শুভাশিস মৈত্র
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, সাংবাদিক
জয়া চ্যাটার্জি তাঁর ‘দ্য স্পয়েল্স অফ পার্টিশন, বেঙ্গল অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছেন, “কলকাতার প্রান্তে বসবাসকারী মানুষগুলো (উদ্বাস্তু, যাঁদের একটা বড় অংশ মনে করতেন, তাঁদের দুরবস্থার জন্য কংগ্রেস দায়ী) দু দশকের মধ্যে বদলা নিল, তৈরি হল কংগ্রেসের বিপরীতে বিরাট এক বিরোধী শক্তি। বামপন্থী শক্তি। যখন দেশভাগ হয়েছিল তখন এই ভাবনাটা বোধহয় কারও মাথায় ছিল না।”
১৯৫২ সাল থেকেই লোকসভা এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি। ২০১৯-এ তারা এই রাজ্যে চতুর্থ শক্তিতে পরিণত হল। প্রায় ৬০ বছরের ব্যবধানে এবারের বিধানসভা ভোটে দেখার, তারা তৃতীয় হতে পারে কি না, না পঞ্চম হয়ে যায়!
পশ্চিমবঙ্গে এতদিন পর্যন্ত, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, নেতৃত্ব ছিল বাঙালিদের হাতে। কংগ্রেসের তরফে ছিলেন বিধান রায়, প্রফুল্ল ঘোষ, প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ রায়; অন্য দিকে কমিউনিস্ট পার্টির সোমনাথ লাহিড়ি, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তের মতো নেতারা। হিন্দুত্ববাদীদের হাতে শ্যামাপ্রসাদ ছাড়া তেমন বলার মতো নাম কিন্তু নেই। বিজেপি নেতা হরিপদ ভারতী বিধানসভায় দুর্দান্ত বক্তা ছিলেন, বিধায়কও হয়েছিলেন, তবে জননেতা ছিলেন না। এই প্রথম একটা ভোট হচ্ছে বাংলায়, যেখানে, যদি হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় আসে, রাজ্যের বাইরের কোনও নেতৃত্বকে (নরেন্দ্র মোদি) দেখে ভোট দেবে বাঙালি। কারণ এই মুহূর্তে এই দলে তৃণমূল থেকে আসা শুভেন্দু অধিকারী ছাড়া এমন কোনও নেতা নেই, যিনি অন্তত একটা পুরসভা নির্বাচনেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিতে পারেন। ফলে এমন ঘটলে, বাংলার রাজনীতিতে সেটা একটা বড় পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হবে— রীতিমত ঐতিহাসিক পরিবর্তন।
স্বাধীনতার আগে, ফজলুল হক একজন বড় মাপের বাঙালি মুসলমান নেতা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার। তবে তিনি কখনও ব্রিগেডে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পাননি। ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি অত্যন্ত আধুনিক কৃষকদরদি ম্যানিফেস্টো নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিল। ভোটের ফল বেরোলে দেখা গিয়েছিল, কোনও দল এককভাবে সরকার গড়ার জায়গায় নেই। মোট ২৫০টি আসনের মধ্যে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি ৪০টি আসন পেয়েছিল। যেটা বলার, সেটা হল, বাঙালি মুসলিম ভোটারদের একটা বড় অংশ সেই নির্বাচনে মুসলিম লিগের মুসলিম প্রার্থীদের ভোট দেননি। তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন, অর্থনৈতিক দাবির সমর্থনে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিকে। মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত বহু আসনে মুসলিম লিগকে হারিয়ে দেন কৃষক প্রজা দলের মুসলিম প্রার্থীরা। ফজলুল হকের পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন যদিও বিতর্কিত এবং ঘটনাবহুল, কিন্তু তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা যে কজন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি মুসলমান নেতাকে পেয়েছি তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে আছেন গনিখান চৌধুরী, আবদুস সাত্তার, মহম্মদ ইসমাইল, হাসিম আবদুল হালিম। মুজফ্ফর আহমেদকে এঁদের মধ্যে ধরছি না। কিন্তু এই সব নেতারাই এসেছেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল থেকে।
