রুখসানা কাজল
শরীর খুবলে কিলবিলিয়ে রাগ উঠে এসেছিল রাজুর মাথায়। উফফ্ আল্লাহ্! সে কী সামান্যতম শান্তিও পাবে না তার নিজের বাড়িতে বসে!
সটাৎ সটাৎ করে যখন বেল্ট চালাচ্ছিল কুকুরটার গায়ে মাথায় পিঠে তখন এক অপার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছিল ওর মনের ভেতর। ইচ্ছে করছিল গুস্তাভের সঙ্গে পূরবীকেও বেধড়ক কতগুলো চড়-চাপড় মেরে দিতে। পূরবী এখন হাতের নাগালের বাইরে যথেষ্ট সুরক্ষিত থাকে। অনেকদিন হয়ে গেল, মেরেধরে মনের ঝাল মেটাতে পারে না সে। বহু বছরের বহু রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ আর অপমান জমে আছে রাজুর মনে। আক্রোশে ফুঁসে আছে মগজ। দুর্দমনীয় সে সব আক্রোশ প্রতিটি মারের সঙ্গে আজ ফেটে বেরিয়ে আসছিল। কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিল না সে। মনে হচ্ছিল, এক্ষুণি সে পিটিয়ে মেরে ফেলবে পূরবীর প্রিয় পোষা কুকুর গুস্তাভকে।
ভাগ্যিস ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছিল! হাতটাও টনটন করছে ব্যথায়। বুড়ো বয়সের বুক ধড়ফড় করছিল কিছুক্ষণ আগেও।
আসলে বহু বছর ধরেই পূরবীকে সহ্য করতে পারে না রাজু। সহ্য হয় না। অনেকবার অনেকরকমভাবে চেষ্টা করে দেখেছে। শান্তি ও সমঝোতার নীতি মেনে নিজেকে বুঝ দিয়ে বারবার এগিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু দুপা এগিয়ে পূরবীর ছায়া দেখলেই ওর ঘেন্না লেগে যায়। কথা শুনলে কান জ্বলে যায়। কাছে গেলে র্যি র্যি করে ওঠে মন। এমনকি এতগুলো বছর ধরে একই ফ্ল্যাটে তার সঙ্গে পূরবী এখনও বহাল রয়েছে, এ ব্যাপারটাও অসহ্য লাগে ওর। কেবলই মনে হয়, নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে স্বীকার করে পূরবী কি পারত না রাজুকে মুক্তি দিতে! কিম্বা পূরবীই থাকত, রাজুকে সুযোগ করে দিত একজন সুস্থ স্বাভাবিক নারীর সঙ্গে আলাদা সংসার গড়ে তুলতে? না হয় দয়াই করত! এক জীবনে অধিকারের পাশাপাশি কখনওসখনও মানুষ তো করুণাও চায়! সামান্য ভিক্ষা কিম্বা মানুষের ঊর্ধ্বে উঠে অতিমানবীয় কোনও দাক্ষিণ্য! না, পূরবী স্বেচ্ছায় সামান্যটুকু ছাড় দেয়নি তাকে।
একজন অযৌন অসুস্থ পঙ্গু নারীর সঙ্গে দিনের পর দিন কেবল কাষ্ঠদণ্ড হয়ে বেঁচে থাকা কী কোনও সুস্থ সবল পুরুষের পক্ষে সম্ভব? রাজুর বুক অম্বলে ভরে যায়! চুকা তেতো তরল গ্যাসের উল্লম্ফন গলা পর্যন্ত এসে মাথাটা ধরে বসে।
মাঝে মাঝে শান্তি ও সমঝোতার ইচ্ছেগুলো উড়ে গিয়ে খুনের ইচ্ছা পেয়ে বসে ওর মনে। বিশেষ করে টাকাপয়সা দেওয়ানেওয়ার সময়! পূরবী যখন ঘাড় কাত করে ওর দিকে তাকায় তখন রাজুর মনে হয়, সে যেন এক্সরে মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চিত বুঝে যায়, আগাপাশতলা ওকে ছেঁকে নিচ্ছে এ খোঁড়া রাক্ষুসী।
তাছাড়া শরীর জড় হলে কী হবে! পূরবীর মাথা খুবই সচল। রাজু ভাল করেই বুঝতে পারে, ঠান্ডা বুদ্ধিতে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ফেঁদে ওকে খেপিয়ে তোলে পূরবী। যাতে ওর ভেতরের অসুখী পশুটা গরগর করে বেরিয়ে আসে প্রকাশ্যে। আর অকথ্য গালাগাল দিয়ে ওর সভ্যভব্য চেহারাটা খুলে ফেলে দূষিত করে ফেলে বাড়ির পরিবেশ। আসলে সমাজের সুপার এলিট হাই ক্লাসে এই যে রাজুর স্নিগ্ধ শান্ত ভদ্র মার্জিত এবং বুদ্ধিজীবী উত্তরণ পূরবী কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।
হিংসা হিংসা! স্রেফ হিংসা! খোঁড়া বুড়ির পেটে পেটে কুচক্র। গুপ্ত শয়তানি নারী যেন কোথাকার!
মেয়েদুটোও হয়েছে তেমন। একেবারে মায়ের অন্ধ বাহন। দু মেয়েই এখন লায়েক হয়ে গেছে। একটু বেশি মাপের বড় লায়েক হয়েছে। রাজুর পরিচয় এখন লাগে না মেয়েদের। রাজুও ওদের তেমন পোঁছে-টোছে না। ওরাও সেভাবে রাজুর খোঁজতল্লাশ রাখে না। আজকাল দু মেয়ের কারও সঙ্গে ওর তেমন সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
বড় মেয়ে রুমকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সঙ্গে হিউম্যান অ্যাক্টিভিস্টও। নানারকম ইস্যুভিত্তিক কর্মকাণ্ড নিয়ে পরিচালিত কয়েকটি এনজিওর স্লিপিং উপদেষ্টা। এছাড়াও বিশেষ রাজনৈতিক গুরু এবং বিশিষ্ট রাজনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার অস্বীকৃত এবং অপ্রকাশ্য পরিচয় রয়েছে। রাজু জানে এসব পকেটভরার রাজনীতি মাত্র। সারা বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েক হাজার নেতাকর্মী রয়েছে এসব দলের। এদের কাজ হচ্ছে সুদৃশ্য পোস্টার ফেস্টুন নিয়ে দেশের স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে হত্যে দিয়ে বসে থাকা বা মিছিল করে প্রতিবাদ করা। কখনও সরকার বিরোধী, কখনও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা বিদেশি কোন রাষ্ট্রের বিপক্ষেও এরা সোচ্চার স্লোগানে উত্তাল করে দেয় রাজধানী। মাঝে মাঝে পুলিশি ধাওয়া মারপিট, গ্রেফতারও চলে। ফেসবুক ভরে যায় এদের সমর্থন পোস্টে। কিছুদিন পর এদের আর দেখা যায় না। তবে কিছু ইনোসেন্ট কর্মী বাদে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীদের পরিচয়ের তলানিতে গেলে দেখা যায়, এদের বাবা বা দাদাচাচারা ছিল সরাসরি বা প্রচ্ছন্ন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী।
আটশট্টি-ঊনসত্তর সালের দিকে সেও জড়িয়ে গেছিলে এরম রাজনীতির সঙ্গে। তখন সত্যিকারের আদর্শ ও স্লোগান ছিল। কমিউনিজম প্রতিষ্ঠায় টেকনিক্যাল ভুল থাকলেও আদর্শের ক্ষেত্রে কোনও ভুল বা আপস ছিল না ওদের দল ও নেতাকর্মীদের। এটা সত্যি, বাইরে থেকে অর্থ এবং অস্ত্রও পেয়েছিল ওরা। একাত্তরের স্বাধীনতার আগে এবং পরে তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে গণজনতার কোনও সম্পর্ক ছিল না। কয়েকজন জোতদার, ভূস্বামী, সাংসদ কিম্বা ধনী ব্যবসায়ীকে খুন করে তারা যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বার্তা দিয়েছিল, তাতে জনগণ তাদের ডাকাত হিসেবেই গণ্য করে নিয়েছিল। অনেকেই ওদের শিক্ষিত ডাকাত, নকশাল ডাকাত, আন্ডারগ্রাউন্ড ডাকাত বলত। পরবর্তীতে এসব দল আভ্যন্তরীণ স্বার্থে অন্ধ হয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল দল উপদল অণুদলে। এমনকি এক দল আরেক দলের নেতাকর্মীদের সন্ধান জানিয়ে দিয়েছিল পুলিশবাহিনিকে। আবার কেউ কেউ নিজেরাই খুনোখুনি করে মরে গেছিল ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বে ও লোভে।
রুমকি সে পথে হাঁটেনি। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাম রাজনীতির কয়েকটা দলকে ইনডাইরেক্টলি নেতৃত্ব দেয় সে। কিন্তু এদের সঙ্গে প্রকাশ্যে কোনও সভাসমিতিতে কখনও যোগ দেয় না। সব সময় দেশের মূল বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে থাকে। মাঝেমধ্যে সেই সব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বড় বড় ইস্যুতে শাহবাগে মোমবাতি জ্বেলে আসে। তাত্ত্বিক কিছুমিছু বলে। সে বক্তব্যে ক্ষমতাসীন প্রতিটি দলের বিপক্ষে যুক্তি থাকে। সে যে কোনও দল হোক না কেন। তবে রাজু জানে, আওয়ামি লিগের একজন বিশুদ্ধ সমালোচক হচ্ছে রুমকি রাজুদ্দিন হাসান। আর আওয়ামি লিগের তো দোষের অভাব নেই। যাবতীয় সাফল্যকে ছাড়িয়ে স্বজনপ্রীতি ও স্বজনতোষণ এ দলের পুরনো অভ্যাস ও দুর্বলতা। বাহাত্তরে বিভেদ এসেছিল এই স্বজনতোষণকে ভিত্তি করে। রাজু জানে না রুমকি কখন, কীভাবে এদের সঙ্গে ভিড়ে গেল! দিন দিন ঝানু হয়ে উঠছে রুমকি আর হাসান। আজকাল অনেকেই রুমকি আর হাসানের বাবা হিসেবে রাজুকে পরিচয় করিয়ে দেয়। রাজুর ফিলিংস হয় ব্লিচিং পাউডারের সঙ্গে নুনচিনিগোলা শরবত খাওয়ার মত।
এখন পর্যন্ত বিয়ে করেনি রুমকি। ইচ্ছে হলে করবে, না হলে করবে না বলে সাফ্ জানিয়ে দিয়েছে ওর মাকে। বারকয়েক লিভ টুগেদার করলেও স্থায়ী সম্পর্কে জড়ায়নি। ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ আড়াল আবডালে বাইসেক্সুয়াল ম্যাম বলে ডাকে। হলেও বা কী। পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে বড় হয়েছে মেয়েরা। তাছাড়া যৌনতা একটি উপভোগের ব্যাপার। জোরজবরদস্তি না করে যে যেভাবে খুশি উপভোগ করতে চাইলে, করুক। রুমকি সারাক্ষণ সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে চলাফেরা করে। ভাবেভঙ্গিতে চে গুভের্যা স্টাইল। চলাফেরায় ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ব্রেনের কিছু অংশ রাসপুটিন আর চাণক্য। সাঙ্গপাঙ্গরাও রুমকির অনুসারি। কখন যে দেশে থাকে আর বিদেশ যায় রাজু এর কিচ্ছুটি জানে না। জানতেও চায় না।
