সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
গদ্যকার, নাট্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
“উত্তরকূট পার্বত্য প্রদেশ। সেখানকার উত্তরে ভৈরব মন্দিরে যাইবার পথ। দূরে আকাশে একটা অভ্রভেদী লৌহযন্ত্রের মাথা দেখা যাইতেছে…। পথের পার্শ্বে আমবাগানে রাজা রণজিতের শিবির… তাঁহার সভার যন্ত্ররাজ বিভূতি বহু বৎসরের চেষ্টায় লৌহযন্ত্রের বাঁধ তুলিয়া মুক্তধারা ঝর্ণাকে বাঁধিয়াছেন। এই অসামান্য কীর্তিকে পুরস্কৃত করিবার উপলক্ষ্যে উত্তরকূটের সমস্ত লোক ভৈরব মন্দির প্রাঙ্গণে উৎসব করিতে চলিয়াছে।”
১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মুক্তধারা’ নাটক রচনা করলেন। দ্রুত বিকাশশীল যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে এই নাটক ছিল রবীন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। এই নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে নদীকে বেঁধে ফেলার ঘটনা আর তা নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত। প্রকৃতির উপাদানকে এভাবে নিজেদের স্বার্থে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করার প্রচেষ্টাকে তিনি কোনওভাবেই মেনে নিতে পারেননি। এমন অযাচিত খবরদারির ফলে প্রকৃতিদেবী রুষ্ট হন। প্রকৃতির অভিশাপ নেমে আসে মানুষের ওপর। প্রকৃতির সঙ্গে সংঘাত নয়, প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানই হল সুস্থভাবে বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠতম উপায়। তাই পথিক যন্ত্ররাজ বিভূতির ‘করিশমা’ দেখে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে— “বাবা রে! ওটাকে অসুরের মাথার মতো দেখাচ্ছে। মাংস নেই, চোয়াল ঝোলা… ওটা এমনতরো সূর্যতারার সামনে মেলে রাখবার জিনিস নয়।”
অথচ একালে এমনটাই দস্তুর। নিজেদের নির্মাণমহিমা সম্প্রচার করতে সবকিছুকেই ঢাউস চেহারা দিতেই হবে, তা সে ‘মূর্তি’ হোক বা নদীশাসনের নামে নির্মিত বাঁধ। উত্তরাখণ্ডের বাঁধভাঙা সাম্প্রতিক বিপর্যয় অনেক অনেক কঠিন প্রশ্নের সামনে বোধহয় দাঁড় করিয়ে দিল। বিষয়টা নিয়ে আলোচনার পরিসর সুবিস্তৃত, তবে আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা নদীশাসনের নানান প্রয়াস ও তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিষয়েই আলোচনাকে পরিমিত রাখব।
নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
এক চিরন্তন প্রশ্ন। গিরিশের জটায় আটকে থাকা জল গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসে নিচে, সাগরের টানে। এই গড়ানো জলের প্রাকৃতিক ধারাই হল নদী। পথ চলতে চলতে এই জলধারাই পাথরের বুকে, মাটির ওপর খোদাই করে খাত, নিজের নাম। ওই নামেই তার পরিচিতি— প্রবাহপথের সবকিছুকে আপন করে নেওয়া। তাই আপন বেগে পাগলপারা নদীকে জড়িয়েই যুগে যুগে মানুষের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা, আবার তাকে নষ্ট করে ফেলাও!
