শীতলকুচির রক্তপাত: বিচ্ছিন্ন নাকি নিরবচ্ছিন্নতা?

অভিষেক ঝা

 



গদ্যকার, অনুবাদক, পেশায় শিক্ষক

 

শীতলকুচিতে চতুর্থ দফার ভোটের দিন কেন্দ্রীয় বাহিনির গুলিতে যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে সেইটি পরিকল্পিতভাবে বিজেপি-রাষ্ট্রের সন্ত্রাস নাকি সেই সময়ে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির ফলাফল তা কোনওদিনই জানা সম্ভব নয়। তাই সেইদিন ঠিক কী হয়েছিল এই অভিমুখের যেকোনও আলোচনাই আসলে বিজেপি-রাষ্ট্রের ফাঁদে পা দেওয়া। সেই ঘটনার পরে প্রতিক্রিয়া হিসেবে যা যা হচ্ছে সেইগুলি আলোচনা করলেই বোঝা যাবে কেন শীতলকুচিতেই গুলি চলেছিল। রাজনৈতিকভাবে দেখলে পুরো কোচবিহার জেলার দুটি মাত্র বিধানসভায় উনিশের লোকসভার ভোটের নিরিখে বিজেপি পিছিয়ে রয়েছে: সিতাই ও শীতলকুচি। এই দুইটি বিধানসভার ভিতর আবার সিতাইয়ে ভোটের ব্যবধান অনেকটাই বেশি (প্রায় পঁচিশ হাজার) এবং শীতলকুচিতে কান-ঘেঁষা ব্যবধান (বারোশোর কাছাকাছি)। এই দুটি বিধানসভা ক্ষেত্রই পুরো কোচবিহারে সবচেয়ে সফলভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে কারণ মুসলিম ভোটারের সংখ্যা এই দুটি বিধানসভা ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি। সিতাইয়ের ব্যবধান টপকে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হওয়ায় রাজনৈতিকভাবেই শীতলকুচিকে যে বিজেপি টার্গেট করবে তা বোঝা কোনও কঠিন ব্যাপার নয়। স্রেফ ভয় দেখিয়ে শীতলকুচিতে বিজেপি-বিরোধী মুসলিম ভোটারদের ঘরে আটকে রাখতে চাওয়া তাই একটি আগাম কষে রাখা ঝুঁকি কারণ দক্ষিণ মালদা থেকে শুরু করে দার্জিলিং অবধি উক্ত ভৌগোলিক অঞ্চল যা তথাকথিত ‘উত্তরবঙ্গ’ নামে চিহ্নিত, সেইখানে প্রতিটা সিট পাওয়া বিজেপির পক্ষে খুবই জরুরি। উনিশের লোকসভার নিরিখে এইখান থেকে যা কিছু হারাবে তা বিজেপিরই হারাবে, বাকি একটি রাজনৈতিক দলেরও এইখান থেকে নতুন করে হারাবার কোনও সম্ভাবনা নেই। শীতলকুচি তাই এই অঞ্চলের ভোটের ক্ষেত্রে বিজেপির রাজনৈতিক পদক্ষেপ। এই ভয় দেখানোর ট্যাকটিক্স বিজেপি নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করবে উত্তর দিনাজপুরের চিকেন’স নেক-এ এবং দক্ষিণ মালদার বিধানসভা ক্ষেত্রগুলিতে যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিজেপি পাঁচশো থেকে হাজার ভোটে পিছিয়ে আছে তৃণমূল কংগ্রেস বা কংগ্রেসের থেকে এবং এই জায়গাগুলির একটা বিরাট অংশ মুসলিম ভোটার। উনিশের লোকসভায় হিন্দু ভোট একত্রিত হয়েছিল শীতলকুচির মতো জনবিন্যাসের বিধানসভাগুলিতে এবং মুসলিম ভোট ভাগাভাগি হয়েছিল। এই অঞ্চলে ফুরফুরা শরিফের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক প্রায় কোনও প্রভাবই না থাকায় মুসলিম ভোটের একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, সেই সম্ভাবনাকে দূর করতে পারে একমাত্র বিজেপি-রাষ্ট্রের সন্ত্রাসের পরিবেশ। শীতলকুচির ঘটনা তাই বিজেপির মরিয়া হয়ে নেওয়া একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ; ‘উত্তরবঙ্গে’ নিজেদের ক্ষতির পরিমাণ যতটা সম্ভব কমাবার জন্য।