ভালো, মন্দ, ভবিষ্যৎ কী— এসব প্রশ্ন কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে রেখে বলা যায়, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের আব্বাস সিদ্দিকির বক্তৃতা একটা পরিবর্তন। এতটা দাপটের সঙ্গে মূল দলগুলির বাইরের (অথচ প্রধান দলগুলির মঞ্চ থেকে) একজন তরুণ বাঙালি মুসলমান নেতাকে ব্রিগেডে বক্তৃতা দিতে এর আগে আমরা দেখিনি। মুসলমান শব্দটা ব্যবহার করছি, কারণ তিনি মুসলমান ধর্মীয় পরিচয় নিয়েই ‘সেকুলার’ ফ্রন্ট-এর নেতা হিসেবে এসেছেন। মুসলমানদের কথা যে দলগুলি বলত সেই সমাজবাদী পার্টি, বসপা, আরজেডি, সিপিএমের মতো দলগুলি একের পর এক নির্বাচনে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে একদিকে, পারিবারিক ঐতিহ্যের ভারে নুয়ে পড়া কংগ্রেস দিশাহীন, অন্যদিকে কেন্দ্রে ৩০০-র বেশি আসন নিয়ে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সংখ্যাগুরুবাদী গণতন্ত্রের দিকে যাত্রার স্পষ্ট ইঙ্গিত, এমন পরিবেশে মুসলমানদের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে নিজেদের কথা নিজের মুখে বলার। সেই শূন্যস্থান পূরণের একটা চেষ্টা আব্বাস সিদ্দিকির ভাষণে দেখা গেল।
লক্ষ্যণীয়, তাঁর একটা ‘পির’ পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তাঁর দলের নামে ‘সেকুলার’ শব্দটা আছে। সিএএ, এনআরসি-র পরিপ্রেক্ষিতে এই শব্দটি মুসলিমদের কাছে সম্মানরক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে এখন, আর যে শব্দটাতে, প্রবল আপত্তি হিন্দুত্বাদীদের। মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল প্রাক্তন বিজেপি নেতা যখন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ঠাট্টা করে বলেন, আপনি দেখছি সেকুলার হয়ে গিয়েছেন, তখন বোঝা যায়, এই শব্দটির প্রতি কী পরিমাণ ঘৃণা রয়েছে কোনও কোনও শিবিরে। আব্বাস সিদ্দিকি যখন তাঁর বক্তৃতায় বললেন তিনি মুসলমান, দলিত, ওবিসিদের হয়ে কথা বলছেন, তখন মনে হচ্ছিল বাম নেতারা এই কথাটা বলছেন না কেন! ১৯৯০-এর ৭ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং যেদিন মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট গ্রহণ করলেন, যেখানে ওবিসিদের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, সে সময় আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ লেখা হল শূদ্র-বিপ্লব ঠেকাতে কীভাবে এর বিরোধিতা করা উচিত। লেখা হল, ‘An urgent need to build up moral and spiritual forces to counter any fallout from an expected Shudra revolution’।
অর্থাৎ মার্কসবাদীরা ‘কাস্ট’ বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও শূদ্র জাগরণের ভয় হিন্দুত্ববাদীদের আছে। আছে বলেই তাঁরা আদিবাসী-সহ বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কথা বলেন, কিন্তু মনুসংহিতার সমালোচনা করেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে এখনই একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়, ৩০ আসনে প্রার্থী দিয়ে যদি ১০-১৫টা আসন পেয়ে যায় আইএসএফ, পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ হবে।
বিরোধী রাজনীতির মধ্যে দিয়ে ব্রিগেডে ধর্মীয় নেতা আব্বাস সিদ্দিকির উত্থানের ঘটনাই বলে দিচ্ছে, বঙ্গ রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদীদের বিপরীতে যাত্রা শুরু হল আর একটি ধর্মভিত্তিক (যতই দুর্বল হোক) রাজনীতির যা হিন্দুত্বাবাদী রাজনীতির মতোই খুব স্পষ্টভাবে অনুদার, সংস্কারবিরোধী, প্রগতিবিরোধী, নারীস্বাধীনতা-বিরোধী। এই স্বীকৃতির ফলে বিজেপির কিছুটা সুবিধা হতে পারে, কারণ বিজেপি বিরোধীদের সম্পর্কে এই কথাটাই বলে এসেছে চিরকাল।
আরও একটি বিষয় এবারের ভোটে নতুন। এত বেশি আইডেনটিটি পলিটিক্স এই রাজ্যে এর আগে কখনও দেখা যায়নি। সবই হয়তো ছিল, কিন্তু কিছুটা আড়ালে। একটা চক্ষুলজ্জার ব্যাপারও ছিল। সেটা ভালো ছিল, না খারাপ, সে তর্ক আপাতত থাক। কিন্তু মানতে হবে, সেই পর্দাটা সরে গিয়েছে এবারের ভোটে। এর জন্য অবশ্য প্রধান কৃতিত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এর ফলে এখন সাংবাদিকদের রিপোর্টিংয়ের পদ্ধতিও বদলে গিয়েছে। এখন সাংবাদিকদের দেখতে হচ্ছে, অমুক আসনে কত শতাংশ মুসলিম, কত শতাংশ মতুয়া ইত্যাদি প্রভৃতি। এভাবে অতীতে বাংলায় আমরা ইলেকশন রিপোর্টিং করিনি। আমাদের এখানে এতদিন গোঁজ প্রার্থী হত। এবারে গোঁজ দল থাকবে ভোট-ময়দানে, চিরাগ পাসোয়ানের মডেলে। এও বাংলায় বিলক্ষণ নতুন।
