সৌমিত্র দস্তিদার
গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, তথ্যচিত্রনির্মাতা
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন যত এগোচ্ছে, ততই এলোমেলো কিছু কথা মনে আসে। এই যেমন কদিন ধরেই মনে হচ্ছে এবারের সিপিএম-বিরোধী শিবিরের অত্যন্ত গুরুতর এক প্রচার হচ্ছে যে সিপিএমের আনঅফিশিয়াল পার্টি লাইন হচ্ছে যে একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম। সোজাসুজি বললে সিপিএম চায় এবার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় বিজেপি আসুক। তৃণমূল যাক। পরে বিজেপির সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে সিপিএম ফের জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসবে। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও প্রবীন সিপিএম নেতা বিমান বসুর ধারণা যে গোটা বিষয়টি বিজেপির আইটি সেলের মস্তিষ্কপ্রসূত। তারা বিরোধী শিবিরকে বিভ্রান্ত করতে এই মিথ্যেটি ছড়িয়েছে। এবং সিপিএম সম্পর্কে যাদের তীব্র বিদ্বেষ, তারা গুজবটি লুফে নিয়ে তার সঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে খবরটি জনমনে চারিয়ে দিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে।
বিমান বসু যাই বলুন, যা রটে কিছু তো একটা বটেই। শুধু শুধু সবাই, এমনকি বিহার নির্বাচনে সিপিএমের জোটসঙ্গী ভাকপা-মালেও যখন একই অভিযোগ করছে, তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন নাও হতে পারে। বিশেষ করে এর আগে যখন সিপিএমের ভোট সাত শতাংশে নেমে গেছিল তখন সন্দেহ হতেই পারে দলের নীতি যাই হোক না কেন, সাধারণ কর্মীদের বড় অংশ পদ্মফুলে ছাপ দিয়েছে। যদি এই অভিযোগের আংশিকও সত্যি হয় তাহলে অবশ্যই এই প্রশ্ন উঠবে— কেন এই অধঃপতন একটা বামপন্থী দলের!
সোজাসুজি এর তিনটে উত্তর হতে পারে। যেহেতু তৃণমূল তাদের মৌরসিপাট্টা কেড়ে নিয়েছে, ফলে জ্ঞাতিশত্রু ওই দলটিই তাদের প্রধান বিপক্ষ— এটা ভেবে নিয়ে ‘শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র’ এই আপ্তবাক্য মেনে দলে দলে বিজেপি সমর্থনে ভোট দেওয়া। এই মনোবৃত্তি যে সিপিএমের সাধারণ স্তরে যে একদম নেই তা বলা যাবে না। কিন্তু এটাই সর্বত্রই হচ্ছে এরকম সরলীকরণ করাও বোধহয় ঠিক হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলি, যতটুকু খবর পাচ্ছি বিধাননগর বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী সুজিত বসুকে হারাতে সিপিএমের অনেকেই এবার বিজেপির সব্যসাচী দত্তকে ভোট দিয়েছে। পাশের বিধানসভা কেন্দ্র দমদমের ছবিটা কিন্তু অন্য। সেখানে যে যাই বলুক পলাশ দাশ কিন্তু মোটের ওপর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন পেয়েছেন।
কসবা ও অন্যান্য অনেক বিধানসভায় সংযুক্ত মোর্চা যেখানে তরুণ ও শক্তিশালী প্রার্থী দিয়েছেন, সেসব জায়গায় এবার মনে হয় না বামেদের ভোট রামে গেছে। ‘নো ভোট টু বিজেপি’ যারা বলছেন তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবটা হয় ঠিকঠাক বুঝছেন না অথবা অন্ধ তৃণমূল আরাধনা তাদের তৃণমূলের ফ্যাসিস্টসুলভ আচরণকে আড়াল করে দিয়ে প্রশান্ত কিশোরের মস্তিষ্কপ্রসূত এই ভুল বার্তা— তৃণমূলই একমাত্র পারে ফ্যাসিবাদকে আটকাতে— সেই প্রচারকে শক্তিশালী করছে।
ঘটনাচক্রে এবার দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগনার একাধিক জায়গায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে যেটুকু যা বুঝেছি তাতে এখন মনে হয় ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র পাশাপাশি স্লোগান তোলা দরকার ছিল ‘নো ভোট টু তৃণমূল’ও। একটা ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আটকাবার জন্য দরকার গণতান্ত্রিক পরিসর। সব্যসাচী ফ্যাসিস্ট, অন্যদিকে সুজিত গণতন্ত্রের পূজারী বা সওকত মোল্লা জিতলে গণতন্ত্র জিতবে— এরকম হাস্যকর ভাবনাচিন্তা কোনও সঠিক রাজনৈতিক তত্ত্ব নয়। বরং মরণাপন্ন রোগীকে অক্সিজেন না দিয়ে কোয়াক চিকিৎসা করার মত অপরিণত চিন্তা।
