বিজেপি-র নদী পরিকল্পনা: এক নতুন গোলকধাঁধা

চন্দন ব্যানার্জী

 


ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, কবি, লেখক, সমাজকর্মী ও বিশ্লেষক

 

 

 

জল ছুটবে নীচ থেকে উপর দিকে!

জল উপর থেকে নীচের দিকে যায়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। পৃথিবীর অভিকর্ষ এর অন্যথা হতে দেয় না। কিন্তু নরেন্দ্র দামোদর মোদির হাতে পড়লে? হ্যাঁ, তখন অবশ্য নদীর জল রাম রাম বলে নীচ থেকে উপর দিকে যেতেও বাধ্য হবে। মুদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়! বিশ্বাস না হলে ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে ভারতীয় জনতা দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে নদী সংক্রান্ত অলীক প্রতিশ্রুতিটি পড়ে দেখুন। এই অসম্ভব সম্ভবামির কথাই দেখতে পাবেন। কী সেই প্রতিশ্রুতি? কেন তা অলীক? প্রতিশ্রুতিটি অলীক কারণ সেখানে বলা হয়েছে: ভাজপা রাজ্যের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভৈরব, সিয়ালমারি আর জলঙ্গি নদী তিনটির অববাহিকা অঞ্চলে দু হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে উত্তরবঙ্গে বর্তমান সেচব্যবস্থার উন্নতিসহ নতুন সেচখাল খনন করা হবে! বাজেটে এই বাবদ টাকা বরাদ্দও নাকি করা হয়ে গেছে কেন্দ্রের বাজেটে।

নদী বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারছেন না যে দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলোকে উত্তরবঙ্গের সেচব্যবস্থায় কিভাবে কাজে লাগানো সম্ভব? যে তিনটি নদীকে ঘিরে এই পরিকল্পনা সেই তিনটি নদীই দক্ষিণবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যে দিয়ে দক্ষিণমুখী বইছে। বস্তুত মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান থেকে গঙ্গার দুটি ধারার অন্যতম ভাগীরথী পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে দক্ষিণমুখী প্রবাহিত হয়েছে। এই ভাগীরথী বা গঙ্গার ডানদিকে দক্ষিণবঙ্গ আর বাঁদিকে উত্তরবঙ্গ। বিজেপি দলের ইস্তাহারে উল্লেখিত নদী তিনটিই গঙ্গার ডানদিকের শাখানদী। সেই নদীগুলো থেকেই জল টেনে নিয়ে গিয়ে গঙ্গার ডানদিকে অবস্থিত উত্তরবঙ্গে সেচব্যবস্থার কাজে কীভাবে লাগানো হবে তা বুঝে উঠতে অনেকেরই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু মুদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় স্লোগানের চাপে তাঁরা বিস্ময় চেপে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন!

নদী তিনটিকে নিয়ে বিজেপি-র এই উদ্ভট প্রতিশ্রুতি তাদের ইস্তাহারের ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন অদ্ভুত পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি প্রদান কার মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েছে? সংবাদপত্র থেকে জানা যাচ্ছে,  এই ইস্তাহার রচনার জন্য এক গঠিত কমিটির দায়িত্বে ছিলেন বাঁকুড়ার সাংসদ ডাঃ সুভাষ সরকার। তাঁর মতে, ইস্তাহারে যখন বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তখন ওই নদীগুলোর জল উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে পাঠানোর ব্যবস্থা সম্পর্কেও পরিকল্পনা নিশ্চয়ই নেওয়া হয়েছে। যদিও তিনি বিষয়টিকে স্বচ্ছ করে তুলতে পারেননি।

গো-কুলের বাইরে যাঁরা বিজেপি-ইস্তাহারের এই প্রতিশ্রুতি পড়েছেন তাঁরা সন্দেহ করছেন যে বিজেপি এখনও পশ্চিমবঙ্গের শুধু ইতিহাস নয়, ভূগোলও  জেনে উঠতে পারেনি! নাহলে এমন গুরুত্বপূর্ণ ভোটের মুখোমুখি এমন উদ্ভট পরিকল্পনা ইস্তাহারে লেখার মত ভ্রান্তি এতবড় একটি কেন্দ্রীয় শাসক দল করে কী করে? পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রটাও কি বিজেপির কার্যকর্তাদের জানা নেই? অথচ আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে তারা রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখছে ও দেখাচ্ছে!

 

নিম্নগাঙ্গেয় নদীত্রয়

জলঙ্গি ভৈরব আর সিয়ালমারি নদী তিনটে মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ নদী। জলঙ্গি নদীটি মুর্শিদাবাদের আখেরিগঞ্জে গঙ্গা-পদ্মার থেকে উদ্ভূত হয়ে পশ্চিমদিকে বয়ে গিয়ে পরে পূর্ববাহিনী হয়ে নদীয়া ও মুর্শিদাবাদে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানার নিকটবর্তী হয়ে প্রবাহিত হয় ও পরে নদীয়ার কৃষ্ণনগরের কাছ দিয়ে নবদ্বীপের বিপরীতে স্বরূপগঞ্জে ভাগীরথীতে মিশে যায়। সিয়ালমারি নদীটি পদ্মার আরও একটি শাখা যেটি ভৈরব হয়ে জলঙ্গি নদীতে মিশেছে ও যার দরুন প্রতি বর্ষায় ওই অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি করে। আর ভৈরব নদীটি চরঘুঘুপাড়ার কাছে পদ্মার থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে কিছু দূর এগিয়ে জলঙ্গিতে মিশে যায়। তবে বর্তমানে দুটি নদীই পদ্মার থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন এবং অনেক জায়গায়তেই চার দিক থেকে আবদ্ধ।

ভৈরব একটি প্রাচীন নদী যার পুরনো ধারার কিছু বিচ্ছিন্ন অংশমাত্রই এখন দৃশ্যমান। ভারি বর্ষায় নদীটি পদ্মার জলে পুষ্ট হয়। বস্তুত ভৈরব ও সিয়ালমারি মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যেই জলঙ্গির সঙ্গে মিশেছে এবং জলঙ্গি আবার নদীয়া জেলার মায়াপুরের কাছে ভাগীরথী-হুগলী নদীতে মিশেছে।

বিজেপি যদিও তাদের ইস্তাহারে জলঙ্গি নদীকে জলঙ্গা নামে অভিষিক্ত করেছে! কল্যাণ রুদ্রর মতো বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞর জিজ্ঞাসা, গঙ্গার ডানদিকের নদী তিনটে গঙ্গার বাঁদিকে উত্তরবঙ্গে কিভাবে কার্যকরী হয়ে উঠবে? কল্যাণবাবুর মতোই রাজ্য সেচ দপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকও নদী তিনটিকে ঘিরে বিজেপির এমন প্রতিশ্রুতির বিষয়ে বিস্ময় লুকোতে পারেননি! তিনি বলেছেন যে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে কৃষির উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ নিলেও তা একাংশে গঙ্গার জলকে নিয়ে গিয়েই তো করে ফেলা সম্ভব। আর উত্তরবঙ্গে প্রবাহিত নদীগুলিকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের জলই তো সেখানকার সেচব্যবস্থায় ব্যবহার করা যায়। তাঁর মতে, বিজেপি-র এই ইস্তাহার রচয়িতাদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব ছিল হয়তো।

আর নীচের দিক থেকে এই নদীগুলির জল তাঁরা গঙ্গা পদ্মাকে ভেদ করে উচ্চগাঙ্গেয় অববাহিকায় নিয়েই বা যাবেন কীভাবে? করসেবকদের দিয়ে বালতি করে?

উত্তরবঙ্গের অন্যতম জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট শহরের বিশিষ্ট গবেষক তুহিনশুভ্র মণ্ডল বহুদিন ধরে নদী সংরক্ষণ বিষয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, নদী তিনটিকে কেন্দ্র করে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তো খুবই সামান্য বিভ্রান্তি। বিজেপির ইস্তাহারে উত্তরবঙ্গের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো সংরক্ষণ অথবা নদীগুলোর ব্যবহার নিয়ে নীরবতাই বুঝিয়ে দেয় যে নদী কিম্বা নদী অববাহিকা বিষয়ে আদৌ কোনও ধ্যানধারণা বা কার্যকরী পরিকল্পনাই তাঁদের নেই। এই অবাস্তব প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তিনি নিশ্চিত, যে বা যাঁরা এমন কথা ইস্তাহারে লিখেছেন তাঁদের এই রাজ্যের ভূগোলের প্রাথমিক ধারণাটুকুও নেই। যেমন, তাঁরা উত্তরবঙ্গের নদীগুলো বিশেষ করে তিস্তা সম্পর্কে নীরব কেন? অথচ এই তিস্তা নদীর জল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছেই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার জলবন্টন নিয়ে আন্তঃরাষ্ট্র চুক্তি এখনও অধরা।

ভারতীয় জনতা দল এমন একটা অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক আর উদ্ভট প্রতিশ্রুতি তাদের ইস্তাহারে দিয়েছিল কেন? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর একটাই; আর তা হল এই যে ওই দলটা আর তার নিজের যত শাখা উপশাখা প্রশাখা ইত্যাদি আছে তারা অবাস্তব অবৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভট কথা বলতে ও অলীক অসম্ভব প্রতিশ্রুতি দিতেই অভ্যস্ত। এর প্রথম প্রকাশ দেখা গিয়েছিল গত শতাব্দের ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গোটা ভারতবর্ষের সব ধরনের গনেশ মূর্তিকে সব রকম দুধ খাওয়ানোর মধ্যে দিয়ে! যদিও এর আগেই বেশ কয়েক বছর ধরে রামমন্দির তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রাজ্য থেকে অযোধ্যায় ‘শ্রীরাম’ লেখা ইট নিয়ে যাওয়া চলতে চলতে ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদটাই ভেঙে ফেলেছিল এই দলটা ও তাদের অনুসারী সংগঠনের বানরসেনারা। পরবর্তীতে সরকারি ক্ষমতার জোরে ওই দলের নেতৃত্বে ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ও সেইসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের ব্যবহার করে অজস্র অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও বিকৃত তথ্যের সুনামিতে দেশের মানুষকে দেশপ্রেম আর প্রাচীন ভারতের কৃতিত্বের গর্বে ভাসিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা শুরু হয়, যা এখনও বিরামহীনভাবে চলছে।

ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান, অর্থনীতি থেকে রাজনীতি, নৃতত্ত্ব থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান, মায় এখন ভূগোলও ওরা পাল্টে দিতে চাইছে! তা যদি নাই হবে তাহলে জলঙ্গির মতো নদী যে নিজেই এখন দূষণের শিকার, যে নদীর বহু জায়গায় বিপুল কচুরিপানা ভাসছে সেই নদীর জলকে আরও দুটি নদীর জলের সঙ্গে গঙ্গার মতো একটা শক্তিশালী নদীর অপর পাড়ে পাইপ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাল্পনিক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার উদ্দেশ্য কী হতে পারে? উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হল চমক তৈরি করে মানুষকে বোকা বানিয়ে সমর্থন জোগাড় করা। ঠিক যেভাবে ভর সন্ধ্যাবেলায় আচমকা ওরা নাটকীয়ভাবে ভালো নোট বাতিল করে, হঠাৎ করে রাতারাতি প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে লকডাউন করে, করোনা তাড়াতে দেশব্যাপী থালা ঘন্টা কাসর বাজানোর নির্দেশ দেয়— কত আর বলা যায়? এই তালিকা যেমন দীর্ঘ তেমনই চমকপ্রদ! বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ও ক্ষমতাসীন বিজেপি দল খুব ভালো করেই জানে যে এই ধরনের  চমক বিশ্বাস করার লোকের অভাব ভারতে নেই। তাই বিজেপি নামক দলটা যে কোন অসুখের নিরাময়ে গোবর চোনার ব্যবহার থেকে গোরুর গলায় হাত বুলিয়ে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর দাওয়াই থেকে গোরুর দুধে সোনা পর্যন্ত খুঁজে পেতে পিছুপা হয় না!

