শৈলেন সরকার
প্রাবন্ধিক, গল্পকার, প্রাক্তন শিক্ষক
গ্রিনবার্গ— তোমরা ভোট নিয়ে কী ভাবছ, কাকে দেবে?
মিস প্লাউ— আমি তো হিটলারকেই ভোট দেব।
গ্রিনবার্গ — হিটলার?
মিস প্লাউ— হ্যাঁ, হিটলার।
গ্রিনবার্গ — (বাঁ দিকে বসে থাকা আইজেনকে লক্ষ্য করে) আর তুমি আইজেন?
আইজেন— (একটু জোর দিয়ে) হিটলার। (ফের একটু কাঁধ ঝাকিয়ে) একমাত্র হিটলারকেই।
তিনজনই ইহুদি। মিউনিখের এক রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা দিচ্ছেন। ১৯৩০-এর গোড়ার দিকের জার্মানি। দৃশ্যটি আসলে ‘জিউস আর কামিং’ নামের একটি টিভি সিরিয়ালের অংশ। সামনে ফেডারেল নির্বাচন। এর আগে ১৯২৮ সালের নির্বাচনে সোশ্যাল ডেমোক্রাট পার্টি রাইখস্ট্যাডের ৪৯১ আসনের মধ্যে পায় ১৫৩টি আসন, এরপর জার্মান ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি ৭৩টি, সেন্টার পার্টি ৬১টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৫৪টি। হিটলারের নাৎসি পার্টি বা ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি বা এনএসডিএপি তখন আনুবীক্ষণীক বললেও কম বলা হয়। শতকরা ভাগ ৩-এর নীচে ভোট নিয়ে আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ১২।
জন্মের সময়ই ঘোষণা করা হয়েছিল, পার্টি হবে বিশুদ্ধ আর্য রক্তের মানুষদের। অর্থাৎ ভারতীয় প্রেক্ষাপটে মোদিদের আরএসএস-এর দাবি মতো ‘বিশুদ্ধ হিন্দু’দের। পার্টি সদস্যদের ইহুদিদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক ও বিয়ে নিষিদ্ধ হল। যাকে আমরা ‘লাভ জিহাদ’-বিরোধী আন্দোলন বলতে পারি। অমান্য করায় হল গুম-খুনও। ১৯২০-তে যে পার্টির সাধারণ সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৫, উগ্র দেশপ্রেম ও ইহুদি বিরোধিতা নিয়ে ১৯২৩-এ তা গিয়ে দাঁড়াল ২০০০-এ। হ্যাঁ, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে যা উগ্র পাকিস্তান ও মুসলিমবিরোধী ও সেনাবাহিনি-কেন্দ্রিক দেশপ্রেম ভিত্তি করে—। এরপর হিটলারের নেতৃত্বে ১৯২৪-এর মিউনিখ ক্যুপ ও পার্টির নিষিদ্ধ হওয়া। ১৯২৫ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়া ও ১৯২৮-এর ফেডারেল নির্বাচন।
১৯২৮-এর জার্মান ফেডারেল নির্বাচনে ৪ কোটি ১২ লক্ষ ভোটারের ভোটে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল অবিশ্যাস্য হলেও ৪২। এখন এই ১৯২৮-এর ভোটের পর যথারীতি সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি, জার্মান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, সেন্টার পার্টি আর জার্মান পিপলস্ পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির হারমান মুলারের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার এবং দলগুলির বিরোধ। ১৯২৮-এর জার্মান ফেডারেল নির্বাচনটা একেবারে ১৯৮৪ ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনের মতো। হিটলার তখনও তেমন কোনও শক্তিই না। ভারতের লোকসভা নির্বাচন ১৯৮৪-র মতোই। হিটলারের তখনকার আসন সংখ্যা মাত্র ১২-র মতো, আর বিজেপি-র ১৯৮৪ সালের আসন সংখ্যা মাত্র ২।
আমরা আবার সেই ‘জিউস আর কামিং’ টিভি সিরিয়ালের তিন ইহুদি বন্ধুর রেস্তোঁরার আড্ডায় আসি। এটি আসলে ইজরায়েলের এক জনপ্রিয় টেলিভিশন শো। ইজরায়েল পাবলিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের প্রযোজনায় ২০১৪ সালের এই টেলিভিশন শো-এর পরিচালক ছিলেন কোবি হাভিয়া।
গ্রিনবার্গ— কিন্তু কেন? হিটলারকেই কেন ভোট দেবে?
আইজেন— আরে গ্রিনবার্গ, সবাইই হিটলারকেই ভোট দেবে।
মিস প্লাউ— হিটলার একেবারে ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবে বাকিদের। সাংঘাতিক প্রাণশক্তি। ভীষণ ক্যারিশম্যাটিক।
গ্রিনবার্গ— তাই?
মিস প্লাউ— দারুন বক্তৃতা দেন মানুষটা। দারুন!
আইজেন— মিস প্লাউ, আমি আমাদের পাড়ায় বক্তৃতা দিতে দেখেছি মানুষটাকে। কী বলব, ওর কথা শুনে আমার মেরুদণ্ড উত্তেজনায় কেঁপে উঠেছে। কারও বলা কথায় আমি ওইভাবে কোনও দিন নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছি বলে মনে করতে পারছি না।
গ্রিনবার্গ— বলো কী? কী বললেন উনি?
আইজেন— হুম্ম্, মানে, ইয়ে—।
মিস প্লাউ— আমরা ঠিক শুনতে পাইনি, বেশ কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়েছিলাম তো!
আইজেন— একেবারে ঠিক।
মিস প্লাউ— কিন্তু হাতের কী চমৎকার ওঠানামা!
আইজেন— ঠিক বলেছ, ওঁর হাতের ওঠানামা ছিল রীতিমতো রোমাঞ্চকর।
মিস প্লাউ— উনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমী, সত্যিকারের জার্মান।
আইজেন— ওঁর থেকে বেশি জার্মান কেউ হতেই পারে না।
খুব চেনা মনে হচ্ছে না? একেবারে হাট-বাজারে, ট্রেনে বা আড্ডায় মোদি-মোদি ‘হাইপ’-এর মতো। আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা, জার্মান-ইহুদি বিয়ে বা যৌনসম্পর্কে নিষিদ্ধতা ও দোষীদের গুম-খুন। ক্যারিশম্যাটিক লিডার, প্রাণশক্তি। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। বাগ্মিতা। এবং দেশপ্রেম। ওঁর থেকে বেশি জার্মান কেউ হতেই পারে না। হ্যাঁ, মোদির মতো ক্যারিশম্যাটিক লিডার, প্রাণশক্তি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, বাগ্মিতা এবং দেশপ্রেম এর আগে কে কবে দেখেছে।
মিস প্লাউ— খুবই বিনয়ী মানুষ উনি। নিজের অতীত জীবন নিয়ে ওঁর কোনও গর্ব নেই, নিজেকে নিতান্তই সাধারণ হিসাবে, একেবারে—।
আইজেন— ওই তোমাদের ব্রুনিং (প্রধানমন্ত্রী) যেমন সব সময় ‘লন্ডনের ছাত্র, লন্ডনের ছাত্র’ বলে নিজেকে নিয়ে—, একেবারেই সেরকম নয়, হিটলার নিজের জীবন নিয়ে জাঁক করে বলতেই চান না কিছু।
সত্যিই, খুব যেন চেনা চেনা ঠেকছে কোথায়। তাঁর অতীত বা পড়াশোনা নিয়ে তেমন জানা নেই কিছু। না, মোদির পড়াশোনা নিয়ে অবশ্য সামান্য কিছু জানা ছিল সবার। তিনি নাকি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টোটাল পলিটিকাল সায়েন্স’-এ স্নাতক। কিন্তু ‘টোটাল পলিটিকাল সায়েন্স’ বলে কোনও বিষয়ের নাম কেউ শুনেছে কোনও দিন? আর এই না শোনাতেই আমাদের মোদির পড়াশুনো নিয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রাইট টু ইনফর্মেশন’ আইনে জানতে চেয়ে উত্তর না পাওয়া।
