স্বপন ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
অতি সম্প্রতি আনলফুল অ্যাকটিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট (ইউএপিএ)-এ বন্দি এ দেশের নাগরিকরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা একটি জামিন বহাল রাখার ঘটনায়, অনুজ্জ্বল হলেও, কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। অতিমারিকালে, গত বছরের ২০শে সেপ্টেম্বর ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজ্যসভায় একটি প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন যে লাগু হবার পর থেকে তিন বছরে এই আইনে গ্রেফতার হওয়া সহনাগরিকের সংখ্যা ৩৯৭৪ এবং তার মধ্যে ৩০০৫ জনের বিরুদ্ধে ততদিনে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। ঘটনা এই যে, এঁদের মধ্যে কোনও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দায়ের করা চার্জশিট যত দুর্বলই হোক না কেন, গ্রেফতারির পরে তাঁদের জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা এতাবৎকাল খুবই ক্ষীণ বলে বিবেচিত হত। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় তাঁদের কাছে সুড়ঙ্গের শেষে আলোর আভাসের মতো প্রতীয়মান হচ্ছে।
ইউএপিএ-তে গ্রেফতারির পরে বিচারের গজকাঠি হিসাবে এখন অবধি যে মামলাটির উল্লেখ স্বতঃসিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়ে আসছিল তা হল ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি (এনআইএ) বনাম ওয়াতালি মামলা। ২০১৯ সালে জহুর আহমেদ শাহ ওয়াতালি গ্রেফতার হন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের এক সদস্যর কাছ থেকে অর্থ জোগাড়ের জন্য যা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ আদালতে ওয়াতালির জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয় কিন্তু দিল্লি হাইকোর্ট বিশেষ আদালতের এই রায় বাতিল করে জামিন ঘোষণা করলে এনআইএ সুপ্রিম কোর্টে যায়। সর্বোচ্চ আদালতের দুই সদস্যের বেঞ্চ সব দিক খতিয়ে দেখে অভিমত প্রকাশ করে যে দিল্লি আদালতের রায়টি ‘পারভার্স’— সম্ভ্রমহীন এবং জামিনের আবেদন বিবেচনা করবার বদলে দিল্লি হাইকোর্ট একটি ছোটখাটো বিচারসভা বসিয়েছিলেন বলেই মনে হয়েছে মাননীয় বিচারপতিদ্বয়ের। এর পর থেকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ইউএপিএ-আইনে আটক ব্যক্তির জামিনের বিবেচনা হত ওয়াতালি মামলার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। কেরল হাইকোর্টের টি এ নাজিব বনাম ভারত সরকার মামলায় এর প্রথম ব্যতিক্রম দেখা গেল যা সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকেও সবুজ সঙ্কেত পেয়েছে।
টি এ নাজিব গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০১০–এ পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া নামক একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সদস্যরূপে জনৈক অধ্যাপক টি জে জোশেফের হাতের পাঞ্জা চপার দিয়ে কেটে ফেলার ঘটনায়। অধ্যাপক জোসেফ নাকি ইসলাম ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করার কাজে লিপ্ত ছিলেন (ব্ল্যাসফেমি) এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সে কাজের শাস্তি দিতে এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছিল, অভিযোগ, নাজিব তাদের মধ্যে একজন। ঘটনার পরে, গ্রেফতারি এড়াতে তিনি ফেরার হয়ে যান বলে দাবি করে এনআইএ। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন ধরা পড়লে নাজিবের হদিশ মেলে এবং তিনি কারাগারে অন্তরীণ হন। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়কালে তাঁর জামিনের আবেদন ছবার প্রত্যাখাত হয়। আদালত প্রতি ক্ষেত্রেই অভিমত দেয় যেহেতু আক্রমণের পরিণতি সম্পর্কে নাজিব ওয়াকিবহাল ছিলেন সেহেতু তিনি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশীদার, ফলে, তাঁর জামিনের আবেদনে সারবত্তা নেই। এবার কিন্তু কেরল হাইকোর্ট তাঁর জামিন মঞ্জুর করে বলে অভিযুক্ত যেহেতু অতি লম্বা সময় জেলেই কাটিয়েছেন এবং যেহেতু কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এখনও দাখিলে সক্ষম হয়নি এনআইএ, সেহেতু তাঁকে জামিন না দেওয়াটা একদেশদর্শিতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে এবং সেটা হবে পূর্ববর্তী মামলাগুলি দ্বারা প্রভাবিত সিদ্ধান্ত।