নদী তথা বহমান জলের ধারা যে এক অমূল্য সম্পদ সে সত্য মানুষ বহু আগেই জানতে বা বুঝতে পেরেছিল। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার আদি পীঠভূমিগুলির দিকে নজর করলেই এমন সমঝোতার নানা স্মারক খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রকৃতির অংশ হওয়ায় নদীকে সেই আদি নিয়ম বা অনুশাসনগুলিকে মেনে চলতে হয়— বর্ষায় জল বাড়লে নদীতেও বাড়ে জলের জোগান, গ্রীষ্মে জলের জোগান কমলে বর্ষার সেই কূলপ্লাবী নদীই হয়ে ওঠে ক্ষীণতোয়া শান্তপ্রবাহী। কখনও কখনও সমতলের নদীখাত উপচে জল উঠে এসেছে কূলে, নদীপাড়ের মানুষ বিস্মিত বিব্রত বিপর্যস্ত হয়েছে সাময়িকভাবে। আবার জল নেমে যেতেই নদীর ফেলে যাওয়া পলির বুকে বুনেছে নতুন স্বপ্নের বীজ— অফুরান ফসলের পসরায় ভরে উঠেছে তার রসদের ভাণ্ডার। নদীর সঙ্গে মানুষের এক ছন্দোময়, সুখী যাপন। পাহাড়ে থেকে নেমে আসা জলের প্রাকৃতিক ধারার সুরের সঙ্গে নিজেদের জীবনের সুরকে মিলিয়ে নিয়ে পরম সুখেই হয়তো দিন কাটছিল মানুষের, নদীর গতি আগলে নিজেদের পরাক্রম জাহির করার কথা তারা সেভাবে ভাবেইনি হয়তো। ‘শিবতরাইয়ের প্রজারা তাই বিশ্বাস করতেই পারে না যে দেবতারা তাদের যে জল দিয়েছেন কোনও মানুষ তা বন্ধ করতে পারে।’ কিন্তু মানুষ কবে নিজের সীমায় নিজেকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে? আর তাই…
এসো, কিছু করে দেখাই…
এমন মানসিকতার বহুল প্রসার শুরু হল যন্ত্রসভ্যতার পত্তনের পর থেকে। ‘বালি-পাথর-জলের ষড়যন্ত্র ভেদ করে মানুষের বুদ্ধি হবে জয়ী এই ছিল উদ্দেশ্য। … যন্ত্রের জোরে দেবতার পদ নিজেই নেব— এই কথা প্রমাণের তাগিদ যেন বড় হয়ে উঠল মানুষের কাছে।’ শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে পশ্চিমে উঠল উন্নয়নের প্রবল ঝড়। যন্ত্রকে হাতিয়ার করে প্রাকৃতিক সম্পদ করায়ত্ত করার লড়াই যত তীব্র হয়েছে ততই মানুষ নিজেকে প্রকৃতির চেনা পরিসর থেকে সরিয়ে, দূরে আরও দূরে নিয়ে গিয়েছে। খরতোয়া নদীকে কংক্রিটের বাঁধনে বেঁধে ফেলে, তার জলের সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভেবেছে মানুষ। সেই বিদ্যুতে চলেছে যন্ত্র— বেড়েছে উৎপাদন— তাল মিলিয়ে বেড়েছে পণ্য, পসরা, বিপণন, মুনাফা। ঝাঁ-চকচকে হয়ে উঠেছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা, উন্নতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছে, পত্তন করেছে ‘অ্যানথ্রোপোসিন’ নামের নয়া যুগের। আর এসবের বিনিময়ে মানুষ ভেঙেছে প্রকৃতি ও মানুষের চিরন্তন সহাবস্থানের নীতিকে। ফল হিসেবে তার জীবন থেকে ক্রমশই হারিয়ে গিয়েছে— ছোটি সি পঞ্ছি, মিষ্টি ফুলের সুবাস, তিরিতিরি ছন্দে বয়ে যাওয়া ঝিরিঝিরি ঝোরা, পাহাড়িয়া ছোট গাঁওয়ের ছোট ঝোপড়ি, মানুষের ছোট ছোট স্বপ্ন, ছোট ছোট পেয়ার ভালোবাসা।
পশ্চিমের সেই ঝড় এসে ঢুকে পড়েছে আমাদের ঘরে। পাহাড়-নদী-বন-জঙ্গল-মাটি-সাগর দাপিয়ে এখন তার অবাধ গতি। সর্বস্তরেই আজ বিকাশের বৈষয়িক ছাপের সিলমোহর পড়েছে। খাড়া হিমালয়ের বুক বেয়ে নেমে আসা সমস্ত জলধারাকেই আজ বেঁধে ফেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা চলছে দিকে দিকে। যে রাজ্যের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের প্রসঙ্গে এত কথার কথকতা সেই উত্তরাখণ্ডের পাহাড় পরিবেশকে তছনছ করে ছোট-বড়-মাঝারি নানান মাপের ৭০টিরও বেশি নদীবাঁধ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রূপায়ণের কাজ চলছে এই মুহূর্তে। ‘খন্তা-কোদাল হাতে মাটি-পাথরের সঙ্গে পালোয়ানি’ শুরু হয়েছে হিমালয়েও সর্বত্র— এদেশে ও আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে। এমনটা যে মোটেও বুদ্ধিমানের মত কাজ হচ্ছে না তা আমরা বুঝব কবে? যতই আকাশছোঁয়া তার বিস্তার হোক না কেন, হিমালয় আদতে একটি অতি দুর্বল পীঠভূমি। সেখানে এমন আস্ফালন… উন্নয়নের দাপাদাপি!
