দুরাত্মার ছল ও এক অবিনশ্বর মানবপ্রবাহ

অয়নেশ দাস

 



গদ্যকার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

মস্তিষ্কের গভীরতম অংশে, আমি নিশ্চিত, এরকম একটি ঘর রয়েছে যেখানে ইচ্ছেরা জমা হয়। বইয়ের পাতার মতো। না, ঠিক বাঁধানো বই না। এলোমেলো। ধুলোও সেখানে পড়ে নিশ্চয়ই। সব ইচ্ছেই চিরটাকাল বেঁচে থাকে না। কিছু তামাদি হয়ে যায়। কিছু ঘুমিয়ে থাকে ধুলোর পরতের নীচে। সেই ঘরটির কাছেই থাকার কথা একটি জলপ্রবাহ। স্বপ্নরা যেখানে শব্দ করে বয়ে আসে। যদিও তাও কখনও সময়ের সঙ্গে শুকিয়ে যায়। আবার জল বাড়লে স্বপ্নরা ঢেউ হয়ে ঢুকে পড়ে সেই ঘরের অন্দরে। স্বপ্নের টানাটানিতে ঘুম ভেঙে যায় কিছু ইচ্ছের যদি না তারা একেবারেই মরে কাঠ হয়ে গিয়ে থাকে। কিন্তু আমি জানি, অনন্ত উন্মুখ ইচ্ছেরা একটু আলাদা। তারা যে আধোঘুমে আসলে জেগেই থাকে স্বপ্নপ্রবাহের অবিনশ্বর আকাঙ্খায়।

সেই অনন্ত উন্মুখ ইচ্ছেরাই কি আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে তাদের ইপ্সিত এক অবিশ্বাস্য জলপ্রবাহের দিকে? একটা একটা করে মেট্রো স্টেশান পার হয়ে যাচ্ছে। দিল্লির হলুদ লাইনের মেট্রো রুট। স্টেশানগুলো চলে যাচ্ছে আর আমি ভাবছিলাম, যদি কোনওভাবে এই দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে যায় তখন তো এই স্টেশানগুলোর এই নাম নিশ্চই আর থাকবে না। এই যে কুতুব মিনার, হৌজ়় খাস, কাশ্মিরি গেট, চাঁদনি চক, জোর বাগ…। নামতে হবে জাহাঙ্গীরপুরিতে। সে নামও হয়তো বদলে যাবে!

ট্রেনে বেশি ভীড় নেই। কোভিড সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন আবার জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে রাজধানীতে। আবার শহর ক্রমশ সিঁটিয়ে যাচ্ছে মাস্কের আড়ালে। এ এক ডানা ছাঁটার মতো। হরিয়ানা, পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ যাওয়ার সমস্ত বর্ডারগুলোও ক্রমে ক্রমে সিল করে দেওয়া হচ্ছে ২৬শে জানুয়ারির পর থেকে। তা অবশ্য কোভিডের জন্য নয়। সিল করে দেওয়া হচ্ছে তাদের আটকে রাখতে, যারা ফসল সৃষ্টির আদিমতম মুহূর্তটি থেকে দু-বেলার দু-মুঠো জোগানে ব্যস্ত থেকেছে। কংক্রিট বোল্ডারের পাঁচিল তুলে আটকানোর চেষ্টা চলেছে লঙ্গরে ফোটা গরম ভাতের গন্ধ। যে গন্ধ আশরীর মেখে সিংঘু, টিকরি, গাজিয়াবাদ সীমান্তে বসে আছে এক অবিনশ্বর মানবপ্রবাহ। মস্তিষ্কের অবিশ্বাস্য জলপ্রবাহ!

জাহাঙ্গীরপুরি থেকে সিংঘু সীমান্ত পার করে চলে গিয়েছে সোনিপত হয়ে পঞ্জাব যাওয়ার মূল রাজপথ। মারুতি ইকোর চারকোনা খোলের মধ্যে জনা পনেরো সওয়ারির প্রাণান্তকর যাত্রায় হংসমধ্যে বক হয়ে বসে আছি। রাজধানীর আঁটোসাঁটো কোভিড আতঙ্ক এখানে উধাও। চারপাশের কাটা-কাটা মুখগুলোর চাহনিতে ইন্দো-সিথিয়ান রক্তের আভাস স্পষ্ট। হমনে তো অবতক কিসিকো করোনা মেঁ মরতে হুয়ে নহী দেখা। আপনে দেখে হো কেয়া? তা হয়তো দেখেছি। কিন্তু এখানে সেটা বলতে ইচ্ছে করল না। কতটা সত্য, কতটা পরিসংখ্যানের খেলা— সে ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছে। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। কিন্তু ভয়ঙ্কর সত্যই হোক বা গভীর কোনও ষড়যন্ত্র; অপর প্রান্তের এই প্রান্তিক মানুষগুলির লড়ে নেওয়ার পুঁজি কিন্তু এই অবিশ্বাসী প্রত্যয়। আমার মধ্যবিত্ততার হিসেব এখানে খাটে না।

এখানে সুখী মধ্যবিত্ততার কোনও হিসেবই খাটে না। এখানে বাতাস শুষ্ক। তাই এখানে গাছেদের পাতা ছোট। এখানে মাটি রুক্ষ। আর্দ্রতা এখানে অর্জন করে নিতে হয়। তাই এখানে হাতের পেশী অনেক বেশি কঠিন। দিল্লির শহুরে চেহারাটা পেরিয়ে এলেই শুরু হয় ছোট ছোট বাবলা গাছের ইতিউতি ঝাড় আর ধুলোময় গ্রাম্য রাস্তা। মার্চের শেষদিক। কাঁচের মতো বায়ুমণ্ডল কাঁপতে কাঁপতে গলে গলে নেমে আসছিল সোনিপতের রাস্তায় আর সেই কাঁচের স্বচ্ছ ওপার থেকে পৌরাণিক আখ্যানেরা ঠিকরে ঠিকরে আসছিল আমার চোখে। বিরাটনগরীতে নির্বাসনকালীন পাণ্ডবরা যে পাঁচটি গ্রামের বদলে হস্তিনাপুরের দাবী ছেড়ে দেবে বলেছিল, এই সেই ভূখণ্ড। এই সেই ভূখণ্ড, যাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ভারতবর্ষের ইতিহাস এক অনন্তকাল। এই ভূখণ্ডের মতোই চিরপিপাসু যুদ্ধ, রক্ত ও সংগ্রামের সে ইতিহাস। এখানে মধ্যবিত্ততার হিসেব খাটে না।

হাইওয়ের আশেপাশে আলো হয়ে আছে কাগজি ফুলের ঝাড়। নীল আকাশের নীচে থোকায় থোকায় সে অসম্ভব এক লাল। কাগজি ফুল এত লাল হয় কি? আগে কখনও দেখিনি। আজ ২০শে মার্চ। ২০২১। ঠিক কতবছর, কতদিন পার হলে সময় ইতিহাস বনে যায়? প্রায় ঠিক এক বছর আগে দিনটা ছিল ২৪শে মার্চ। দেশের প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ প্রায় স্বৈরতান্ত্রিকভাবে ঘোষণা করেছিলেন দেশব্যাপী লকডাউনের। তার ঠিক পরে পরেই, যদি তাকে ইতিহাস বলা যায়, দিল্লি থেকে নিষ্ক্রমণের এই রাজপথগুলিতে লেখা হচ্ছিল সেই নিদারুণ ইতিহাসের দৃশ্যাবলি। হাজারে হাজারে আশ্রয়হীন, সম্বলহীন অভিবাসী শ্রমিকদের ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর থেকে রক্ত শুষে নিয়েছিল এই সব রাজপথ। অ্যাশফল্ট চুঁইয়ে সেই উষ্ণ তরল নিশ্চয়ই পিপাসা মিটিয়েছিল এই অনন্ত পিপাসু ভূখণ্ডের। নইলে ঠিক এক বছর পর, হাইওয়ের আশেপাশে কাগজি ফুলের রং এত লাল কেন? থোকায় থোকায় অসম্ভব এক লাল?

