ডানা

উন্মেষ মিত্র

 

দূর্বাদলবাবুর ইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই শখ ছিল একটা ডানা কিনবেন। তখন বিদেশের বাজারে সবে ডানা এসেছে। ইস্কুলবেলাতে দূর্বাদলবাবুর নানান ধরনের দেশি বিদেশি বিজ্ঞান পত্র-পত্রিকা পড়ার নেশা ছিল। কলেজ স্ট্রিট থেকে কেনা একটা পত্রিকায় প্রথম দেখেছিলেন ডানার ছবি, বিদেশের লোকজন কেমন ডানা পরে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, লন্ডনের আকাশে একদল ডানা পরিহিত মানুষ হাসিমুখে পোজ দিচ্ছে, এরকমই একটা সাদা-কালো ছবি ছাপা হয়েছিল ওই পত্রিকার পাতায়। সেদিনই দূর্বাদলবাবু ঠিক করে ফেলেছিলেন একটা ডানা কিনবেন। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই মানুষ সব কিছু করতে পারে না। যেমন দূর্বাদলবাবুর ইচ্ছে ছিল কলেজের প্রফেসর হবেন, একটা বিদেশি কুকুর পুষবেন, তিন মাসে একবার পাহাড়ে ঘুরতে যাবেন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শুরুর আগের দিন দূর্বাদলবাবুর বাবা ধর্মতলার কাছে বাসে চাপা পড়ে মারা গেলেন। প্রফেসরের চেয়ারে বসার বদলে দূর্বাদলবাবু লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক-এর চাকরি নিলেন। আর কী ই বা তিনি করতে পারতেন, বাড়ির বড় ছেলে, দুই বোন, এক ছোট ভাই। বিদেশি কুকুরের বদলে সকালে প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী হল রোডেশিয়ানরা আর ঘুরতে যাওয়া বলতে লিলুয়ায় ছোটপিসির বাড়ি, বছরে একবার তারাপীঠ।

তবু কিছু মানুষ ভয়ঙ্কর ধরনের জেদী হন, হাজার হেরে যাওয়া, হাজার প্রতিকূলতার মাঝে সস্নেহে লালন করেন কিছু স্বপ্ন। ভারতে ডানা প্রথম আসে দিল্লিতে, স্বাভাবিকভাবেই সাধারণের কেনা প্রায় অসাধ্য ছিল। তারপর কলকাতায় চাঁদনী চকের একটা দোকানে প্রথম ডানা বিক্রি শুরু হয়। দূর্বাদলবাবু মাঝেসাঝেই অফিস থেকে ফেরার পথে সেই দোকানের পাশ দিয়ে ঘুরে বাড়ি ফিরতেন। আকাশছোঁয়া দাম সে ডানার! পেটমোটা বড়লোকদেরই সামর্থ্য আছে সেসব কেনার, ডানা লাগিয়ে আকাশে উড়তে উড়তে ফেসবুকে ডিপি দেওয়ার সে কী ঢং! অফিস যাওয়ার সময় দূর্বাদলবাবু যখন পাদানিতে ঝুলতেন তখনই বাসের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেত একদল ছেলেমেয়ে, দূর্বাদলবাবু হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেন। সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে পার্কে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন দূর্বাদলবাবু, হঠাৎ মাথার ওপর এসে পড়ল একগাদা পানের  পিক, আকাশে তাকিয়ে দেখেন ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ডানা পরিহিত নব্য বড়লোক আর তার সঙ্গীসাথীরা। সভ্যতা নেই, ভদ্রতা নেই, চিটফান্ডের কাঁচা টাকায় খুব উড়ছে! আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত-পা তুলে কাঁচা খিস্তি দিয়েছিলেন দূর্বাদলবাবু, পরদিনই অবশ্য পাড়ার কাউন্সিলর এসে বাপ-মা তুলে ভদ্র হয়ে থাকার শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিল। এসব দেখে শুনে মাঝে মাঝে গা জ্বালা করত দূর্বাদলবাবুর। অবশেষে সিদ্ধান্তটা তিনি নিয়েই ফেললেন, ব্যাঙ্কে জমানো সব টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে এক শনিবার অফিস থেকে ফেরার পথে চাঁদনীর নতুন দোকানটা থেকে পছন্দ করে জীবনের সর্বস্ব সঞ্চয় দিয়ে নীল রঙের একটা ডানা কিনেই ফেললেন।

