রূপা মজুমদার
দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার, শুকতারা ও নবকল্লোল পত্রিকার সম্পাদক
আমি আমার প্রতিষ্ঠান দেব সাহিত্য কুটিরের সঙ্গে যুক্ত হই ২০১৬ সালে আর ২০১৮ সালের বইমেলায় ইন্দ্রাণীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সেবারই বইমেলা প্রথমবার বিধাননগর সেন্ট্রাল পার্কে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওই বইমেলায় মিত্র ঘোষের স্টলে গিয়েই ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব বাড়ে। ওঁর আর আমার ভাবনাচিন্তার মধ্যে অনেক মিল ছিল। আমরা দুজনেই নতুন কিছু করতে চেয়েছি। এই যে মান্ধাতা আমলের পুরনোপন্থী কলেজ স্ট্রিট, সেই কলেজ স্ট্রিটে সবদিক থেকে আধুনিকতা আনাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। কাজে, কর্মে, পেশাদারিত্বে, লেখকদের যোগ্য সম্মান দেওয়ার ক্ষেত্রে অথবা পাঠকদের জন্যেও কিছু ভাবনাচিন্তা করা, ছোট-বড় সমস্ত প্রকাশকদের মধ্যে একটা মেলবন্ধন তৈরি করা— এই সমস্ত দিকে নজর দিয়ে বইপাড়ার একটা সর্বাঙ্গীন উন্নতি বরাবর ইন্দ্রাণীর ভাবনার মধ্যে ছিল৷
বইপাড়ায় আসার পরেই ঠিক এই কথাগুলো আমারও মনে হত। এশিয়ার বৃহত্তম এই বইপাড়া অনেক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। যেমন, বইপাড়ায় মেয়েদের জন্য কোনও টয়লেট নেই। বইপাড়ার সকলের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক কোনও সংগঠন নেই। যে গুটিকয় সংগঠন আছে, তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে, সেখানে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই, মাত্র দু-তিনজন প্রকাশকের মুখ দেখা যায় সেখানে। শুধুমাত্র বইমেলার সময় নিজেদের বই বিক্রি করা, নিজেদের প্রোমোট করা ছাড়া এদের আর কোনও কাজ নেই। এমনটা হবে কেন? সংগঠনে আরও অনেকের, সকলের মুখ দেখা যাবে না কেন? অনেকের কথা বলার একটা জায়গা তৈরি হবে না কেন? এটা প্রথম থেকেই আমাদের মনে প্রশ্ন ছিল। কোনও প্রকাশককে ছোট না করেও বলছি, ব্যবসার বার্ষিক পরিমাণ দিয়েও তো বইপাড়ায় প্রকাশকদের অবস্থানটা বোঝা যায়, বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও অন্যান্য বড় প্রকাশক যারা, তাদেরকে কেন সেই সংগঠনের আওতায় আনা হবে না? একটি সংগঠন, তাতে মাত্র দু-তিনটি মুখ, আর অন্যান্য যে কটি সংগঠন তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ— দুঃখের বিষয় কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় প্রকাশকদের মধ্যে কোনও একতা নেই। দিনের পর দিন বই, বাংলা সাহিত্য কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। সেই কোণঠাসা জায়গায় নিজেদের মধ্যে যদি কোনও একতা না থাকে, মেলবন্ধন না থাকে, তাহলে আমরা লড়াই করব কীভাবে? আমাদের লড়াইটা তো নিজেদের মধ্যে নয়। আমাদের একজোট হয়ে সরকারকে বলতে হবে, আমাদের গ্রান্ট চাই, আমাদের লাইব্রেরি পারচেজ-এর সুবিধা চাই। আমরা হাহুতাশ করি, বিদেশের ছেলেমেয়েরা প্রচুর বই পড়ে, অথচ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না। আমাদের দেশের সরকার ছেলেমেয়েদের বই পড়া বাড়ানোর জন্য কোনওদিন আদৌ কোনও পদক্ষেপ নিয়েছে কি? কটা সংবাদমাধ্যম সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন? বইপাড়ার অস্থায়ী বইয়ের দোকানগুলোকে পাকাপাকি করা দরকার। আমাদের এখানে কারও কোনও বিমা নেই। সম্প্রতি আমফানের সময় ছোট ছোট বইবিক্রেতাদের কত ক্ষতি হয়ে গেল। দেখা গেল, বইপাড়ায় কতজনের ঠিকঠাক ট্রেড লাইসেন্স নেই। আমরা বড় কয়েকটি সংস্থা আমফানের সময় যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা বীমাসংস্থার থেকে তুলে নিয়েছি, কিন্তু কত ছোটখাটো দোকান ক্ষতি সহ্য করতে না পেরে পথে বসে গেছে। কারণ তাদের কোমরের সেই জোর নেই। এই সমস্ত অভাব অভিযোগ আমরা সরকারকে জানাতে চাই। আর সেকারণেই আমাদের সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। আর সংঘবদ্ধ হওয়ার তাগিদ থেকেই আমার আর ইন্দ্রাণীর বন্ধুত্বের সূত্রপাত। প্রতিটি সম্পর্কের একটা ভিত্তি থাকে, তেমনি আমার আর ইন্দ্রাণীর সম্পর্কের ভিত্তি ছিল বইপাড়ার উন্নতি।
বইপাড়ার সকলকে নিয়ে নিজেদের একটা সংগঠন তৈরি করার জন্য আমরা আক্ষরিক অর্থে প্রকাশকদের দোরে দোরে ঘুরেছি। আমরা দুজনে যে দুটি প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার, সেসব ইগো আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের কাজই ছিল প্রতিটি প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করা, ঐক্যবদ্ধভাবে একটা সংগঠন তৈরি করা যেখান থেকে আমরা বলতে পারব যে বইপাড়া কর্পোরেট হোক, সকলের বিমা সুবিধা থাকুক, ছোট ছোট অস্থায়ী দোকানগুলোর বদলে একটা স্থায়ী কাঠামো আসুক, একটা ঠিকঠাক জায়গা হোক যেখানে পাঠক বসে চা-কফি খেতে খেতে বই নিয়ে আড্ডা মারতে পারবেন। আমাদের কফি হাউসের মতো ঐতিহ্যশালী জায়গার কী দুর্দশা হয়েছে তা তো আমরা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি! আমরা কেন লেখকদের যোগ্য সাম্মানিক দিতে পারছি না। ইংরেজি ভাষার লেখক শুধুমাত্র বই লিখেই স্বনির্ভর রয়েছেন, বাংলাভাষার লেখকদের কেন পেট চালানোর জন্য অন্য একটা চাকরিতে বা পেশায় কাজ করতে হবে? কেন আমরা প্রকাশকরা তাদের যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দিতে পারি না? ইন্দ্রাণীর সঙ্গে সঙ্গে আমিও চেয়েছিলাম এই সমস্ত দিকগুলোর কথা চিন্তা করে পদক্ষেপ নিয়ে বইপাড়া আধুনিক হোক৷ আমরা প্রকাশকদের পাশে যেমন দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, তেমনিভাবে লেখক ও পাঠকের পাশেও দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। তার কারণ প্রকাশকরা যদি লেখকদের পাশে না দাঁড়ান, লেখকরাও প্রকাশকদের পাশে দাঁড়াবেন না।
ইন্দ্রাণীর আর আমার মনের ও চিন্তার এত মিল ছিল বলেই আমরা এই কাজে একসঙ্গে এগোতে পেরেছিলাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যদি বইপাড়ার সামগ্রিক উন্নতি হয়, তাহলে আমাদের অর্থাৎ প্রকাশকদেরও উন্নতি হবে। আরেকটা ব্যাপারও বলা দরকার, আমার আর ইন্দ্রাণীর মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। আমি হয়তো বললাম, আচ্ছা ইন্দ্রাণী, ওঁর বইটা তুমি করো, আমি আরেকজনের বই করছি। এর-ওর প্রকাশনা সংস্থা থেকে অমুকের বই আমাকে খাবলে নিতে হবে, এমন মানসিকতা আমাদের ছিল না।
ইন্দ্রাণীর আরেকটা কাজ আমার খুব ভালো লেগেছিল। ও বইবন্ধু বলে একটা সংস্থা তৈরি করেছিল। বইবন্ধু একটা খুব অভিনব কনসেপ্ট, একটা সাহিত্যের কর্মশালা যার ফলে সাহিত্যের মান বৃদ্ধি হবে এবং তার প্রসারও ঘটবে। ও ছুটির দিনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে বড় বড় সাহিত্যিকদের নিয়ে যেত, ওখানে গিয়ে একটা গল্প বলার অনুষ্ঠান বা স্টোরি টেলিং সেশনের আয়োজন করত। প্রতি রবিবার সম্পূর্ণ নিজের খরচে কোনও প্রথিতযশা লেখককে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে দূরের কোনও জেলার স্কুলে চলে যেত ইন্দ্রাণী। কুড়ি-তিরিশটা বাচ্চার সঙ্গে বসে গল্পের কর্মশালা করত। গল্প শোনানোর পর বাচ্চাদের নিজেদের লিখতে বলা হত। হয়তো লেখার জন্য কোনও একটা বিষয় বলে দেওয়া হত। সেই লেখা থেকে ভালো লেখাগুলো বেছে পাণ্ডুলিপি তৈরি হত। ইন্দ্রাণী সেই লেখাগুলো ছাপত। অর্থাৎ রবিবারের সকালে শুরু হলেও সেই সকালেই শেষ হয়ে যেত না বইবন্ধুর কর্মশালা। সেইসব ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মনে কী অসাধারণ সদর্থক প্রভাব ফেলত এই কর্মশালাগুলি, তা আমি কল্পনা করতে পারি। পরের দিকে বইবন্ধু এমন জনপ্রিয় হল যে প্রতি রবিবার কোনও মা কোনও স্কুল বা ক্লাব থেকে ডাক পেত ইন্দ্রাণী। এইভাবেই আমাদের নতুন প্রজন্মকে সাহিত্যের দিকে আরও একটু এগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল ইন্দ্রাণী। একজন নারী হয়ে আমি বুঝতে পারি, সারা সপ্তাহ কাজ করার পর ঘরের দায়িত্ব সামলে, একটা ছোট মেয়ের দায়িত্ব সামলে, অশীতিপর বাবার সব প্রয়োজনের খেয়াল রেখে, কতখানি কর্মক্ষমতা আর উদ্যম থাকলে একজন নারী এইরকম গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে। ইন্দ্রাণী এই বাড়তি দায়িত্ব শুধু পালন করেনি, সেই কাজে সে সফলও হয়েছিল।
মিত্র ও ঘোষ-কে ইন্দ্রাণী কীভাবে আধুনিক করে তুলেছে সেটা অনেকেই জানেন। অনেকে সেকথা বলবেনও। আমি ইন্দ্রানীর আরেকটা দিকের কথা বলব। আমফানের সময় আমফান-বিধ্বস্ত বইপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বইপাড়াকে সাহায্য করার জন্য ও ‘মিলাপ’ বলে একটা এনজিও-র সহযোগিতা নিয়ে দেশ-বিদেশের অনুদান (যার মধ্যে কলকাতা নাইট রাইডার্স-এর মতো সংস্থাও রয়েছে) জোগাড় করে প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পুস্তক-ব্যাবসায়ীর হাতে এককালীন দশ হাজার টাকা করে তুলে দিয়েছে ও। এটা একটা বিরাট কাজ বলে আমি মনে করি। শুধু তাই নয়, করোনার সময় যখন পুরো বইপাড়া