কণিষ্ক চৌধুরী
শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সমাজবিজ্ঞানের উৎসাহী ছাত্র ও গবেষক
পূর্ব প্রসঙ্গ: মতাদর্শের খোঁজে ভগৎ সিং: মাঝের কথা
১৯২০-র দশকে উত্তর ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা (১৯১৯) সহ ব্রিটিশ সরকারের বর্বর দমন-পীড়ন। দ্বিতীয়ত, অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা ও গান্ধির ব্রিটিশ-তোষণ নীতি। তৃতীয়ত রুশ বিপ্লব ও মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণার প্রসার। চতুর্থত, বিপানচন্দ্র মতে “সোভিয়েত প্রভাবের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য নেওয়া এবং বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার কৌশল, পদ্ধতি ও সংগঠন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতীয়দের সেখানে পাঠানোর ব্যাপারে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের আগ্রহ। ১৯২৬ সালে হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (এইচআরএ)-এর আশফাকউল্লাহ রাশিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করার সময় কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হন। ১৯২৮ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান (আর্মি) অ্যাসোসিয়েশন (এইচএসআরএ) বিজয় কুমার সিংহকে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার জন্য প্রতিনিধি নিযুক্ত করে। পরবর্তী সময়ে চন্দ্রশেখর আজাদ ব্যর্থ চেষ্টা করেন যশপাল ও সুরেন্দ্র পান্ডেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠানোর।” (চন্দ্র, বিপান। ২০০০ : ১৯৪)। পঞ্চমত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিকশ্রেণির জাগরণ। সশস্ত্র বিপ্লবীদের উদীয়মান নেতা ছাড়াও প্রবীণ নেতাদের অনেকেই এই নতুন সামাজিক শক্তির মধ্যে নতুন বৈপ্লবিক সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তাকে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। (পূর্বোক্ত: ১৯৩)
এইসব কারণেই শচীন্দ্রনাথ সান্যাল ও তাঁর বিপ্লবী বন্ধুরা কিছুটা পরিমাণে হলেও মধ্যবিত্ত বৃত্তের বাইরে এসে উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামকে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে পেরেছিলেন। যদিও এটা ছিল মধ্যবিত্ত রোমান্টিকতা থেকে আংশিক মুক্তি, পুরোপুরি নয়। তাঁরা একদিকে যেমন সমাজতন্ত্র ও শ্রমিক-কৃষকের সামাজিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলেন, তেমনি অন্যদিকে দেশব্যাপী বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেন। বিপান চন্দ্রের ভাষায়:
এক সর্বজনীন সংগঠন সৃষ্টির প্রয়াসে তাঁরা [বিপ্লবীরা] ১৯২৪ সালে “প্রবীণদের” অর্থাৎ শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জী ও রামপ্রসাদ বিসমিল-এর মত পুরনো বিপ্লবীদের নিয়ে হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মি গঠন করলেন। ভগৎ সিং, শিব ভার্মা, সুখদেব ও আজাদ-এর মত তরুণরা ছিলেন এইচআরএ-র সদস্য এবং এর কার্যক্রম ও চিন্তাধারা ছিল পুরনো ও নূতনের এক মিশ্রণ। এইচআরএ নবীন বিপ্লবীদের এক প্রাগ্রসর কর্মসূচি রচনায় সাহায্য করেছিল এবং পুরনো ঐতিহ্যের সঙ্গে নবীনদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতেও তাঁদের সাহায্য করেছিল।
(চন্দ্র, বিপান। ২০০০ : ১৯৫)
১ জানুয়ারি ১৯২৫-এ শচীন্দ্রনাথ সান্যাল রেভলিউশনারি পার্টি অফ ইন্ডিয়ার নামে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। এই ইশতেহারের মধ্যে বিপ্লবী সংগ্রামের পরিবর্তিত ভাবধারার ইঙ্গিত মেলে। এখানে পাওয়া যাবে একই সঙ্গে অতীতের পিছুটান ও অগ্রসর ভাবনার সাক্ষ্য। তাঁর লেখায় বিপ্লবী আবেগ ঝরে পড়েছে ছত্রে ছত্রে:
এই বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ার দুর্বলের ভীতির উদ্রেক করে, সাহসী ও পরাক্রমীকে উজ্জীবিত করে, আর প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের করে তোলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন যেমন রোধ করা যায় না, তেমনি এই বিপ্লবের গতিও অপ্রতিরোধ্য। যে নয়া আন্দোলন আজ ভারতভূমিতে জন্ম নিয়েছে, অভীষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত তা কখনওই নিঃশেষিত হবে না। স্বৈরাচারীর নিষ্ঠুর পীড়ন বর্ষিত হবে এর ওপর, সন্দিহান ব্যক্তিরা ছুড়ে দেবে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, আর যারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে তারা করবে কঠোর সমালোচনা। কিন্তু তরবারির আঘাতে চিন্তা ও আদর্শের মৃত্যু ঘটানো যায় না। আমাদের চেতনার গভীরে যে মহান ভাবনার উদ্ভাস ঘটেছে, তাকে উপেক্ষা করা যাবে না। বিদ্রূপবাণে বিদ্ধও করা যাবে না।
(সিং, ভগৎ। ২০১২ : ১০০)
পূর্ববর্তী বিপ্লবীদের আবেগদীপ্ত মেজাজটি এখানে স্পষ্ট। এদিক থেকে দেখলে সাবেকি মেজাজের ধারাবাহিকতাটি বেশ ভালোভাবেই লক্ষ করা যাবে। প্রসঙ্গত বলা ভালো, বিপ্লবী রাজনীতির মধ্যে প্রথম দুই দশকে গীতার ‘নিষ্কাম ধর্মে’র বেশ ভালো রকমের প্রভাবই ছিল। একটি আধ্যাত্মিক উদ্দীপনা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদের আঙিনায়। ফলে আবেগই হয়ে উঠেছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার। শচীন্দ্রনাথের বিপ্লবী ইশতেহার ও সংগঠন এই আবেগ ও আধ্যাত্মিকতাকে বিপ্লবী আন্দোলনের কেন্দ্রে স্থান দিয়েছিল। কিন্তু বিবেক, যুক্তিবাদ ও বাস্তবতাকে তিনি কখনওই অস্বীকার করেননি। তিনি ধর্মকে সমর্থন করলেও, বর্ণ-জাতগত বৈষম্য সম্পর্কে নীরব থাকলেও, মায়াবাদকে সমর্থন করেননি। কারণ তাঁর কাছে জীবন ও স্বাধীনতা অলীক কিছু নয়, ভ্রান্ত/মিথ্যা জ্ঞান বা মায়া নয়, বরং ভীষণ রকমের বাস্তব। বেদান্ত দর্শনের প্রতি তাঁর যথেষ্ট সমীহ ও অনুরাগ থাকলেও অদ্বৈত মতবাদকে খুব একটা গ্রাহ্য করেননি। অদ্বৈত বেদান্ত মতের বিপরীতে গিয়ে ইহজাগতিক সুখ-দুঃখকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। ব্রিটিশ শাসন-শোষণকে মায়া বলে উড়িয়ে দেননি। আর স্বপ্ন দেখেছেন ব্রিটিশমুক্ত ভারতবর্ষের। ইশতেহারের (আশু) ঘোষিত লক্ষ্য ছিল: সংঘবদ্ধ ও সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা। (পূর্বোক্ত: ১০০-১০১) সর্বজনীন ভোটাধিকার ভিত্তিতে গঠিত হবে এই প্রজাতন্ত্র আর সমস্ত ধরনের শোষণের অবসান ঘটানোই হবে এর আদর্শ।
…সেই উদ্দেশ্যেই এই প্রজাতন্ত্রে রেলওয়ে ও অন্যান্য যোগাযোগ ও পরিবহন মাধ্যম, ইস্পাত উৎপাদন, খনি ও জাহাজ নির্মাণের মত বৃহৎ শিল্পগুলির জাতীয়করণ ঘটানো হবে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভোটদাতাদের সুযোগ থাকবে তাদের প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার। বস্তুত এ অধিকার না থাকলে গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হয়। তাছাড়া আইনসভার পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে শাসন বিভাগের ওপর, এমনকি প্রয়োজনে আইনসভা শাসন বিভাগীয় প্রতিনিধিদের ক্ষমতাচ্যুতও করতে পারবে।
(পূর্বোক্ত: ১০১)
সেই সময়ের নিরিখে এই ঘোষিত লক্ষ্যটি নিঃসন্দেহে অনেকটাই এগিয়ে থাকা কর্মসূচি। দুটি দিক থেকে এটি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত পূর্ববর্তী কোনও বিপ্লবী সংগঠনই এইরকম সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনও লিখিত ঘোষণাপত্র রচনা করেনি। তাদের কারও কারও লিখিত ঘোষণাপত্র থাকলেও উত্তর স্বাধীনতা পর্বে তারা কেমন ধরনের রাষ্ট্র-সরকার-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তা নিয়ে তাদের হয়তো কোনও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। কোনও কোনও বিপ্লবী তো রাজতান্ত্রিক ভাবনাকে পর্যন্ত অতিক্রম করতে পারেননি। শচীন্দ্রনাথ কিন্তু রাজতন্ত্র সম্পর্কে একেবারেই মোহহীন ছিলেন। তাই এই ইশতেহারে সরাসরি প্রজাতন্ত্রের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্রজাতন্ত্রটি অবশ্যই উদারনৈতিক প্রজাতন্ত্র এবং ব্রিটিশ সংসদীয় মডেল দ্বারা প্রভাবিত। কারণ এখানে ‘আইনসভার পূর্ণ কর্তৃত্ব’ বলতে সংসদের সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়েছে। এই সংসদ তাই শাসন বিভাগ বা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতেও সক্ষম। দ্বিতীয়ত, লক্ষ্যটি মূলগতভাবে বুর্জোয়া উদারনৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত হলেও, অর্থনৈতিক প্রশ্নে সমাজতন্ত্রের নীতিগুলিকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। তাই ইশতেহারে বৃহৎ শিল্প ও পরিবহনের ওপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।
শচীন্দ্রনাথ একজন ধর্মবিশ্বাসী ও অধ্যাত্মবাদী। এবং একইসঙ্গে বাস্তববাদী। তাই তিনি ইশতেহারে লেখেন:
ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে আমরা তুলে ধরতে চাই সেই মহান সত্যকে যে, জগত মায়ামাত্র নয়, উপেক্ষা করার জিনিস নয়, ঘৃণারও বস্তু নয়, বরং এই জাগতিক জীবন সেই মহাআত্মার প্রকাশ যা সব শক্তি, জ্ঞান আর সৌন্দর্যের আধার।
(পূর্বোক্ত)
এইভাবে তিনি চমৎকারভাবে একটি সামঞ্জস্য সাধনের সূত্রের সন্ধান করেছেন, যা প্রকাশ পেয়েছে জাতীয় মুক্তি ও আন্তর্জাতিক ভাবনার মধ্যে সমন্বয়ের সূত্রে। “পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং নানা জাতি ও রাষ্ট্রকে নিয়ে এক সহযোগী বিশ্ব গঠনের স্বপ্ন দেখে এই বিপ্লবী দল। তাই প্রাচীন ভারতের ঋষিগণের আদর্শ এবং আধুনিক বলশেভিক রাশিয়ার দৃষ্টান্ত এর প্রেরণা। (পূর্বোক্ত)।
সন্ত্রাসবাদের পথ যে সঠিক নয়, ভারতীয় বিপ্লবীরা তা বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। তাই তাঁরা সন্ত্রাসবাদ ও নৈরাজ্যবাদী পথকে পরিত্যাগ করেছিলেন। শচীন্দ্রনাথের মতে বিপ্লবীরা সন্ত্রাসবাদী নন, আবার নৈরাজ্যবাদীও নন। তিনি সন্ত্রাসমূলক কাজকে একটি কৌশল হিসেবে নিতে চেয়েছেন, কোনও আদর্শ বা নীতি হিসেবে নয়। তিনি এই ইশতেহারে লিখেছেন:
সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে এই দুটি শব্দই [সন্ত্রাসবাদ ও নৈরাজ্যবাদ] রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে। বিপ্লব সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন উঠলেই অবধারিতভাবে এই শব্দ দুটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা সে এদের যতই অপপ্রয়োগ ঘটুক না কেন। আসলে বিপ্লবীদের গায়ে এই তকমাগুলি এঁটে দিয়ে তাদের হেয় করা অতি সহজ। কিন্তু ভারতবর্ষের বিপ্লবীরা সন্ত্রাসবাদীও নয়, নৈরাজ্যবাদীও নয়। তারা কখনওই দেশে বিদ্রোহ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেনি। সুতরাং নৈরাজ্যবাদী তাদের বলা যায় না। তেমনি সন্ত্রাস সৃষ্টিও তাদের লক্ষ্য নয়। তাই সন্ত্রাসবাদী আখ্যাও তাদের পক্ষে সঠিক নয়। শুধু সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আসবে, এটা তারা মনে করে না। সন্ত্রাসের জন্যই সন্ত্রাস— এ তত্ত্বেও তারা বিশ্বাস করে না। তবে হ্যাঁ, অনেক সময় প্রতিশোধ নেওয়ার উপযুক্ত পন্থা হিসেবে তারা সন্ত্রাসকে বেছে নেয়।
(পূর্বোক্ত: ১০৩)
শচীন্দ্রনাথের মতে, ব্রিটিশ রাষ্ট্রই সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে ভারতবাসীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই “এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে হবে পাল্টা সন্ত্রাস দিয়ে।” (পূর্বোক্ত: ১০৪)। ইশতেহারের এই ঘোষণারই প্রতিফলন দেখা যাবে এইচআরএ-র গঠন ও কর্মসূচিতে (১৯২৪-২৫)। এখানে অন্যতম কর্মপন্থা হিসেবে বলা হয়েছে: “মাঝে মাঝে প্রতিশোধমূলক ক্রিয়া-কলাপ ও প্রচারের মাধ্যমে জনমনে আমাদের সম্পর্কে সহানুভূতি জাগিয়ে তোলা এবং এইভাবে একদল দরদী সমর্থক তৈরি করা।” (পূর্বোক্ত: ১০৯)।
এইচআরএ নিঃসন্দেহে একটি উন্নততর কাঠামোর কথা ভেবেছিল। এর গঠন সম্পর্কিত ধারণায় প্রকাশ্য ও গোপন কাজের সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা দেখা যায়। এখানে একদিকে জনসংযোগমূলক কাজ গড়ে তোলার কথা রয়েছে, তেমনি সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করার কথাও রয়েছে। অর্থাৎ ডাকাতির মধ্য দিয়ে অর্থ সংগ্রহের পথটিকে এখানে খোলা রাখা হল। এর পরিণতি যে মোটেই ভালো হল না, কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলাই তার বড় প্রমাণ।
২
এইচআরএ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিপ্লবীদের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হল। সশস্ত্র বিপ্লবের লক্ষ্যে তাঁরা যে প্রকাশ্য ও গোপন কাজ গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে একটি বড় সমস্যা ছিল অর্থের অভাব। প্রকাশ্য গণ কাজ যেহেতু তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণে গড়ে তুলতে পারেননি, তাই তাঁদের অর্থ সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়। পরিণতিতে তাঁরা নানা পথের কথা ভাবতে থাকেন। একটা পর্বে তাঁরা সরকারি অর্থ লুঠ করার সিদ্ধান্ত নেন। যখন এইসব পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে, তখনই খবর এল শচীন্দ্রনাথ সান্যালের গ্রেপ্তারের। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ কলকাতায় শচীন্দ্রনাথ সহ আরও বেশ কয়েকজন পুলিশের হাতে বন্দি হন। এটা বিপ্লবীদের কাছে একটা বেশ বড় ধরনের আঘাত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে বিপ্লবীরা ভেঙে পড়লেন না। তাঁরা নতুন উদ্যমে বিপ্লবের কাজকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা নিয়ে পরিকল্পনায় মগ্ন হলেন।
এইচআরএ-র বিপ্লবীরা রেলের অর্থ লুঠ করার পরিকল্পনা করেন। ট্রেন ডাকাতির প্রস্তাবটি করেন রামপ্রসাদ বিসমিল। শচীন বক্সী, রাজেন লাহিড়ী, মন্মথ গুপ্ত, চন্দ্রশেখর আজাদ সহ আরও অনেকেই এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। বিপ্লবী আশফাকউল্লাহ কিন্তু এই প্রস্তাবে অসম্মত হন। তিনি বিপ্লবী সাথীদের বলেন:
…টাকার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। টাকার অভাবে কাজ ব্যাহত হচ্ছে— এও দেখছি সবাই। কিন্তু এই অভাব পূরণের পদ্ধতিটাও ভেবেচিন্তে গ্রহণ করা দরকার। … অর্থসংগ্রহের যে উপায়ের কথা ভাবছি আমরা তা ভয়ঙ্কর, এতে সংগঠন বিপন্ন হবে। সবে আমরা কাজ শুরু করেছি। আমাদের আদর্শ প্রচার সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে। সংগঠনও বাড়ছে একটু একটু করে। এই সময়ে সরকারি অর্থ লুঠ মানে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। সে ক্ষেত্রে সরকারের পাল্টা আক্রমণ সহ্য করার শক্তি কি আমাদের আছে? … সন্দেহ নেই সেই শক্তি আমরা এখনও সংগ্রহ করতে পারিনি। তাই সংযত হয়ে, অসীম কষ্ট স্বীকার করে সেই শক্তি গড়ে তুলতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে সেই পর্যন্ত। তার আগে সরকারি অর্থ লুঠের কাজ হবে আত্মহত্যার সামিল। তাই ঐ পথ গ্রহণ করতে পারি না আমরা।
(ঘোষ, শংকর। ২০১৩ : ৫৩-৫৪)
