প্রতিভা সরকার
প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক, সমাজকর্মী
শর্বরী,
চিরদিনের বন্ধু আমার,
ইলেকশন-সম্ভবা পশ্চিমবঙ্গের কথা জানতে চেয়েছ। সত্যিই আমরা যেন দিন গুনছি, কবে সেই মহাক্ষণ আসবে, নতুন সরকার ভূমিষ্ঠ হবে। কিন্তু অন্ধকার কাটবে কি? এই প্রশ্ন উঠলেই পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুখে কুলুপ এঁটে রাখি। আজ আমার এবং আমার মতো অনেকে নিতান্ত সাধারণ মানুষের দ্বিধাদ্বন্দ্বের কিছুটা তোমার সঙ্গে ভাগ করে নেব বলেই এই চিঠি লেখা।
এই আলো-আঁধারের প্রশ্নটাই জ্বালাচ্ছে সারাক্ষণ, বুঝলে! সম্ভব নয়, যেভাবে সমস্ত পরিবেশ বিষিয়ে গেছে, তাতে আলোঝলমল একটা সকাল এনে দেওয়া বোধহয় আর কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। রাস্তার ত্রিফলা আলো সব কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল, রাস্তা থেকে উঠে আসা একটা ভয়ঙ্কর ত্রিমুখী লড়াই প্রত্যেকের ঘরে এবং মনেও যেন কী করে সেঁধিয়ে গেল। এখন তুমি চাও বা না-চাও, এই লড়াইতে তোমাকে থাকতেই হবে এ কথা জেনেও যে, তোমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য তোমার দিকে যে কোনও মূহূর্তে ধেয়ে আসতে পারে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, নির্যাতন, এমনকী মৃত্যুও।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে এই প্রথম একটা প্রবল হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে এতখানি মরিয়া হয়ে নেমেছে। হাতে তাদের তুরুপের তাস— এনআরসি আর সিএএ। সংখ্যালঘু নির্যাতনে তাদের যা রেকর্ড, তাকে ছুঁতে পারে এমন ক্ষমতা আর কোনও দলের নেই। গোরুর দোহাই দিয়ে মানুষ পিটিয়ে মারাও তো ভারতবর্ষ এই প্রথম দেখল। আর দাঙ্গা! একের পর এক দাঙ্গা বাঁধানো ওদের কাছে ছেলেখেলা।
আর আছে জনবিরোধী নীতি। লকডাউনে অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু ও লাঞ্ছনা কোনও সভ্য দেশে ভাবা যায়! চারটে লেবার ল এবং তিনটে কৃষি আইন এদেরকে একেবারে বেআব্রু করে দিয়েছে। বেসরকারিকরণের নামে দেশের সমস্ত সম্পদ বেচে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী গর্বভরে বলেন, সরকারের কাজ ব্যবসা করা নয়। তাহলে ব্যবসা করবে ওই বিশেষ রাজনৈতিক দলটির অনুরাগী কর্পোরেটরা। আর তাদের কাছে একের পর এক বিক্রি হয়ে যাবে লাভজনক সংস্থাগুলি। কর্পোরেট তোষণ করতে গিয়ে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে নির্বিচারে— তাতে বনবাসী মানুষ যে বে-ঘর হচ্ছে, কারও হুঁশ আছে?