বরং আমি বলব চূড়ান্ত বাইনারি, হয় তৃণমূল নয় বিজেপি, এই বিভ্রান্তির মধ্যে এবার কিন্তু জনগণের একটা অংশ সংযুক্ত মোর্চার দিকে কিছুটা হলেও ঝুঁকেছে। গ্রামে গ্রামে তৃণমূলের অত্যাচার কতটা ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট চেহারা নিয়েছিল তা কলকাতায় বসে কল্পনা করাও কঠিন। ফলে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে প্রাণ বাঁচাতে নিজের নিজের মতো করে বিকল্প খুঁজবেন তা ক্ষেত্রবিশেষে আপত্তিকর মনে হলেও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ধরে নিন, একটা বিধানসভায় এক হাজার ভোটের মধ্যে পুরোটাই ভাগ হয়ে গেল তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। আপনি ভাবছেন আপনার নো ভোট টু বিজেপি প্রচারে প্রভাবিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক তৃণমূলকে ভোট দিয়ে ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে অন্তত এবারের মতো আটকে দিল, বাস্তব কিন্তু তা বলছে না। হিলির সীমান্ত অঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামেও বিরাট সংখ্যক মানুষ বিজেপির দিকে ঝুঁকছে এটা বাস্তব। সেখানে দিমিত্রভ তত্ত্ব কোনও কাজে আসছে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটা বিরাট অংশ এবার একদম আনকোরা নতুন আব্বাস সিদ্দিকীর দল আইএসএফ-কে পছন্দ করছে এর পিছনে সমীকরণটা শুধু আব্বাস সিদ্দিকীর নামে গালমন্দ করলে বোঝা যাবে না।
সিপিএম-এর গণভিত্তি গত কয়েক বছরে বদলে গেছে এটা ঠিক। গ্রামীণ সর্বহারা বা শহরের গরিব শ্রমজীবী মানুষের পরিবর্তে দলের শ্রেণিভিত্তি অনেকাংশে মধ্যবিত্ত, গ্রামের স্কুলমাস্টার, কলেজ অধ্যাপক, সরকারি চাকুরে নির্ভর হয়েছে। ফলে সুবিধেবাদী ঝোঁক কিছু কিছু এলাকায় পার্টিকে গ্রাস করেছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের অবস্থা যা তার সঙ্গে অনেকাংশে মিল আছে বিহারের ভাকপা-মালের। জহর দত্ত, বিনোদ মিশ্রের সময় পার্টির শ্রেণিভিত্তি ছিল গরিবস্য গরিব কাহার, কোচোয়ান, ধোবি, নাই, দর্জি ইত্যাদি সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ। জহর দত্ত ও বিনোদ মিশ্রের প্রথম দিকের ডেরাই ছিল ভোজপুরের আরায়। দর্জি মহল্লা অব্যয়পুরায়। পার্টি এখান ত্থেকেই শক্তিশালী হয়েছে। আরার ছোট্ট পার্টি অফিস আস্তে আস্তে বড় হয়েছে। সেই সঙ্গে পার্টির শ্রেণিভিত্তি অনেক বদলে গেছে। একদা যে অতি পিছড়ে বর্গের মানুষ সিপিআই-এমএল লিবারেশনের অগ্রণী বাহিনি, তাদের সরিয়ে নেতৃত্বে এখন উঠে এসেছে মধ্যমবর্গ যাদব, কুর্মি, এমনকি ভূমিহারেরাও। ফলে এই প্যারাডাইম শিফট-এর অভিযোগ শুধু সিপিএমের ক্ষেত্রেই খাটে না। অন্যান্য বামপন্থী দলের ক্ষেত্রেও একই জিনিস প্রযোজ্য। উনিশশো সাতানব্বই সালে জেএনইউ-এর তুখোড় ছাত্রনেতা চন্দ্রশেখর সিওয়ানে খুন হয়েছিলেন আরজেডির সাহাবুদ্দিনের হাতে। সেই দলের সঙ্গেও কিন্তু সমঝোতা করতে পরবর্তী সময়ে অসুবিধে হয়নি মালের। একবার মালে বিহার বিধানসভায় বিপুল আসন জিতেছিল। এক সপ্তাহ বাদেই তাদের বড় অংশ রাতারাতি লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলে চলে গেছিলেন। ৯২ সালে অযোধ্যার রামমন্দির ইস্যু যখন বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির পালে হাওয়া দিচ্ছে তখনও খোদ ফৈজাবাদ কেন্দ্রে জিতেছিলেন সিপিআই-এর মিত্র সেন যাদব। পরে দল বদলে চলে গেলেন মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টিতে। কিন্তু