ছোট মেয়ে মিতিলের ক্লিন হার্ট। যা বলবে সামনাসামনি ফাটিয়ে বলে চলে যায়। রাজুর মতই মুখফোড়। ওর মতই যাচ্ছেতাই বলে গালিগালাজ করতে জানে। এ মেয়েটা প্রেম সংসার সন্তান নিয়ে থাকতে ভালবাসে। যদিও সংসারের স্থায়িত্ব সারাক্ষণ টালমাটাল করে রাখে। এ পর্যন্ত তিনবার বিয়ে করেছে। দেশি বিদেশি তিনজন স্বামী। দেশি বিদেশি চারজন ছেলেমেয়ে। এখন বিদেশে থাকে। বিদেশি বর। খুব ভাল চাকরি করে। হুটহাট করে রাজুকে কল দেয় কোনও কোনও দিন। প্রতিটা কল শেষ হয় দুজনের তুমুল ঝগড়া দিয়ে। বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে দুজনের যে কেউ খট করে কেটে দেয় কল। এক কালে রাজুর ধারণা ছিল ছোট কন্যাটি হয়ত তাকে ভালবাসে। একটুখানি হলেও তাকে বোঝে। কিন্তু সে ধারণায় হাতুড়িপেটা করে এ মেয়েটাও বহু দূরে সরে গেছে।
তবে তাদের দু মেয়েই যথেষ্ট মারকুটে। যে কোনও হাতিয়ার চালাতে দক্ষ। পূরবী এ জিনিসটা বেশ ভাল করেছে। রুমকি মিতিলের আত্মবিশ্বাস আছে, মেরে তবে মরবে।
অসুস্থ মায়ের সেবাযত্ন আর রাজুর হাত থেকে মাকে রক্ষা করার জন্যে মেয়েরা ষণ্ডা দেখতে দুজন লাঠিয়াল টাইপের মহিলা রেখে গেছে ফ্ল্যাটে। এদের নাম সে এখনও জানে না। প্রতিমা ফতিমা জাতীয় কিছু হবে হয়তো বা। নিঃশব্দে মারধোর করতে এরা যে কী জাতের পারদর্শী তা কল্পনাও যায় না! প্রথম প্রথম এদের স্রেফ দুঃস্থ মহিলা ভেবে তেমন পাত্তা দেয়নি সে। ওদের সামনেই পূরবীকে বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে আঘাত করেছিল রাজু। কিন্তু একদিন দিনেদুপুরে সামান্য একটা গামছা দিয়ে ওরা এমন প্যাচে কষেছিল রাজুকে, দিন দশেক আর বিছানা থেকে উঠতে পারেনি সে। তখনই বুঝেছিল, কয়েক শতাব্দী আগের খুনি ফাঁসুড়েদের বংশ এখনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি এদেশ থেকে।
এখন খানিক ভয়ে থাকে সে। ফাঁসুড়ে মহিলা দুজনের কারণে গুটিয়ে রাখতে হয় ওর জিঘাংসা।
রাজু আজকের ঘটনাটাকে নিজের মত করে বুঝে নেয়। ওর দৃঢ় বিশ্বাস কাণ্ডটা ঘটানো হয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র করে। পূরবী দিব্যি জানত, লেখাটার প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে রাজু। আজকালের মধ্যে ফিনিশিং টাচ দিয়ে পাঠিয়ে দেবে পত্রিকায়। এটা বুঝেই ওকে ডিস্টার্ব করার জন্যে গুস্তাভকে পাঠিয়ে দিয়েছিল ওর রুমে।
আহা রে ওর লেখাটা!
