প্রবীর মুখোপাধ্যায়
প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
আজ থেকে ১১৪ বছর আগে, ১৯০৭ সালে পাঞ্জাবের কৃষকদের সরকারের গোলাম বানানোর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার নিয়ে আসে তিন-তিনটি আইন— দোয়াব-বারি অ্যাক্ট, পাঞ্জাব ল্যান্ড কলোনাইজেশন অ্যাক্ট আর পাঞ্জাব ল্যান্ড অ্যালায়েন্সেস অ্যাক্ট। এই সব আইনের মাধ্যমে কৃষকদের জমিজিরেত ফসল সব ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল সরকার। কৃষকের মান-ইজ্জত আর থাকবে না। এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠে গোটা পাঞ্জাব। গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলেন সর্দার অজিত সিং (শহীদ-এ-আজম ভগত সিং-এর কাকা)। আন্দোলনে যোগ দেন লালা লাজপত রায় ও আরও অনেক রাজনৈতিক নেতা। পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে লালা বাঁকে দয়াল রচনা করেন “পগঢ়ী সম্ভল জট্টা” যে গান আজও লোকের মুখে মুখে প্রচলিত। উত্তর ভারতে মস্তক-আবরণ পাগড়ির একটা বিশেষ সম্মান ও গুরুত্ব আছে। ব্রিটিশ সরকারের আনা এই তিনটি আইন কৃষকদের সেই সম্মান লুঠ করে নিতে চায়— সেই কারণে কবি সবাইকে আহবান করছেন আত্মাভিমান রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে, নিজের পাগড়ির সম্মান রক্ষা করতে। এই আন্দোলন পরিচিত হচ্ছে “পগঢ়ী সম্ভল জট্টা” আন্দোলন হিসেবে। শ্রমজীবী কৃষকের জমি-ফসল রক্ষার সংগ্রাম তার স্বাধিকার, স্বাভিমান আর স্বনির্ভরতা রক্ষার আন্দোলনের স্তরে উন্নীত হয়ে গেল।
এরই প্রতিচ্ছবি কি আজ উত্তর ভারতের কৃষক আন্দোলনের মধ্যে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে? এখনই হয়ত উত্তর পাওয়া যাবে না, কারণ অনেক পথ চলা এখন বাকি আছে। তবুও যেটুকু দেখা গেছে তার মধ্যে এই আন্দোলনের গভীরতা আর ব্যাপ্তি নিশ্চয় করে অনেক চিন্তার খোরাক যোগাচ্ছে। এই আন্দোলন যে শুধু এই কৃষি আইনগুলি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তাই নয়, প্রশ্ন তুলেছে সাংবিধানিক নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে, প্রতিবাদের ভাষা কী হবে তাই নিয়ে, মানুষের জীবন-জীবিকা-সম্মানের সব প্রশ্ন যে আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায় না এবং সেই কারণে সর্বোচ্চ আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে, সংসদীয় ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা নিয়ে, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক সমাজের রীতিনীতির রূপরেখা নিয়ে।
এত সব প্রশ্নের জবাব এই প্রবন্ধে দেওয়া সম্ভব নয় আর এই লেখকের পক্ষে সম্ভবও নয়। এখানে আলোচনা কৃষি আইনগুলির চারপাশেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
কর্পোরেট সেক্টরের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য কীভাবে সংবিধানের অপব্যবহার করে দেশের ব্যাপকতর কৃষিজীবী মানুষের কাছ থেকে তার জমি আর ফসল ছিনিয়ে নেওয়া হবে তার অনন্য উদাহরণ পাওয়া যাবে সাম্প্রতিক এই তিনটি কৃষি আইনে। উৎপাদনের মাধ্যম যে জমি আর উৎপাদনের ফল যে ফসল তার মালিকানা কৃষকের কাছে যে কত গুরুত্ব বহন করে সেটা আমরা— তথাকথিত লেখাপড়া জানা শহুরে মানুষেরা— বুঝতে পারি না বা বুঝতে চাইও না। কিন্তু কৃষকের কাছে এই দুটি তার বেঁচে থাকার প্রধানতম শর্ত। জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেলে, ফসলের মালিকানা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলে সে আর কৃষক থাকবে না, মজুরি-ভিত্তিক-শ্রমিক হয়ে যাবে। এই কথাটা আমাদের পক্ষে বোঝা শক্ত হলেও কৃষকের পক্ষে নয়, তাই বড় হোক, ছোট হোক, সব কৃষক একসঙ্গে এই তিন আইনের বিরোধিতাতে কোমর কষে নেমেছে।
