চারটি কবিতা
সংবেদনশীলতা প্রসঙ্গে
শপথও একরকম কথার কথা, মহামান্য জীবনে হঠাৎ খেলো হয়ে যায়।
বরং স্তনযুগল আর যোনির মাঝে বিস্তৃত সুরেলা তারটির কথা ভাবুন;
সেখানে ট্রাপিজের অভ্যেস করেনি— এমন মানুষ দুর্লভ।
সাদা গলবস্ত্র অনেককে দূর থেকে দুলতে দেখে কাশফুল মনে হয়,
অথচ আপনার প্রাক-উৎসব ইউটোপিয়ায় তারা কেউ আমন্ত্রিত নয়।
তাদের চোখ জ্বলছে হোমে, যজ্ঞে, চিতায়… অথবা নিছকই রাত জেগে।
রাধা, রামী কিংবা আপনার প্রিয় অভিনেত্রীর জ্যামিতির কাছে
শেয়াল কিংবা বামন হয়ে যাওয়া কোনও পাত্রীর ছবি
দেখা-মাত্র নাকচ করলে আপনার ঘুম ভালো হয়।
নিষ্কাম জ্যাঠামশায়ের দ্বিতীয় বিবাহের প্রীতিভোজ তৃপ্ত করে আপনাকে।
সোনার আংটি— জনৈকের মেধাবী হাসির মতই বাঁকা;
সে আংটিতে কনডোম বেঁধে ফোলাতেই একটা চড় আর দুটো ছি-ছি ফেটে যায়।
ঠিকে-ঝি কামাই করে, কারেন্ট চলে যায়, কলে জল আসে না নিয়ম মেনে।
এত নেতির মাঝেও কী অদ্ভুত নৈপুণ্যের সঙ্গে ভাত রান্না হয় প্রতিদিন!
রাজার মত পায়ের ওপর পা, ছেঁড়া চটি— আরও একদিন পার করে শাসনকাল।
চটে গিয়ে জানলা বন্ধ করলেন? আমি তো সবই আপনার পেছনে…
দেওয়ালের ওই ক্যালেন্ডারকে বললাম!
জিভ বেরিয়ে এসেছে, চোখে জল… একটা চোখে উইতে কেটে কেমন করে দিয়েছে!
আপনার দেখে মায়া হয় না?
[ভাদ্র, ১৪২৫]
আয়োজন
একটা সাদা কাগজে ফাউন্টেন পেন দিয়ে কবিতা লিখব।
তারপর সেই কাগজের নৌকা বানিয়ে রেখে দেব…
সবুজ জলে নয়
লাল মেঝের ওপর, যেখানে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে
রোদ্দুর আসে।
ভাবি আর ভুলে যাই।
কাগজের নৌকার ছবি দেখে মনে পড়ে—
খবরের কাগজ দিয়ে নৌকা বানাব?
বাংলা খবরের কাগজ দিয়ে?
তারপর আবার মনে পড়ে—
সাদা কাগজ, ফাউন্টেন পেন, লাল মেঝে আর রোদ্দুরের ফ্রেম।
বাহুল্য আর বিলাসিতা তেতো বিরক্তি প্রসব করছে কাছে-দূরে,
বলতে সঙ্কোচ হয়—
এত আয়োজন, একটা জুতসই ছবি তোলার জন্য!
একটা কেজো ছবি। দরকার। কিছুতেই হয়ে উঠছে না।
[শ্রাবণ, ১৪২৬]
পারিবারিক ছুটি
ফেনা শুকিয়ে পড়ে থাকে অস্থি-নুন।
নুন মিশে যায়
বালিতে
ইমারতে
ঘামে
এই অবধি শুনে, মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ভাবো—
ফেনা মিশে আছে এই সব কিছুতে।
ঢেউ মিশে আছে।
একটা আস্ত সমুদ্র, অথবা মহাসাগরই মিশে আছে।
মহাসংক্রমণের মাঝে আমরা হাসি,
নুনের পুতুলের মত মহাসাগরে গলে যেতে যেতে মনে হয় —
রুম ফ্রেশনারে ঝাউবনের গন্ধ নেই কেন!
[১৪২৫]
গ্ল্যাডিয়েটর
এক ষড়পদ শঙ্খ সূর্যোদয়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে
আর সমুদ্র পিছিয়ে যাচ্ছে বালি ঘেঁটে, একটু একটু করে,
সেখানে সারি সারি গোড়ালির অগভীর চিহ্নে ডুবে যায়
মৃত ঝিনুকের অবশেষ।
সেখানেই কোন এক ব্রহ্মমুহূর্তে, হাতে হাত রেখে
সমুদ্রকে ছেঁকে ফেলছিল দীর্ঘ মানবশৃঙ্খল!
জানি, কেউ বিশ্বাস করবে না…
হেটো ধুতি পরে বসে চা খাওয়া আধবুড়ো লোকটাও—
ভোর রাতে গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে ওঠে।
তার হাঁটুর প্রাচীন ক্ষত চিহ্ন, সেও এক অসম যুদ্ধের স্মৃতি।
লোকে বলে— মাতাল পড়ে গেছিল ভাঙা বোতলের ওপর;
মাতাল হাসে… ভাঙা বোতলের কাচ হাসে, হাসির শব্দ ঢেউয়ে ভাঙে খান খান।
জানি, কেউ বিশ্বাস করবে না…
শেষ রাতে, ওই মাতাল আধবুড়ো বেয়নেটকেই হাল করে সমুদ্রে নৌকা ভাষায়।
ওর তখন ঘোর থাকে, নেশা কেটে যায়।
ও ভুলে যায়, এমনই ভোর রাতে—
কে কে পালিয়ে গেছিল ওকে একা রেখে।
কেমন ছিল চাবুকের প্রথম শপাং।
আলাদা আলাদা পালিয়ে যাওয়ার কথা
ষড়পদ শঙ্খর মত পিছিয়ে যাওয়া ঢেউয়ের দিকে হাঁটা শুরু করে।
সাদা কাপড়ে ঢাকা শব কাঁধে নিয়ে চার-জন তালে তালে পা ফেলে
পালকীর বেহারার মত হুন-হুনা রব তুলে ছুটে যায় মহশ্মশানের দিকে।
আর হঠাৎই দোকানি মনে করিয়ে দেয়—
দাম মিটিয়ে দেওয়ার কথা!
আমাকেই ডাহা মিথ্যেবাদী প্রমাণ করে উঠে চলে যায় প্রাচীন যোদ্ধা,
চলে যায় আঁশ-ছাড়ানো হাটে, গোড়ালির তলায় পেয়ালা পিষে দিয়ে।
[কার্তিক, ১৪২৭]