***

পনেরো সওয়ারির মারুতি ইকো বর্ডারের কিছু আগেই নামিয়ে দেয়। অপেক্ষা করছিলেন ছত্তিশগড়ের বিপ্লবী গণ-আন্দোলন কর্মী তুহিন দেব। প্রথমবারের জন্য বাকি পথটা তুহিনদার সাহায্যের ভরসাতেই যেতে হবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পুলিশ চৌকি। একটু দূরে কাঁটাতার ও বোল্ডার দিয়ে রাস্তা বন্ধ। লাইন করে কার্বাইন হাতে দাঁড়িয়ে, বসে আছে র‍্যাফ। যত্র-তত্র দাঁড়িয়ে আছে অ্যান্টি-রায়ট ভ্যান। ওপারে যেন অন্য একটা দেশ! পুলিশ-সেনা আরও যে বাড়তে চলেছে সে ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। বিল পাশ করিয়ে দিল্লি রাজ্য সরকারের ক্ষমতা আরও কমিয়ে ফেলা হয়েছে। দিল্লি সুরক্ষার ভার আরও বেশি করে চলে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। কাঁটাতার আরও মোটা হবে। আরও উঁচু করে গাঁথা হবে কংক্রিট বোল্ডার।

সিংঘু গ্রামের চারপাশ ঘেরা প্রায় সমস্ত রাস্তাই হয় বন্ধ, নয় কাটা-খোঁড়া। একটিই সরু ঘুরপথ খোলা, সেটার অবস্থা কহতব্য নয়। ক্রশ-কান্ট্রি র‍্যালির মতো যেটা দিয়ে যাতায়াতের জন্য এই রাজপথের সমস্ত গাড়ি-মানুষ, কুন্ডলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার শ্রমিকদের দুর্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। তিন মিনিটের রাস্তা, লেগে যাচ্ছে তিরিশ মিনিটেরও বেশি। কোনও পক্ষ হয়তো আশা করে ছিলেন, স্থানীয় মানুষদের তিক্ততা কাজে লাগিয়ে অবস্থানরত কৃষকদের সঙ্গে সংঘাত লাগিয়ে দেওয়া যায়। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষ যখন একবার বুঝতে পারেন, তখন সে বোঝা এত সহজে মোছে না। কিছুদিন পরে স্থানীয় অটোচালক অলতাফ বলেছিল, মজে কি বাত ইয়ে হ্যায়, ইয়ে জো রাস্তা বন্ধ্‌ হ্যায়, ইয়ে কিসানো নে নহী বন্ধ্‌ করা। ইয়ে তো সরকার নে বন্ধ্‌ করায়া। কিসান তো সর্ভিস রোড ছোড়কে বৈঠা হ্যায়। তখলিফে যো দে রহা হ্যায়, বো তো সরকার নে দে রহা হ্যায়। ঔর কাফি দিনো সে দে রহা হ্যায়।লকডাউন খেয়ে নিয়েছে অলতাফের বহুকষ্টে জমানো চল্লিশ হাজার টাকা আর মিষ্টি একটা শাদির স্বপ্ন।

খালসা এইডের তাঁবু থেকে ডানদিকে মোড় নিলেই সেই অবিশ্বাস্য মানবপ্রবাহ। এক অতলান্ত ট্রাক্টর শহর। প্রথমবারের মতো যখন সে পথ ধরে চলছিলাম, সে ছিল এক অবিশ্বাস্য স্বপ্ন-উড়ান। মনে হচ্ছিল কোনও স্লো-মোশান শটের মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে নিয়েছি। অবিশ্রান্ত উড়ে চলেছে হাজারে হাজারে হাজারো রঙের পতাকা। একের পর এক ক্যাম্প পার হচ্ছি আর ভাবছি, এও কি সম্ভব! ট্রাক্টরকেই মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেওয়া হয়েছে অক্লেশে। গুরদ্বারা থেকে আর কৃষকদের যৌথ উদ্যোগে চলছে ছোট-বড় অসংখ্য লঙ্গর। গরম ভাত আর ক্ষীরের গন্ধ ভেসে আসছে সেখান থেকে। খোলা হয়েছে চিকিৎসা কেন্দ্র। বৃদ্ধ-অসুস্থদের যাতায়াতের সুবিধায় চলছে ই-রিকশা। মাঝে মাঝে আওয়াজ তুলে যাচ্ছে ছোট-বড় মিছিল। নারী-পুরুষ মিলিত কন্ঠে কেঁপে উঠছে চারপাশ। সাড্ডা হক, এথে রক! তালে তাল মিলিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে নিহাঙ্গ যোদ্ধার বাদামী ঘোড়া। সগর্বে উড্ডীন পতাকায়, দেওয়ালে দেওয়ালে তুলির রেখায়, ট্রাক্টরের গায়ে লাগানো স্টিকারে, হৃদয়ের কাছে সযত্নে বেঁধে রাখা ব্যাজে উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন শহীদ ভগৎ সিং। ট্রাক্টর ঘেরা উঠোনে গোল হয়ে বসে সত্তরোর্ধ বরিষ্ঠরা। গলায় তাঁদের সন্ত রবিদাস। সূর্য নুয়ে পড়েছে তাঁদের উদাত্ততার সামনে। সেই নতজানু আলোয় সিল্যুয়েটে মিশে আমি সাক্ষী হয়ে থাকছিলাম বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-দৃশ্যের এক অনির্বচনীয় উৎসবের। প্রতিরোধ-প্রতিস্পর্ধার এক অভূতপূর্ব উৎসবের। যৌথতার এক মহা-মহোৎসবের।

আমি এখানে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করায় আমার এক প্রিয় বন্ধু হেসে বলেছিল, মধ্যবিত্তের বিপ্লবের আঁচ পোহাতে যাচ্ছিস? আপাত সারবত্তা-সম্পন্ন সেই খোঁচাটি কিন্তু আমার ইচ্ছেটির মুখ ফেরাতে পারেনি। কারণ সে ছিল আমার এক অনন্ত-উন্মুখ ইচ্ছে। সে খুঁজে নিয়েছিল তার অভীষ্ট জলপ্রবাহ। সেই প্রবাহে ঝরে পড়ছিল আগুন। সে আগুন শুধু আঁচ পোহানোর আগুন নয়। সে আগুন ঝলসে নেওয়ার আগুন। পুড়িয়ে নিতে হয় বলেই আমার হৃদয় পুড়ছিল। যেন অগ্নিশুদ্ধ হচ্ছিল। আমি মোহগ্রস্তের মতো চলছিলাম আর কানে দূরাগত ‘সরফরোসি কি তমন্না অব হমারে দিল মে হ্যায়’ ভেসে আসছিল। আর বুঝতে পারছিলাম আমার মস্তিষ্কের ভেতরে অস্ফুটে কেউ বলছিল— হয়, এখনও হয়। এভাবেও জ্বলে ওঠে এখনও আগুন। লাভাস্রোতের মতো নেমে আসে অনন্ত আগুনের অবিনশ্বর জলপ্রবাহ।

***

লকডাউনের অন্ধকারে একতরফা পাশ করা হয়েছিল তিনটি কৃষি আইন। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। ভাবা হয়েছিল বিনা প্রতিরোধে লাগু করে দেওয়া যাবে নতুন আইন। পরিকল্পনা অনেক দিনের। প্রস্তুত হয়েই ছিল আদানির বিপুল খাদ্যশস্য মজুতের সিলো স্টোরেজ। কিন্তু জল ঢেলে দিল কৃষকদের এই অভূতপূর্ব আন্দোলন। রাষ্ট্রের দিক থেকে দমিয়ে দেওয়ার যাবতীয় চেষ্টা চালানো হয়েছে। এক ইঞ্চি নড়ানো যায়নি কৃষকদের। ভাড়াটে মিডিয়া বাহিনি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কুৎসিত বিরোধী প্রোপাগান্ডা নিয়ে। তাঁদের নড়ানো যায়নি। দেগে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে দেশবিরোধী-খালিস্তানি বলে। তাঁদের নড়ানো যায়নি। তিনশো জনের বেশি শহীদ হয়েছেন। তাঁদের নড়ানো যায়নি। দীর্ঘ পাঁচ মাস হতে চলেছে। তাঁদের নড়ানো যায়নি।

বরং আকারে আরও বড় হয়ে চলেছে আন্দোলনের পরিধি। হরিয়ানা-পঞ্জাবের কৃষকরা তো একজোট ছিলেনই। ধীরে ধীরে জুড়ে গিয়েছেন উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানের কৃষক। প্রতিদিন জুড়ে চলেছে বাকি দেশ। মুর্শিদাবাদ থেকে গিয়ে আজ একমাস হতে চলল ঘর ছেড়ে সিংঘুতে বসে আছে কৃষক সন্তান সামিরুল। এই অনবদ্য জোটবদ্ধতায় আঘাত কি আসেনি? দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। এই জোটবদ্ধতার মশাল প্রথম হাতে নিয়েছিলেন পঞ্জাবের কৃষক। তাঁদেরও ভাগ করে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে অনবরত। লুধিয়ানা থেকে এসেছেন আন্দোলনকারী যুবক লাখবীর সিং। বলছিলেন, মোগা জেলায় যে সিলো স্টোরেজ আছে, সেখান থেকে বারবার টোপ ফেলা হচ্ছে এলাকার কৃষকদের দিকে। সরকারি মান্ডি থেকে দাম বেশি ধরানো হচ্ছে। সঙ্গে মোটরসাইকেল মুফতে দেওয়া হচ্ছে। এইভাবে কৃষকদের মধ্যেও লড়িয়ে দেওয়ার খেলা চলছে। কিন্তু পঞ্জাবের কৃষক সবুজ বিপ্লব পার করে আসা কৃষক। কর্পোরেট ছক ধরে ফেলতে ওঁদের অসুবিধে হয়নি। ওঁরা জুড়েই আছেন। ক্রমাগত জুড়ে চলেছেন।

জুড়ে চলেছেন ছোট কিসান। এই বিলে সবচেয়ে বেশি বিপদ ছোট ও মধ্য কৃষকদেরই। অথচ তাঁদের আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা চলেছিল। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। মূলস্রোতের মিডিয়া বারেবারে এই অসামান্য আন্দোলনটিকে ছোট করে দেখাতে চেয়েছে বড় কৃষকের আন্দোলন হিসেবে। ভাতিন্ডা থেকে এসে আছেন মনদীপ সিং ও বৃদ্ধ স্বরূপ সিং। যাদের জমির পরিমান এক একরেরও কম। ক্ষেতের মকাই তুলে নিয়ে এসেছেন লঙ্গরের জন্য। মুক্তাসর থেকে সাইকেলে করে আরও মকাই নিয়ে আসছেন মনদীপের বন্ধু। ওঁরা জুড়েই আছেন। ক্রমাগত জুড়ে চলেছেন।

জুড়ে চলেছেন শ্রমিকরাও। প্রথম থেকেই নারা চলছে কিসান-মজদুর একতার। লাগোয়া কুন্ডলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় শ্রমিকদের জন্য অনেকদিন ধরেই লড়ছেন মজদুর অধিকার সংঘের নোদীপ কৌর, শিবকুমার। সংঘবদ্ধ করছেন শ্রমিকদের এই আন্দোলনে। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। জানুয়ারিতেই গ্রেপ্তার হন দুজন। পুলিশ কাস্টডিতে অকথ্য অত্যাচার চলে। শিবকুমারের দুটি পা-ই ক্ষতবিক্ষত আজও। এখনও ভালো করে হাঁটতে পারছেন না। কিন্তু মনোবল ভেঙে পড়েনি এতটুকুও। ওরা জানেন কিসান-মজদুর একতার গুরুত্ব। সুন্দর হাসিতে আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে শিবকুমারের তরুণ মুখটি। আকেলে কিসান ইয়ে লড়াই নহী জিত সকতা। কিসান মজদুর একসাথ লড়কে ইয়ে জঙ্গ জিতনা পড়েগা। ওঁরা জুড়েই আছেন। ক্রমাগত জুড়ে চলেছেন। জুড়ে যাচ্ছেন এমনকি অপর প্রান্তের মানুষেরাও। হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র জেলার বিজেপির ভূতপূর্ব কার্যকর্তা সাব সিং বসে আছেন ধর্নায়। জনতা নে ভোট ডালকে ইনকো সত্তাপে লেকে আয়া থা। কর্পোরেট নহী। অব জনতা হী ভাগায়েগা। ওঁরা জুড়েই আছেন। ক্রমাগত জুড়ে চলেছেন।