পশ্চিমবঙ্গে আট দফায় ভোট হচ্ছে। এর ফলে বিজেপির সুবিধে হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে এই রাস্তায় হাঁটার সুযোগ মমতাই করে দিয়েছেন। এটা ঠিক, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার আমদানি মমতা করেননি। এটা বহুদিন ধরেই ছিল। ২০০৩-এর পঞ্চায়েত ভোটের আগে-পরে মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় শ খানেক মানুষের মৃত্যুই বোধহয় এখনও সারা দেশের রেকর্ড হয়ে আছে। কিন্তু মমতা ২০১১-তে নির্বাচনী প্রচারে বাঙালি ভোটারদের কথা দিয়েছিলেন, তিনি এই জিনিস বন্ধ করবেন ক্ষমতায় এলে। তিনি সে কথা রাখেননি। ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটের হিংসা এবং বিরোধীদের ভোটে দাঁড়াতে না-দেওয়া, সারা দেশের সামনে পশ্চিমবঙ্গের মাথা নিচু করে দিয়েছে।
সারা দেশেই এমএলএ, এমপি কেনাবেচার অভিযোগ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পরস্পরের বিরুদ্ধে করে চলেছে। এসব এতদিন মূলত ছিল গোবলয়ের কালচার, কিছুটা দক্ষিণেরও। বাংলা এই কুৎসিত কালচার থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিল। এসব অপ-রাজনীতি বাংলায় আমদানি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধীদের দল ভাঙানোর যে খেলাটা তিনি শুরু করেছিলেন, সেই খেলাতেই তাঁর দল এখন নাস্তানাবুদ। ভোটের ফল বেরনোর পর এই খেলার ‘সেকেন্ড এপিসোড’ আরও নোংরা হয়ে উঠতে পারে। তার জন্য বাঙালির প্রস্তুত থাকাই ভালো।
আমাদের রাজনীতিতে সকলের জন্য স্বাস্থ্য, শিশুর পুষ্টি, সকলের জন্য সমমানের প্রাথমিক শিক্ষা, শিশুশ্রম এসব বিষয় নির্বাচনে কখনওই বড় কোনও ইস্যু হয়ে ওঠে না। এবারই প্রথম— তা-ও নেহাত কোভিডের সৌজন্যে— সকলের জন্য স্বাস্থ্য বিষয়টি উঠে এসেছে নির্বাচনী প্রচারে। সব দলকেই এই নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। এরই মধ্যে রাজস্থানেও পশ্চিমবঙ্গের ধাঁচে সকলের জন্য স্বাস্থ্য কর্মসূচি অনেকটা এগিয়েছে বলে খবর। বেশ কয়েকটা শিবিরে গিয়ে দেখেছি, বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যসাথী কর্মসূচিতে যা সাড়া দেখা যাচ্ছে তা অন্য কোনও কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। বিজেপি পাল্টা আয়ুষ্মান-এর কথা বলছে। কিন্তু যেটা বলা হচ্ছে না সেটা হল, আয়ুষ্মান দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের জন্য। কিন্তু ওয়েবসাইটে গিয়ে খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, কার্যত সংখ্যাটা আরও অনেক কম। স্বাস্থ্যসাথীতে যেমন মাঝে মধ্যে রিফিউজালের খবর পাওয়া যাচ্ছে (যদিও ১০ কোটি বেনিফিশিয়ারির সংখ্যার বিচারে সে অভিযোগ খুবই নগন্য), নেট-এ সার্চ দিয়ে দেখুন, আয়ুষ্মানেও এমন অভিযোগ বহু। আমাদের মতো দেশে এই ধরনের প্রকল্প চালু করতে গেলে, কিছুদিন এসব হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্য— পৃথিবীতে খুব কম দেশেই এমন প্রকল্প আছে। নীতিগতভাবে বলাই যায়, সরকার যদি সবার জন্য রাস্তা তৈরি করতে পারে, সবাইকে পানীয় জল দিতে পারে, সবাইকে পাঠ্যবই দিতে পারে, তবে স্বাস্থ্যও দেওয়া সম্ভব। প্রয়োজন মানসিকতার। ভোটের জন্য হলেও, মানতে হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা যুগান্তকারী প্রকল্পে হাত দিয়েছেন। সফল হলে ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে। আর এটা যদি সম্ভব হয়, তাহলে সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা হোক পরবর্তী দাবি। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক।