সুশোভন ধর
প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার
ফরাসি বিদেশমন্ত্রী জঁ-ইভ ল্য দ্রিয়ঁ আগামী ১২ এপ্রিল সন্ধেবেলা ভারতে পদার্পণ করতে চলেছেন। এখানে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হবে। সেখানে আলোচনা হবে কীভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক নহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্র-সুরক্ষা বাড়ানো যায়, একযোগে নানারকম সম্ভাব্য বিপদ-আপদের মোকাবিলা করা যায়, ইত্যাদি। স্মরণ রাখা যাক, এই গত ৭ এপ্রিল বঙ্গোপসাগরে ফরাসি পরিচালনায় ভারত এবং ফ্রান্সের যৌথ নৌ মহড়া লা পেরুজ শেষ হল। ফলে ফরাসি বিদেশমন্ত্রীর আগমন এবং বৈঠকগুলি ঘটতে চলেছে এর এক সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু খবর সেগুলি নয়। ফরাসি বিদেশমন্ত্রীর এই সফরের প্রাক্কালে ফরাসি সংবাদমাধ্যম এবং ইন্টারনেট যে খবরে ছয়লাপ হয়ে রয়েছে তা হল “রাফাল পেপার্স”[1]।
রাফাল জেট কেনা সংক্রান্ত ভারত-ফ্রান্সের এই ধোঁয়াশাময় চুক্তি সম্পর্কে ‘মিডিয়াপার্ট’ প্রথম বোমাটা ফাটায় ২০১৮ সালে। যে সব খবর তারা সে সময় প্রকাশ্যে এনেছিল তা আমাদের উপমহাদেশে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে। এখানে একটু বলে রাখা থাক, চুক্তিটি চূড়ান্ত করেছিল পূর্বতন ইউপিএ সরকার, যাতে ভারতের ১২৬টি রাফাল জেট কেনার কথা, যেগুলির প্রযুক্তি ফরাসি সরকার দেবে এবং তৈরি হবে রাষ্ট্রায়ত্ত হিন্দুস্থান এরোনটিকস লিমিটেড (হ্যাল)-এ।
ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদি এই চুক্তি পরিবর্তন করেন। লক্ষ্য— অনিল আম্বানির রিলায়েন্স গ্রুপকে বরাতটা পাইয়ে দেওয়া। এসব বহু-আলোচিত তথ্য যে, অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে অনিল আম্বানিদের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এবং মোদির ঘোষণার মাত্র ১৩ দিন আগে এই তাদের এই ভুঁইফোড় অ্যাভিয়েশন কোম্পানিটিকে নথিভুক্ত করা হয়।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় যে কেবলমাত্র ৩৬টি রাফাল বিমান ফ্রান্সেই তৈরি হবে। এবং এর জন্য তিনগুণ খরচ পড়বে। বিরোধীরা যথারীতি প্রশ্ন তুলেছিলেন, সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু বিস্ময়করভাবে সুপ্রিম কোর্ট তখন মনে করল যে এ নিয়ে কোনও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের প্রয়োজন নেই।
এই ঘটনার চার বছর পরে, গত রবিবার, ৪ এপ্রিল, মিডিয়াপার্ট আবার নতুন কিছু খবর প্রকাশ্যে নিয়ে এল। তাদের খবর অনুযায়ী দাসো কোম্পানি সুষেণ গুপ্তাকে ১ মিলিয়ন ইউরো দিয়েছিল। কে এই সুষেণ গুপ্তা? ইনি একজন মধ্যস্থতাকারী, ভাষান্তরে দালাল। এবং এখানেই এনার পরিচয় শেষ নয়। অগাস্টা-ওয়েস্টল্যান্ড গ্রুপের ভারতকে হেলিকপ্টার বিক্রি নিয়ে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, তাতে এই সুষেণ গুপ্তা অর্থ পাচারকারী হিসেবে অভিযুক্ত।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ৫০টা রাফাল-সি বিমান তৈরি করার খরচের হিসেবে ‘ক্লায়েন্টকে উপহার’ কলামে দেখানো হয়েছে। এবং পরে তার আর কোনও হদিশই পাওয়া যায়নি। মজাটা হল, এর পরেও ফরাসি দুর্নীতি-বিরোধী সংস্থা এটা আদালতকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
গত সোমবার, ৫ এপ্রিল, ভারতের প্রায় সব কটি বড় মিডিয়া হাউজই এই খবরটি হেডলাইন করে। ফলত সেই পুরনো বিতর্ক— রিলায়েন্স গ্রুপকে সুবিধা দিতে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যালকে বঞ্চিত করতে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে— আবার জেগে উঠেছে। টুইটারেও হ্যাশট্যাগ রাফালস্ক্যাম শিরোনামে উঠে এসেছে। বহু ইন্টারনেট-ইউজারই সোমবার থেকে সরকারের জবাব চাইছেন এবং “রাহুল গান্ধিই ঠিক বলেছিলেন”— এরকম কথাও উঠতে শুরু করেছে।