***

ওঁদের নড়ানো যাচ্ছে না। ওঁরা মাটি কামড়ে আছেন। সদর্পে। এতজন শহীদ হয়েছেন শীতের প্রচন্ডতায়। সামনে আসছে ভয়ঙ্কর দাবদাহের দিন। ওঁরা বিন্দুমাত্র টলছেন না। ক্যাম্পে ক্যাম্পে লেগে যাচ্ছে এয়ার কুলার। না, সরকার বিজলির ব্যবস্থা করে দেয়নি। নিজেরাই করে নিয়েছেন। তাতেও তো ভয় থাকে। বিশেষ করে বৃদ্ধদের জন্য? অশীতিপর স্বরূপ সিং হাসেন। মরনা কেয়া নই বাত হ্যায় জী? না, মৃত্যুর ভয় এদের নেই। কোভিডের ভয় দেখিয়ে এদের আটকানো তো হাস্যকর। আন্দোলনের মূল শর্ত হল কৃচ্ছসাধন, এই আপ্তবাক্য তাঁরা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন। নিজেদের সবটুকু দিয়ে এরা সোচ্চারে লঙ্গর চালাচ্ছেন। শুধু নিজেদের ক্ষিদে মেটাচ্ছেন না, ক্ষিদে মিটছে আশেপাশের সবার, এলাকার মানুষজনের, এমনকি পাহারারত র‍্যাফেরও।

কতদিন চলবে এইভাবে? এই প্রশ্ন একটা মধ্যবিত্ত সংশয় জাগিয়ে তোলে। যা সময়কে ভয় পেতে শেখায়। ওঁরা সময়কে জয় করে ফেলেছেন। না হলে ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (ক্রান্তিকারী)-র নেতা সতবীর সিং কিভাবে অবলীলায় বলেন, যব তক না ইয়ে তিন কালা কানুন রদ কিয়া যায়েগা, হম বৈঠে রহেঙ্গে। কিন্তু কতদিন? ও জিতনা ভি দিন লগ জায়ে। সামনে ঘনীভূত হচ্ছে আবার একটি লকডাউনের আশঙ্কা। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। আগের লকডাউনকে হাতিয়ার করে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল শাহিনবাগ। এবার কি তবে কৃষক আন্দোলনের পালা? সতবীর সিং-এর চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে। যো ভি হো, হম নহী হটেঙ্গে। যদি কোর্ট বলে উঠে যেতে? সুপ্রিম কোর্ট হী হামকো বৈঠনে কো বোলা। হম কিঁউ উঠেঙ্গে? যাই হোক সে উত্তর ভবিষ্যতই বলতে পারবে।

কিন্তু কোথা থেকে আসছে এই শক্তি? এত আত্মবিশ্বাস? আসলে এই আন্দোলন শুধু আর আন্দোলন নেই। পরিণত হয়েছে এক অসামান্য যৌথতার মহোৎসবে। আসল শক্তি লুকিয়ে এই যৌথতার ধারণায়। এই যৌথতা যুগ যুগ ধরে লালিত হয়ে এসেছে শিখ কৌম চেতনায়। এ সেই কৌম চেতনা যা একদিকে ধারণ করে যুদ্ধক্ষেত্রের অপরাজেয় নিহাঙ্গ সাহসিকতা, আবার অন্যদিকে ধারণ করে নানক-রবিদাসের অপূর্ব সাম্যের চেতনা। যে কৌম চেতনা থেকে উৎসারিত হয় ভগৎ সিং-এর স্বার্থত্যাগের চেতনা। এই চেতনা থেকেই জোটবদ্ধতার অসীম শক্তিতে বলীয়ান তাঁরা। তাই ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে তাঁরা সদাপ্রস্তুত। জড়িয়ে ধরে খাইয়েছিলেন অমৃত পাল সিং। চার মাস হয়ে গেল দিল্লি থেকে এসে লঙ্গর চালাচ্ছেন। চোখদুটো তাঁর কোনও প্রকৃত সাধকের মতো। ইনসান কো না চিজ জলদি জলদি চাহিয়ে হোতা হ্যায়। লেকিন ঐসা হোতা নহী হ্যায়। সময় হোতা হ্যায়। সময় আনে তক ওয়েট করনা পড়তা হ্যায়। না, সময়ের সংশয় ওঁদের ভয় ধরাতে পারবে না। বিপ্লব যদি হতেই হয়, সময়কে জিতেই হতে হয়। সম্পৃক্ত করে রাখতে হয় শিকড়ের সঙ্গে নিবিড়তর যোগাযোগ। বাঙালিদের সম্পর্কে পাঞ্জাবি কৃষকদের এখনও খুবই উচ্চ ধারণা। সতবীর সিং আবেগমথিত হয়ে পড়েন। হম বঙ্গালীও কো শোতে হুয়ে দেখনা নহী চাহতা। বস ও একবার ইয়াদ করলে উসকা অরিজিন কেয়া হ্যায়। আমি মাথা নিচু করে ফেলি। লালন আজ বিস্মৃতপ্রায়। বাঙালির আকাশে উদ্ধত জয় শ্রীরাম চিৎকারে ঢাকা পড়তে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর চেতনা। উত্তর ভারতের কৃষকরা কিন্তু তাঁদের বিপ্লবাকাঙ্খার সঙ্গে তাঁদের শিকড়কে মেলাতে পেরেছেন। ললাটে ভগৎ সিং-এর আলো নিয়ে বুকের মধ্যে তাঁরা জ্বালিয়ে নিয়েছেন নানক-রবিদাস।