 

ভুল বকতে ট্যাক্স নেই!!

এরিক ফন্ দানিকেনও ভাজপা নামক দলটির কল্পনার সঙ্গে দৌড়ে বহু যোজন পিছনে থাকবেন। এমনিতেই অলীক চমক বা অত্যাশ্চর্য ঘটনার প্রতি সাধারণ মানুষ এমনকি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত মানুষও অমোঘ আকর্ষণ বোধ করে থাকে। ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের অসংখ্য শিক্ষক থেকে বিজ্ঞানীরা নিজেরাও গড্ডলিকা প্রবাহে সামিল হন, বেশিরভাগ শিক্ষক ও বিজ্ঞানীরা এসব দেখেও চোখ সরিয়ে মৌন থাকেন। আর যে মুষ্টিমেয় জনেরা প্রতিবাদ করেন সেই সংখ্যালঘুদের প্রতিবাদের স্বর ও চিত্র সংখ্যাগুরুদের সম্মিলিত চিৎকারে তলিয়ে যায়।

আজ ওরা ভোট কুড়নোর জন্য নদীপ্রবাহকেও নিজেদের ইস্তাহারের অন্যতম প্রতিশ্রুতিতে সামিল করে কয়েকটি জেলার মানুষকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, গঙ্গার গতিপথের বাঁদিকে অবস্থিত উত্তরবঙ্গে তিস্তা তোর্সা মহানন্দা জলঢাকা রায়ডাক (১ ও ২)-এর মতো শক্তিশালী নদীগুলোসহ আরও কিছু নদী রয়েছে। আর সেই সমস্ত নদীই উত্তরের উঁচু অবস্থান থেকে দক্ষিণের নিম্ন অভিমুখে বয়ে চলে। তৎসত্ত্বেও গঙ্গার গতিপথের ডানদিকের তিনটে নদী, যেগুলো নিজেরাও দক্ষিণবঙ্গে গঙ্গার শাখানদী (distributary), তাদের জল গঙ্গার মতো বড় ও শক্তিশালী নদী পেরিয়ে উত্তরবঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেচব্যবস্থা গড়ে তোলার মতো উর্বর পরিকল্পনার পশ্চাতে অন্য কোন গভীর ষড়যন্ত্রমূলক উদ্দেশ্য থাকাও অসম্ভব নয়।

তাছাড়াও, মানুষ এখন ক্রমশ ঠেকে শিখে বুঝতে পেরেছে যে বৃহৎ নদ-নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীশাসন করে নিজেদের সমস্যা দূর করা তো দূর বরং নিজেদের বিপদ আরও বৃদ্ধি করেছে! অতীতে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দু-একজন বিশেষজ্ঞ বাঁধ দেওয়ার বিষয়ে যে মত পোষণ করতেন আজ অনেক অনেক বিশেষজ্ঞ সেই মত শুধু পোষণই যে করেন তা নয়, সেই মতের স্বপক্ষে আন্দোলনও করেন। ভাগীরথী ও হুগলি নদীতে পলি পড়ার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নাব্যতা বৃদ্ধি করে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর জন্য ফরাক্কা বাঁধের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর শেষ হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন প্রধান বাস্তুকার শ্রীকপিল ভট্টাচার্য সেই প্রকল্পের বিরোধিতা করে সুনির্দিষ্ট মত উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, গঙ্গা ও ভাগীরথীর প্রবাহরেখার তারতম্যের কারণে স্বাভাবিক জল সঞ্চালনের সমস্যা হবে ও তার ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখার জন্য অন্য পথ খুঁজবে। ফলে মালদহ আর মুর্শিদাবাদ জেলা দুটিতে জলবদ্ধতা দেখা দেবে।