কংগ্রেস বলছে তারা রাফাল কেনা নিয়ে বহুবার সতর্ক করেছে— “স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে অন্যতম বড় কেলেঙ্কারি এই ঘটনা।” আমাদের মনে থাকার কথা গত নভেম্বরেই কংগ্রেস অভিযোগ করেছিল— “রাফাল কিনতে গিয়ে দেশের কোষাগার থেকে অর্থ তছরুপ হয়েছে।” কিন্তু কম্প্রোটার অ্যান্ড অডিটর গেনারেল (সিএজি) সেই সময় বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অস্বীকার করে।
ফলে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে সরকারকে আক্রমণ করার এই নতুন সুযোগ কংগ্রেস দু হাতে আঁকাড়ে ধরতে চাইবে। সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রনদীপ সিং সুরজেওয়ালা প্রশ্ন তুলেছেন— “দাসো ‘ক্লায়েন্টকে উপহার’ দেওয়ার নাম করে এই যে এক মিলিয়ন ইউরো দিয়েছে সেটা কি বাস্তবত মিডলম্যানকে তার কমিশন দেওয়া নয়?”
রনদীপ নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন। বলেছেন— “মধ্যস্থতা, কমিশন বা দুর্নীতির যে কোনওরকম ঘটনাই গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। যেমন, অস্ত্র-ঠিকাদারকে নিষিদ্ধ করা, চুক্তি বাতিল করা এবং বিপুল আর্থিক জরিমানা করা।” অন্যান্য কংগ্রেস নেতারাও বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সরকারের দিকে আঙুল তুলে সোচ্চার হয়েছেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ টুইট করেছেন— “এ কেবল হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আসল ঘোটালা তো আছে ওই ৫০ শতাংশ কম্পেনসেশন কন্ট্রাক্ট[2]-এর মধ্যে, যার সিংহভাগই ঢুকেছে অনিল আম্বানির ঘরে।” চুক্তির এই শর্ত অনুযায়ী ফরাসি সরকারকে বিক্রয়মূল্যের ৫০ শতাংশ আবার ভারতীয় কোম্পানিগুলিতে বিনিয়োগ করতে হবে।
ভারত সরকার যথারীতি দ্রুত মুখরক্ষায় নেমেছে। আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এই সমস্ত অভিযোগকেই ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়— “কি সুপ্রিম কোর্ট, কি সিএজি কেউই চুক্তিতে কোনও গলদ খুঁজে পায়নি। কংগ্রেস শুধুমাত্র ভোটের কারণে রাফাল নিয়ে জলঘোলা করছে।” ইন্টারনেটে মোদি-সমর্থকেরা যথারীতি বিদেশি চক্রান্ত খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের বক্তব্য, ভারতের আভ্যন্তরীণ সুস্থিতি নষ্ট করার জন্য এক বামপন্থী সংবাদমাধ্যম এসব ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছে। স্মরণ করা যাক, কৃষক আন্দোলনে রিহানা এবং গ্রেটা থুনবার্গের সমর্থনের সময়েও আমরা একই ধরনের বিদেশি চক্রান্তের কথা শুনেছিলাম।
সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন চলছে। অন্যদিকে ফরাসি বিদেশমন্ত্রী জঁ-ইভ ল্য দ্রিয়ঁ-র দুদিনের মধ্যেই ভারতে আসছেন। এইরকম একটা সময়ে এই ঘটনার উন্মোচন নিঃসন্দেহে ভারতীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে। লক্ষ্যণীয়, দেশের মূলধারার মিডিয়া, যাদের অধিকাংশই নিজেদের অত্যধিক মোদিপ্রীতির জন্য ইদানীং গোদি মিডিয়া বলে নাম করেছে, তারাও অধিকাংশই এই ঘটনা নিয়ে খবর করেছে। জল কোনদিকে গড়ায় তা দেখার জন্য এখন আমরা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব।
[1] https://www.telegraphindia.com/india/kickbacks-in-rafale-deal-french-portal-mediapart/cid/1811968
[2] প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাবেচার চুক্তিতে সরঞ্জামের উত্পাদক “কম্পেন্সেশন” বলে এক ধরনের ছাড় দেয়। চুক্তির অঙ্কের একটা অংশ সরঞ্জাম আমদানিকারী দেশে বিনিয়োগ করা হয় মূলত ভ্যালু অ্যাডিশন বা সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে।