নীপবীথি ভৌমিক
এই সময় এদিকটা ভীষণ একটা অন্যরকম পরিবেশ। এইমাত্র বেশ খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গেল, তবে আজ দিন তিনেক হল আকাশের মুখ থুবড়ে পড়েছে যেন। কাজের বাড়ির বৌদিরা বলছে খবরে নাকি বলেছে বঙ্গোপসাগরের উপর প্রবল নিম্নচাপ। অথচ, এই বঙ্গোপসাগরটা যে কোথায় তা আজও মাথায় ঢুকল না মিনার। মাঝে মাঝে ভাবে এই বাংলার উত্তরে, কখনও বা মনে হয় ঊই দক্ষিণ দিকের কোনও এক জায়গায়! কেন যে মাসিমার কথাটা শোনেনি মিনা, আজ হাড়ে হাড়ে টের পায় সে।
কনুই-এর নিচের কালশিটেটা এখন আর শত চেষ্টা করেও লুকানো যাচ্ছে না। মিত্রবাড়ির বৌদি গেল ঠাণ্ডায় যে লম্বা হাতের ব্লাউজখানা দিয়েছিল, এই ভরা জ্যৈষ্ঠতে মিনা সেইখানা পরে রান্না করতে আসে বাবুদের বাড়িতে। কিন্তু হাতা খুন্তি তেল মশলা আর ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে মাঝেমাঝেই এই কালো রক্ত জমা দাগখানা বেরিয়ে আসে। এই তো সেদিন শর্বরীদিদির বাড়িতে, একঘর লোকজন, দিদির স্কুলের অন্য দিদিমণিরা যেদিন এসেছিল…।
শর্বরীদিদি বোঝে সব, একটা স্কুলে ভর্তি করে দিতেও চেয়েছিল সে। এই পাড়াতেই, দিদির বাড়ির কাছেই। ভালোই হত, মাতাল স্বামীও টের পেত না, আবার বাবুদের বাড়ির রান্নার কাজ সেরে ওর মতো মেয়েমানুষগুলোর সাথে লেখাপড়াটাও শেখা হয়ে যেত। কিন্তু পেটের ছেলেখানা যে ঘরে একা! বছর দেড়েক হবে হয়তো, ওদেরকে কি কেউ বয়স বলতে পারে! হাতের মাপেই ওদের বয়স! এখনই কত বোঝে এরা, আর ভালোবেসে বিয়ে করা বরটা! মিনার নজর চলে যায় ঘোষবাড়ির রান্না ঘরের লাগোয়া বারান্দার বেসিনের আয়নার দিকে। গতবারের মারের দাগটা বেশ জ্বলজ্বল করছে।
মাসিমার বাড়ির ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে ওর হঠাৎই চোখে পড়ে যায় পাশে নতুন বিল্ডিংটায় জলের লাইন করতে আসা মিস্ত্রি নলিনীর। সেইখান থেকেই ওদের প্রেমের শুরু। তারপর ধীরে ধীরে ভালোবাসা। বাসস্ট্যাণ্ডের ওপারে যে বস্তিটা সবে জমতে শুরু করেছে, কাজের খোঁজে ওপার বাংলা থেকে আসা নলিনীরা সেখানেই থাকে। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে ডাক্তার মাসিমার হাতে গড়ে পিঠে ওঠা মিনা যে মাত্র বারোটা বসন্ত পার করতে না করতেই এভাবে পালিয়ে চলে যাবে নলিনীর হাত ধরে, বৃদ্ধা মাসিমাও মনে হয় ঘুণাক্ষরে টের পাননি। ভালো ইস্কুলে ভর্তি করেছিলেন ওর মাসিমা, নিজের একমাত্র ছেলের বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা দিয়ে বৃদ্ধা মাসিমা মিনাকে নিজের সন্তানের মতোই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। নলিনীর কথাও জানতেন মাসিমা, ইচ্ছা ছিল মিনা অন্তত একটা পাশ দিলেই চারহাত এক করে দেবেন।
ভাঙা ঝুপড়ির মধ্যে এখন শুধু আতঙ্কের ছায়া, কোলের ছেলেটাও কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে! আজকাল বুকের দুধও শুকিয়ে গেছে ভাতের থালা থেকেও বেশি পাওয়া স্বামীর মারের চোটে। শর্বরীদিদির দেওয়া পুরনো মোবাইল ফোনে চোখ রেখে দ্যাখে প্রায় রাত বারোটার কাছাকাছি। শেষ ট্রেনের প্যাসেঞ্জার নামিয়ে কিছুক্ষণের ভিতরেই ফিরে আসবে আকণ্ঠ মদ গিলে ওর বর নলিনী। না, না এখন আর রাতগুলো স্বামীর আদরের অপেক্ষায় থাকে না– মিনার তেল মশলা, ঝালে পোড়া ক্লান্ত শরীরের প্রতিটি অংশ বরং অপেক্ষা করে নলিনীর নখের আঁচড়ানো, কামড়ানোর, আর তা মেটাতে না পারলেই অশ্রাব্য গালি এবং মারধর। মিনা ভাবে– কী যেন নাম বলছিল মিত্রবাড়ির বৌদি? রেপ! হা, হা, হা।
–উঁহু, আমরা তো সব ছোটলোকের জাত, পেটে কালির জলও নেই, বাবুর বাড়ির লেখাপড়া জানা স্বামীগুলোও যদি মাতাল হয়ে বউদের শরীর নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলতে পারে…
মিনার চোখে ভেসে ওঠে শর্বরী দিদিমণির হাত, পিঠ, কোমরের কাছে রক্ত-জমা দাগগুলো, দিদির মিষ্টি হাসির আড়ালে ঢাকা চোখের জলের নিচে।