তবু কেন তাদের পছন্দ করছে অনেক বাঙালি? প্রশ্নটি বেশ গোলমেলে। উত্তরে অনেককিছুই বলতে পারা যায়। অপদার্থতা, অপশাসন, প্রতিশোধস্পৃহা, জুলুম, দুর্নীতি, পারিবারিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি, আর টেবিলের তলে হাত মেলানো ছাড়াও আরও কিছু আছে, জানো, যা আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে, আমাদের ক্লান্ত, আরও ক্লান্ত করে।
যেমন আমাদের ছুপা সাম্প্রদায়িকতা।
যদি তোমাকে বলি, সেকুলার ইন্ডিয়ান ফ্রন্টের আব্বাস সিদ্দিকির গায়ে নির্বিচারে জঙ্গি বা আইএসআই-এর চরের তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে একশ্রেণির শিক্ষিত হিন্দু, তুমি কি বিশ্বাস করবে? নিজেদের মধ্যে কথায়, ফেসবুক পোস্টে এই আক্রমণ শানানো হচ্ছে বামজোটকে অপদস্থ করবার জন্য। হ্যাঁ, আমি জানি, আব্বাস অতীতে নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করেছে, এবং এই পিরজাদার মধ্যে আমি মহান সুফি ট্র্যাডিশনের ছিটেফোঁটাও দেখিনি। কিন্তু তাই বলে আইএসআই বা দাউদ ইব্রাহিম? হ্যাঁ, ফেজ টুপি-পরিহিত আব্বাসকে দেখে বাঙালি হিন্দুদের নাকি এইসব মনে পড়ে যাচ্ছে, দাঙ্গা লাগবার বা মুসলমানের হাতে কচুকাটা হওয়ার ভয় চাগিয়ে উঠছে। মুসলমান মাত্রেই মিরজাফর, সে আর কে না জানে! মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া দেব না, বিয়ে-শাদির প্রশ্নই ওঠে না, এরপর এত দিন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে চিপকে লেগে থাকার পরও তাদের হাতে থাকে হারিকেন। তাই তারা যদি নিজেদের দল গড়ে বা জোটে গিয়ে অধিকারের ছায়াও হাসিল করতে চায়, পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার ব্যাপারে নিজের এজেন্সি খাটাতে চায়, তাহলে তাদের জঙ্গিগোষ্ঠী বানিয়ে দেব!
হায় রে বাঙালির সেকুলারিজম!
আব্বাস সিদ্দিকিকে নিয়ে আমার সব প্রশ্নের জবাব এখনও খুঁজে পাইনি। সে তো আমার ব্যক্তিগত সমস্যা। কিন্তু নেতারা সব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পান, তারপর জোট করেন, ব্যাপারটা এইরকম নাকি? নাকি জোটের অঙ্ক অন্য থাকে? আব্বাস সিদ্দিকিকে দলে পাওয়ার জন্য সেইজন্যই তো সব দলগুলো অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছে। যাই হোক, আব্বাসবাবুর ‘আসল’ মুখ যাইই হোক, বাঙালি হিন্দুর তথাকথিত অসাম্প্রদায়িকতার আসল মুখটি এবার নিশ্চিতভাবেই দেখা গেল।
এই নির্বাচনটা পুরো দিশাহীন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মাগ্গিগন্ডার বাজারে, যেখানে গত একমাসে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৪৫ টাকা আর তেলের দাম তো রোজই বাড়ছে, সেখানে মূল নির্বাচনী ইস্যু হওয়া উচিত ছিল অর্থনৈতিক। কিন্তু কয়লা আর গোরুপাচার, সোনাচালান আর কাটমানির চক্করে পড়ে সেসব এখন দূর অস্ত। সে সব অভিযোগ জানাবার জন্য যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, শুনলে তুমি কানে আঙুল দেবে। মোটকা, হোদল কুতকুত, সোনাবৌদি, চালচোর— এইসব শুনে শুনে কান পচে গেল গো।
এখন দেখছি বিজেপি দলটাও এইসব শব্দ ব্যবহারকে বৈধতা দিতে বড় বড় থিওরি নামাচ্ছে এবং অন্যদের মতোই সাবঅল্টার্নের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দিচ্ছে। তাদের মতো করে বাচন প্র্যাকটিস করাই নাকি চূড়ান্ত। আরে বাবা, একজন সাবঅল্টার্ন মানুষ প্রচণ্ড রেগে গেলে বা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে যে ভাষা ব্যবহার করেন, তা যদি সুসজ্জিত মঞ্চে মাইক ফুঁকে প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে বলা হয় তাতে যা হয় তা হল কনটেক্সট থেকে বিচ্যুত করে ভাষার অপব্যবহার। অন্য পরিবেশে তা স্বাভাবিক হতে পারে, কিন্তু একমাত্র উদ্দেশ্য যখন অন্যকে ছোট এবং নিচু দেখাবার ‘টুল’ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া তখন স্বাভাবিকতা এবং সহজতা হারানো ভাষা বিকৃত এবং আরোপিত হয়ে যায়, এই সহজ বুদ্ধিটুকু আমাদের থিওরিস্টদের নেই? নেতানেত্রীদের কথা না-হয় বাদই দিলাম। যেখানে কোনও কিছুই স্বতঃস্ফূর্ত নয়, সবটাই মাপাজোকা এবং যান্ত্রিক, প্রচণ্ড বুদ্ধির খেলা, সেখানে সাবঅল্টার্ন স্বতঃস্ফূর্ততার দোহাই দেওয়া কেন! সাবঅল্টার্ন কোনও মানুষকে শ্রোতা দর্শকদের সামনে রাজনৈতিক কোনও ইস্যু নিয়ে বলতে বলো, তিনিও অন্য ভাষায় মুখ খুলবেন।
না-হয় বাদ দাও এই সব। যা বলছিলাম তোমাকে, একটা নির্বাচন লড়া হয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামাজিক ইস্যুকে সামনে রেখে। বিজেপি কী করছে? রাজনীতির নামে ভারতীয় সংবিধানকে বিপন্ন করেছে, হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনের প্রাণপণ চেষ্টা করেছে আর জনস্বার্থের বিনিময়ে কর্পোরেট ক্যাপিটালের সবচেয়ে ধান্দাবাজ অংশকে মদত দিচ্ছে। প্রত্যেকটিই জনবিরোধী কাজ। তাতে নির্লজ্জ মদত দিয়ে যাচ্ছে গোদি মিডিয়া। সারা ভারতে অজস্র দমনমূলক আইন প্রণয়ন করে বিরোধী পরিসরকে একেবারে হাওয়া করে দেওয়ার কৃতিত্ব বিজেপিরই।
আমাদের রাজ্যে অবশ্য হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনের কথা অন্য দল বলেনি, কিন্তু শাসক যেভাবে আলতো করে বিজেপির মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে, তাতে বিজেপির সুবিধে বই অসুবিধে হয়নি। যেমন দ্যাখো, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো ধর্ম দিয়ে ধর্ম তোলার নীতি। বিজেপি হনুমানচালিশা পড়ার কথা বলতেই আমি যদি উল্টোডাঙার ওভারব্রিজ ঘেঁষে বিশাল হনুমানের মূর্তি বসিয়ে দিই, তাহলে কী আর আদর্শিক টক্কর নেওয়া হল? উলটো ধর্ম নিয়ে হুল্লোড়ে হাওয়া দেওয়া হল। এরপরে গোটা ভিআইপি রোড ধরে সারারাত ডিজে বাজলে আর বাঁক কাঁধে পুণ্যার্থীদের গালাগাল শুনলে হজম করা ছাড়া উপায় কী বলো!