মনে রাখা দরকার, একজন নাগরিকের সাধারণ আইনি অধিকারগুলোর সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার হওয়া নাগরিকের অধিকারগুলি বিবেচিত হয়ে থাকে। সে ধারাই এমন যে জামিন এখানে ব্যতিক্রম। জামিনের আবেদন বিবেচনায় আদালত সাধারণত ইউএপিএ আইনের ৪৩ডি(৫) ধারাটিকে মানদণ্ড ধরে নিয়ে থাকে। এই ধারা কী বলছে তা দেখে নিতে পারি একবার। বলছে “on a perusal of the case diary or the report made under section 173 of the CrPC is of the opinion that there are reasonable grounds for believing that the accusation against such person is prima facie true”— যদি কেস ডায়েরি বা রিপোর্টের ভিত্তিতে দেখা যায় যে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় ফৌজদারি বিধির ১৭৩ ধারায় তোলা অভিযোগগুলির যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তি আছে তা হলে ধরে নিতে হবে যে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগসমূহ প্রাথমিকভাবে সত্য। এ একটা মারাত্মক ধারা কেন না ১৭৩ ধারায় এমনিতেই আদালত অভিযুক্তের পূর্ব অপরাধ, ফেরার হওয়ার সম্ভাবনা, অভিযোগকারীর ক্ষতিসাধনের চেষ্টা ইত্যাদি নানা দিক বিবেচনা করে জামিনের আবেদন ফয়সালা করে। এই ইউএপিএ আইনে এসব তো বিবেচ্য বটেই, উপরন্তু রয়েছে এই ‘প্রাইমা ফেসি ট্রু’ বলে ধরে নেওয়ার লাইসেন্স, ফলে সুধা ভরদ্বাজ থেকে উমর খালিদ, সকলেরই কারাজীবন ইলাস্টিকের মত লম্বা হতে বাধা নেই। এর প্রথম ব্যতিক্রম ঘটল টি এ নাজিবের এই মামলাটির ক্ষেত্রে।
কেরল হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টে গেলে জাস্টিস রামানা, সূর্যকান্ত ও অনিরুদ্ধ বোসের বেঞ্চ অবশ্য মেনে নিয়েছে যে আদালতের জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করার হক আছে যদি ওই ‘প্রাইমা ফেসি ট্রু’ সংস্থানটি সঠিকভাবে প্রযোজ্য হয়। নাজিবের ক্ষেত্রে আদালতকে এড়িয়ে চলার, ফেরার হওয়ার নজির আছে ফলে সে জামিন পেলে আবার পালাবে না তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এনআইএ যে কেরল হাইকোর্টের জামিনের সুযোগ দেওয়াকে চ্যালেঞ্জ করে বলছে এই মামলায় এখনও ২৭৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি, তা সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনায় লোকটা পাঁচ বছরের বেশি জেল খেটে ফেলার পরে অভিযোগকারীর দুর্বলতা, অভিযুক্তের নয়। দ্বিতীয়ত, এ মামলায় যারা অভিযুক্ত হয়ে জেল খাটছে তাদের সর্বোচ্চ কারাবাসের মেয়াদ হতে চলেছে আট বছর। নাজিব সে মেয়াদের দুই তৃতীয়াংশ বিচারাধীন হয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। তৃতীয়ত, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় বলছে “Watali dealt with an entirely different factual matrix”— ওয়াতালি মামলার সঙ্গে এটাকে মেলানো যাবে না কেন না সে মামলার ঘটনাজাল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নাজিবের জামিন মঞ্জুর করে কেরল হাইকোর্ট আধিকার লঙ্ঘন তো করেইনি বরং ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত নাগরিকের ‘মৌলিক অধিকার’-এর প্রেক্ষিতে দেখতে হবে এই রায়কে। সুতরাং সর্বোচ্চ আদালত এতাবৎকালের প্রথার বাইরে গিয়ে একটি ইউএপিএ মামলার ৪৩-ডি(৫) উপধারাটিকে বিবেচনা করেছে বলা যায়। এর আগে ব্যতিক্রম ঘটেছিল সারুফা জারগারের মামলায় যখন গর্ভাবস্থার কারণে তাকে জামিন দিয়ে দিল্লি হাইকোর্ট বলেছিল এ যেন প্রিসিডেণ্ট বা অনুসরণযোগ্য নজির হিসাবে ইউএপিএ আইনের অন্য মামলায় দাখিল করা না হয়, কেন না অভিযোগকারী সংস্থা জামিনের বিরোধিতা করেননি। নাজিবের মামলায় এই একুশ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের রায় অবশ্য ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’— বিচারে দেরি মানে বিচারে বঞ্চনা— এই যুক্তি মেনে পরবর্তী সমস্ত মামলায় এ রায়কে উল্লেখ করার সুযোগ খুলে রেখেছে। উচ্চতম আদালতের সাম্প্রতিককালের হাল-হকিকতের নিরিখে এই রায়কে অন্তত আপাতভাবে অন্ধ কারায় আশার আলো বলে মনে হচ্ছে। মুম্বই হাইকোর্টে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত কবি ভারাভারা রাও মামলায় যখন ওষুধ-বিসুধ-চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়ার কথা উল্লেখিত হবে, যখন সুধা ভরদ্বাজের মামলাটি বয়ে যাওয়া সময়ের নিরিখে আবার শোনা হবে, যখন ফাদার স্ট্যান স্বামীর বয়স ও মানসিক স্থিতি পুনর্বার বিবেচিত হবে, যখন উমর খালিদের জামিনের আবেদন আবার উঠবে আদালতে, তখন এই নাজিব মামলার রায় নিশ্চয়ই উল্লেখিত হবে মানবাধিকারের স্বপক্ষে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে উদ্দীপিত করতে। মনে হচ্ছে একটি আশার বীজ উপ্ত হয়েছে ঊষর মাটিতে, তবে পাতাগুলি সবুজ হয়ে ওঠার আগেই গরু-ছাগলে তা মুড়িয়ে খেয়ে যাবে কিনা তা বলবে সময়।
এই লেখা প্রেসে যাওয়ার মুখে খবর পাওয়া গেল কবি ভারাভারা রাও জামিন পেয়েছেন। অসুস্থ এই একাশি বছর বয়সি কবির জামিনের আবেদন শুনতে গিয়ে আদালত এই প্রথম মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন এখনও দ্বিশতাধিক সাক্ষীর বয়ান নেওয়া বাকি আর সেটা একজন অসুস্থ মানুষকে বিচারের আগেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি করে রেখে দেওয়ার যুক্তি হতে পারে না। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। বলেছিলাম কিছুটা আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যেন।