বন্ধ তখন ইন্দ্রাণী শুধু নিজের সংস্থার ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিয়েছে তা-ই নয়, কলেজ স্ট্রিটের ছোট ছোট দপ্তরী, মুটে এমনকি ঠেলাওয়ালাদের জন্য প্রায় একমাস ধরে কমিউনিটি কিচেন চালিয়েছে সে। নিজে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করে চালের ব্যবস্থা করা, কারও কাছ থেকে ডাল বা অন্য কিছু, এইভাবে দিনের পর দিন কিচেনটা চালিয়ে গেছে। কোনওদিন আমাকে মেসেজ করে জানাচ্ছে, রূপা, কালকে ক্যান্টিন চালানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। একটু পরেই আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছে, রূপা, এইমাত্র একটা অনুদান এল, কালকের ব্যবস্থাটা হয়ে যাবে। বইপাড়ায় এই কাজটা ও ছাড়া তথাকথিত কোনও সংগঠন করতে পারেনি। যেসব সংগঠন যারা সারা বছর নানা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে শুধুমাত্র নিজেদের উন্নতির জন্য যাবতীয় কারসাজি করে চলেন, কী করে শুধু নিজেদের বইগুলো বেশি বেশি লাইব্রেরি পারচেজ করানো যায় তার চিন্তায় মশগুল থাকেন, তারা কেউই কিন্তু করোনা বা আমফান বিধ্বস্ত বইপাড়ার উন্নতিসাধনে কোনওভাবে এগিয়ে আসেনি। ইন্দ্রাণী এসেছিল।
ইন্দ্রাণীর আরও একটা মস্ত গুণ ছিল। ও প্রতিবাদ করতে, বিদ্রোহ ঘোষণা করতে জানত। আমি হয়তো অনেক নরম সুরে, মধ্যপন্থী হয়ে কথা বলি। ইন্দ্রাণী সবসময়ই চরমপন্থী। কোনও কিছু বা কারও কথা ভালো না লাগলে ও খোলাখুলি তা বলে দিতে দ্বিধা করত না। ওঁর মধ্যে কোনও দ্বিচারিতা ছিল না। একজনকে ভালো লাগছে না কিন্তু নিজের প্রয়োজনে তার সঙ্গে মিষ্টি হেসে কথা বলে যেতে হবে— এটা ইন্দ্রাণী করতে পারেনি কোনওদিন৷
পাশাপাশি, ইন্দ্রাণী কোনও গার্হস্থ বা দাম্পত্য অত্যাচার সহ্য করতে পারত না। ও অনেক মহিলাকে অনেকভাবে মনোবল জুগিয়েছে। এই সমস্ত অনেক ঘটনাই আমার জানা ছিল না, এখন নানা সূত্র থেকে, নূরদার কথা থেকে ঘটনাগুলো উঠে আসছে। কোনও বিপদগ্রস্ত মানুষের কাছে গিয়ে যদি বলা যায় ‘আমি আছি’, এই কথাটুকু বলে বা কাউন্সিলিং করে কতখানি সাহস জোগানো যায় তা আমরা জানি।
ইন্দ্রাণী এইভাবে চলে যাওয়ায় লড়াইটায় আমি একা হয়ে গেলাম। শুধু একা হয়ে গেলাম, তাই-ই নয়, আমার মনে হয় আমি আদৌ এই লড়াইটাকে একা একা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব না।
আমরা যখন শুনলাম এবছর কোভিডের জন্য বইমেলা হচ্ছে না, আমরা নিজেরা ঋষিকেশ পার্কে সাতদিনব্যাপী একটা বইমেলা করেছিলাম। এখানে আমরা প্রকাশকদের ফ্রি স্টল দিয়েছিলাম ও পাঠকদের জন্য ২৫-৩০ শতাংশ ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা করেছিলাম। পাঠকের কাছ থেকে প্রভূত সাড়া পেয়েছিলাম। ইন্দ্রাণীর শরীরটা তখন থেকেই একটু খারাপ ছিল। কিন্তু তখন কেউই জানতাম না যে এমনকি ও নিজেও জানত না যে কর্কট রোগ ওঁকে আক্রমণ করেছে। পায়ের ব্যথার চিকিৎসা হছিল, হঠাৎ এমআরআই-তে দেখা গেল রোগটা ক্যানসার। তারপর ঠিক এক মাসের মধ্যে ট্রিটমেন্ট শুরু হল। প্রথম কেমোটাই সহ্য করতে পারল না ঈন্দ্রাণী, প্রথমেই ডব্লিউবিসি কাউন্ট খুব বেড়ে গেল, হিমোগ্লোবিন কমে গেল৷ ইন্দ্রাণী চলে গেল।
