শতাব্দী দাশ
শিক্ষক ও সমাজকর্মী, প্রাবন্ধিক
অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণে এবারের আন্তর্জাতিক নারীদিবস এল ভারতে। মার্চ মাস নারীদের উদযাপনের মাস। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবসের মাস৷ অধিকার, দাবি-দাওয়া, প্রতিরোধের নিরিখে কতটা পথ চলা হল আর কতটা পথ চলা বাকি, তা ফিরে দেখার মাস। আর এই মাসেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবদের দু-দুটি রায়ের ভাষা নিয়ে নারী তথা লিঙ্গ রাজনৈতিক কর্মীরা আলোড়িত, শঙ্কিত, ক্ষুব্ধ।
মার্চের প্রথম দিনেই তাঁর জোড়া রায়ের আত্মপ্রকাশ৷ প্রথমটির ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি বোবদে এক ধর্ষককে প্রশ্ন করেছেন, ‘ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে রাজি আছ?’ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আছে পকসো-তে মামলা। অভিযোগকারিনী ধর্ষণের শিকার হয়েছে নাবালিকা বয়স থেকে, ক্লাস নাইন থেকে৷ অভিযোগ, তার বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে তার বাড়িতে একদিন অভিযুক্ত চড়াও হয় ও হাত পা বেঁধে নাবালিকাকে ধর্ষণ করে প্রথমবার। এরপর আরও বহুবার নাবালিকা অবস্থাতেই যৌন সম্পর্ক করা হয়। আরও অভিযোগ, মেয়েটিকে ও তার ভাইকে খুনের হুমকি দিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হত৷ মেয়ের বাবা-মা যখন জানতে পারে, তখন তারা পুলিসে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু তারা দোলাচলে ছিল৷ জানাজানি হলে যদি মেয়ের বিয়ে না হয়? এই সময় পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ের বাড়িতে আসে ধর্ষকের মা। হাতে-পায়ে ধরে মেয়ের বাবা-মাকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি করায়। একটি এগ্রিমেন্টে সই করিয়ে নেওয়া হয় তাদের দিয়ে, মেয়ের আঠারো বছর বয়স হলেই সেই মহিলা নাকি এই মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবে। আঠারো হয় মেয়েটির। ধর্ষক এখন বিয়ে করতে নারাজ, সে বিবাহ করে নিয়েছে অন্য কাউকে৷ এগ্রিমেন্টটি আসলে ছিল পকসো ও ধর্ষণের অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতির উপায়। এইবার বাবা-মার টনক নড়ে৷ তারা আইনের দ্বারস্থ হয়। কেউ বলতেই পারে, মেয়ের বাবা-মা প্রথম থেকেই বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে ভুল করেছে। ঠিকই। কিন্তু যে ভুল সাধারণ নাগরিক করে, সেই ভুল সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিও করতে পারেন কি? উক্ত মামলার শুনানিতে বিচারপতি বোবদে বলেছেন:
- ধর্ষক কি ধর্ষিতাকে যেকোনওভাবে বিয়ে করতে প্রস্তুত?
- ধর্ষক সরকারি কর্মচারী, আটচল্লিশ ঘণ্টার বেশি জেল খাটলে তার চাকরি যেতে পারে৷ তাই শ্রী বোবদে তাকে আগাম জামিনও দিয়েছেন এক মাসের জন্য।
- একমাস পরে জানাতে হবে, বিয়ে করা আদৌ সম্ভব কিনা৷ তার পরে সেই অনুযায়ী বোবদে ধর্ষকের সম্পর্কে ভবিষ্যৎ রায় দেবেন।
উক্ত রায় থেকে উদ্ভুত প্রশ্নগুলো খুব স্পষ্ট।
প্রথমত, একজন অন্যায়কারী আসামীর অন্যায় কি বিয়ে করলে মকুব হয়? কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে অ্যাসিড আক্রমণের ভয় দেখানো কোনও ধর্ষককে বিয়ে করা সম্ভব? দ্বিতীয়ত, ধর্ষককে বিয়ে করার নিদান এতদিন খাপ পঞ্চায়েত দিত। খাপ আর সুপ্রিম কোর্টে কী তফাত থাকল তবে? তৃতীয়ত, মাননীয় প্রধান বিচারপতি সরকারি কর্মচারী হিসেবে ধর্ষককে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছেন কেন? ধর্ষক সরকারি কর্মচারী না রিক্সাওয়ালা, তা দেখে বিচার হবে? চতুর্থত, মাননীয় বিচারপতি স্পষ্টতই ধর্ষককে বর্তমান স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে বলছেন। বা দুই বউ নিয়ে সংসার করতে বলছেন। ঠিক কী বলছেন তিনি? কীভাবে বলছেন ও কোন আইনে বলীয়ান হয়ে?