তাও বলব না যে মালের লড়াই সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কিছু কম গুরুত্বের বা দলটা আদ্যন্ত সুবিধেভোগী। আসলে সামগ্রিকভাবে সারা ভারতেই বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে নানা টানাপোড়েন চলছে। এই সময় স্রেফ একটা দলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কুৎসা না করে আত্মসমালোচনাও জরুরি ছিল। দরকার ছিল নতুন রাজনৈতিক ডিসকোর্সের খোঁজ করা। বামপন্থী সব দলই বছরের পর বছর ধরে তাদের নীতি, কর্মসূচিতে রাষ্ট্রীয় চরিত্র কৃষি পরিস্থিতি নিয়ে যে মূল্যায়ন করে আসছে তা একুশ শতকের পরিবর্তিত পৃথিবীতেও একই থেকে যাবে কিনা তা নিয়েও সব দলের মধ্যেই বিতর্ক ওঠা দরকার। শুধু ও খুব খারাপ আর আমরা একেবারে লেনিনের কপি করে বিপ্লব আনব— এসব আত্মম্ভরিতা বড় হাস্যকর। এ কোনও সিরিয়াস রাজনীতি নয়, পরস্পরের প্রতি কাদাছোড়াছুড়ি।
সিপিএমের যে অংশের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে খেয়াল করে দেখবেন অধিকাংশই দেশভাগের পর পুববাংলা থেকে চলে এসেছে বা আসতে বাধ্য হয়েছে। মুসলিম সমর্থকদের একজনও সাধারণভাবে বিজেপিকে ভোট দেবেন না। কলোনির সিপিএম যে ইস্যুতে যাচ্ছে, শুনতে খারাপ লাগলেও তা হল দেশভাগ। তারা বংশপরম্পরায় সত্যিমিথ্যে মিশিয়ে ওপারের মুসলিম অত্যাচারের কাহিনি শুনে বড় হয়েছে। এর দায় কি শুধুই সিপিএমের? সব বামপন্থী দলের মধ্যেই আমাদের দেশভাগ নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের তত্ত্বের কাছাকাছি ধারণা বদ্ধমূল। ওই ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাব, জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব, দেশভাগ হয়ে গেল ধর্মের কারণে। এই চেনা পাঠের বাইরে গিয়ে কোনও বাম দল সংগঠিতভাবে ঠিক কী কী নতুন চিন্তা সাধারণ তরুণ প্রজন্মকে শুনিয়েছেন তা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। বরং অধিকাংশ প্রগতিশীল মহলই দুই মৌলবাদই সমান বিপদ এই বুলি আউড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মৌলবাদকে আড়াল করে ইসলামোফোবিয়াকে সুকৌশলে জনমনে চারিয়ে দিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে।
এবার রাম পরে বাম— এই যদি নীতি হয় তবে তা কোনও নির্দিষ্ট একটি দলের অ্যাজেন্ডা নয়। হিন্দু বাঙালি সমাজের বড় অংশের গোপনে লালিত মুসলিম বিদ্বেষের পরিণাম। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে গরিব মানুষের হাতে বিজেপির টাকা জোগানের রাজনীতির নিশ্চিত ভূমিকা আছে। সিপিএম যদি গণআন্দোলনের পথ ছেড়ে কাঁটা দিতে কাঁটা তোলার শর্টকাট বেছে নেয়, তাহলে তা চূড়ান্ত সুবিধাবাদ ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি তৃণমূল যদি সামান্য গণতন্ত্রের চর্চাও করত, তাহলে তাদের দালান এভাবে এত সহজে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ত না। বিজেপি জিতুক বা না জিতুক, গণতন্ত্রের চর্চা আজ সবচেয়ে জরুরি।
সিপিএম-এর নিন্দে হচ্ছে হোক, কিন্তু তারাই একমাত্র বামপন্থী দল যারা এবার অসংখ্য তরুণ মুখকে সংসদীয় লড়াইয়ে সামনের সারিতে এনে জানান দিয়েছে তারাও অচলায়তন ভাঙার পথে চলতে চায়। এই একঝাঁক তরুণদের সম্বন্ধে অন্য বামেরা কুর্নিশ করা দূরে থাক, এক লাইনও প্রশংসা করেনি। যারা সহি বিপ্লবী বলে দাবি করেন তাদের এই রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতাও বড্ড চোখে লাগে। এই সঙ্কীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে খেটেখাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষায় একজোট হতেই হবে। আওয়াজ উঠুক আগামীর বঙ্গে গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাম ঐক্য বিকশিত হোক।