যাই হোক আমাদের বর্তমান ভারতীয়দের মতোই ইহুদিরা তখন এক যথার্থ দেশপ্রেমীতে মুগ্ধ। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বালাকোট। দারিদ্র অশিক্ষা বা গণতন্ত্রহীনতার সূচকে যত উচ্চস্থানে বা সামাজিক উন্নয়নের সূচকে যত নিম্নস্থানেই থাকুক না কেন সামরিক শক্তিতে তো আমাদের ভারত চিন-আমেরিকা-রাশিয়ার ঠিক পরেই। অতএব পেটে আর মুখে গামছা বেঁধে ‘ভারতমাতা কি জয়’। এবং তিনি আমাদের হিটলার। আমাদের সেই ‘জিউস আর কামিং’ টিভি সিরিয়ালে আমরা দেখি আড্ডা শেষে তিন ইহুদি বন্ধুই হিটলারকে পছন্দ না করার মতো কোনও কারণই খুঁজে পেল না। যেমন বিহার নির্বাচনে দেখি লকডাউন সময়ে কয়েক শো বা হাজার কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে মৃত অসংখ্য মানুষের স্মৃতি পাশে সরিয়ে মানুষজন ভোট দিচ্ছে মোদিকেই। সেনাবাহিনিভিত্তিক দেশপ্রেম বলে কথা। হ্যাঁ, তখন ‘বিহার রেজিমেন্টে’র সেনারা চিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রাণ দিচ্ছে যে। হ্যাঁ, ঠিক কোনও গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে সীমান্তে ঝামেলা হবে আর সেনাবাহিনিভিত্তিক দেশপ্রেমের বন্যা বইবে।
‘জিউস আর কামিং’ এপিসোডের শেষ দৃশ্যে হিটলার-প্রেমে গদগদ তিন ইহুদি ‘জার্মানির জনগণ ও গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যে’ কথাগুলি উইশ করে যার যার পানপাত্র তুলে নেয়।
এই ১৯৩০-এর ফেডারেল নির্বাচনে রাইখস্ট্যাডের মোট আসন সংখ্যা বেড়ে হল ৫৭৭। রাইখস্ট্যাডের মোট আসনসংখ্যা বাড়লে কী হবে নির্বাচনে জেতা আসন সংখ্যা কমল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বা পিপলস্ পার্টি দুজনেরই। কমে হল যথাক্রমে ১৪৩ আর ৪১। আসন সংখ্যা বাড়ল দুই পার্টির— এনএসডিএপি বা হিটলারের নাৎসি পার্টি আর কমিউনিস্ট পার্টির। কমিউনিস্ট পার্টি আগের ১৯২৮-এর নির্বাচনের আসন সংখ্যা থেকে ২৩টি বাড়িয়ে পেল ৭৭টি আর বেশিরভাগ ইহুদিদের সমর্থন নিয়ে হিটলারের নেতৃত্বে এনএসডিএপি বা নাৎসি পার্টি আসন সংখ্যা এক লাফে বাড়ল অবিশ্যাস্যভাবে ৯৫টি এবং বেড়ে দাঁড়াল ১০৭। একেবারে ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচন। বিজেপি-র আসনসংখ্যা ২ থেকে ৮৫ হয়ে উঠে আসা। এবং এবার থেকে জার্মান জুড়ে হিটলার উন্মাদনা ও ১৯৩৩-এ চ্যান্সেলর আর ১৯৩৪-এ ফ্যুরর। এর মধ্যেই ১৯৩৩-এ তৈরি হয়ে যাচ্ছে দাচাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। হ্যাঁ, আমাদের অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পের মতোই। প্রথমত রাজনৈতিক বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের জন্যই। এরপর ১৯৩৫-এ ইহুদিবিদ্বেষী ‘ন্যুরেমবার্গ আইন’। এবার ইহুদিদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ব্যবসাবাণিজ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া। ঘেটো। অর্থাৎ দেশে আমরা যেমন পরপর ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙতে দেখি, এরপর ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা আবার ২০০৬-এ গুজরাটেরই বরোদার দাঙ্গা। এরপর এই গুজরাট দাঙ্গার নায়ক কুখ্যাত নরেন্দ্র মোদিকেই কিন্তু ২০১৪ সালে আমাদের ভারতের ‘জনগণমন অধিনায়ক’ হতে দেখব। এবং ২০১৯ সালে ভারতীয় হিটলারকে আমরা কিন্তু আরও সমর্থন বাড়িয়েই আসতে দেখব। এর মধ্যেই আসামের ১৪ লক্ষ বাঙালির নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া। অসংখ্য মানুষকে ডি-ভোটার করে দেওয়া, ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো। জার্মানের হিটলারের কীর্তি হিসেবে আমরা দেখব ১৯৩৮-এ গোটা জার্মান ও অস্ট্রিয়া জুড়ে ইহুদি ব্যবসায়ীদের ওপর আক্রমণ, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া। এবং নির্বিচার গুলি। ইতিহাস কুখ্যাত ‘নাইট অব ব্রোকেন গ্লাস’। শেষমেশ গ্যাস চেম্বার, গ্যাস ভ্যান ও ৬০ লক্ষ ইহুদি নিধন। একেবারে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যেই।
আমরাও কিন্তু পেয়ে গেছি নির্বাচন ১৯৮৪, নির্বাচন ১৯৮৯। পেয়ে গেছি আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার ‘লাভ জিহাদ’ আইন। পেয়ে গেছি ২০১৪ সালের লোকসভা, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকার, আবার ২০১৯-এ পুলওয়ামা-বালাকোট ঘটিয়ে সমর্থন আরও বাড়িয়ে আবার আবার—। জার্মানের হিটলারের ক্ষেত্রে যেমন পেয়েছিলাম লন্ডনে পড়াশোনা করা পণ্ডিত প্রধানমন্ত্রী ব্রুনিং (ভারতীয় প্রেক্ষাপটে পড়ুন অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং)-এর সঙ্গে অতীত নিয়ে কথা বলতে না চাওয়া ‘বিনয়ী’ (অর্থাৎ কার্যত মূর্খ) হিটলারের তুলনা, এবং ব্রুনিং-কে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ারকি করা। হ্যাঁ, আমাদের সর্বকালের সেরা ‘পণ্ডিত’ প্রধানমন্ত্রী মোদির পাশে মনমোহন সিং-কে কী অনায়াসেই ইয়ার্কির পাত্র করে তোলা হল ভাবুন।
মোদির দৌলতে আমরা তাহলে পেয়ে গেছি এনআরসি। ডিটেনশন ক্যাম্প। চ্যান্সেলর, ফ্যুরর। পেয়ে গেছি ‘ইহুদি’ বা ভারতীয় প্রেক্ষাপটে মুসলিম বা ঘৃণ্য দলিতদের জাতিগতভাবে সমাজবিচ্ছিন্ন করা। ওদের বাড়ি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্বিচার গুলি। ‘নাইট অব ব্রোকেন গ্লাস’। এখন শুধু ‘১৯৪১’-এর অপেক্ষা। শুরু হবে গ্যাসচেম্বার, নির্বিচার গুলি। বিশুদ্ধ হিন্দুরক্ত ছাড়া বাকিদের—।
কিন্তু বাংলার নির্বাচন কি আমাদের হিটলারকে সেই সুযোগ পেতে দেবে?