চার নম্বর নিউজডেস্ক
একশো দিন। একটা মাইল পাথর। প্রেক্ষাগৃহে একটানা একশো দিন পেরিয়ে যেতে পারলে সিনেমা হিট, থিয়েটার মঞ্চসফল। ক্ষমতায় একশো দিন কাটিয়ে জনগণের সামনে একশো দিনের কৃতিত্বের খতিয়ান পেশ করে নির্বাচিত সরকার৷ এগুলো রুটিন, সাধারণ নিয়ম। ভারতবাসী এই সমস্ত কিছুর চেয়ে অনেক বড়, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একশো দিন পেরোনোর সাক্ষী রইলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে নভেম্বর ২৬-এর শীত রাতে দিল্লি সীমান্তে কৃষিজীবী মানুষজনের অবস্থান বিক্ষোভ হিসেবে যা শুরু হয়েছিল, আজ একশো দিন পেরিয়ে তা শাসকের অপশাসন ও অগণতান্ত্রিক চরিত্রের বিরুদ্ধে এক গোটা দেশব্যাপী সামগ্রিক গণ-আন্দোলনের রূপ পেয়েছে। ৬ মার্চ ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক ইতিহাসের এই উজ্জ্বলতম একশো দিন পূর্ণ হল।
এই একশো দিন পূর্তির সমারোহ কৃষকরা পালন করলেন, না ফুলে-বেলুন-কেকের টুকরো দিয়ে নয়, বরং গানে, স্লোগানে, কালো পতাকায়, রাজপথ ঘেরাও-এর মাধ্যমে। গতকাল পাঁচ ঘণ্টা ধরে দিল্লি সীমান্তে নানা প্রতিবাদস্থল সংযোগকারী রাজপথ কেএমপি এক্সপ্রেসওয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মাধ্যমে ঘিরে রাখেন কৃষকেরা। আন্দোলনকারীরা অর্থাৎ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা দেশবাসীকে অনুরোধ করেছিলেন ৬ মার্চ নিজেদের বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলন করতে, কালো ব্যাচ পরতে।
সংযুক্ত কিসান মোর্চা আন্দোলন তীব্রতর করার লক্ষ্যে, গতকাল থেকে গোটা দেশে সুনির্দিষ্টভাবে ‘এমএসপি দিলাও অভিযান’-এর ডাক দিয়েছেন৷ এই আন্দোলন উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত মিথ্যাচার ও ছলচাতুরি আরেকবার মানুষের সামনে তুলে ধরবে৷ ‘এমএসপি দিলাও’ আন্দোলন শুরু হবে দক্ষিণ ভারত থেকে, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ হয়ে এই অভিযান ক্রমে উত্তরভারতের নানা রাজ্যে প্রবেশ করবে। সারা দেশের সমস্ত কৃষক, কৃষিশ্রমিকদের এই আন্দোলনে যোগদান করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এবং আমাদের পশ্চিমবাংলাতেও। আমরা যখন এখানে ভোটের নানান রঙ্গতামাশা নিয়ে ব্যস্ত সে সময়েই কৃষক নেতারা ঘোষণা করেছেন আগামী ১২ থেকে ১৪ মার্চ সারা রাজ্যে বেশ কয়েকটি কিসান মহাপঞ্চায়েতের জন্য আসছেন দিল্লির আন্দোলনের কৃষক নেতারা। মহাপঞ্চায়েতগুলি হবে কলকাতা, সিঙ্গুর, আসানসোল এবং নন্দীগ্রামে। আরও দু-একটি জায়গা যোগ হতে পারে এই তালিকায়।
পশ্চিমবাংলার সঙ্গে কৃষক নেতারা কেরল এবং অসমেও যাবেন। যে সব রাজ্যে এ বছর বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন, সেইসব রাজ্যে কৃষকেরা যাবেন, সভা-সমাবেশ করবেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন, সরাসরি মানুষকে জনবিরোধী, মিথ্যেবাদী ও বিশ্বাস-ভঙ্গকারী বিজেপি দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে আর্জি জানাবেন। তাঁরা নির্দিষ্টভাবে কোনও দলের স্বপক্ষে প্রচার করবেন না, কিন্তু বিজেপিকে রাজ্যে ক্ষমতায় আনা যে কত বড় ঘাতক সিদ্ধান্ত হতে পারে, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করবেন।
আসন্ন ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবসকে সামনে রেখে দেশের বড়-ছোট নানা বাণিজ্যিক সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমগুলি ফুল, চকোলেট, প্রেসার কুকার থেকে শুরু করে সলিটেয়ার হীরের বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করবে। ঠিক সেইসময় দিল্লির সীমান্তে কৃষকেরা নারী দিবস পালন করবেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। ওইদিন প্রতিবাদ মঞ্চে বিভিন্ন মহিলা সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কৃষিকাজে নারীদের অবদানকে সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য। ওইদিন মঞ্চ সামলাবেন কৃষকরমণীরা, ভাষণ দেবেন কৃষকনেত্রীরা। যাঁরা চাষবাস সম্পর্কে সামান্য খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন কী পরিমাণ শ্রমদান করেন কৃষক পরিবারের মেয়েরা। তা সত্ত্বেও চাষি বলতেই এখনও অনেকের কাছে মাথায় গামছা বাঁধা, পাগড়ি পরা পুরুষের ছবি ভেসে ওঠে। সেই স্টিরিওটাইপ ভেঙে দেবে ৮ মার্চের প্রতিবাদস্থল।