শুধু তাই নয়, এই তিনটি কৃষি আইনের মাধ্যমে কীভাবে সংসদীয় রীতিনীতি জলাঞ্জলি দিয়ে এই সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে চলেছে তার উদাহরণও আমাদের সামনে আসছে। আসলে লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসার পর থেকেই বর্তমান সরকার এই কাজ করে চলেছে প্রায় অবাধেই। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (CAA), জাতীয় নাগরিকপঞ্জী প্রণয়ন (NRC), জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন (NEP) এমন অনেক উদাহরণ-ই আমাদের সামনে আছে। প্রায় বিনা প্রতিরোধে প্রতিবাদে সরকার নিজেদের ইচ্ছে জনগণের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে চলেছে। শুধু এই কৃষি আইনের ক্ষেত্রে এত সহজে ব্যাপারটা করে ফেলা যাচ্ছে না। একগুঁয়ে কৃষকেরা রুখে দাঁড়িয়েছে বলেই অনেক প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। কৃষকদের প্রতিরোধ গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সংখ্যালঘু জনমতের উপযুক্ত মান্যতা এইসব মৌলিক প্রশ্ন সামনে এনে দিয়েছে।
কৃষি আইন নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতেই কৃষি আইনগুলির সাংবিধানিক বৈধতা প্রসঙ্গ আলোচনা করে নেওয়া দরকার।
আমাদের সংবিধানের একেবারে শুরুতেই বলে দেওয়া হচ্ছে “India, that is Bharat, shall be a Union of States” (অনুচ্ছেদ ১)। ইন্ডিয়া, অর্থাৎ ভারত, রাজ্যগুলির একটি সঙ্ঘ। সুতরাং এখানে রাজ্য আর সঙ্ঘ সহাবস্থান করবে। সংবিধানের ২৪৫ অনুচ্ছেদে বলে দেওয়া হচ্ছে স্টেট অর্থাৎ রাজ্য আর ইউনিয়ন অর্থাৎ সঙ্ঘ সরকারের মধ্যে কার্যক্ষমতা ও অধিকার কীভাবে ভাগ করা থাকবে।
একটা বিষয় এখানে পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। সংবিধানে কোথাও কেন্দ্র বা কেন্দ্রীয় সরকার এমন শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়নি। কেন্দ্র বা কেন্দ্রীয় বললে রাজ্যের মাথার ওপরের সংস্থা বলে মনে হয়। কিন্তু সংবিধান প্রণেতারা ইউনিয়ন বা সঙ্ঘ সরকারকে রাজ্যের মাথার ওপরে বসাতে চাননি। তাঁরা চেয়েছিলেন যে রাজ্য সরকার ও ইউনিয়ন সরকার নিজের নিজের এক্তিয়ারভুক্ত কাজ স্বাধীনভাবে নির্বাহ করবেন। প্রয়োজনে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবেন। সেইজন্য সংবিধানে সপ্তম তফসিলে ইউনিয়ন তালিকা, রাজ্য তালিকা আর যুগ্ম তালিকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। এই তালিকার ভিত্তিতে ইউনিয়ন সরকার আর রাজ্য সরকারের ক্ষমতা ও এক্তিয়ার সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। উভয়ে একত্রে কী কী কাজ করবেন সেটা বলা আছে যুগ্ম তালিকায়।
অনুচ্ছেদ ২৪৬-এর প্রথম তালিকা— ইউনিয়ন তালিকার ৪১ ও ৪২ অনুচ্ছেদে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে আর দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য ও ব্যবসায় প্রসঙ্গে ইউনিয়ন সরকারের অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু কৃষিজ পণ্যের কথা এখানে বিশেষ করে বলা হয়নি। ঐ তালিকারই ৮২ অনুচ্ছেদে ইউনিয়ন সরকারের কর ধার্য করার অধিকার থেকে কৃষিক্ষেত্র থেকে অর্জিত আয়কে পৃথক রাখা হয়েছে। এমন কি ৮৬, ৮৭ আর ৮৮ অনুচ্ছেদে যথাক্রমে মূলধনী সম্পদ (ক্যাপিটাল অ্যাসেট), এস্টেট ডিউটি আর সম্পত্তি উত্তরাধিকার করের ক্ষেত্রেও কৃষিক্ষেত্র থেকে অর্জিত আয়কে ইউনিয়ন সরকারের এক্তিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছে।
এবার আসি দ্বিতীয় তালিকা— রাজ্য তালিকায়। কৃষি (১৪), জমি (১৮), মৎসচাষ (২১), বাজার এবং মেলা (২৮), ভূমি-রাজস্ব (৪৫), কৃষিজ আয় (৪৬), কৃষিজমির উত্তরাধিকার (৪৭) আর কৃষি জমির ক্ষেত্রের এস্টেট ডিউটি (৪৮) সবই রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভূক্ত।