আশফাকউল্লাহর বক্তব্য যথেষ্ট যৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও ট্রেন ডাকাতির প্রস্তাবটিই গৃহীত হয়। সেই মতো পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। ৯ আগস্ট ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ। লক্ষ্ণৌ জংশন থেকে ১৪ মাইল দূরে, রাত্রি সাড়ে আটটায় কাকোরি থেকে ট্রেন ছাড়ার সময় চারজন লোক গার্ডের গাড়িতে উঠে পড়েন এবং বলেন যে, কাকোরিতে তাদের মালপত্র পড়ে আছে, তারা আনতে যাবে, সেই জন্য গাড়ি ওখানেই থামাতে হবে। গার্ড অসম্মত হয়ে ট্রেন চালিয়ে যান। কাকোরি আর আলমনগরের মাঝামাঝি দুজন বিপ্লবী গার্ডকে রিভলভার দেখিয়ে ভয় দেখান এবং শিকল টেনে ট্রেন থামিয়ে ফেলেন। তখন অন্যান্য বিপ্লবীরা গাড়িতে উঠে আসেন এবং টাকাভর্তি লোহার সিন্দুকটি নামিয়ে নিয়ে যান। মসৃণভাবে গোটা কাজটি হলেও একজন গোর্খা সেপাই বিপ্লবীদের গুলিতে মারা যায়। (ঘোষ, কালীচরণ। ২০১৭ : ২ : ১৯২)। সিন্দুক ভেঙে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ছিল ৪৬৭৯ টাকা ১ আনা ৬ পাই। সেই অর্থ নিয়ে বিপ্লবীরা রাতের অন্ধকারে নিজ নিজ জায়গায় ফিরে যান।
এরপরই শুরু হয়ে যায় ব্যাপক পুলিশি ধরপাকড় ও অত্যাচার। গ্রেফতার করা হয় প্রায় ২৫ জনকে। শুরু হয় কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা। এইচআরএ-র প্রায় প্রত্যেক নেতাই ধরা পড়ে যান। বিচারে ফাঁসির আদেশ হয় চারজনের— রামপ্রসাদ বিসমিল, রৌশন সিং, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ও আশফাকউল্লাহ খান। ১৬ জন বিপ্লবীকে পাঁচ/দশ বছর বা যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ড দেওয়া হয়। প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয় এইচআরএ-র প্রথম সারির নেতাদের। এই নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসতে হয় নবীন প্রজন্মকে। ভগৎ সিং, ভগবতীচরণ বোহরা প্রমুখ এই দায়িত্ব তুলে নেন নিজেদের কাঁধে।
কাকোরি মামলায় বন্দি কমরেডদের মুক্ত করার জন্য বিপ্লবীরা পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। জি এস দেওলের তথ্য থেকে জানা যায়: “১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে ভগৎ সিং এতে অংশ নেওয়ার জন্য কানপুর যান। কিন্তু এই সম্পর্কিত খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। অনুরূপ আর একটি পরিকল্পনা হয়েছিল ১৯২৬ সালের জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসে, যাতে ভগৎ সিং-ও অংশ নেন। কিন্তু এটিও অকার্যকরী হয়।” (বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজয়। ২০০৫ : ৭৭)।
১৯২৭-এর ডিসেম্বর মাসে চার বিপ্লবীর ফাঁসি হয়ে যায়।
৩
এইচআরএ-র নির্দেশিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিপ্লবীরা গড়ে তোলেন নওজোয়ান ভারতসভা। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলা এই প্রকাশ্য সংগঠনটির মূল কারিগর ছিলেন ভগৎ সিং। এ কাজে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন ভগবতীচরণ বোহরা এবং রামচন্দ্র কাপুর। নওজোয়ান ভারতসভার ইশতেহারে রাশিয়ার পথকেই অনুসরণযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইশতেহারের সুস্পষ্ট ঘোষণা: “মহান রাশিয়াই আজ সারা পৃথিবীকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছে।” (সিং, ভগৎ। ২০১২ : ১১২)। এখানেই নির্দেশিত হয়েছে তাদের লক্ষ্য:
জনগণের স্বার্থে গণবিপ্লব। অর্থাৎ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের কাছে স্বরাজকে পৌঁছে দিতে হবে। স্বরাজ শুধু পেলেই হবে না, জনগণের স্বার্থেই স্বরাজকে চালিত করতে হবে। সে কাজ মোটেই সহজ নয়। আমাদের নেতারা অনেক রকমের প্রস্তাব দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু গণজাগরণের একটি সুদৃঢ় ও সঠিক পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার সাহস তাঁরা কেউই দেখাননি। সংক্ষেপে বললে এই দাঁড়ায় যে লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে রাশিয়ার যুবশক্তির মতো আমাদের দেশের সুযোগ্য ও উদ্যমী যুবকদেরও তাদের মূল্যবান জীবনটাকে কাটাতে হবে গ্রামের মানুষের মধ্যে। প্রকৃত বিপ্লব কী সে সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে এই আসন্ন বিপ্লবের অর্থ শুধু শাসকশ্রেণীর বদল নয়, এর ফলে তৈরি হবে এক নতুন রাষ্ট্র, এক নয়া ব্যবস্থা। এটা এক দিনের বা এক বছরের কাজ নয়। বহু বছর কঠোর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে সেই মহাযজ্ঞ আর তা করতে পারে একমাত্র বিপ্লবী তরুণেরাই।
(পূর্বোক্ত: ১১৫)
এই উদ্ধৃতির মধ্যে ভগৎ সিংয়ের চিন্তার তিনটি বিশিষ্ট দিক ধরা পড়ে। প্রথমত, এখানে স্বাধীনতা ও স্বরাজ বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বাধীনতা ও স্বরাজের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই সংগ্রাম চলবে দীর্ঘকাল ধরে এবং বিপ্লবীদের কঠোর আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তৃতীয়ত, যুবশক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিপ্লবের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। এখানে লক্ষ করার বিষয় হল যে, এইচআরএ-র মতো ভারতসভার ইশতেহারে সমাজতন্ত্রকে সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা না হলেও, পরোক্ষভাবে সমাজতন্ত্রকেই বিপ্লবের লক্ষ্য হিসেবে মনে করা হয়েছে। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের পথই অনুকরণযোগ্য ও অনুসরণযোগ্য বলে ঘোষিত হয়েছে।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত নওজোয়ান ভারতসভার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ভগৎ সিং এবং ভগবতীচরণ বোহরা ছিলেন প্রচার সম্পাদক। তাঁদের নেতৃত্বে সংগঠন দ্রুত বিকশিত হতে শুরু করে। কংগ্রেসের সমাজবাদী চিন্তার সমর্থকেরাও সভার সমর্থক ও সহযোগীতে পরিণত হয়ে পড়লেন। ভগৎ সিংয়ের অন্যতম কমরেড যশপাল লিখেছেন:
নওজোয়ান ভারতসভার অন্যতম কার্যক্রম ছিল গান্ধীবাদী কংগ্রেসের আপসকামী নীতির মুখোশ খুলে দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিপ্লবী রাজনীতির উপযোগিতা বোঝানো এবং তাঁদের মধ্যে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি উৎপন্ন করা। সেই সময় পাঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেসের বামপন্থী মনোভাবাপন্ন নেতা যেমন, ডাঃ সত্যপাল, ডাঃ কিচলু, কেদারনাথ সায়গল, পিন্ডিদাস, এঁদের সহযোগিতা মিলছিল। … নওজোয়ান ভারতসভার বৈপ্লবিক রূপ তার সামাজিক কর্মসূচিগুলির মধ্যে দিয়ে প্রকট হত। উগ্র রাজনৈতিক ব্যাখ্যা, বক্তৃতা ছাড়াও সভা সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে সকলকে নিয়ে সর্বজনীন ভোজসভার আয়োজন করত। এই ভোজে সুস্বাদু, বহুমূল্য খাবার পরিবেশন হত না। সাধারণত চট বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা হত। খিচুড়ি, ছোলার পোলাউ, মাঠা এইসব ছিল খাবার। কিন্তু এই ভোজে সম্মিলিত হত সমস্ত সম্প্রদায়, বর্ণ ও জাতির মানুষ। তাঁরা সকলে একসঙ্গে বসে একে অপরের পরিবেশনায় মহানন্দে ভোজ খেতেন। একবার তো কিছু দুঃসাহসী যুবক মুসলমান, শিখ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের নিষিদ্ধ মাংস একসঙ্গে পাকিয়ে দিব্যি হিন্দু, মুসলমান, শিখ সমস্ত সম্প্রদায়ের লোকেদের নিয়ে গোস্ত-রুটির ভোজ বানাল।
(উদ্ধৃত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজয়। ২০০৫ : ৯-৮০)
১৯২৬-এ ভগৎ সিংয়ের বয়স তখন ১৯ বছর। সেই বয়সেই তিনি রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার দিক থেকে যথেষ্ট পরিপক্কতা অর্জন করেছিলেন। তিনটি বিষয় তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রথমত, ব্রিটিশদের তাড়িয়ে কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতাই নয়, জনগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সকল ধরনের শাসন ও শোষণের অবসান ঘটানো সম্ভব। তৃতীয়ত, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে বস্তুবাদ এবং সেকুলারবাদকে গ্রহণ করতে হবে। আর এই ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সেকুলারবাদ ও বস্তুবাদের ব্যবহারিক প্রয়োগ, যশপালের লেখায় তাই পাওয়া যায় নওজোয়ান ভারতসভার পংক্তিভোজ আয়োজনের কর্মসূচি। এখানে হিন্দু-মুসলিম-শিখ নির্বিশেষে একইসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতেন। এমনকি নিষিদ্ধ মাংসও খেতেন, যা তাঁদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করত।
৪
১৯২৬-২৭ পর্বে ভগৎ সিং তাঁর সময়কে পূর্ণভাবে নিয়োগ করেছিলেন বিপ্লবের কাজে। একদিকে অধ্যায়ন আর অন্যদিকে সংগঠন প্রসারের কাজ। মার্কসবাদী দর্শন ও সমাজতন্ত্রবাদের ওপর তাঁর আস্থা সুদৃঢ় হয়েছিল এই সময়েই। নওজোয়ান ভারতসভাকে তিনি এই লক্ষ্যেই পরিচালনা করেছিলেন। ভগৎ সিং এর এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পুলিশের চোখ এড়ায়নি। তারা সুযোগ খুঁজছিল ভগৎকে গ্রেপ্তার করার এবং সে সুযোগ তারা পেয়েও গেল। ঘটনাটি এইরকম: ১৯২৬-এ অক্টোবর মাসে লাহোরে দশেরা উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত এক মেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। ঘন ভিড়ে বোমা ফাটায় বহু লোক জখম হয়। এই বিস্ফোরণের সঙ্গে ভগৎ সিং বা বিপ্লবীদের কোনও যোগাযোগ না থাকলেও পুলিশ চক্রান্ত করে ভগৎ সিং সহ কয়েকজন কলেজছাত্রের নাম এর সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। এই অজুহাতেই ১৯২৭ সালের মে মাসে তারা ভগৎ সিংকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে পুলিশের হেফাজতে রাখা হয় গোটা একমাস। ভগৎ সিংয়ের উকিল বিষয়টি আদালতে পেশ করার দাবি তোলেন। কিন্তু কোনও অভিযোগের ভিত্তিতেই পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে কোনও মামলা তৈরি করতে পারল না। আদালতে পেশ না করেই জামানতের ভিত্তিতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হল। জামানতের মূল্য ছিল ৪০,০০০ টাকা। এই বিরাট অঙ্কের জামিন দেওয়া সত্ত্বেও ভগৎ সিংকে গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয়। ভগৎ সিংয়ের রচনার মধ্যে ঘটনাটি একটি বিবরণ পাওয়া যায়। যেখানে তাঁর সমসাময়িক কালে চিন্তার ধরন ধরা পড়ে:
১৯২৭ সালের মে মাসে আমি লাহোরে গ্রেপ্তার হলাম। আমার কাছে এটা বেশ অপ্রত্যাশিতই ছিল। পুলিশ যে আমাকে খুঁজছে সেটাই আমি বুঝতে পারিনি। একদিন একটা উদ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ আমাকে ঘিরে ফেলল। সত্যি কথা বলতে কি আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম যে গোটা ঘটনাটায় আমার তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। আমি কোনও উত্তেজনা, কোনও শিহরণ বোধ করলাম না। শান্তভাবেই পুলিশের হেফাজতে চলে গেলাম। পরের দিন আমাকে রেলপুলিশের হাজতে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে আমি পুরো একমাস ছিলাম। সেখানে নানাভাবে পুলিশ অফিসাররা জেরা করতে লাগলেন। তাঁদের ধরনধারণ দেখে মনে হল যে কাকোরি ষড়যন্ত্রের বিষয়ে এবং সামগ্রিকভাবে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে আমার যোগসূত্রটা জানাই ওঁদের উদ্দেশ্য। তাঁরা আমাকে বলতে লাগলেন যে ওই ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার চলার সময় আমি লক্ষ্ণৌতে ছিলাম এবং ওঁদের উদ্ধারেরও পরিকল্পনা করেছিলাম। তাঁরা এটাও বলেন যে এ ব্যাপারে ওঁদের সম্মতি পাওয়ার পর আমি কয়েকটা বোমা সংগ্রহ করি। এরই একটা নাকি ফেলা হয়েছিল ১৯২৬-এর দশেরা উৎসবের দিনে। এরপর আমার স্বার্থেই ওঁরা আমাকে বলেন যে যদি আমি বিপ্লবী দলের সম্পর্কে কিছু তথ্য ওঁদের দিই তাহলে আমাকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে। এমনকি আমাকে রাজসাক্ষী হিসেবেও আদালতে তোলা হবে না। এ প্রস্তাবে হাসা ছাড়া আমার আর কী-ই বা করার ছিল। যতসব অপদার্থের দল। আমাদের দলের যে আদর্শ, তাতে আমরা কি নিজের দেশের নিরীহ মানুষের ওপর বোমা ফেলতে পারি? একদিন সকালে সিআইডির তৎকালীন সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট মিঃ নিউম্যান আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমার প্রতি রীতিমত সহানুভূতি দেখিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন তিনি। তারপর অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানালেন যে আমি যদি তাঁদের দাবিমতো বিবৃতি না দিই তাহলে তাঁরা আমার বিরুদ্ধে কাকোরি ষড়যন্ত্র এবং দশেরা বোমা বিস্ফোরণের ন্যক্কারজনক খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনবেন। তিনি এটাও জানাতে ভুললেন না যে আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবার মতো তথ্যপ্রমাণও তাঁদের হাতে আছে। যদিও এসব ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলাম, কিন্তু তখন আমি বিশ্বাস করতাম যে পুলিশ চাইলে সব কিছুই করতে পারে। ওই দিন কয়েকজন পুলিশ অফিসার এসে আমাকে রীতিমত পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন যাতে আমি দিনে অন্তত দুবার ভগবানের নাম নিই। কিন্তু আমি যে নাস্তিক। আর এটাই তো আমার জীবনের চরম পরীক্ষার মুহূর্ত। আমাকে তো বুঝতে হবে যে আমি কি শুধু সুখের দিনে নাস্তিকতার বড়াই করি, নাকি জীবনের কঠিনতম ক্ষণেও নিজের বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকার সামর্থ্য আমার আছে। অনেক ভাবনাচিন্তার পর অবশেষে স্থির করলাম যে ভগবানকে ডাকব না। সেই ছিল আমার সত্যিকারের পরীক্ষা। আর সে পরীক্ষায় আমি সফলভাবেই উতরেছিলাম। একবারের জন্যও নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে নিজের বিশ্বাসকে বিসর্জন দেওয়ার কথা আমার মনে আসেনি। সুতরাং আমার নাস্তিকতার ভিত ছিল বেশ মজবুত।
(সিং, ভগৎ। ২০১২ : ৪৮-৪৯)
ভগৎ সিংয়ের এই বিপ্লবী দৃঢ়তা দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থানের ভিত্তিতে। তিনি ততদিনে বুঝে গিয়েছিলেন যে ভারতে বিপ্লবের কাজ সম্পন্ন করা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট দার্শনিক অবস্থান। পূর্ববর্তী বিপ্লবীরা রুশ বিপ্লব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবলেও, দর্শনগত দিক থেকে ছিলেন ভাববাদী। ফলে তাদের লক্ষ্য ও পদ্ধতির মধ্যে দুস্তর ব্যবধান তৈরি হয়। ভগৎ সিং এই স্ববিরোধিতা থেকে ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে মুক্ত করলেন। সমাজতন্ত্রর সঙ্গে যুক্ত করলেন বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে। রাজনীতিকে মুক্তি দিলেন ধর্মের নিয়ন্ত্রণ থেকে। ভারতীয় রাজনীতিতে সেকুলারবাদের সুস্পষ্ট প্রয়োগ শুরু হল ভগৎ সিংয়ের মধ্য দিয়েই।
এক বছর বাদেই ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগবতীচরণ বোহরা প্রমুখের নেতৃত্বে জন্ম নেয় এইচআরএ-র পরিবর্তিত ও উন্নততর রূপ এইচএসআরএ (হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন/আর্মি)। শিব বর্মার রচনা থেকে পাওয়া যায়:
…ভগৎ সিং ১৯২৮ সালের গোড়া থেকেই সারা দেশের বিভিন্ন বিপ্লবী গ্রুপগুলিকে একত্রিত করে সারা ভারত ব্যাপী নতুন চিন্তা ও আদর্শের ভিত্তিতে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার উদ্যোগ নেন। ভগৎ সিংয়ের এ সম্পর্কে প্রস্তাব ছিল: (ক) এটাই উপযুক্ত সময়, যখন বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করা দরকার যে, সমাজতন্ত্রই আমাদের দলের চরম লক্ষ্য; (খ) আমাদের দলের নামও এই অনুসারে পাল্টানো প্রয়োজন, যাতে মানুষ বুঝতে পারে আমাদের মূল লক্ষ্য কী; (গ) আমাদের কেবলমাত্র সেইসব ‘অ্যাকশন’-এই হাত দেওয়া উচিত, যেগুলির সঙ্গে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ দাবি এবং ভাবাবেগ জড়িত, এ ছাড়া সামান্য পুলিশ অফিসার বা পুলিশি চরদের খতম করার মধ্যে দিয়ে সময় নষ্ট করা উচিত নয়; (ঘ) অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও একমাত্র সরকারি অর্থভাণ্ডারেই হাত দেওয়া উচিত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর অ্যাকশন যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই উচিত; (ঙ) ব্যক্তি নেতৃত্বের পরিবর্তে সমষ্টিগত যৌথ নেতৃত্বের দ্বারাই দল পরিচালিত হওয়া দরকার। এইসব বিষয়ের ওপর ভগৎ লাহোর ও কানপুরের সাথীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এছাড়া তিনি দলের অন্যতম নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ ও অপর পলাতক আসামী কুন্দনলালেরও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি সংগ্রহ করে রাখেন। এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, দিল্লিতে পরবর্তী সভায়, সমস্ত প্রদেশের প্রতিনিধিদের ডাকা হবে এবং সভা হবে ১৯২৮ সালের ৮ই ও ৯ই সেপ্টেম্বর। পাঁচটা প্রদেশের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্যে চারটি প্রদেশ দিল্লির সভায় যোগ দিতে সম্মত হয়। বাংলা এই সভায় যোগ দিতে চায় না। … ফলে, দিল্লির সভা অনুষ্ঠিত হয় বাংলা প্রতিনিধিদের ছাড়াই। সব সমেত চারটি প্রদেশের দশজন কমরেড, ৮ই সেপ্টেম্বর ১৯২৮ তারিখে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় জমায়েত হন। প্রতিনিধিদের প্রদেশভিত্তিক উপস্থিতি ছিল: পাঞ্জাব থেকে দুজন, বিহার থেকে দুজন, রাজস্থান থেকে একজন এবং যুক্তপ্রদেশ থেকে পাঁচজন। যুক্তপ্রদেশের পাঁচজনের মধ্যে আবার দুজন তাঁদের শর্ত পূরণ না হওয়ায় সভায় অংশ নিতে অস্বীকার করেন। ফলে সর্বমোট আটজন ওই সভার আলোচনায় অংশ নেন। চন্দ্রশেখর আজাদকে তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থেই দিল্লির সভায় হাজির থাকতে নিষেধ করা হয়। দুদিনের দীর্ঘ আলোচনা শেষে সভায় পেশ করা ভগৎ সিংয়ের প্রস্তাবগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে (৬-২) গৃহীত হয়। বিহারের দুই প্রতিনিধি ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ এবং মনমোহন ব্যানার্জী, দলের নাম পাল্টানোর প্রস্তাব ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ গ্রহণের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
(উদ্ধৃত, বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজয়। ২০০৫ : ১০২-৩)
এই সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের প্রদেশ অনুযায়ী একটি তালিকা এখানে দেওয়া হল:
- পাঞ্জাব – ভগৎ সিং ও সুখদেব
- রাজস্থান – কুন্দনলাল
- যুক্তপ্রদেশ – শিব বর্মা, ব্রহ্মদত্ত মিশ্র, জয়দেব কাপুর, বিজয়কুমার সিনহা ও সুরেন্দ্রনাথ পান্ডে
- বিহার – ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, মনমোহন ব্যানার্জী
আগেই বলা হয়েছে বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই সভাতে যোগ দেননি। কিন্তু কেন? বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার দায়িত্ব ছিল শিব বর্মার। তিনি যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা অনুশীলন দলের একটি অংশমাত্র। এঁরা দিল্লির সভায় যোগদানের ক্ষেত্রে যেসব শর্তের কথা বলেন, সেগুলি ছিল ভগৎ সিংয়ের নতুন দলের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে শুধু অসামঞ্জস্যপূর্ণই নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত। ফলে শিব বর্মার পক্ষে এইসব শর্তগুলিকে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আর তাই এঁরা সভাতে কোনও প্রতিনিধিও পাঠাননি। পরে ১৯২৮-এর শেষ দিকে অনুশীলন সমিতির অন্যতম নেতা ত্রৈলোক্য মহারাজ, প্রতুল গাঙ্গুলী প্রমুখের সঙ্গে যখন ভগৎ সিংয়ের সাক্ষাৎ হয় কলকাতাতে, তখন তাঁরা ভুল বোঝাবুঝিটি বুঝতে পারেন। তাঁরা বিপ্লবী যতীন দাসকে বাংলার প্রতিনিধি করে পাঠান। যতীন দাস এইচএসআরএ-র একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এইচএসআরএ-র সৈনিকদের আধুনিক কায়দায় বোমা বানাবার কলাকৌশল শিখিয়ে দলের অস্ত্রভাণ্ডারকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন।
এইচআরএ-র সংবিধানের মধ্যে সংগঠনের বিভিন্ন কমিটি গঠনে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতির কোনও উল্লেখ ছিল না। কিন্তু নবগঠিত এইচএসআরএ-তে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ব্যবস্থাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। ফিরোজ শা কোটলার সভার পর ৭ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। ভগৎ সিং এবং বিজয়কুমার সিনহার ওপর সারা ভারতে আন্তঃ-প্রাদেশিক যোগাযোগ ও দলের প্রচারের দায়িত্ব বর্তায়। সুখদেবের ওপর পাঞ্জাব, ফণীন্দ্র ঘোষের ওপর বিহার, কুন্দনলালের ওপর রাজস্থান এবং শিব বর্মার ওপর যুক্তপ্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়। চন্দ্রশেখর আজাদকে করা হয় হিন্দুস্থান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি-র সর্বাধিনায়ক— সেনাপতি।
এইচআরএ থেকে নাম পরিবর্তন করে এইচএসআরএ করা হয়েছিল। এইচএস আরএ-র নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল সমাজতন্ত্র (সোশালিস্ট) শব্দটি। ঘটনা হল, এটি কেবলমাত্র একটি শব্দের সংযোজন ছিল না। এটি ছিল এক বিরাট উত্তরণের সূচক।
প্রথমত, এইচআরএ-র মধ্যে সমাজতন্ত্রের ধারণাটি থাকলেও তা ছিল প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট। এইচএসআরএ-তে সংগঠনের লক্ষ্য যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হল।
দ্বিতীয়ত, এইচআরএ ইওরোপের ঊনবিংশ শতাব্দীর উদারনৈতিক প্রজাতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। ভগৎ সিং এইচআরএ-কে এই বৃত্তের হাত থেকে মুক্ত করে একটি বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত করার ক্ষেত্রে সার্থক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
তৃতীয়ত, এইচআরএ-তে সন্ত্রাসবাদ তাত্ত্বিক ধারণা হিসেবে পরিত্যক্ত হলেও শচীন্দ্রনাথ সান্যালরা এই কৌশলটিকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেননি বা করতে পারেননি। এইচএসআরএ কিন্তু একেবারে গোড়া থেকেই সন্ত্রাসবাদকে বর্জন করে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ও আদর্শকে গ্রহণ করে।
চতুর্থত, এইচআরএ-তে সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উপস্থিতি না থাকলেও, এইচএসআরএ-তে তা গ্রহণ ও প্রয়োগ করা হয়েছিল।
পঞ্চমত, এইচআরএ-র কর্মসূচি আধ্যাত্মিকতা থেকে মুক্ত ছিল না। এ বিষয়ে এইচএসআরএ-র অবস্থান ছিল অনেক স্পষ্ট। মূলত ভগৎ সিংয়ের প্রভাবে এই সংগঠনের মধ্যে সেকুলারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
ষষ্ঠত, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে এইচআরএ-র বক্তব্য ছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের। তার প্রতিফলন এর কর্মসূচি ও ইশতেহারে দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে এইচএসআরএ-র বক্তব্য ছিল অনেক বেশি অগ্রসর ও স্পষ্ট। ডিসেম্বর ১৯২৯-এ এইচএসআরএ-র একটি ইশতেহার রচনা করেন ভগবতীচরণ বোহরা। এখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকেই সংগঠনের লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা দেশের শ্রমিক-কৃষক সহ সাধারণ জনতার শোষণ ও দুর্দশার কথাই এখানে বলা হয়েছে। ইশতেহারের ভাষাটি খুবই আকর্ষণীয়:
সাম্রাজ্যবাদের মুঠোর মধ্যে ভারত আজ যন্ত্রণায় কাতর। লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী জন্ম থেকেই দারিদ্র্য আর অজ্ঞতার অসহায় শিকার। বিদেশি শাসন আর ক্রমাগত অর্থনৈতিক শোষণ ভারতবাসীর একটা বড় অংশের মনুষ্যত্ববোধকেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এঁরাই ভারতের কৃষক ও শ্রমিক। ভারতের এই সর্বহারা মানুষগুলির অবস্থা আজ সত্যিই শোচনীয়। এঁদের বিপদ দুদিকেই। একদিকে বিদেশি পুঁজিবাদ ক্রমাগত আঘাত হানছে। অন্যদিকে, ভারতীয় মুনাফালোভীদের কপটতাও তাঁদের জীবনে টেনে আনছে ঘোর বিপর্যয়। এই দ্বিতীয় দল প্রগতিবাদের মুখোশ পরে বিদেশি শাসনের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। ভারতবর্ষের একদল রাজনীতিক যেভাবে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে সওয়াল করছেন, তা থেকেই পরিষ্কার হাওয়া কোন দিকে বইছে। বিদেশি শাসকদের কাছ থেকে দেশের শাসনক্ষমতার সামান্য ভাগ পাওয়ার আশায় ওই মুনাফালোভী ভারতীয়র দল নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। তাই ওই বঞ্চিত, শোষিত মানুষগুলির একমাত্র ভরসা আজ সমাজতন্ত্র। সামাজিক বৈষম্য দূর করে প্রকৃত স্বাধীনতার সন্ধান দিতে পারে একমাত্র সমাজতন্ত্রই।
(সিং, ভগৎ। ২০১২ : ১২০-২১)
সমাজতন্ত্রকে বিপ্লবীরা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে আঁকড়ে ধরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা ছিল সেই সময়ের দ্বারা সীমাবদ্ধ। ভারতবর্ষের সমকালীন পরিবেশ এবং বিপ্লবীদের অভিজ্ঞতা ও বয়স অনেক ক্ষেত্রেই সমাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিপ্লবীরা নিজেরাও এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। যশপাল লিখেছেন:
দিল্লির সভার নেতৃত্ব করে ভগৎ সিং-ই। তারই পরামর্শে, সমাজবাদ, দলের ঘোষিত লক্ষ্য বলে স্বীকৃত হয়। দলের ‘হিন্দুস্থান প্রজাতন্ত্র সংঘ’ নাম বদলে ‘হিন্দুস্থান সমাজবাদী প্রজাতন্ত্র সংঘ’ করে দেওয়া হয়। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, মার্কসবাদ বা সমাজবাদের বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তগুলির সবদিক আমরা ভালোভাবে বুঝে ফেলেছিলাম। সমাজবাদের দিকে এগোনোর সেই আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। সমাজের শ্রেণীভিত্তি আমরা বুঝেছিলাম, চাষী-মজুরের রাজত্ব আমাদের লক্ষ্য হয়েছিল বটে, তবে চাষী-মজুরের সংগঠিত শক্তির সহায়তায় সেই লক্ষ্যপ্রাপ্তি কেমন করে ঘটবে, সে কথাটা ভালো করে বুঝতে পারিনি।
(বন্দোপাধ্যায়, বিজয়। ২০০৫ : ১০৩-৪)