নীলাঞ্জন দত্ত
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী
লোকটি হঠাৎ খুব রেগে গেল। প্রাইভেট বাসে মালিকদের ‘অনুরোধে’ ‘অনুদান’ হিসেবে কিছু বাড়তি ভাড়া দিতে আমরা তো ইদানিং অভ্যস্তই হয়ে গেছি, কিন্ত সেদিন কন্ডাক্টার ‘নতুন ভাড়া’ চাইতেই মলিনবেশ, শ্রান্তমুখ, দিনের শেষে ঘরে ফেরা মানুষটি জানতে চাইল, “কেন?” কন্ডাক্টার তেলের দামের গল্পটা শুরু করতেই সে ফেটে পড়ল। এবং এবার বুঝলাম, সে হিন্দিভাষী। সাধারণ মানুষ রেগে গেলে তাদের মুখ থেকে মাতৃভাষা বেরিয়ে আসে, যদিও এক্ষেত্রে বাবু বাঙালির পছন্দ ইংরেজি। যাই হোক, আমার এই সহযাত্রী যা বললেন তা এইরকম: “অওর হামারা সবকুছ পানি কা হিসাব সে চলতা হ্যায় কেয়া? দাম জিসনে বঢ়ায়া উনসে পুছিয়ে তেল কিঁউ মেহঙ্গা হুয়া।” এর সঙ্গে যোগ করলেন, “উনসে ইয়ে ভি পুছিয়ে কে লকডাউন করকে সাত মাহিনে কে লিয়ে হামারা কাম কিঁউ ছিন লিয়া থা?” এবং বলেই চললেন, “ইস সে পহলে নোটবন্দি কিঁউ কিয়া থা? ইয়ে সব করকে কেয়া হুয়া?” এক মহিল যাত্রী ফোড়ন কাটলেন, “ইলেকশনের বক্তৃতা দিচ্ছে নাকি?”
লোকটি অবশ্যই ইলেকশনের বক্তৃতা দিচ্ছিল না; এবারের নির্বাচনে এসব নিয়ে বক্তৃতা খুব কমই শোনা গেছে। তার তোলা প্রশ্নগুলো আমরা নির্বাচনী প্রচারে উঠতেই দেখিনি, উত্তর পাওয়া তো দূরের কথা। অথচ প্রশ্নগুলো খুব জরুরি ছিল। নোটবন্দি নিয়ে তবু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে, কিন্তু করোনাকবলিত গত একটা বছরে যা যা ঘটে গেল, তা ২০২১-এর পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে তেমন কোনও ইস্যুই হয়ে উঠতে পারল না।
১৬ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ১৫ জানুয়ারি ২০২১— এই এক বছরের মধ্যে ৩০০ দিন ভারতবাসী লকডাউনে কাটিয়েছে। এই সময়ে চিন ছাড়া সব দেশেরই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে— সারা পৃথিবীর হিসেব ধরলে ৪.৩ শতাংশ। ভারতে এই সঙ্কোচন সবচেয়ে বেশি— ৯.৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের এই সঙ্কোচনের মানে কী? সাধারণভাবে বলা যায় কলকারখানায় উৎপাদন কমেছে, মানুষের হাতে টাকা কম এসেছে, বাজারে জিনিসপত্রের চাহিদা কমেছে, একটানা বন্ধ থাকতে থাকতে বহু কারখানা, দোকানপাট লাটে উঠেছে, বহু মানুষ রুজি-রোজগার হারিয়েছে। এদের সংখ্যাটা কত? কারও সঠিক জানা নেই। আমাদের দেশের ভেতরেই ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা যখন জীবন বাজি রেখে ঘরমুখো হাঁটা মেরেছিল, তখনই তো দেখা গিয়েছিল, তাদের কোনও পরিসংখ্যান আসলে কেউ রাখে না। কেউ বলল তিন কোটি, কেউ চার কোটি, কেউ ছ কোটি। প্রত্যেকটাই যে অনেক বড় বড় সংখ্যা তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
যাই হোক, সব মিলিয়ে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা একটা হিসেব করেছে— ২০২০ সালে পৃথিবীতে কাজ হারিয়েছে প্রায় সাড়ে এগারো কোটি মানুষ। এবং বিশ্বব্যাঙ্ক বলছে, প্রায় ১২ কোটি মানুষ এই সময়ে ‘চরম দারিদ্রের’ মুখে পড়েছে। ভারতে বেকারত্বের হার এর আগে থেকেই বেড়ে চলছিল। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি বা সিএমআইই-র হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে আরও অন্তত এক কোটি চাকরি উবে গেছে। কাজ হারানোর দলে সবচেয়ে বেশি যোগ দিয়েছে কারা? ‘উইমেন অ্যাট ওয়ার্ক’ নামে একটা রিপোর্ট বেরিয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে, যে সব মেয়েরা আগে কিছু না কিছু কাজ করে কিছু আয় করত, তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই এই সময় কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে, প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমজীবী নারীর জীবনে এই লকডাউন কোনও না কোনওভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। আরও শুনুন, সিএমআইই বলছে, নারী-পুরুষ মিলিয়ে কাজহারাদের ৮০ শতাংশেরই বয়স কুড়ির ঘরে— অর্থাৎ যাদের কর্মজীবন সবে শুরু হয়েছিল।
কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স জানাচ্ছে, সারা দেশে প্রায় এক কোটি ৭৫ লক্ষ ছোট ব্যবসা লকডাউনের ফলে ঝাঁপ বন্ধ করার মত অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এদের মোট ক্ষতির পরিমাণ চার থেকে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা। মনে রাখবেন, এই ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলির ওপর বিভিন্নভাবে নির্ভর করে আরও কয়েক কোটি মানুষের সংসার চলে।
ওয়াশিংটনের পিউ গবেষণাকেন্দ্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে ভারতে ‘মধ্যবিত্ত’ বর্গটা প্রায় তিনভাগের এক ভাগ ছোট হয়ে গেছে আর ‘গরিব’দের সংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এবং, রুজি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কমে আসার ফলে সাধারণ মানুষ ক্রমেই ঋণের ফাঁসে জড়িয়ে পড়ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুসারে, ২০২১ অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে দেশের মানুষের মোট ধারের পরিমাণ মোট জাতীয় উৎপাদনের মূল্যের ৩৭ শতাংশ পেরিয়ে গেছে, যেখানে তাদের মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ নেমে এসেছে জিডিপির ১০.৪ শতাংশে।
এখনও পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব এইচআইভি বা ‘এইডস’ ভাইরাসের মত পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় বলে দেখা যায়নি। লকডাউনের প্রভাব কিন্তু ইতিমধ্যেই শিশুদের মধ্যে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে গেছে। যারা শিশু মনস্তত্ব নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা বলছেন, দীর্ঘকাল ঘরবন্দি থাকার ফলে শৈশবের স্বাভাবিক বিকাশ দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁরা সাবধান করছেন, সারা বিশ্বেই শিশুদের মানসিক রোগ মহামারির আকার ধারণ করছে। বেরোতে না পারা, খেলতে না পারা, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না পারা, স্কুলে যেতে না পারা— সব মিলিয়ে জীবন তাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অনেক শিশু আবার খুব সমঝদার— তারা দেখতে পাচ্ছে তাদের পরিবারের বড়রা এমনিতেই জীবিকা হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত, এর মধ্যে আর তারা নিজেদের দুঃখের কথা বলে অথবা কোনও আবদার করে তাদের বিব্রত করতে চায় না। তারা এই বয়সেই নিজেদের কষ্ট মনের মধ্যে চেপে রাখতে চাইছে— এবং মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে।
এবার অন্যদিকে দেখুন। এই কালবেলার মধ্যেই ভারতের ‘বিলিয়নেয়ার ক্লাব’, অর্থাৎ যে পুঁজিপতিদের ব্যক্তিগত সম্পদ ১০০ কোটি টাকার ওপর, তারা ফুলেফেঁপে উঠেছে। এদের দলে আরও ৪০ জন যোগ হয়ে এখন সদস্যসংখ্যা ১৭৭-এ দাঁড়িয়েছে। মুকেশ অম্বানি তাঁর সবচেয়ে ধনী ভারতীয় খেতাব অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তাঁর রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সম্পদ ২৪ শতাংশ বেড়ে এখন তা বিশ্বের অষ্টম সম্পদশালী কোম্পানি। এর পরেই আছেন গৌতম আদানি, যাঁর সম্পদ ২০২০ সালে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ‘হুনান গ্লোবাল রিচ লিস্ট’ এমন তথ্যই দিচ্ছে। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা ফিকি সমীক্ষা করে দেখেছে, একবছর ধরে করোনা ভাইরাস আর লকডাউনের আঘাতে সাধারণ মানুষ যখন বিপর্যস্ত, ভারতীয় শিল্পপতিদের ‘আত্মপ্রত্যয়’ তখন তুঙ্গে উঠেছে।
সেই নোটবন্দির সময় থেকেই তুমুল চেষ্টা চলছিল “গরিব লোকের” “ময়লা” নগদ লেনদেনের বদলে দেশকে “পরিচ্ছন্ন” ক্যাশলেস বা নগদবিহীন ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে সজোরে ঠেলে দেওয়ার। এটা নতুন যুগের পুঁজিবাদের একটা স্বপ্ন, যা তাকে বিশেষ করে ২০০৮ সাল থেকে চলে আসা তার লাগাতার সঙ্কট থেকে উদ্ধার করতে পারে বলে পুঁজিবাদী পণ্ডিতরা মনে করে। করোনার আবহে সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ নেওয়ার দিকে অনেকটা এগিয়ে গেছে। বিশ্বখ্যাত ‘ফিনটেক’ বা অর্থনৈতিক প্রযুক্তি সংস্থা এফআইএস বলছে, এই সময় ভারতের ই-কমার্স ক্ষেত্র এতই প্রসারিত হয়েছে যে তা অবশ্যই ২০২৪-এর মধ্যে তার ১১১ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রাকে ছুঁতে পারবে।
এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার একটার পর একটা আইন পাস করেছে পার্লামেন্টকে শিকেয় তুলে রেখে। ভারত ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনুদার গণতন্ত্রের’ মুকুট পরেছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ প্রায় সবই তো করোনার ভোগে গেছে। যদিও আশ্চর্যভাবে কৃষকরা পাঁচ মাস ধরে দিল্লিকে ঘিরে ঘেঁষাঘেঁষি করে ধর্নায় বসে আছে এবং তাদের মধ্যে করোনার মড়ক লেগেছে বলে শোনা যায়নি। টিভি চ্যানেলের বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে কোনও প্রশ্নও তুলছে না।
আমাদের সেই রাতের রাগী বাসযাত্রী যদি একটু ইনটেলেকচুয়্যাল অ্যাকাডেমিক টাইপ হত, তাহলে হয়ত শাহাব জাফরির কবিতার সেই অমোঘ লাইনটা কোট করেই বলত: “তু ইধার উধার কি না বাত কর, ইয়ে বতা কি কাফিলা কিঁউ লুটা।” বলতেই পারে। এই লাইনটা তো ভারতের পার্লামেন্টেও বহুবার উদ্ধৃত হয়েছে, টিভিতেও শোনা গেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, সে তার পরের লাইনটাও বলত, যা সচরাচর কেউ বলে না: “মুঝে রাহজানোঁ সে গিলা নহীঁ তেরি রাহবরি কা সওয়াল হ্যায়।”
এধার ওধার দেখিও না আর, কাফিলা কেন লুট হল তাই বলো।
লুটেরাদের প্রশ্ন করব কেন, তুমিই যখন পথ দেখিয়ে চলো?
কারণ, সে তো আমাদের সরাসরি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে বলেছিল— এই করোনার অন্ধকারে তুমি আমার হাত ধরে এ কোথায় নিয়ে এলে?