তৃতীয় তালিকা অর্থাৎ যুগ্ম তালিকার ৬ অনুচ্ছেদে বলা হল সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কৃষিজমিকে বাইরে রাখা হচ্ছে।
এর থেকে পরিষ্কার হচ্ছে যে সংবিধান প্রণেতারা কৃষিক্ষেত্রকে সম্পূর্ণভাবে রাজ্যের অধিকার ও এক্তিয়ারে রাখতে চেয়েছেন। বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ভৌগলিক ও পরিবেশগত এবং সাংস্কৃতিক বহুমুখীনতার কারণে কৃষিজ পণ্যের, কৃষিপদ্ধতির আর কৃষিপণ্যের বিপণন ব্যবস্থায় বিভিন্নতা ভারতের এক লক্ষণীয় বৈশিষ্ট। অনেকেই যুক্তিযুক্তভাবে মনে করেন যে সেই বিশিষ্টতাকে বজায় রাখার কারণে কৃষিক্ষেত্রকে একান্তভাবে রাজ্যের অধিকারে রাখা ভারতের সংবিধানের একটি মৌলিক শর্ত এবং সে কারণে অপরিবর্তনীয় শর্ত। ইউনিয়ন সরকার রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে তাদের সম্মতি না নিয়ে এই নতুন এই কৃষি আইনগুলি প্রণয়ন করে নিজেদের এক্তিয়ার ও অধিকারের বাইরে গেলেন।
এই আইনগুলি প্রণয়নে কীভাবে যে সংসদীয় রীতিনীতি অগ্রাহ্য করা হয়েছে সেটা বোঝার জন্য এই আইন প্রণয়নের কালপঞ্জি বিস্তারিতভাবে দেখা দরকার। কৃষিজ পণ্য বিপননের জন্য ২০০৩ সালে Agricultural Produce Marketing Committee সংক্ষেপে APMC গড়ে তোলা হয়। কিন্তু এই বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা আর পরিচালন করা সম্পূর্ণরূপে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার এমন কয়েকটি রাজ্যে এপিএমসি গড়ে ওঠে, আবার অনেক রাজ্য উদাসীন থাকে। বিহারে পরবর্তী সময়ে এপিএমসি ভেঙেও দেওয়া হয়। প্রধানত সবুজ বিপ্লব যেসব এলাকায় সফল হয়েছে সেখানেই সরকারি সহায়তায় এই ‘মান্ডি’ গড়ে উঠেছে। কৃষক এই এপিএমসি মান্ডিতে এসে প্রধানত ধান, গম, তুলো, পাট আর আখ সরকার-নির্ধারিত নিম্নতম সহায়ক মূল্যে (Minimum Support Price বা MSP) নির্দিষ্ট পাইকারি ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারে। আর এই সুবিধার জন্য কৃষককে সরকার নির্ধারিত হারে কর দিতে হয়, যে কর কেবলমাত্র ঐ মন্ডি পরিচালনার কাজে ব্যয় করতে পারে রাজ্য সরকার। কৃষককে যে মন্ডিতেই বিক্রি করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা কখনওই ছিল না, তবে খোলা বাজারে কৃষিপণ্যের ক্রয়মূল্য সবসময়েই এমএসপি-র থেকে কম থাকায় কৃষকের কাছে মন্ডিতে বিক্রি লাভজনক। তবে মন্ডির পাইকারি ক্রেতারা কতটা পণ্য কিনতে পারবে ও মজুত করতে পারবে তার মাত্রা সরকার আগে থেকেই নির্ধারণ করে দিত বলে অনেক সময়েই কৃষককে বাড়তি ফসল খোলা বাজারে কম দামে বিক্রি করতে হত। সরকারের ফুড কর্পোরেশন, জুট কর্পোরেশন আর কটন কর্পোরেশন এইসব মন্ডির পাইকারদের কাছ থেকে এইসব পণ্য কিনে সরকারি ভান্ডার গড়ে তুলত যার ফলে প্রয়োজনের সময়ে সেগুলি বাজারে বিক্রি করে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা যেত আর গরীব মানুষদের জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু থাকত।
উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার অন্যতম আবশ্যিক উপাদান বাজারি ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। কৃষিক্ষেত্রে এই বাজারি ব্যবস্থাকে সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই এপিএমসি চালু করা হয়েছিল। আবহাওয়া ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে কৃষিব্যবস্থা বিশেষরূপে প্রভাবিত হয় বলে কৃষিজ পণ্য বিপণনে অনিশ্চয়তা অনেক বেশি। এপিএমসি আর এমএসপি-র মাধ্যমে এই অনিশ্চয়তা কিছুটা হ্রাস করা সম্ভব হয়েছিল বলে কৃষকেরা কিছুটা উপকৃত হয়েছে। তবে দুর্নীতি, প্রশাসনিক অদক্ষতা আর সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষের প্রভাবের ফলে উপকারের মাত্রা খুবই সীমিত।