ধর্ষক এবং ধর্ষিতার মধ্যে সম্পর্ক নির্যাতনকারী এবং নির্যাতিতার। তাদের মধ্যে এর অধিক কোনও সম্পর্ক যে গড়ে উঠতে পারে, এ ভাবনাই নারীদেহের শুচিতার ধারণার উপর আধারিত। সেই কাল্পনিক শুচিতা যার দ্বারা হৃত হয়েছে, তাকেই সেই নারীকে বিয়ে করতে হবে, এ যদি সমাজের নিদান হয়, তবে তা নিন্দার্হ। কিন্তু আদালতের নিদান হিসেবে তা শুধু নিন্দনীয় নয়, তা ধর্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের আইনানুগ যাবতীয় বিচার পদ্ধতিকে লঙ্ঘন করে। তা নারীর শরীরের স্বাধিকার ও যৌনতায় নারীর সম্মতির প্রয়োজনকেও অস্বীকার করে।
একই দিনে আরেকটি মামলার (বিনয় প্রতাপ সিং বনাম উত্তরপ্রদেশ সরকার) শুনানির সময় মাননীয় প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘কোনও দম্পতি যদি স্বামী-স্ত্রীর মত একসঙ্গে থাকেন, তবে সেই স্বামী যতই নৃশংস আচরণ করুন, তাদের মধ্যেকার যৌন সম্পর্ককে কি আইনত ধর্ষণ বলা চলে?’
এক্ষেত্রে তিনি বিচার করছিলেন বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দীর্ঘ সহবাসের পর বিবাহে পুরুষের অসম্মতি জনিত একটি মামলার। যৌন সম্পর্ক হওয়ার পরেও যেকোনও পক্ষ পরবর্তীকালে মনে করতে পারে, সে সম্পর্কটি বজায় রাখতে অপারগ। অতীতে দেখা গেছে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক হলে তা ধর্ষণ কিনা, তা নিয়ে বিচারপতিরা মামলা থেকে মামলান্তরে পৃথক পৃথক রায় দিয়ছেন৷ ধরে নেওয়া যেতে পারে, তাঁরা সম্পর্কে ইতি টানার কারণগুলি বিচার করেছেন। তার মধ্যে প্রতারণার সম্ভাবনা আছে নাকি তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন৷ আর দেখেছেন হয়ত যৌনতায় মেয়েটির সম্মতি ছিল কিনা।
কিন্তু শ্রী বোবদে যে ভাষায় অভিযোগকারিণীর অভিযোগ খারিজ করলেন তা প্রণিধানযোগ্য৷ প্রথমেই তিনি বললেন ‘যতই নৃশংস আচরণ করুক…।’এই শব্দবন্ধের দ্বারা তিনি অন্তরঙ্গ সঙ্গী কর্তৃক নির্যাতনকে যেন স্বীকৃতি দিলেন। গুরুত্ব হ্রাস করলেন তার। তিনি যা বললেন, তা আসলে বৈবাহিক সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আবদ্ধ দম্পতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ স্বামী-স্ত্রীর মতো যারা বসবাস করে, তাদের স্বামী যতই নির্মম যৌনতা করুক, তাকে ধর্ষণ বলা যায় না-এই তো তাঁর মূল উপজীব্য৷ এতে শুধু বিবাহে প্রতিশ্রুত মহিলারাই ভয় পাবেন না, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন বিবাহিত মহিলারাও।