নির্বাচনভিত্তিক এই রাজনীতির বাইরেও শীতলকুচি পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলি একটি বৃহত্তর রাজনীতির অংশ। একইদিনে ভোট দিতে গিয়ে খুন হওয়া আনন্দ বর্মনের রাজবংশী-সত্তাকে ফোকাস করে বিজেপি এবং সেই সত্তার বিপ্রতীপে রাখা হয় কেন্দ্রীয় বাহিনির গুলিতে নিহত চারজন মুসলিমকে। খুব সুচতুরভাবে ‘রাজবংশী’ সত্তাকে একটি নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা হিসেবে না ধরে আনন্দ এবং বাকি চারজনকে পৃথক করা হয় ‘হিন্দু’ ধর্মের ভিত্তিতে যা বিজেপির সর্বভারতীয় ছক। মজার ব্যাপার এই যে ‘রাজবংশী’ সত্তার পূর্বজরা নিজেদের আদি ধর্ম ছেড়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছে এই অঞ্চলের উপর দিয়ে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বখতিয়ারের তিব্বত অভিযানের সময় এবং আর্যাবর্তজাত ‘হিন্দু’ ধর্মকে গ্রহণ করেছে সপ্তদশ শতাব্দীতে। [সূত্র: “Negotiating with the Changing Landscape: The Case of the Rajbanshi Community”,  Gautam Chandra Roy, EPW, 26th September, 2020]। সুতরাং এই অঞ্চলের দীর্ঘতম সময় ধরে বাস করতে থাকা জনজাতিটিকে শুধুমাত্র ‘হিন্দু’দের একটি সম্প্রদায় হিসেবে দেখানো হলে বিজেপির আর্যাবর্তীয় ভারতের ধারণা মজবুত হয় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে ‘গ্রেটার কোচবিহার’ নামের একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যার ভিত্তিপ্রস্তরই স্থাপিত হয়েছে ‘রাজবংশী’ সত্তাকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অভিপ্রায়ে। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে রাজবংশী সংগঠনগুলি বিজেপির তীব্র বিরোধিতা করেছিল ‘হিন্দু বাংলাদেশি’কে নাগরিকত্বের অধিকারের ইস্যুতে। রাজবংশী সত্তাকে শুধুমাত্র হিন্দুর সত্তা হিসেবে দেখিয়ে সেই ক্যা-বিরোধিতাকেও প্রতিরোধের চেষ্টা বিজেপি শুরু করল। বিজেপি-রাষ্ট্রের ‘ওয়ান নেশন’ তত্ত্বে আর্যাবর্তের বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ববাদের মেটা-ন্যারেটিভে সমস্ত ইন্ডিজেনাস সত্তাকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপটিই হল সেই সত্তার দ্বারা একই অরিজিনের ইন্ডিজেনাস মুসলমানকে ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করানো। শীতলকুচির ঘটনার প্রতিক্রিয়াতেও সেই একই মোডাস অপারেন্ডি খেয়াল করা যায়। বিজেপি জানে যে এই সেই ব্রহ্মাস্ত্র যা এই সময়ের ‘উচ্চশিক্ষিত’ হিন্দু, ‘অর্ধশিক্ষিত’ হিন্দু, ‘ডিগ্রিধারী শিক্ষিত’ হিন্দু, ‘অশিক্ষিত’ হিন্দু, ‘কুশিক্ষিত’ হিন্দু, ‘নিরক্ষর’ হিন্দু প্রত্যেকের প্রিয়তম ড্রাগ। এবং একটি ড্রাগড-নেশন নিজের কাঙ্খিত ড্রাগটি পেলে ভোট দেওয়ার সময় বাদবাকি যাবতীয় ইস্যু ভুলে গিয়ে জম্বির মতো ভোট দিতে যায়। শীতলকুচির রক্ত অবশ্যই হিন্দু-ভোটকে হিন্দুত্ববাদের জন্য ভোট হিসেবে একত্রিত হতে সাহায্য করবে। শীতলকুচির ঘটনা তাই বিজেপির সবচেয়ে মরিয়া এবং বিজেপির নিজস্ব সাক্ষরবাহী চেষ্টা বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পথে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...