এপিএমসি-র মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারি সহায়তায় কৃষিজ পণ্যের জন্য এক রাষ্ট্রীয় বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা। কৃষিব্যবস্থাকে এর মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে বাজারি পুঁজির নিয়ন্ত্রণে আনা। ২০০৩ থেকে অনেক চেষ্টা করেও সে কাজে বিশেষ সফলতা আসেনি। বরং মন্ডিব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি সব সামনে আসছে আর এই ব্যবস্থার সংস্কারের দাবী উঠতে শুরু হল। ২০১৪-১৫ সালে ইউনিয়ন সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আর প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রাহ্মণিয়ম। সেই বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা-তে (Economic Survey) বলা হল: কৃষিজ পণ্যের জন্য এক রাষ্ট্রীয় বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। ২০০৩ সাল থেকে আলাপ-আলোচনা চালিয়েও সাংবিধানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে এই বাজার গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কেন্দ্র (সরকারি নথিপত্রে সঠিকভাবে ইউনিয়ন বা সঙ্ঘ শব্দ ব্যবহার না করে ভুলভাবে কেন্দ্র শব্দই ব্যবহার করা হয়— এবং কোনও রাজ্যই আপত্তি করে না— বর্তমান লেখকের মন্তব্য) আর রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতা কীভাবে ভাগ করা আছে সেই প্রশ্ন বিবেচনা করতে হবে। এটা ঠিক যে কৃষিজ পণ্য বিপনন কমিটি (Agricultural Produce Marketing Committee সংক্ষেপে এপিএমসি) গঠন করার অধিকার রাজ্য সরকারকেই দিয়েছে সংবিধান। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাজার গড়ে তোলার প্রশ্নে নির্ণায়ক ভূমিকা কেন্দ্রকে নিতে হলে সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থাও করতে হতে পারে। যুগ্ম তালিকার ৩৩ অনুচ্ছেদ যেখানে খাদ্যবস্তু, যার মধ্যে আছে তৈলবীজ, তেল, তূলো, পাট ইত্যাদি সংক্রান্ত ব্যবসা, বাণিজ্য, উৎপাদন, সরবরাহ আর বিপণন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে বা ইউনিয়ন তালিকার অনুচ্ছেদ ৪২ যেখানে আন্তঃরাজ্য ব্যবসা ও বাণিজ্যের কথা বলা আছে সেগুলির সুবিধা নেওয়া যেতে পারে। নির্দিষ্ট কৃষিজ পণ্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার আইন সংসদ একবার অনুমোদন করে দিলে সেই আইন রাজ্যের আইনের থেকে বেশি ক্ষমতা লাভ করবে। কিন্তু এমনটা করতে গেলে কেন্দ্র বেশি মাতব্বরি করছে বলে মনে করা হতে পারে আর সেটা সহযোগিতামূলক সঙ্ঘ-ভাবনা (Cooperative federalism)-র যে নতুন সদিচ্ছা তার পরিপন্থী হবে। [বিস্তারিত দেখুন: Economic Survey, 2014-15, Chapter 8, A National Market for Agricultural Commodities – Some Issues and the Way Forward, pp. 117 – 121]
কিন্তু চুপ করে বসে থাকলে তো চলবে না। তৃতীয় বিশ্বের সব অর্থনৈতিক কাজ-কারবার বিশ্বপুঁজির নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যেই নব্য উদারবাদী অর্থব্যবস্থা— উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ আর বিশ্বায়নের মাধ্যমে উৎপাদনের সব মাধ্যম আর উৎপাদিত পণ্য বাজারি ব্যবস্থার অধীনে আনতে হবে। এই প্রক্রিয়া চালু হয়েছে সেই ১৯৯০-৯১ সাল থেকে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাজার ভারতে কৃষিব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি কর্পোরেট আওতায় আসেনি, সুতরাং কিছু একটা করে এখানে দখলদারি আনতে হবে।