খাড়া হিমালয়… দুর্বল হৃদয়
ভারতের উত্তর সীমায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়— পর্বতকুলের এক নবীন প্রতিনিধি। গঠনশৈলীর বিচারে এই পর্বতশ্রেণি ভঙ্গিল গোত্রীয়, অর্থাৎ প্রবল আনুভূমিক ভূ-আলোড়নের ফলে নমনীয় পাললিক শিলায় ভাঁজ পড়ে পর্বতশ্রেণির উত্থান টার্শিয়ারি যুগে। বিজ্ঞানীরা রসিকতা করে বলেন— একেবারেই সেদিনের উঠতি ছোকরা। এহেন ‘উঠতি ছোকরা’ এই মুহূর্তে আলোচনার একদম কেন্দ্রবিন্দুতে। উপলক্ষটি আর অজানা নয়। অতএব এমন একটা সুবিশাল, সুবিস্তৃত পর্বতশ্রেণিকে কেন ভঙ্গুর, সংবেদনশীল বলা হচ্ছে তার কারণগুলো একটু অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
হিমালয় পর্বতমালা উত্তর থেকে দক্ষিণে তিনটি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণি নিয়ে গঠিত। একদম উত্তরে সর্বোচ্চ অংশ বা হিমাদ্রি, মাঝখানে মধ্য হিমালয় এবং সর্বদক্ষিণে অবহিমালয় বা শিবালিক হিমালয়। দক্ষিণের এই পর্বতশ্রেণির সীমানা বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত রয়েছে প্রধান ‘সীমান্ত চ্যুতিরেখা’টি। বলা বাহুল্য এই সক্রিয় চ্যুতিরেখার অবস্থানের কারণেই হিমালয় পর্বত অত্যন্ত ভূকম্পপ্রবণ, ভূতাত্ত্বিকভাবে অতিসংবেদনশীল, দুর্বল। ভূবিজ্ঞানীদের মতে আজ থেকে ২০-২২ মিলিয়ন বছর আগে এই চ্যুতিরেখাটির সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই সময় থেকেই ক্রমাগত এই অঞ্চলে ঠোকাঠুকির পর্ব জারি রয়েছে। এই সীমান্ত চ্যুতির দক্ষিণাংশে রয়েছে ভারতীয় পাত এবং উত্তরাংশে সুবৃহৎ ইউরেশীয় পাত। এই দুই অভিসারী পাতের আনুভূমিক চলনের ফলেই অতীতে হিমালয় পর্বতের সৃষ্টি। পাত-চলনের ফলে সীমান্ত বরাবর প্রবল পীড়নের সৃষ্টি হয়, শিলাস্তরগুলো আরও সংবেদী হয়ে ওঠে— সৃষ্টি হয় প্রবল মাত্রার ভূকম্পন। এমনই এক অঞ্চলে, যেখানে পর্বত গঠনের কাজ এখনও চলছে, সেখানে নদীবাঁধ নির্মাণ কতখানি যুক্তিসঙ্গত? এমন কথা যে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিজ্ঞানীরা বলছেন এমনটা কিন্তু মোটেই নয়। যেদিন থেকে হিমালয় পর্বতকে নিয়ে এমন সব অদূরদর্শী পরিকল্পনার ছক কষতে শুরু করেছে সরকার, তার অনেক অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানীমহলে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি!
বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আরও নতুন নতুন তথ্য। যা এই অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তকে রীতিমত প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কুমায়ুন অঞ্চলে কালী নদীর ওপর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের যৌক্তিকতা যাচাই করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেন, ওই অঞ্চলে অসংখ্য সক্রিয় চ্যুতিরেখা রয়েছে যেগুলো খুব বড় মাপের ভূমিকম্পের কারণ হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতে। তেমনটা হলে সমস্ত তথাকথিত উন্নয়নমুখী প্রকল্পের কী হাল হবে তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। রাঙ্গুনখোলা চ্যুতিরেখা বরাবর শিলাস্খলন হতে পারে যেকোনও সময়, কম্পাঙ্কের মাত্রা ছুঁতে পারে ৭.৪ (রিখটার)। সে ক্ষেত্রে পরিণতির বিষয় কথা বলার সাহস পাই না।
নদীশাসন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং…
হিমালয় অফুরান জলবিদ্যুৎ শক্তির উৎস। স্বাভাবিকভাবেই উত্তরাখণ্ডের মত এক পার্বত্য রাজ্যে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনাও যে প্রতুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত কয়েক দশকে চোখধাঁধানো উন্নয়নকে হাতিয়ার করে এই অঞ্চলে বেড়েছে মানুষের গতায়াত, বেড়েছে হোটেল, রিসর্ট, ব্যবসায়িক কেন্দ্র ইত্যাদি। এই সমস্ত কারণে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। মসনদে আসীন সরকারের কাছে, বাঁধ দিয়ে নদীর জল আটকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করাই একমাত্র সমাধান বলে মনে হচ্ছে। আর তাই কালী, দারমা, গোরী, ধোলী, অলকানন্দা, মন্দাকিনী, ভাগীরথী— সমস্ত নদীতেই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যেগুলো সবই গড়ে উঠছে প্রধান সীমান্ত চ্যুতিরেখা অঞ্চলে। এই অঞ্চলে ভূমিকম্প একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। অথচ এখানেই জোরকদমে চলছে নদী বাঁধার কাজ। অবশ্য এত হইচই, গেল গেল রবের মধ্যেও বাঁধ নির্মাণকারী সংস্থাগুলো চুপ করে বসে নেই। তাদের মতে যেভাবে বাঁধের নির্মাণ চলছে, তা সমস্তরকম বিপর্যয়কে এড়িয়ে যেতে পারবে। তাই এ বিষয় অনাবশ্যক আশঙ্কার কিছু নেই।
চামোলির সাম্প্রতিক ঘটনা আমাদের গভীর শঙ্কায় শঙ্কিত করেছে। তেহরিতে যে সুবিশাল নদীবাঁধ নির্মিত হয়েছে তাকে নিয়েও জাগছে শঙ্কা। বিপর্যয়ের আতঙ্কে জলাধার থেকে জল ছেড়ে দেওয়া আবার তা ভর্তি করার মতো ঘটনা বাঁধসংলগ্ন অঞ্চলে শিলাস্তরের উপর চাপের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে বারংবার। এর ফলেও শিলা ভাঙছে, বাড়ছে ভয়, আশঙ্কা।
পাশাপাশি একথাও মাথায় রাখতে হবে যে পশ্চিম হিমালয়ের যে অংশে উত্তরাখণ্ড রাজ্যটি অবস্থিত সে অংশটি ভারতের অত্যন্ত ভূমিধস-প্রবণ অঞ্চল হিসেবেও পরিচিত। অতি-সক্রিয় প্রাকৃতিক শক্তিগুলির কার্যকারণ প্রভাবে এই অঞ্চলের শিলারাশি বেশ দুর্বল ও নমনীয় হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ক্রমাগত বাড়ছে উন্নয়নমুখী অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপ— সড়ক নির্মাণ, খনিজ উত্তোলন, আবাসন নির্মাণ, ইত্যাদি। পর্বতকে ভেঙেচুরেই নির্বিবাদে এইসব কাজ চলছে। ফলে উৎপন্ন হচ্ছে বিপুল পরিমাণে শিথিল অবস্কর, পাথুরে জঞ্জাল। বৃষ্টির জলের স্পর্শে পর্বতঢাল পিচ্ছিল হয়ে উঠলেই সৃষ্টি হচ্ছে প্রবল ধস, বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন, অবস্করের আকস্মিক পতনে হচ্ছে জীবনহানি, বিনষ্ট হচ্ছে জনগণের অর্থে নির্মিত নানান প্রকল্প। সমস্যার শিকড় এতটাই গহীন যে আগামী দিনে গোপেশ্বর, যোশীমঠ, বদ্রীনাথের মত জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলো বিপন্ন হতে পারে প্রবল ভূমিধসের কারণে। বাদ যাবে না চিপকো আন্দোলনের ভরকেন্দ্র চামোলি।
এই দুর্বল সংস্থানিক ভিত্তিভূমিতে কিছু নির্মাণ করা যে খুব সহজ নয়, বাঞ্ছনীয় নয় তা প্রতি পদে উপলব্ধি করছে নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদার সংস্থাগুলিও। দীর্ঘ সুড়ঙ্গ খুঁড়ে নদীর জলকে ভিন্নপথে চালিত করার যে প্রকৌশল, তাও বিপজ্জনক, অত্যন্ত ঝুঁকিবহুল। এই অঞ্চলের পর্বতমালার আভ্যন্তরীণ শিলাবিন্যাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা, জ্ঞান ছাড়াই নিজেদের খুশিমতো সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলে তার পরিণতিও যে মোটেই সুখকর হবে না তা বুঝব কবে?