সংখ্যালঘু ‘তোষণ’টাও এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়। সত্যি সত্যি গরিব মুসলমানের সমস্যার কোনও সুরাহা হোক বা না-ই হোক, ইদের ইফতারে ঘোমটা দেওয়া বা মাথায় রুমাল বাধা ক্ষমতাবানদের দেখতে তো ভালোই লাগে। মাঝখান থেকে ঝাল গিয়ে পড়ে ‘দুধেল গাই’ সংখ্যালঘুর ওপরেই, ব্যাটা তো সবটা ক্ষীর খেয়ে নিল— কিন্তু তারা থেকে যায় যে তিমিরে সেই তিমিরেই।
অথচ একদিন তো এইরকম ছিল, জানো, যখন রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা রাখার সচেতন চেষ্টা এই পশ্চিমবাংলাতেই দেখা যেত। বাম আমলের ভেঙে পড়া শেষটায় নেতারা পুজোটুজো উদ্বোধন করতে গেলেও, আগে কিন্তু এসব বারণ ছিল। অলিগলিতে শনিমন্দির চিরকালই, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে প্রকাশ্যে আরাধ্যের উল্লম্ফন হালের ব্যাপার। ধর্মের পালে উদ্দেশ্যমূলক বাতাস দিলে তা পরিণত হয় ধর্মোন্মাদনায়, যার ঠিকে এখন আর বিজেপির একার নয়। তবে সুবিধের ভাগটা অবশ্যই তার বেশি।
বিরোধী পরিসর এখনও একেবারে উবে যায়নি এ রাজ্যে। তবে চেষ্টার ত্রুটি নেই। গণস্মৃতিকে দুর্বল বলে সবাই, তাই ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিভীষিকা এখন আর দুঃস্বপ্নে হানা দেয় না বোধহয়। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে তাতেও কি বিজেপির সুবিধে হয়নি? বিরোধী পরিসর ফাঁকা পড়ে থাকবার বস্তু তো নয়। বামফ্রন্ট পাশে দাঁড়াতে পারছে না, বেশ তো, শক্তিশালী বিজেপি তো আছে, এইরকম সহজ সমীকরণ অনেক ফ্লোটিং ভোটারকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কোনও পার্টিনেতার শিলমোহরের অপেক্ষায় থোড়ি বসে থেকেছে তারা। তারা তো কোনও পার্টির বন্ধুয়া শ্রমিক নয়, পৈতৃক সম্পত্তিও না। তাদের ঘর ভেঙেছে, আগুন লেগেছে, তারা বিজেপির নৌকোয় উঠে বসেছে, কে গ্রেটার, কে লেসার ইভিল— সেসব না-ভেবেই। এরা তো ফ্লোটিং, কিন্তু শাসক দলের প্রায় ৫০ জন নেতা, যাদের ওপর পার্টির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা, তারা হুড়মুড়িয়ে বিজেপি হয়ে গেল! বিজেপির ক্ষমতা, অর্থবল, ঘোড়া কেনাবেচা করার ক্ষমতা বিচার করে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সদ্য সদ্য পণ্ডিচেরির উদাহরণে আরও অসহায় লাগছে। যাকে বিজেপিবিরোধী ভেবে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করব, সে যদি কাল জয় শ্রীরাম বলে হাতে ত্রিশূল তুলে নেয়?
গণতান্ত্রিক পরিসরকে হত্যা করা এখন তো রাজনীতিকদের খুব পছন্দের খেলা। সমস্ত দমনমূলক আইনকে মাঠে নামিয়ে আনা হয়েছে সে খেলায় সুবিধা করে দেওয়ার জন্য। বিরোধিতা করলেই দেশদ্রোহীর তকমা, জেলের ঘানি টানা। নাহলে গুপ্তঘাতকের গুলি। আচ্ছা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো পারতেন এই আইনগুলো এ রাজ্যে লাগু হতে দেব না— এই নারা তুলতে। যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলির কাজে অনবরত বাধার সৃষ্টি করা হয়, তাদের মাথায় দলীয় পছন্দের লোক না-বসিয়ে বহুজনমান্য কাউকে বসাতে। বামের এবং রামের, উভয়ের ভালো ছাত্র হতে তো কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি!
ইলেকশনে অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে বাম ছাড়া কেউই বেশি কিছু বলছে না। চাকরিবাকরি কোথাও নেই, তা নিয়ে মিথ্যা আশ্বাস আছে মাত্র। এত বেকারের চাকরি করে দিলাম বা দেব, এইটাই চলতি কথা। বাস্তবে আছে শুধু বেকারত্ব, দুর্নীতির কারণে আদালতের হস্তক্ষেপ, আর দাবি আদায়ে বিকাশ ভবনের সামনে বেকার অনশন ও ধর্না। কোথাও পুলিশ এসে মাঝরাতে পিটিয়ে তুলে দিচ্ছে, কোথাও মারতে মারতে একেবারেই মেরে ফেলছে।
তবু নাকি কেন্দ্রের তুলনায় এ রাজ্যের চাকুরিপ্রার্থীর সংখ্যা কম। হয়তো হবে, কারণ সিভিক পুলিশ, পার্শ্বশিক্ষক, চুক্তিশ্রমিক— এমন নানা অভিনবত্বের বাড়বাড়ন্ত, যাতে নামে চাকুরিজীবীর সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু পেট চলে না। আর চাকরির জন্য কাটমানি। সিভিক পুলিশের রেট কত, কত নির্দিষ্ট শিক্ষকের চাকরির জন্য— শুনতে পাই, এসবই ঠিক করা আছে। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। যারা টাকা দিতে পারে না তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়, স্থগিতাদেশ আসে। আমও যায়, ছালাও যায়। বহু বছর হল বাংলার ছেলেমেয়েরা এই চক্কর থেকে বেরোতে পারছে না। সিএসসি, এসএসসির মাধ্যমে সুশৃঙখলভাবে চাকরি পাওয়া এখন ঘটে না বললেই চলে।
কৃষকের আত্মহত্যা বাংলাতেও ঘটেছে, ঋণে তারা জর্জরিত, এমএসপি-তে শস্য বেচতে পারে কত জন? ফড়েদের হাতের পুতুল। অভাবী বিক্রির চক্করে অসহায়। আমি বিশ্বাস করি না তৃণমূলের জায়গায় বিজেপি এলে এদের অবস্থা ভাল হবে, যা হবে তার ঝলক তো দিল্লি সীমান্তে দেখেই যাচ্ছি। মাঝখান থেকে মনে পড়ে যাচ্ছে, কত কৃষক আত্মহত্যা করছে এ রাজ্য থেকে সেই তথ্য এনসিআরবি-কে জানানো বারণ হয়ে গেছে সরকারি নির্দেশে। মুখ্যমন্ত্রী এই তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে গলা তুলতে পারতেন, বলতে পারতেন এ রাজ্যে এসব কার্যকর হবে না।
বাস্তবে শ্রমিক কৃষকদের অবস্থা নিয়ে আদৌ রাজনীতিকরা ভাবিত নন। নির্বাচনী প্রচারে এসে সাহাগঞ্জে বক্তৃতা দিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ডানলপ কারখানা নিয়ে স্পিকটি নট হয়ে রইলেন। অথচ এখানে ১৪১৫ জন শ্রমিকের মোট বকেয়া ১৯ কোটি ৪০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। বকেয়া আছে ১৭৩ কোটি টাকার পিএফ। ৫১ একরের বিশাল কারখানা পড়ে আছে ভূতের বাড়ি হয়ে। নির্বিবাদে চুরি হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রপাতি, মায় বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা। এইরকম বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আগে তৃণমূল, পরে বিজেপি হয়ে যাওয়া সমাজবিরোধী নেতারা। দু দলের অনাগ্রহই যাদের মূলধন।