বাস্তবে লেখার একেবারে শেষ প্যারায় ছিল ও। এর মধ্যে কখন যে ঘরে ঢুকে ল্যাপটপের কানেকশন তার নিয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছিল গুস্তাভ কে জানে! লেখার মাতালে মগ্ন ছিল বলে সেভাবে খেয়াল করেনি। হঠাত তুপ করে একটা শব্দ হয় আর সঙ্গে সঙ্গে অফ হয়ে যায় ওর ল্যাপটপ। গুস্তাভ তখনও খেলছিল। খেলতে খেলতে কানেকশন তার টেনে খুলে ফেলেছে। তবুও রক্ষে! লেখাটা সেভ করা ছিল! কিন্তু নিবন্ধটার এমন মোক্ষম জায়গায় এসে ল্যাপটপ অফ হয়ে গেল যে লেখার ধারাবাহিকতা, স্পিড আর মুড নষ্ট হয়ে গেল রাজুর।
ভারতের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে লিখছিল সে। নিখিল ভারত কংগ্রেসের মাথা মুড়িয়ে ঘোল খাইয়ে বিপুল ভোটে দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। বিপুল আনন্দে সরকার গঠন করেছে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ। নড়বড়ে করে দিয়েছে কেরলের শক্ত বাম ঘাঁটি। সেই সঙ্গে সশব্দ পতন হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। বাম রাজনীতি এখন ভারতে শরশয্যায়। উবে গেছে কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গে মোদি শক্ত করে দাঁত ফুটাতে না পারলেও বামকে শূন্য করে ছেড়েছে ঘাসফুল। বাম দলের বাম হার্মাদ কমরেড ও নেতাকর্মীদের কেউ কেউ ওপেনলি ঘাসফুল বা লোটাস কর্নারে টার্ন নিয়ে নিয়েছে। তারা সকালবিকেল এখন ঘাসফুলে উড়ছে! তবে ঘাসফুলেও এবার ধ্বস নেমেছে। মহাধ্বস। ঘাসবনে ফুটে উঠছে দুটি একটি করে করে যূথবদ্ধ পদ্মের কলি। ঘাসফুলের কয়েকজন রাখালরাজা আধফুটন্ত পদ্ম হাতে নর্মসহচরীসহ রাজসরোবরের পাঁকে ফুটবে বলে স্ব-অভিমানে চেয়ে আছে। গুনগুনানো ভ্রমরের দল জুটে গেছে তাদের সঙ্গে।
তবে কি তৃণ-বাম সৈনিকদের জন্মান্তর ঘটছে? পারস্পরিক শত্রুতা ফেলে সুবর্ণ সুযোগের সন্ধানে ঘোলা রাজনীতির পিচ্ছিল পথে গলাগলি করে রামো রামো জয়ধ্বনি তুলে তারা জয় শ্রীরামেই ভোট ঠুকে দিল!
ভোট গেলে গেল। তা যেতেই পারে। কে না জানে, জনতা জনার্দন। যার ভোট, তার ইচ্ছে। কিন্তু কমিউনিজম ঝেড়ে ফেলে অদৃশ্য তামা তুলসি হাতে জ্জ্যয়সিরাম বোল তুলে যে ঝানু এবং পরীক্ষিত অনেক বাম রাজনীতিবিদও চলে যাচ্ছে ঘাসফুল আর পদ্মবনে!
আহা ভারত। মহাভারতের পথে পথে এখন গেরুয়া ধূলার ধূম্রজাল! তবে কি অশ্বমেধের ঘোড়া গেরুয়া সাজে ছুটে চলেছে! এর প্রভাব কী পড়বে না বাংলাদেশ সহ পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর রাজনীতি সমাজ পরিবার আর ব্যক্তিগত সম্পর্কের বুননে?
অন্যদিকে ধুঁকছে অসম। ঝেঁটিয়ে দিচ্ছে বাঙাল আর মুসলিমদের। চার পুরুষের অধিবাসী বাঙালি, জমিজিরেত ঘরবাড়ির মালিক হওয়া সত্ত্বেও স্রেফ কাগজ দেখাতে না পারায় জেল কিম্বা নির্বাসিতের আশ্রয়কেন্দ্রে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। হাত বেঁধে পশুর মত টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে স্ত্রীকে পুত্র কন্যা স্বামী আত্মীয়দের সামনে। স্বামীকে স্ত্রী পুত্র কন্যা আত্মীয়দের সামনে।
মুসলিম এবং দলিত শ্রেণি ঠোঁটের ডগায় বিপদ নিয়ে বসবাস করছে। তাদের উপর করা একাধিক মামলামোকদ্দমা, হত্যা, খুন, গুম, অত্যাচার, নির্যাতন স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। অবৈধ অভিবাসন, চোরাকারবার, জঙ্গি হামলা ইত্যাদির ধোঁয়া তুলে বছরের পর বছর কাঁটাতার দিয়ে বাংলাদেশকে বদ্ধ করে ফেলছে ভারত। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং জনগণের ওপর ভারতের এই নির্বাচনের ফলাফল কতটা পজিটিভ বা নেগেটিভ প্রভাব রাখবে ইত্যাদির প্রবাবিলিটি নিয়ে লেখার স্রোত ধেয়ে আসছিল ওর মাথায়। একটি চোরা আশঙ্কা ইতোমধ্যে উঁকি দিচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কারা যেন এক্সাম্পল হিসেবে ভারতকে দেখাচ্ছে। ভারতের জনগণ যদি ধর্মীয় দলকে ক্ষমতায় বসাতে পারে তো তোমার এত পাছা পোড়ে ক্যান ভাইজান!
