শামিম আহমেদ
অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
সুকুমার সেন বলেছিলেন, ‘ফুরফুরা’ মানে শান্ত হাওয়া। এই ফুরফুরা এখন বঙ্গ রাজনীতিতে হট টপিক। ফুরফুরা শরিফের আব্বাস সিদ্দিকি নতুন দল গড়ে এবং বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বাংলায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন। ফুরফুরা শরিফ বিখ্যাত দাদা হুজুরের জন্য।
দাদা হুজুর অর্থাৎ হজরত আবু বকর সিদ্দিকি, যিনি ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণে অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন, তাঁর জন্যই ফুরফুরার দেশ জুড়ে সুনাম। হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন শুধু নয়, বাংলা ভাষার প্রসার ও প্রচারে দাদা হুজুরের অবদান ছিল স্মরণীয়। মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে দাদা হুজুরের বেশ কিছু জায়গায় মতাদর্শগত বিরোধ ঘটে। কিন্তু তিনি কখনওই লিগের সমর্থক ছিলেন না। বরং তিনি জীবদ্দশায় লিগের সঙ্গে হিন্দু মহাসভার জোট দেখে গিয়েছেন। আপাদমস্তক স্বদেশি এই মানুষটি ছিলেন ধর্মগুরু। সুন্নি হানাফিদের একটি বড় অংশ দাদা হুজুরকে আজও মেনে চলেন। মান্য করেন সিলসিলা-ই-ফুরফুরাকে।
এই বংশের ছেলে আব্বাস সিদ্দিকি নতুন দল গড়েছেন— ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট। দল গড়ে ভোটে লড়ার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। আব্বাসের অন্ত্যজ হিন্দু ও মুসলমানদের একাংশের কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা আছে। সেটা ভোটের বাক্সে কতটা প্রতিফলিত হবে, এই লেখার সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
স্বাধীনতার পর বাঙালি তথা ভারতীয় মুসলমানদের নিজস্ব কোনও দল ছিল না, তাঁরা প্রায় সকলেই সেকুলার দলকে ভোট দিয়ে এসেছেন। মুসলমান দল বানালে যে সেটা অ-ধর্মনিরপেক্ষ হবে, এমন কথা কিন্তু বলছি না। আব্বাস মুসলমান সমাজে মূলত একটি ধর্মীয় মুখ। মুসলমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের একটি বড় অংশ বাকি সকলের মতো একটা হতাশায় ভুগছে। তরুণদের মধ্যে এটি অনেক বেশি। সেই হতাশার অনেক কারণ— কর্মহীনতা, গণতন্ত্রের পরিসর কমে যাওয়া, তৃণমূলের দুর্নীতি, সর্বোপরি দেশজুড়ে বিজেপির রণহুঙ্কার। এ সবের মধ্যে আছে মূল্যবৃদ্ধি, এনআরসির মতো নানা বিষয়। হতাশায় নিমজ্জিত হলে মানুষ কিছু আঁকড়ে ধরে উঠতে চায়। যে সব রাজনৈতিক দল এ রাজ্যে রয়েছে, তাদের উপর আস্থাশীল থাকতে পারছেন না মুসলমানদের একটি অংশ। এই জায়গাটিকে আব্বাস ঠিকঠাক অ্যাড্রেস করতে পেরেছেন। তৃণমূল যে মানুষটির ঘর জ্বালিয়েছে, সে কোন জায়গা থেকে বিজেপিকে আটকাতে তৃণমূলকে ভোট দেবে? দেবে না। সে সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসনের কথা শুনেছে, কংগ্রেসের হাল দেখেছে; তাহলে তার দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়! মানুষ স্বভাবত প্রতিহিংসাপরায়ণ, যে তাকে মেরেছে সে তার বদলা নিতে চায়। আব্বাসের গরম বক্তৃতা তাকে কিছুটা হলেও আরাম দিচ্ছে।
ফুরফুরা শরিফের পির বংশে প্রচুর সদস্য। তাঁদের মধ্যে নানা রাজনৈতিক মত আছে। এক কালে বিভিন্ন দলের নেতারা ভোটের আগে ফুরফুরা দরবার শরিফে যেতেন আশীর্বাদ নিতে। ফুরফুরার অনেকে এক কালে বামেদের সমর্থক ছিলেন, দক্ষিণপন্থীও আছেন বহু মানুষ। এই বংশের মানুষদের প্রধান কাজ ধর্মীয় জলসা করা। সেটি দিয়ে জীবিকার প্রয়োজনও মেটে। পশ্চিমবঙ্গের বহু জেলায় তাঁদের মুরিদ বা শিষ্য নেহাত কম নয়। আব্বাসের সেই অনুগামীরা কি আদৌ আব্বাসকে ভোট দেবেন? বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। কেউ কেউ বলছেন, দেবেন। বড় অংশ বলছেন, আব্বাস ভাই ফ্রান্সের খুনিকে সমর্থন না করলেই পারতেন, অনেকে বলছেন, ক্ষমতায় এলে ভাইজান সাংসদ অভিনেত্রীকে গাছে বেঁধে পিটিয়ে মারবেন, এমন কথা তো বিজেপির লোকজন বলে! বিজেপিকে আটকাতে কেন তবে আব্বাস ভাইকে ভোট দেব!
বিজেপির বাড়বাড়ন্তে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনীতির আঙিনায় আনতে চাইছেন। তাই আব্বাস সিদ্দিকির ‘রাজকীয় আগমন’ নিশ্চিত ছিল। এর ফলে বঙ্গ-রাজনীতির যে ‘লাভ’ হয়েছে, তা হল হায়দরাবাদের আইমিম নামক দলটিকে বঙ্গে প্রসার বিস্তারে রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ‘রাজকীয় আগমন’ কেন বলছি, এই কারণে যে, আব্বাস সিদ্দিকির শর্তেই এক কালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম এক কথায় আসন-রফায় রাজি হয়েছে, সেই ভাবনা থেকে এমন কথা বলা।
একটি মিথ আছে বঙ্গে, মুসলমান ভোট তৃণমূল পায়। যেহেতু মুসলমান বিজেপিকে ভোট দেয় না সাধারণত, তাই এমন ভাবনা অমূলক নয়। কিন্তু গ্রামের দিকে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, বিশেষত মুর্শিদাবাদ ও মালদায়, কংগ্রেস ও সিপিএমের একটি বড় ভোট বাক্স আছে। দক্ষিণবঙ্গে যদি আব্বাস মুসলমান ভোটে থাবা বসাতে পারেন তাহলে তৃণমূলের ভোট কমবে। অনেকেই এমন কথা বলছেন, তৃণমূলকে পরাজিত করার লক্ষ্যে বামফ্রন্ট আব্বাস সিদ্দিকির সব শর্তে রাজি হয়েছে।
হাতে রইল বিজেপি। বিজেপির বিপদ সম্পর্কে কী ভাবছে এই কং-বাম-আব্বাস জোট? অতি বড় বাম সমর্থকও জানেন, জোট ক্ষমতায় আসবে না। বাকি রইল বিজেপি আর তৃণমূল। তৃণমূলকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে জোট মাঠে নামবে, সেটাই স্বাভাবিক। তার যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য কারণও আছে। বিজেপিকে রুখতে কী আয়োজন জোটের?
আব্বাস সিদ্দিকিই বা কী ভাবছেন? তিনি অন্ত্যজ হিন্দু ও মুসলমানদের বহু ভোট পাবেন, কিন্তু আসন পাবেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এর ফলে আখেরে লাভবান হবে বিজেপি।