ইন্দ্রাণী কদিন আগেও বলেছিল আমি শিগগির ফিরে আসব। তখন ও বা আমরা কেউই ভাবতে পারিনি যে আজকের এই দিনটা আমাদের দেখতে হবে। ভানুবাবু, ইন্দ্রাণীর বাবা এখনও বেঁচে আছেন, বারো বছরের ছোট্ট মেয়ে তিন্নি আছে, অথচ মাত্র পঞ্চাশ বছরে চলে গেল ইন্দ্রাণী। তিন্নির সঙ্গে ঘটনার পরেও আমার দেখা হয়েছে। ইন্দ্রাণীর মেয়ে মায়ের মতোই শক্ত। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। একটা মানুষের চলে যাওয়ার পর তাঁর জায়গাটা তো অবশ্যই ফাঁকা, পূরণ হবারও নয়, তাও পজিটিভিটি নিয়ে জীবনটাকে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন পরিবারের মানুষরা।
ইন্দ্রাণীর সঙ্গে কাজেকর্মে প্রচুর জায়গায় গেছি৷ দিল্লিতে প্রকাশক সংস্থাগুলির বার্ষিক সভায় গেছি, আবার দুর্গাপুরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ পালনের অনুষ্ঠানেও গেছি। অনেক গল্প, অনেক আড্ডা, অনেক স্মৃতি জমে আছে। বইমেলায় মিত্র ও ঘোষের স্টলে লেখকদের বসার জন্য আরামদায়ক সোফা পাতা থাকত। তাদের জন্য আনা থাকত কড়াপাকের সন্দেশ। ওখানে নিজেই ক্যাশে বসত ইন্দ্রাণী। সারাক্ষণ স্ট্যাম্প মারছে, সই করছে, ক্যালকুকেটরে হিসেব করছে। তারই মধ্যে লেখকরা গেলে তাঁদের সঙ্গে আতিথেয়তা করছে। আমি আমাদের স্টল থেকে মিত্র ও ঘোষে মাঝে মাঝে হাঁফ ছাড়তে যেতাম। আমি গেলেই ইন্দ্রাণী আমাকে আপ্যায়ন করে সোফায় বসাত। নূরদা মাইকে ঘোষণা করতেন— দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার রূপা মজুমদার আমাদের স্টলে এসেছেন। আমি সোফায় বসে খুব আবদার করে ইন্দ্রাণীকে বলতাম, ইন্দ্রাণী, আমার খিদে পেয়েছে৷ ইন্দ্রাণী ও নূরদা সঙ্গে সঙ্গে কচুরি, আলুর দম, কড়াপাকের সন্দেশ আমাকে জোর করে খাওয়াতো।
এরপরেও বইমেলা আসবে। আমিও নিশ্চয়ই মিত্র ও ঘোষের স্টলে যাব। সোফা থাকবে। সন্দেশও থাকবে। নূরদা ঘোষণা করবেন। কিন্তু ক্যাশের চেয়ারটাতে আমার বন্ধু ইন্দ্রাণী সেদিন থাকবে না।
বলিষ্ঠ স্মৃতিচারণ ছাড়া আর কী বলব একে! তবে এই লেখা তার থেকেও বেশি। যেভাবে বইপাড়ার প্রেক্ষিতের সঙ্গে ইন্দ্রানী দত্ত রায়কে জুড়েছেন লেখিকা তাতে এই লেখা নিছক স্মৃতিচারণের থেকে অনেক বেশি হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষিতের প্রতি যদি সংশ্লিষ্ট লোকজন সার্থকতা দেখান তবেই লেখাটির সার্থকতা।
একবার লিটল ম্যাগাজিন সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন পাঁচ জন সম্পাদককে করেছিলাম। দু’জন জবাব দেন। তিন মাস সময় নিয়েও দু’জন কোনরকম জবাব দিয়ে উঠতে পারেননি। রূপা মজুমদার হোয়াটস আপে প্রশ্ন পাঠাবার আধ ঘন্টার মধ্যে তার উত্তর দেন। এই প্রবন্ধ পড়ে জানতে পারছি এত তাড়াতাড়ি সাড়া দেবার বোধ ও আদর্শ।
ইন্দ্রানী দত্ত রায় ও রূপা মজুমদার- দু’জনের প্রতিই শ্রদ্ধা রইল!