শনি বাজছে অমঙ্গলের সুরে। বাংলাদেশ পোক্তভাবে ঢুকে যাচ্ছে ধর্মের গলিতে।
লেখাটার ফিনিশিং আউলে গেল এই গুস্তাভ হারামজাদার জন্যে! লেখক সত্তার ন্যাচারাল ফ্লো উবে গেল রাগের হাওয়ায় চেপে। দুঃখে মাথাটা জ্বলে উঠেছিল। বেদম কষে লাথি মারার আগেই ছুটে পালিয়ে গেছিল গুস্তাভ। রাগ গিয়ে পড়ে গুস্তাভের মালকিনের উপর। কাঁহাতক সহ্য করা যায় এই উপদ্রব! শালার শালা ফ্ল্যাট! এর চে ফাইজুলের বাগানবাড়িতে চলে গেলে বেশ হত। একচ্ছত্র নিরিবিলিতে বসে স্থানীয় গারোদের ঘরে বানানো পানীয় চু খেতে খেতে দু তিনদিনের ভেতর একটানে নামিয়ে ফেলতে পারত লেখাটা! এমনকি লেখা শেষের আনন্দে শরীরের জট ভাঙাতে কোনও মফঃস্বল সুন্দরীর কোলে ফুর্তিসে শুয়ে বসে আনন্দ উপভোগ করতে পারত!
ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির পাকেচক্রে ল্যাদ খেয়ে শহর নগর, আধাশহর বা গ্রামের উচ্চকাঙ্খী মেয়েরা এখন খুব স্মার্ট এবং স্বাবলম্ব-আকাঙ্ক্ষী। শারীরিকভাবে যাবতীয় ছুৎমার্গহীন নির্মেদ সাহচর্য দিতে এবং নিতে এরা এখন যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ, জড়তাহীন এবং হিসেবি। এরা নিজেরাই শারীরিক ক্রিয়ার স্টেজ অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে দেয়। নাগরিক লেডিদের চাইতে এদের রেট বেশ সস্তা। ফাউ হিসেবে উদ্ভট উদ্বায়ু ফ্যান্টাসিতে ভোগা নাগরিক খদ্দেররা বাড়তি পায় এদের শরীরে ভরপুর লেপ্টে থাকা মাটির সোঁদা গন্ধ। গেরস্থালি তাপউত্তাপ।
ওইসব চরম মুহূর্তেও রাজুর চকিতে মনে পড়ে যায়, ওর মাকে। ফুটন্ত ভাঁটফুল স্তন, ছৈতান ফুলের ঋতুমতী গন্ধ, বাসকপাতার নিরাময়ী আদর আর শাপলা পাপড়ির অটুট মায়াকাজলে মাখা ছিল মায়ের মুখখানি। বিক্রমপুরের বিশাল বাড়ির উঠোনে ধান সেদ্ধ করছে মা। শুকনো খেজুরের ডাল চুলোর আগুনে গুঁজে দিয়ে হয়ত রাজুর কথাই ভাবছিল। খেতে বসে পরভৃৎদের দঙ্গলে একমুঠো ভাত ছড়িয়ে দিচ্ছে তার অশ্রুমতী মা। ভাবছে, রাজু বেঁচে আছে তো! কেমন আছে? ধরতে পারলে রক্ষীবাহিনী কি বাঁচিয়ে রাখবে তার ছেলেকে? আর কি দেখা হবে এ পোড়া জীবনে? ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে এ তুই কি হলি রে বাপ?