আর একটা কথা শর্বরী, এই বাংলায় আইডেন্টিটি পলিটিক্সকে বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু আসলে তাদের উন্নতি হোক এটা কোনও দলই চায় কিনা, বুঝে উঠতে পারি না। কত বোর্ড গঠিত হয়েছে শুধু পাহাড়ে, সে তো তুমি জানোই, মতুয়া, মাহাতো ছুঁয়ে জঙ্গলমহল অবধি আরও কত বোর্ড— তার হিসেব দিতে পারব না। তাৎক্ষণিক কিছু পাওয়া আর ভোট দেওয়া, এই কর্মকাণ্ডের বাইরে গিয়ে ভোটব্যাঙ্কের সার্বিক উন্নয়ন কেউ করেনি, করবেও না বোধহয়।
তৃতীয় যে জোট, বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ, তারা ব্রিগেডের ভিড়ে উজ্জীবিত। সত্যিই এতকালের ক্ষমতাহীনতার পরেও এত সমর্থক দেখে মনে হয় আবেগ আর আদর্শ এখনও, এত কিছুর পরও বেঁচে থাকে তাহলে! যারা এই কঠিন গরমে লাল ঝান্ডা কাঁধে মাঠ ভরায় তাদের পাওয়ার তো কিছু নেই। বরং তারা মনে করিয়ে দেয়— একটা বাম দল, অনেক ‘বোকা’ মানুষের প্রিয় দল, কখনওই কর্পোরেট কায়দায় চলতে পারে না। তার দায়বদ্ধতা টাটা আম্বানিদের কাছে নয়, এইসব সাধারণ মানুষের কাছে। নৈতিকতা বামের ভিত্তিভূমি। নীতির সঙ্গে হালের রাজনীতিকে মেশাবার অসাধ্যসাধন সে যদি করতে পারে, তবেই সে সত্যকারের বাম। মানুষের থেকে বিচ্যুতি ঘটেছিল বলেই না মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
তুমি অনেক যুক্তি দিতে পারো, শর্বরী, বলতে পারো আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ষড়যন্ত্রের কথা, অগুন্তি টাকা ছড়াবার, মিথ্যে প্রচারের কথাও, সেসব বহুল পরিমাণে সত্য হওয়া সত্ত্বেও আমার কিন্তু মনে হয় দীর্ঘদিন বামেরা টিকে ছিল ওই নৈতিকতার জোরেই। যেদিন থেকে পাড়ায় দাদাগিরি শুরু হল, অভ্যন্তরীণ ক্লিকবাজির কথা ছেড়েই দিলাম, শুরু হল আর সবার মতো হওয়ার সাধনা, কারণ সবাই ভোটের রাজনীতি করতে এসেছে, বামও তাই— সেদিন থেকেই শুরু পাশ থেকে মানুষের সরে যাওয়ার। আজ যখন কেউ বলে বামের দেখানো পথেই তৃণমূলের উল্লম্ফন, এমনকী কাটমানির ক্ষেত্রেও, প্রতিবাদ করতে গিয়ে গলায় জোর পান না অনেকেই। যদিও সারদা-নারদায় মন্ত্রীদের উৎকোচ গ্রহণের কোনওটাই বাম আমলে হয়নি। হয়নি কোনও বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারি। প্রতিশোধস্পৃহায় ফেটে পড়লেও আজ অবশি কোনও নেতাকে জেলের ঘানি টানানো যায়নি। বরং সুশান্ত ঘোষের মতো অনেককেই সসম্মানে মুক্তি দিতে হয়েছে।
একটা কথা আমি বুঝেছি, জানো? মানুষ আদ্যন্ত বিশ্বাস করে, বামপন্থার কোনও বিচ্যুতি হয় না। অন্যেরা যা খুশি তাই করতে পারে, বামপন্থীরা নয়। কেউ কেউ এই ধারণাকে মুখোস করে এঁটে নেয় বাম-বিরোধিতার জন্য, বাস্তবে হয়তো তার নজর একটা সরকারি বা বেসরকারি পুরস্কারের মতো তাৎক্ষণিক কিছুতে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ বামেদের পারফেকশনে সত্যিই বিশ্বাসী, আর তাদের সমালোচনার পেছনে থাকে পুঞ্জীভূত অভিমান আর আশাভঙ্গের বেদনা।
এই কারণেই বামের যুদ্ধ আরও কঠিন। শুধু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াইই তো সব নয়, নিজের ভেতরেও বামশক্তির লড়াই চলতে থাকে অহরহ, নিজেকে আরও উন্নত করার, সামাজিক ন্যায়ের ধারণা, যা তার প্রাণভোমরা, তাকে আরও নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করার। এ লড়াই শুধু আবেগ দিয়ে জেতা যায় না, দরকার হয় কঠোর অনুশীলন আর অবশ্যই স্বপ্ন দেখার চোখ। খুব কঠিন কাজ, কঠিন দায়িত্বও। অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েকের একটি উদ্ধৃতি খুব খেটে যায় এই পরিস্থিতিতে, “প্রশ্ন এটা নয় যে এদেশে বামেদের কোনও ভবিষ্যৎ আছে কিনা, প্রশ্ন হল বামেদের ছাড়া এদেশের কোনও ভবিষ্যৎ আছে কিনা।” চারপাশের ঘটনাবলি প্রমাণ করছে, নেই। কিন্তু অনৈক্যজর্জরিত বামেরা না এখনও প্রস্তুত, না তাঁদের মধ্যে এখনও আছেন এক বিশাল মাপের নেতা, যিনি গণদেবতার হৃদ্স্পন্দন অনুভব করতে পারেন নিজের বলে।
যদি সরকারি বামেরা ভাবে, সংসদীয় রাজনীতিতে অত আদর্শনিষ্ঠার বালাই অচল, ভাবতেই পারে। যদি ভাবে অন্যরা যে চালে মাত করে, তাতে আমাদেরও কাজ চলে যাবে, তা-ও ভাবতে পারে। তবু কিছু বোকা লোক শেষ অবধি তাদেরই মুখ চেয়ে থাকবে, নারীবাদীরা নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য ব্রিগেডে ভিড় জমাবে, না-পেলে সামাজিক মাধ্যমে রাগে ফেটে পড়বে, হাতে রামধনু পতাকা আন্দোলিত করবে বিজেপি সরকারের দ্বারা বুনিয়াদি অধিকার যাদের প্রত্যাখ্যাত, সেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা। পরিবেশকর্মীরা জানবে এইই তাদের শেষ আশ্রয়, বন-জঙ্গল-নদীর লড়াইতে তাদের ‘ন্যাচারাল অ্যালাই’ বামশক্তি। ফলে শুধু শ্রেণিচেতনা ছড়িয়ে দেওয়া নয়, বামের দায়িত্ব এখন অনেক গুরুভার, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও গুরুতর হবে।
এইরকম একটা কাঁটা-বিছানো তিনমাথার মোড়ে প্রহর গুনছে পশ্চিমবঙ্গবাসী। ভুল বললাম, গোটা ভারতবর্ষ, যে ভারতের বলয় শাসকের টেনে দেওয়া গণ্ডিকে ছাপিয়ে যায় সবসময়, সেই গণতন্ত্রপ্রেমী অসাম্প্রদায়িক শান্তিকামী মানুষের চোখ অর্জুনের চোখের মতো নিবদ্ধ এই নির্বাচনে। বিজেপির জয়রথের চাকা কাদায় তলিয়ে যাওয়া শুরু হোক এই নির্বাচনের মাধ্যমেই, এইই তাদের মনোগত ইচ্ছা। শেষের শুরু।
তুমি কী বলো?
গৈরিক ফ্যাসিস্ট শাসনে অতিষ্ঠ হরেক সচেতন নাগরিকই প্রতিভাদির কথার সঙ্গে একমত হবেন। পশ্চিমবঙ্গের ফ্যাসিস্টকরণ রোখার যুদ্ধে বামপন্থাই আদর্শের ভীমশেল। শাসকদল বিজেপির মত খেলতে গিয়ে আজ আরেক বিজেপিই যেন! চেতনার আলোয় জ্বলে উঠুক এবারের নির্বাচন, দেখাক বাকি ভারতকে যে বাংলা উত্তরপ্রদেশ হতে চায় না।