২০১২ সালে নির্ভয়া ধর্ষণ কাণ্ডের পর ভার্মা কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বৈবাহিক ধর্ষণকেও ধর্ষণ বলা হোক৷ সে প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। তা নিয়ে আন্দোলন আজও জারি। তার মধ্যেই সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতির রায়ের এই ভাষা যেন বিয়েতে বা অন্তরঙ্গ সম্পর্কে (লিভ ইন-কেও বিয়ের সমতুল গণ্য করা হয় আদালতে) শারীরিক, মানসিক এবং যৌন অত্যাচারের গায়ে স্বাভাবিকতার শীলমোহর এঁকে দিল। আমাদের দেশে বৈবাহিক ধর্ষণ সংক্রান্ত কোনও ফৌজদারি আইন নেই৷ কিন্তু আছে ২০০৫ সালের গৃহহিংসা আইন, যেটি একটি সিভিল আইন, যেখানে যৌন হিংসার কথাও উল্লিখিত৷
আদালত অবমাননা না করে এটুকু বলাই যায় যে প্রধান বিচারপতির রায় দ্ব্যর্থহীনভাবে নারীবিদ্বেষী ও তাঁর ভাষা ঘোর পিতৃতান্ত্রিক৷ ইতোমধ্যেই খোলা চিঠি লিখে দেশের নানা প্রান্ত থেকে তাঁর ইস্তফা দাবি করেছেন চারশ-র বেশি লিঙ্গসাম্য কর্মী। ভারতের সংবিধানে আছে লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার। ভারত CEDAW (কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অফ অল ফর্মস অফ ডিস্ক্রিমিনেশন আগেইন্সট উইমেন) -এ স্বাক্ষর করেছিল। এই দুটি রায়ের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি খুব উজ্জ্বল হল কি?
মনে পড়ে, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি বিদ্যালয়ে এখনও পড়ানো হয় রোমান পুরাণের প্রসেরপাইনের গল্প, যেখানে অপহৃত মেয়ে অপহরণকারীকে বা নির্যাতককে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। সিলেবাস-প্রণেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ হওয়ায় বর্তমান লেখক একবার সেই গল্পটির লিঙ্গগত অন্যায় ও অসাম্যের দিকটির দিকে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ উদ্দেশ্য ছিল, পাঠ্যক্রমে যদি তাঁরা বিকল্প কোনও গল্পের কথা ভাবেন, সে বিষয়ে আলোচনা। তাঁরা বলেন, সঠিক বার্তা দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষকের উপরেই থাকুক আপাতত, যদিও শিক্ষকদের সে বিষয়ে কোনও গাইডলাইন দেওয়া নেই। এখন যখন মাননীয় প্রধান বিচারপতিই নির্যাতকের সঙ্গে নির্যাতিতার বিয়ে দিতে চাইছেন, তখন অবোধ কিশোর-কিশোরী দূরস্থান, সমগ্র ভারতবাসীর কাছেই বা কী বার্তা যাচ্ছে?
আবার দ্বিতীয় কেসে গার্হস্থ্য যৌন হিংসা নিয়ে যে মন্তব্য তিনি করেছেন, তাতে গৃহহিংসা সংক্রান্ত যাবতীয় আন্দোলনও কি পিছিয়ে পড়ছে না? একে তো সরকার-বিরোধী যে কোনও মত প্রকাশ করলেই নোদীপ থেকে সফুরা থেকে দিশা— গ্রেপ্তার হচ্ছেন একের পর এক নারী, যাঁরা হিন্দুরাষ্ট্র-নির্ধারিত নির্জীব আজ্ঞাবহ নারী-ভূমিকাটি মেনে নেননি। উপরন্তু এই দুটি রায় যেন আপামর ভারতীয় নারীকূলকেই মনুসংহিতার যুগে নিক্ষেপ করল৷ এ কোন অন্ধকারের দিকে আমাদের পশ্চাদপসরণ?