কথায় বলে শয়তান কখনও নিদ্রা যায় না। এখানেও ঠিক তাই দেখা গেল। সারা পৃথিবীর সঙ্গে ভারত যখন অতিমারি করোনার আক্রমণে কাবু, সবাই যখন এই অজানা ভাইরাসের সংক্রমণ কীভাবে প্রতিহত করবে সেই সব বিষয় নিয়ে ব্যস্ত, তখনই ইউনিয়ন সরকার সুযোগ পেয়ে গেল। ব্রিটিশ আমলের মহামারি আইন আর বাজপেয়ি আমলের প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ আইনের সুযোগে সারা দেশের প্রশাসনিক সব অধিকার এখন ইউনিয়ন সরকারের স্বরাষ্ট্রদপ্তর আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীনে। আসলে আইনের মাধ্যমে এই অধিকার দেওয়া হয়েছে মহামারি আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ দ্রুত ও কার্যকরীভাবে করার জন্য। কিন্তু মোদি সরকারের কাছে এই সুযোগ এসে গেল তুরুপের তাস হিসাবে। ভেবে দেখুন, ২০২০ সালের জুন মাসে যখন করোনা অতিমারির ভয়ঙ্কর প্রকোপ চলেছে সেই সময়ে হঠাৎ করে ইউনিয়ন সরকার কৃষিক্ষেত্র নিয়ে বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়ল। ৫ জুন ২০২০ তারিখে The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Ordinance, 2020 অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) হিসাবে জারি হল। তিন মাসের মধ্যে এই অধ্যাদেশ আর নতুন দুটি বিল ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংসদের উভয় সভায় অনুমোদন করিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর করিয়ে আইন হিসাবে বলবত করে দেওয়া হল। আর কোনও সংসদীয় কাজে এই ধরনের তৎপরতার উদাহরণ নেই। অতিমারির সময়ে কেন এই তৎপরতা তার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কী অতিমারি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একান্তভাবে রাজ্যের অধিকারভুক্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকারকে কাজে লাগিয়ে কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটের অধীনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হল? সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যে বলা হয়েছে ভারতের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের অধিকার এমন কি সংসদেরও নেই, এই কাজ কি সেই রায়কে অগ্রাহ্য করল না?
এবার আসি কীভাবে আইন পাশ করানো হল সেই প্রশ্নে। সাধারণত সংসদে কোনও বিল পাশ করাতে হলে কয়েকদিন আগে বিলের খসড়া সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফলে সদস্যরা নিজেরা এবং নিজ দলের মধ্যে বিল প্রসঙ্গে আলোচনা করে বিলের পর্যালোচনা করতে পারেন। এবার যেদিন বিল নিয়ে আলোচনা হবে সেদিন সদস্যরা বিলটির বিষয়ে প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু এই সব প্রয়োজনীয় সংসদীয় ব্যবস্থা আমাদের সংসদে বর্তমানে প্রায়শই অনুপস্থিত থাকে। এই বিল তিনটির ক্ষেত্রেও লোকসভার স্পিকার আর রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের বিশেষ অনুমতি নিয়ে আলোচনার দিনেই সদস্যদের হাতে খসড়া বিল তুলে দেওয়া হল। যে ব্যবস্থা জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল কৃষিবিল পাশ করানোর ক্ষেত্রে। দেশে কিন্তু তখনও করোনা অতিমারির দাপট— করোনা মোকাবিলায় কোনও জরুরি বিল পাস করানোর প্রয়োজন হলে এ ব্যবস্থা গ্রহণে কোনও প্রশ্ন আসত না। কিন্তু কৃষিবিলের ক্ষেত্রে কেন এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা উচিত। লোকসভায় বর্তমান শাসকদলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা— সুতরাং সেখানে প্রায় বিনা আলোচনাতেই বিল তিনটি পাশ হয়ে গেল। বিলগুলি একটু গভীরভাবে পর্যালোচনার কথা বিরোধী কিছু সদস্য তুললেও সেসব অগ্রাহ্য করা হল। রাজ্যসভায় শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তখন অবধি সুনিশ্চিত ছিল না, তাই বিরোধীদের ‘ডিভিশন’ বা ভোটাভুটির দাবী অগ্রাহ্য করে ধ্বনিভোটে বিলগুলি পাশ করানো হল, যদিও সংসদীয় রীতি অনুসারে একজন সদস্য-ও যদি দাবী করেন তাহলেও সেই বিলের পক্ষে বিপক্ষে ভোটের ব্যবস্থা করার কথা। আইন এবং প্রচলিত সংসদীয় রীতিনীতি অনুসরণ করাই গণতান্ত্রিক সরকারের কর্তব্য যাতে করে সাধারণ নাগরিক এগুলিকে মান্যতা দেয়। তা না করে আমরা দেখেই চলেছি যে এই সরকার এইসব ‘কনভেনশন’ না মানাটাই অনুসরণ করে চলেছে নানা ক্ষেত্রে।
