়েও টোটো চালাত। বেশ করত। টোটোই চালাত, চুরি করত না। ‘শিক্ষিত হয়েও’ কথাটা ব্যবহারের চেষ্টা করবেন না প্লিজ। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও তাকে আমি কমরেড বলতাম। কেননা, তার কর্মনিষ্ঠায় সাংগঠনিকতা ছিল। একটা দায়বোধ ছিল। সেটা বৃহত্তর পরিসরের। মইদুলেরও পরিবার ছিল। প্রৌঢ়া মা, স্ত্রী, দুই ছোট্ট মেয়ে। তাদের স্বপ্ন বুকে নিয়ে, বৃহত্তর দায়বোধ মাথায় নিয়েই, মইদুল কলকাতায় এসেছিল। আরেকটু স্বচ্ছলতার নিশ্চয়তা পেতে। নিশ্চয়তা দিতেও। চারটে মানুষের স্বপ্ন ধারণ করা সেই বুকেই জোরালো আঘাত করল রাষ্ট্র। মইদুল ইসলাম মিদ্যা মরে গেল।

মইদুল-সহ আরও অনেকে সেদিন মিছিলের ভিড়ে যন্ত্রণা সহ্য করেছে। অনেকেরই ঠিকানা হয়েছিল হাসপাতালের খাটের ঠান্ডা চাদর। কেউ কেউ কপালে জড়ানো শ্বেতশুভ্র ‘রাষ্ট্রীয়’ চিহ্ন নিয়ে আবারও নেমে এসেছিল পথে। ঠিক তার পরদিনই একটি হরতাল ডাকা হয়েছিল। অর্ধদিবস। মইদুল-সহ আরও অনেক কমরেডই সেদিন হাসপাতালের কেবিনে বন্দি। আমি কলকাতা ফিরব। আমার বাঁকুড়ার দিকের কাজ শেষ। এবার পুবমুখো হয়ে কলকাতা ফেরা। আসার পথে বেশ কয়েক জায়গায় কিছু খুচরো কাজের পরিকল্পনা। বিষ্ণুপুর, জয়পুর, কোতুলপুর। বাঁকুড়ার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ওম গায়ে মেখে নিয়ে ফেরার আকুতি।

শেষ গন্তব্য কোতুলপুর। সেখান থেকে দেড় কিলোমিটার ভেতরে একটা সাঁওতাল-অধ্যুষিত গ্রাম খিরিতে পরব নাচ আর ডং নাচের দৃশ্যায়ণ চলছে। মাটি-লেপা বাড়ি দরকার আমাদের। নইলে ফ্লেভার আসবে না। বিশ্বায়ন চাই, অথচ বিশ্বায়নের সমস্যাগুলো শেষমেশ নিজেদেরই পরিপন্থী হয়ে ওঠে। এই সহজ সত্যিটা আর যে কবে বোঝা যাবে! মাটির উঠোনে রংবেরঙের নারী-পুরুষের সমাগমে এক অন্য সমাজের গন্ধ। মাদল বাজছে। গুমগুম। বন্য আওয়াজের সুরে মাদকতা ওঠে স্বাভাবিকভাবেই। লোকজন ভিড় করে আসে। একটা বেশ ব্যাপার হচ্ছে বটে। সম্মানীয় অতিথিদের আপ্যায়নের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করার তোড়জোড়। তারপর… নিশ্চিন্তির ঘেরাটোপে বাড়ি ফেরার পালা। শুধু কাঁটার মতো একটাই দুশ্চিন্তা— হরতালে গাড়ি আটকে যাবে না তো?

গাড়ি আটকায়নি। নির্বিঘ্নেই সমস্ত কাজ সমাধা করে বেশ মজা নিয়েই কলকাতায় ফিরেছিলাম।

ঠিক তার তিনদিন পরে, প্রেমদিবসের একদিন পরে, সরস্বতী পুজোর একদিন আগে, মইদুল ইসলাম মিদ্যা মরে গেল। আমাদের সকলের জন্য একটা সুখস্বর্গের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে যুবনেতা মইদুল শহিদ হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার আনন্দ নিয়ে আমরা কোতুলপুর থেকে কলকাতায় ফিরেছিলাম। কোতুলপুরে মইদুলের বাড়ি। বাড়িতে আছে মা, বউ, দুটো মেয়ে। কলকাতা থেকে মইদুল কোতুলপুর ফিরতে পারল না।

মইদুলের ডাকনাম ছিল ফরিদ। ফরিদ মরে গেছে। প্রেমদিবসের পরদিন মায়ের কোল খালি করে মরে গেছে ফরিদ। তার বউ একা হয়ে গেছে, মেয়েরা আশ্রয়হীন। তার মৃত্যুর ভারে রাতারাতি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের স্পর্ধা টলবে না। সরকার থাকবে গদিতেই। তবু সে মৃত্যু অতুলনীয়। তার ডাকনামের মতোই সে মৃত্যু অনন্য।

আর এই আমরা, গণতান্ত্রিক সমাজ-পরিকাঠামোর আপাত-সুবিধাজনক জায়গায় বসে থাকা সম্মোহিতের দল এক উদযাপন দেখব। বৃহত্তম গণতন্ত্রের বীভৎস, জবরদস্ত এক উদযাপন।

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...