গঙ্গা নদী একটি কম গতিসম্পন্ন নদী হওয়ায় এই নদীর গতিপথ আঁকাবাঁকা (meandering), এমন নদীর একটি বাঁক থেকে পরবর্তী বাঁকের দূরত্বকে বলা হয় meandering curve বা বাঁক আর একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে যে কটি বাঁক থাকে তাকে meander frequency বলে। শ্রীযুক্ত ভট্টাচার্য, বলেছিলেন ফিডার খাল বা মৃতপ্রায় হুগলি-ভাগীরথীর মধ্যে দিয়ে হঠাৎ করে বিপুল জলরাশি (৪০,০০০ কিউসেক) প্রবাহিত করলে উজানে বিহার পর্যন্ত অন্য সব নদীর meander frequency-র ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে আর তার ফলে ওই নদীগুলোতে জলবদ্ধতা, নদী-ভাঙন ও চর সৃষ্টি ত্বরান্বিত হবে। বস্তুত ফরাক্কা বাঁধ তৈরির পর থেকে কপিলবাবু উল্লেখিত ঘটনাগুলো বিরামহীনভাবে পরিলক্ষিত হয়েই চলেছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নীতীশ কুমার থেকে সমাজকর্মী শ্রীমতী মেধা পাটেকরসহ আরও অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ফরাক্কা বাঁধটি উপড়ে ফেলার দাবি জানিয়ে আসছেন। প্রয়োজনে রেললাইন ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বজায় রেখেও তা করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এমন শতাধিক বাঁধ ইতোমধ্যেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফরাক্কা বাঁধ ভাগীরথী ও হুগলি নদীর নাব্যতা এমনই কমিয়েছে যে কলকাতা বন্দর চালু রাখার জন্য আগের তুলনায় দ্বিগুণ ড্রেজিং করতে হয় যা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ, উপরন্তু বিহারের বন্যার দায় তো আছেই। এমতাবস্থায় ভারতীয় জনতা দলের ইস্তাহারে জলঙ্গি ভৈরব আর সিয়ালমারী নদী তিনটির জল উত্তরবঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেখানে সেচ ব্যবস্থা করার বিষয়টি উল্লেখ করার আগে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে কী? এমন অর্বাচীন প্রকল্প কার্যকর হলে ইংরেজ রাজত্ব থেকে স্বাধীনতালাভের পরেও এখনও পর্যন্ত বঞ্চিত ও অবহেলিত পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যটির বিস্তৃত অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য লঙ্ঘিত হবে না তো?

আপাতত ভরসা একটাই; আর তা হল পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি দলটির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাটিও শিয়ালমারি নদীর জলস্তরের নাব্যতার সঙ্গেই একমাত্র তুলনীয়। সম্প্রতি (১৫ এপ্রিল ২০২১) জানা গেল, বিজেপি তাদের অনলাইন ইস্তাহারে উত্তরবঙ্গ শব্দটি মুছে দিয়েছে। বাকি সব এক থাকায় এখন সমস্যা দাঁড়িয়েছে, দক্ষিণবঙ্গের মাত্র তিনটি— তাও আবার দুটোই খুব ছোট ও বর্ষাকালীন (একটা আবার মানচিত্রেও আসে না)— নদী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বা দক্ষিণবঙ্গের সেচ পরিকল্পনার অর্থ কী? পাগলা দাশু থাকলে অবশ্য এই প্রশ্নে খেপে গিয়ে বলত: পদ্মকুলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত কোন কাজ বা কথারই বা অর্থ আছে, অ্যাঁ, শুনি?

 

তথ্যসূত্র

  1. www.telegraphindia.com23.03.2021
  2. The Telegraph, 23.03.2021
  3. Wikipedia
  4. www.murshidabadzp.in
  5. m.jagranjosh.com

 

কৃতজ্ঞতা

  1. বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক তাত্ত্বিক তথা সক্রিয় সমাজকর্মী অশোক মুখোপাধ্যায়
  2. ভূগোল শিক্ষিকা অর্থিতা গাঙ্গুলী দাশগুপ্ত
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4885 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...