***

পাঁচদিন পরে দিল্লিতে কোভিড সংক্রান্ত আরও কড়াকড়ি। ফাঁকা মেট্রোতে ঝিমুচ্ছিলাম। হঠাৎ কৃষক আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা কানে এল। দৃশ্যতই কর্পোরেট পোষাকে দুই যুবকের একজন আরেকজনকে কিছু বলছে। ইয়ে লোগ সির্ফ খুদ নহী খা রহে হ্যায়। বুলা বুলাকে দুসরোকো খিলা রহে হ্যায়। আপ বোলো, ঘরসে পৈসা লেকে আপ ঐসা করোগে কেয়া? কোই করতা হ্যায়! সব পৈসা আ রহা হ্যায় শালা বাহার সে। আমি আর শুনতে চাইলাম না। কর্পোরেট সভ্যতা আমাদের শুধু লোভ আর আত্মমগ্নতাই শিখিয়েছে। সাকেত মেট্রো স্টেশান পার করে ট্রেন ভূগর্ভের টানেল থেকে উঠে এল সারফেস লাইনে। জানলা জুড়ে দেখা দিল তারা ভরা ঝকঝকে আকাশ। আমি সেই আকাশে চোখ রাখলাম। সেই তারাদের মাথার ওপরে রেখে মুক্তাসরের কোনও এক গ্রামের রাস্তা ধরে সাইকেল চালিয়ে আসছে মনদীপের বন্ধু। পেছনের ক্যারিয়ারে বাঁধা তার সামান্য জমির সারাটা উপার্জন। এক বস্তা মকাই। পরশুই হয়তো কোনও লঙ্গর থেকে ভেসে আসবে ডাক। আও জী, রোটি লে লো জী, হমারে ক্ষেত কা ফ্রেস মকাই সে বনা। মধ্যবিত্ত হিসেব, পুঁজিবাদী হিসেব কী করে বুঝবে সেই ডাকে কত ইচ্ছের জন্ম হয়! কত অযুত অনন্ত-উন্মুখ ইচ্ছের! সেই ইচ্ছেরা খুঁজে নেয় অবিনশ্বর কোনও জলপ্রবাহ, যাতে আগুন জ্বলে ওঠে আর সেই আগুনকে ঘিরে বসে থাকে অনন্ত কৃষকের দল। মুখে তাঁদের উদাত্ত সন্ত রবিদাস। আগুন পাক খেয়ে ওঠে আকাশে। আগুনের ফুলকি মেখে সপ্তর্ষিমন্ডলকে মনে হয় সোনার কাস্তে। দিল্লি মেট্রোতে এখন আবার লাগু হয়েছে দূরত্ববিধি। দুজন মানুষের মধ্যে এক একটি দুর্লঙ্ঘ ক্রশ। অনেক রাতের সিংঘু, টিকরির আকাশের নীচে ট্রাক্টরে ট্রাক্টরে তখন বিছিয়ে যাচ্ছে যৌথতার নকশি কাঁথা।


*সমস্ত ছবি লেখকের তোলা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...