ফাইজুলের বাগানবাড়িতে কল দিলে যে কোনও সময় কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে এমন ব্যবস্থা করা আছে। কেয়ারটেকার জগলুলের কাছে অতিথিদের জন্যে ডেইলিকেয়ার অ্যাক্টিভিটিজের সঙ্গে উপাদেয় দেশি মদ এবং দেশি নারীদের নামধামসন্ধান লিস্টিভুক্ত করা আছে। কচি ধাড়ি, ডাঁসা কুচ্ছিত, বিধবা সধবা, বিচ্ছিন্না, প্রৌঢ়া, কর্মজীবী বা গৃহস্থ নারীদের মোবাইল নম্বর মুখস্থ জগলুলের। কেউ চাইলে আলাদ্দিনের দৈত্যের মত উঠতি তরুণ বা কিশোরও এনে দেয় জগলুল।
রাগের সঙ্গে যৌন চিন্তা মিশে এক বিশ্রী শারীরিক বিক্রিয়া তৈরি হয় রাজুর। নেকড়ে নেকড়ে স্বভাবে শরীরের রোমকূপগুলোর সঙ্গে বুড়ো পুরুষাঙ্গটিও জেগে ওঠে সখেদে। আর্টিকেলটি লিখতে যে বাঁধা বিঘ্নের বিশ্রী জট পাকিয়ে গেছে তা খুলতে গেলে এখন ওর নিজেকেও স্খলন করতে হবে। আটষট্টির অতৃপ্ত শরীর। ক্ষুধার চাইতে দ্রুত স্খলন হতে চাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে ওঠে। কমপ্যাক্ট ফিজিক্যাল অ্যাপিসাইট। উগ্র, উদগ্র ব্যসন। সময়মত নিবৃত্তি না হলে সে পাগলের মত ক্ষুধার্ত হয়ে যায়।
রাগের মোহে ক্ষণিকের জন্যে একবার ভেবেছিল, যত কষ্টই পাক গিয়ে পূরবীকে ধ্বসে দিয়ে আসে। আইনত সে তো তার স্ত্রী। সামাজিক সবরকমের সুযোগসুবিধে সম্মান তো পূরবীই ভোগ করছে। সুতরাং স্বামীকে তৃপ্ত করার দায় তো স্ত্রীর।
পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। আজকাল কি সব সহবাস ধর্ষণ-ফর্সনের কথা শোনা যাচ্ছে। সম্মতি-টম্মতি না নিয়ে নারীদের দেহ নিয়ে ভোগের লীলাখেলা আর চলবে না। এমনকি সে নিজের স্ত্রী বা প্রাণের বান্ধবী হলেও নয়।
তার তো অসুস্থ বুড়ি স্ত্রী। পিওর হ্যান্ডিক্যাপড। অযৌন হয়েও দখলে রেখেছে রাজুর জীবন। কে বোঝে? মানুষ কেবল মহত্ব চায়। পূরবীর হুইলচেয়ার ধরে রাজুর নিমীলিত চেহারাই দেখতে চায় সবাই। সে যে খোজা বা ইম্পোটেন্ট নয়, কেউ কি ভাবে সে কথা!
নিজেকে সামলে নেয় সে। পূরবীর তেমন কিছু ক্ষতি হয়ে গেলে এ বয়সে এসে মানহানির অসম্মানে জড়াতে হবে তাকে। বড় অসম্মানের ব্যাপার হয়ে যাবে তখন। তাছাড়া গুঁড়ো কৃমি মার্কা একদল সাংবাদিক গজিয়ে উঠেছে। রগরগে সংবাদ বানাতে খুব ওস্তাদ এরা। পাবলিকও আচাটার দল। খায় আর আরও চায়!
তাছাড়া পূরবীকে ভেবে অতিকায় এক বিবমিষায় গুলিয়ে ওঠে ওর মন।
শেষপর্যন্ত শারীরিক তাড়নার পাগলামি রাজুকে ঠেলে নিয়ে আসে যন্ত্রমানবীর কাছে। এইই ভাল। বেশ ময়না ময়না টাইপের সুইট লেডি। যথেচ্ছ ব্যবহারে ধর্ষণ-ফর্সনের মামলায় ফেঁসে যাওয়ার ভয় নেই।
নীতি সমাজ এবং অন্ধ অনুগামীদের কাছে দায়বদ্ধ, স্ত্রীতে অসুখী একজন সক্ষম পুরুষের এ ছাড়া আর উপায় কী!