এবারে যে তিনটি কৃষি আইন নিয়ে বিতর্ক সেই আইনগুলি আর বর্তমান সরকারের বক্তব্য অনুসারে এদের উদ্দেশ্য দেখে নেওয়া যাক।
প্রথম আইন— The Farmers’ Produce, Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020— সরকারের বক্তব্য: (১) বর্তমানে কৃষক তার ফসল এক নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই বিক্রি করতে পারে। এলাকার বাইরে বিক্রির ওপর কিছু কিছু বিধি-নিষেধ আছে। এই নতুন আইনের ফলে কৃষক তার উৎপাদিত ফসল “উৎপাদনের, সংগ্রহের আর মজুত করার ব্যবস্থা আছে এমন যে কোনও স্থানে” বিক্রি করতে পারবে; (২) কৃষক নিজেকে নথিভুক্ত করলে তার ফসল ইলেক্ট্রনিক বাণিজ্য ব্যবস্থা ও ই-কমার্সের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে; এবং (৩) ‘ফসল বিক্রির জন্য বর্তমানে যে নির্দিষ্ট এলাকা (মন্ডি) আছে’ তার বাইরের কোনও জায়গায় ফসল কেনে-বেচা হলে রাজ্য সরকার কৃষকদের, ঐ ব্যবসায়ীদের এবং ই-বাণিজ্য প্ল্যাটফর্মের ওপর কোনও মার্কেট ফি, সেস বা আর্থিক দায় চাপাতে পারবে না।
দ্বিতীয় আইন— Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Act, 2020— সরকারের বক্তব্য: (১) কৃষকেরা ফসলের দামের কথা বলা আছে এমন চুক্তি ক্রেতার সঙ্গে করার আইনগত সুবিধা পাবে; এবং (২) এ সংক্রান্ত কোনও বিরোধ দেখা দিলে তা মেটানোর ব্যবস্থা এই আইনে বলা থাকছে।
তৃতীয় আইন— Essential Commodities (Amendment) Act, 2020— (১) খাদ্যশস্য (যেমন ধান, গম, বাজরা, ভুট্টা ইত্যাদি), ডাল, আলু, পেঁয়াজ, খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত তৈলবীজ ও তেল— এগুলিকে অবশ্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হল। এর ফলে “বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া” অন্য সময়ে কী পরিমাণে এসব দ্রব্য মজুত করা যাবে তার কোনও সীমা থাকল না; এবং (২) কৃষিপণ্যের মজুতের সীমা স্থির করা যাবে কেবলমাত্র মূল্যবৃদ্ধির কারণেই।
এবার এক-এক করে দেখা যাক সরকারের বক্তব্যের সারবত্তা। সব সময়েই সচেতনভাবে প্রচারিত অর্ধসত্য মিথ্যার থেকেও ক্ষতিকর। প্রথম আইনের প্রথম বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা, আপনি আমি সবাই কলকাতায় বসে কাশ্মিরের আপেল, নাগপুরের কমলালেবু এরকম অনেক কৃষিজ পণ্যই নিয়মিত কিনে আসছি। এই আইন আসার আগের থেকেই কৃষক তার ফসল ভারতের যে কোনও জায়গায় বিক্রি করতে পারে। অনেক রাজ্যে Agricultural Produce Market Committee (APMC) Act অনুসারে যে কৃষক-মণ্ডি স্থাপিত হয়েছে কৃষক সেখানে নির্দিষ্ট কয়েকটি ফসল, প্রধানত ধান, গম, ভুট্টা আর আখ, সরকার-নির্ধারিত মূল্যে Minimum Support Price বা এমএসপি-তে সরকারি এজেন্টদের কাছে বিক্রি করতে পারে। মন্ডির বাইরেও কৃষক ফসল বিক্রি করতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে মন্ডির বাইরে দাম এমএসপি-র তুলনায় কম থাকায় কৃষক মন্ডিতে-ই বিক্রি করতে চায়। কিন্তু সরকারের এজেন্টরা কত ফসল কী পরিমাণে আর কোন তারিখ থেকে কোন তারিখ অবধি কিনতে পারবে তার সীমা সরকার বেঁধে দেওয়ার ফলে অনেক সময়েই কৃষককে উদ্বৃত্ত ফসল কম দামে মন্ডির বাইরে বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। এছাড়াও মন্ডিতে ফসল বিক্রির জন্য কৃষককে রাজ্য সরকার নির্ধারিত হারে কর/সেস দিতে হয়। এই কর/সেস রাজ্য সরকার ব্যবহার করে মন্ডি পরিচালনার খরচ আর মন্ডিতে আসা-যাওয়ার রাস্তা তৈরি করা আর সারানোর খরচের জন্য। কৃষকদের