রবিবার সাধারণত একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠেন দূর্বাদলবাবু, কিন্তু আজ উত্তেজনায় ভোরের আলো না ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল। বলা ভালো সারারাত তাঁর ঘুমই হয়নি। রাতে খুব গোপনে বাক্সবন্দী করে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরেছেন দূর্বাদলবাবু, তাঁর মত ছাপোষা লোক ডানা কিনেছে শুনলে রাস্তাঘাটে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে, তারপর দূর্বাদলবাবু একা মানুষ, শহরে চুরি-ডাকাতির উপদ্রব যা বেড়েছে তাতে জানাজানি হয়ে গেলে বাড়িতে ডানা রেখে অফিসে যাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। উত্তেজনায় দুপুরের খাবারও ঠিকমত খেতে পারলেন না। আজ সেই বহুপ্রতীক্ষিত দিন, যে দিনের স্বপ্ন দূর্বাদলবাবু এত বছর ধরে লালন করে এসেছেন। মাঝে মাঝেই বাক্সটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখছেন, মাঝে মাঝে গায়ে চিমটি কেটে পরখ করছেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো– গাঢ় নীল রঙের ডানা, অদ্ভুত একটা গন্ধ তার গায়ে, হ্যাঁ দূর্বাদল দাস আজ রাতে এই ডানা গায়ে আকাশে উড়বেন।

দূর্বাদলবাবু এখন ইডেন গার্ডেনস-এর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছেন, নিচে যেন সবুজ মখমলের গালিচা। আহা, উপর থেকে এই কলকাতা শহর কী অদ্ভুত মায়াময়! কিছুক্ষণ আগে ভিক্টোরিয়ার পরীর ডানা ছুঁয়ে ফেলার দূরত্ব দিয়ে উড়ে গেছেন। হাওড়া ব্রীজের ওপর দিয়ে তিন চক্কর দিলেন। গঙ্গার ওপরের আকাশে প্রেম করছে একজোড়া ছেলেমেয়ে, মেয়েটিকে কোথায় যেন দেখেছেন দূর্বাদলবাবু, টিভিতে হবে বোধহয়। বাঁক ঘুরে উড়ে চললেন দক্ষিণ কলকাতার দিকে। এখন দূর্বাদলবাবু বেশ নীচ দিয়েই উড়ছেন, শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে, আসলে প্রথম আকাশে ওড়া তো। কোন বাড়ির ছাদে একটু বিশ্রাম করা যায় সে কথা ভাবছেন এমন সময় কানে এল চিৎকারটা। দূর্বাদলবাবু সজাগ হলেন। খানিকটা হাওয়ায় শরীরটা ভাসিয়ে উড়ে চললেন উপরের দিকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে খানিকক্ষণ বাদে চোখে পড়ল দৃশ্যটা। একজন, হ্যাঁ একটি মেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটে চলেছে গলিপথে বেয়ে আর দু’টো গলি পাশেই যেন ধাওয়া করছে দু’টো মোটর বাইক। ব্যাপারটা বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় লাগল না দূর্বাদলবাবুর। মেয়েটি গলির এক কোণে লুকিয়ে পড়েছে, ওদিকে ক্ষুধার্ত হায়নার মতো চক্কর কেটে যাচ্ছে মোটরবাইক দু’টো। দূর্বাদলবাবু রোগাপটকা মানুষ, কীভাবে লড়বেন এক দঙ্গল রক্তের গন্ধ পাওয়া পিশাচের সাথে? কিন্তু মেয়েটা? মেয়েটাকে ফেলে কীভাবে যাবেন? পুলিশ ডাকবেন? এত রাস্তা ঘুরলেন হাতে গোনা দু-একজন পুলিশ দেখতে পেয়েছেন, কলকাতাকে সুরক্ষিত শহর ঘোষণা করে মাননীয়া যে ডানাওয়ালা পুলিশ নিয়োগের কথা বলেছিলেন, কই তারা? কয়েক সেকেন্ড গ্লাইড করে ঝড়ের বেগে নীচের দিকে নামতে লাগলেন দূর্বাদলবাবু, নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেন মেয়েটির সামনে। দূর্বাদলবাবুকে আচমকা দেখে মেয়েটি কেমন শিউরে উঠল। “আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ, প্লিজ…।” দূর্বাদলবাবু অবাক হলেন, তারপর মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছিলেন নির্যাতিত একটি মেয়ের মনে পুরুষ মাত্রই নির্যাতক– এই ধারণা গেঁথে বসে। ধীরে ধীরে দূর্বাদলবাবু এগিয়ে গেলেন মেয়েটির সামনে। মেয়েটি দুই হাত জোড় করে সমানে কাকুতি মিনতি করে যাচ্ছে তখনও, ধীরে ধীরে নিজের শরীর থেকে ডানাটা খুলে এগিয়ে দিলেন মেয়েটির সামনে।

দূর্বাদলবাবুকে সেদিন রাতে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছিল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...