আগামী ১৫ মার্চ দেশের প্রায় বেশিরভাগ শ্রমিক সংগঠনগুলি একত্রে ‘Anti-Privatisation Day’ বা ‘বিলগ্নিকরণ বিরোধী দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কৃষক আন্দোলনের মঞ্চ থেকে সংযুক্ত কিসান মোর্চা শ্রমিক সংগঠনগুলিকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করেছে। কৃষক-শ্রমিক ঐক্য শাসকের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে এক ইতিবাচক রাজনৈতিক সচেতনতাকে তুলে ধরছে, এবং দেশের পক্ষে এ যে কত বড় সুসংবাদ তা আমরা সবাই আশা করি বুঝতে পারছি।
কৃষকরা যখন নিজেদের আন্দোলনকে আরও জোরদার করছেন, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন নতুন নতুন শ্রমিক গোষ্ঠীর দিকে, যুক্ত করছেন আরও বেশি সংখ্যক সাধারণ মানুষের সঙ্গে, ঠিক তখন রাষ্ট্রও বসে নেই। সে তার নিজের কাজ করে চলেছে। সম্প্রতি জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন নোদীপ কৌর, শ্রমিক সংগঠনের কর্মী। কৃষক আন্দোলনের পক্ষে প্রচার করার জন্য, জনমত গড়ে তোলার অপরাধে তাঁকে জানুয়ারির ১২ তারিখ গ্রেফতার করা হয়েছিল। নোদীপ জামিন পেয়েই ফিরে এসেছেন সিঙ্ঘু বর্ডারে। জানিয়েছেন, কীভাবে হাজতের ভেতরে অত্যাচার চালানো হয়েছে তাঁর ওপর। ঠিক একইভাবে, দলিত আন্দোলনকারী ও মজদুর অধিকার সংগঠনের কর্মী শিব কুমারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ। তাঁরও জামিন মিলল এই এতদিনে— গত বৃহস্পতিবার৷ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে শিব কুমারকে কাস্টডিতে কিরকম হিংসার শিকার হতে হয়েছে। তাঁর নখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে, হাড় ভেঙেছে, তাঁর পায়ে ও পায়ের পাতায় নিয়মিত আঘাত করা হয়েছে। স্বাধীন মতপ্রকাশের ও শাসকের সঙ্গে ভিন্নমত হওয়ার অপরাধ কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে নিচ্ছে রাষ্ট্র। প্রসঙ্গত, তিনটি মানবাধিকার সংস্থা একযোগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে চিঠি লিখে অবিলম্বে শিব কুমারের ওপর ঘটা অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন।
বস্তুত, এই ঐতিহাসিক ১০০ দিন সাক্ষী হয়ে থাকল শাসকের নির্মমতা এবং বর্বরতারও। জলকামান ছোড়া থেকে পরিখা কেটে, কাঁটাতার দিয়ে কৃষকদের ঘিরে ফেলা; জল, বিদ্যুৎ সহ সমস্ত সুযোগসুবিধা বন্ধ করে দেওয়া; নেতাদের এবং সহানুভূতিশীল বিভিন্ন ব্যক্তিদের নামে দেশদ্রোহিতার মামলা দায়ের… এ সমস্ত কিছুই দেখা গেছে এই সময়ে। পেটোয়া সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে অপপ্রচারগুলির কথা ছেড়েই দিলাম। ২৫০ জন কৃষক শহীদ হয়েছেন এখন পর্যন্ত। তাঁদের এতদিন যুঝতে হয়েছে উত্তর ভারতের হাড়কাঁপানো ঠান্ডার সঙ্গে, এবার যুঝতে হচ্ছে চামড়াপোড়ানো গরমের সঙ্গে, এবং এর পরে যুঝতে হবে বর্ষার সঙ্গে। কিন্তু এ সমস্ত কিছুই আমাদের অন্নদাতা বোকা বুড়োদের চোয়াল আরও শক্তই করতে পেরেছে কেবল।
শাসক যেভাবে কোভিডকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার শাহিনবাগ আন্দোলনকে দমন করেছিলেন, এক্ষেত্রে আর তা সম্ভব হচ্ছে না। শাসক-ঘনিষ্ঠ কিছু স্বার্থান্বেষী সেলব্রিটি ছাড়া কৃষকেরা দেশ ও বিদেশের সর্বস্তরের প্রচুর মানুষের সমর্থন পেয়েছেন। জনসমর্থন দিন দিন বাড়ছে। কারণ কৃষক আন্দোলন আর শুধুমাত্র কৃষি আইনের বিরুদ্ধাচারণের মধ্যেই আবদ্ধ নেই। এই আন্দোলন সামগ্রিকভাবে বিজেপি সরকার সীমাহীন মিথ্যাচার ও কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির চরিত্রবৈশিষ্টকে সকলের কাছে উলঙ্গ করে দিয়েছে। তাই একশো দিন পেরিয়ে গিয়েও ক্রমশ গড়ানো তুষারবলের মতো কলেবরে বৃদ্ধি পাচ্ছে আন্দোলন। আন্দোলনের ভর যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভীত শাসকের দমনপীড়ন। তাই কৃষক আন্দোলন একশো দিনের মাইলফলক পেরিয়ে গেলেও আত্মতুষ্ট হওয়ার সময় এটা নয়, বরং আজ স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে আরও তীব্রতর আন্দোলনের শপথ নেওয়ার দিন।