নির্বাচিত সদস্যেরা পরিচালনা সমিতির মাধ্যমে মন্ডির কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। মন্ডির বাইরে বিক্রিতে সেই কর/সেস লাগে না। আর যে সব রাজ্যে এপিএমসি মন্ডি নেই সেখানে খোলা বাজারেই কৃষককে ফসল বিক্রি করতে হয়, স্বভাবতই সেখানে এমএসপি-র কোনও বাধ্যবাধকতা থাকে না। মন্ডির মাধ্যমে যে সব খাদ্যশস্য কেনা হয় তার একটা বড় অংশ ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া এফসিআই কিনে নেয়। এগুলিই আবার রেশন দোকান ও সরকারি গণবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে গরীব জনগণের কাছে বিক্রি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে সরবরাহ করা হয়। অন্যান্য সরকারি ব্যবস্থার মত এই ব্যবস্থায়ও প্রচুর ত্রুটি, দুর্নীতি আর অব্যবস্থা আছে। সেগুলিকে ঠিক করার জন্য দাবী করে আসছে কৃষকেরা। সরকার সেদিকে নজর না দিয়ে এই ব্যবস্থা পুরোপুরি তুলে দেওয়ার পথে এগিয়ে এল এই আইনের মাধ্যমে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসব ক্ষেত্রে ত্রুটি সংশোধন করার পরিবর্তে বেসরকারিকরণের ফল কী হয় সে আমরা সবাই দেখছি, এবার খাদ্যের ওপরেও খোলা বাজারের রাস্তা প্রশস্ত করে দিল সরকার। এফসিআই-এর কাছে যথেষ্ট চাল-গম না থাকলে লকডাউনের সময়ে কী অবস্থা হত একবার কল্পনা করে দেখুন তো।
কৃষক না কি বেশি দাম পাবে! বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক অশিক্ষক কর্মচারীদের কী অবস্থা? ডাক্তার–নার্সেরা মাইনে না পাওয়া/কম পাওয়া নিয়ে কেন রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়? কৃষিব্যবস্থা আজকেও অনেকটাই প্রকৃতি-নিয়ন্ত্রিত— সে কারণে অনিশ্চয়তা এখানে বেশি। মন্ডির মাধ্যমে, এমএসপি-র মাধ্যমে সেই অনিশ্চিত অবস্থায় কৃষকদের কিছুটা সুবিধা দেওয়া যায়। আর সেটা তুলে দিলে পুঁজির মুনাফা সৃষ্টির ক্ষমতা বেড়ে যায়। অনিশ্চয়তা থেকেই মুনাফার উদ্ভব (Uncertainty breeds profit)— অর্থশাস্ত্রী নাইট (Knight)-এর এই অমোঘ বাণী অর্থনীতির সব ছাত্রই জানে। আর এই আইনে সেই অনিশ্চয়তা সৃষ্টির ব্যবস্থা পাকাপাকিভাবে করা হল। দ্বিতীয়ত, নিজের নাম ও বিবরণী নথিভুক্ত করা, ই-কমার্সে অংশগ্রহণ এসব কাজ যে অধিকাংশ গ্রামীণ কৃষকের ক্ষমতার বাইরে সে কথা কি অস্বীকার করা যায়? অথচ এই আইন অনুসারে সেই ব্যবস্থা কৃষককে করতে হবে। তৃতীয়ত, বেসরকারি বাজারে রাজ্য সরকার কোনও কর/সেস নিতে পারবে না। তাহলে পরিকাঠামো তৈরি করা ও বজায় রাখা হবে সরকারি তহবিল থেকে অর্থাৎ জনগণের ট্যাক্সের পয়সা থেকে, মুনাফা কিন্তু ঢুকবে পুঁজিপতির পকেটে।
দ্বিতীয় আইন আরও মারাত্মক। এই আইনের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে চুক্তিচাষ বা Contract Farming আর আগাম (ফাটকা) বাজার ব্যবস্থা যাকে ইংরাজিতে Forward Trading বলে তার রাস্তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। চুক্তিচাষের মাধ্যমে কৃষককে সর্বস্বান্ত করে আফিম, নীল এই সব চাষ করিয়ে কীভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তার মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যাবে শশী থারুরের লেখা An Era of Darkness, উইলিয়াম ডালরিম্পলের বই The Anarchy, অমিতাভ ঘোষের Sea of Poppies উপন্যাসে। আর এর বিরুদ্ধে কৃষকদের অসামান্য বীরত্বের লড়াই আমরা ছেলেমেয়েদের জানতে দিই না। ‘নীল দর্পণ’ কেউ পড়ে কি? ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধের পরে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ অবধি ভারতের নানা প্রান্তে শত-সহস্র আন্দোলনের কথা এখন আর বলা হয় না। তাই সরকার গলা ফুলিয়ে চিৎকার করে বলতে পারে চুক্তিচাষের ফলে কৃষকের কত ভাল হবে! সাম্প্রতিক সময়ে তুলোর চুক্তি চাষে কত কৃষক আত্মহত্যার পথে যেতে বাধ্য হয়েছে সে সংখ্যা আমাদের মনে কোনও প্রভাব ফেলে না। এমনকি যে সিঙ্গুর নিয়ে আমাদের এখানকার কাগজে পাতার পর পাতা খবর লেখা হয় সেখানেও আলুর চুক্তিচাষে কৃষকদের কত ভাল হয়েছে তার হিসেব আমরা রাখি কি? এই আইনে আবার ফাটকা বাজার ব্যবস্থাকেও কৃষিক্ষেত্রে মান্যতা দেওয়া হল। আর কৃষিপণ্যের কেনাবেচা নিয়ে কোনও বিরোধ হলে সেই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কৃষকের আদালতে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। বিরোধ হলে যেতে হবে সরকারি আমলার কাছে স্তরে স্তরে— আর আমলারা সব ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের সন্তান— কৃষকের ন্যায় পাওয়ার এমন সহজ রাস্তা এতদিন আমরা দেখিনি।
এবার আসি তৃতীয় আইনের ক্ষেত্রে। মজুতদারি–মুনাফাখোরির পক্ষে এমন পদক্ষেপ কখনও কল্পনা করা যায়নি এর আগে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন সবসময়েই মরশুমি, অথচ চাহিদা সারা বছর ধরে। সেইজন্য যখন ফসল ওঠে, তখন জোগান চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। সেই কারণে চাহিদা-জোগানের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক। ফসল মজুত করে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে যাতে অনৈতিক মুনাফা না করা যায় সেই কারণে Essential Commodities Act-এ অবশ্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুতের ওপর নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। বর্তমান সংশোধনী আইনে এই সীমা তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে যে কোনও ব্যবসায়ী যত ইচ্ছা কৃষিজ পণ্য মজুদ করতে পারবে। মাঝারি আর ছোট ব্যবসায়ীরা বড় কর্পোরেটদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশই পিছু হঠতে থাকবে। ইতিমধ্যেই বিহার ও রাজস্থানের বিভিন্ন এলাকায় রেলস্টেশনের পাশাপাশি এলাকায় আদানি কোম্পানি বিরাট বিরাট শস্যভাণ্ডার গড়ে তুলছে তার ছবি আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখছি। আরও দেখছি যে ফ্রেট করিডরের মাধ্যমে কিসান রেলের সাহায্যে এই সব ভাণ্ডারে ফসল আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা সরকার কত তৎপরতার সঙ্গে করছে। সুতরাং এই বাজারে কর্পোরেট মুনাফা যে বাড়বে সেটা নিশ্চিত। আর মুনাফা কর্পোরেটের বাড়লে কৃষকের আয় যে কমবে এটাও নিশ্চিত। তবে প্রধানমন্ত্রী মনে করেন যে ধনী না হলে অন্যকে ধন বিতরণ করবে কী করে? পাঠক, যা বোঝার বুঝে নিন!
তাহলে সারমর্ম কী দাঁড়াল? এই তিনটি কৃষি আইন সাংবিধানিক নীতি-নৈতিকতাকে অগ্রাহ্য করে, প্রচলিত গণতান্ত্রিক রীতি অস্বীকার করে, সন্দেহ উদ্রেককারী পদ্ধতির মাধ্যমে সংসদে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই তিনটি আইন কৃষকদের জমি ও ফসলের ওপর যে অধিকার সেই অধিকার কেড়ে নিয়ে বড় পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার এক পদক্ষেপ। আমরা, যারা সংবিধান নিয়ে বড় বড় কথা বলি, গণতন্ত্রের ঢাক বাজাতে থাকি, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা অহরহ বলি, তারা কতদূর বুঝতে পারছি জানি না, কিন্তু ‘সেই বোকা বুড়ো’ কৃষকেরা মূল সত্য বুঝে গেছে। তারা জানে ‘কালা কানুন’ পুরোটাই কালা, সংশোধন করে কিছু হবে না, ফেলেই দিতে হবে। স্বাভিমান, স্বাধিকার আর স্ব-নির্ভরতা বজায় রাখতে গেলে জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিভেদ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একযোগে দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের পথে যেতে হবে। তাই তারা নিজের পাগড়ি সামলানোর আহ্বান জানিয়েছে। আমরা কী করব সেটা এখন আমাদেরই স্থির করতে হবে।