প্রসঙ্গ: বিশ্ব-উষ্ণায়ন… বিপদের অন্যদিক?
পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। তাহলে সূর্যদেব কি আগের তুলনায় প্রখরতর হচ্ছেন? না, ঠিক তা নয়। আসলে মানুষের ‘চলো বদলাই’ মার্কা কাজকর্মের ফলে আবহমণ্ডলে প্রতিনিয়ত সংযোজিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ তাপ ধারণে সক্ষম উপাদানের, ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত তাপের একটা বড় অংশই আটকে পড়ছে পৃথিবীর আবহমণ্ডলে। আমরা এক উষ্ণতর পৃথিবীতে বাস করছি— বলা ভালো বসবাসে বাধ্য হচ্ছি। প্রত্যেক ক্রিয়ারই কিছু প্রতিক্রিয়া থাকে। এই উষ্ণায়নের ফলে হিমে ঢাকা হিমালয়েরও বড় রকমের পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন সংক্রান্ত গবেষণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা আইপিসিসি (Intergovernmental Panel on Climate Change – IPCC) পৃথিবীর জলভাগ ও বায়ুমণ্ডলে এই উষ্ণায়নের প্রক্রিয়া ঠিক কী প্রভাব ফেলতে চলেছে সে সম্পর্কে এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, এই উষ্ণায়নের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে চলেছে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে। কী হতে পারে এর ফলে? আইপিসিসির বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, উষ্ণতা বাড়লে বাড়বে হিমগলন প্রক্রিয়া, ফলে সুমিষ্ট পেয় জলের জোগানে ভারসাম্যের অভাব ঘটার পাশাপাশি বাড়বে বন্যা, হিমধস এবং প্রবল ভূ-স্খলন বা ভূমিপাতের ঘটনা। মৌসুমী বর্ষার চরিত্রে পরিবর্তন ঘটলে এমনই সব বিপর্যয়ের মাত্রা আগামী দিনে অনেকটাই বেড়ে যাবে।
২০১৩ সালের ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের কথা একটু স্মরণ করা যাক এই অবসরে। খুব অল্পসময়ের মেঘভাঙা বৃষ্টির দাপটে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল নদীশাসনের জন্য নির্মিত কংক্রিটের সীমানাপ্রাচীর। আর তারপর সেই নিয়মভাঙা নদীজল প্রবল ভূমিধস ঘটিয়ে, ‘চোরাবারি’ গ্রাব বাঁধের বাধা সরিয়ে, হ্রদ-উপচানো জলের প্রবল আঘাতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল দেবধাম কেদারনাথকে। মন্দির কোনওরকমে রক্ষা পেলেও বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু আজও আমাদের স্মৃতিকে তাড়িয়ে ফেরে।
সাম্প্রতিক অতীতের এমনই সব ঘটনা ভাঁজ ফেলেছে আবহবিজ্ঞানী তথা পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের কপালে। বিশ্ব উষ্ণায়নের দরুন ভারতের গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ুর ওপরও গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে চলেছে। আবহবিজ্ঞানীদের আশঙ্কিত অনুমান বৃষ্টিপাতের অনিয়মিতির দরুন হয়তো আরও ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। বৃষ্টি বাড়লে পাহাড়ি নদীগুলি বয়ে নিয়ে আসবে আরও আরও বালি, পাথর; আগ্রাসী জলধারার আঘাতে ভাঙবে প্রবাহপথের সমস্ত অপ্রাকৃতিক বাধা; কমবে টিকে থাকা নদীবাঁধের আয়ুষ্কাল; ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হবে লাগামছাড়া। জলস্রোতের দাপটে পার্বত্য ঢালের গঠন ও স্থিতিতে ঘটবে ব্যাপক পরিবর্তন, ফলে বাড়বে বিপর্যয়। সেই বিপর্যয়ের চেহারা-চরিত্র কেমন হবে তা এই মুহূর্তে অনুমান করাও কঠিন। উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহগুলো ক্রমশই পিছু হটছে। এই পিছু হটার ফলে হিমালয় হারাচ্ছে তার অপরূপ নান্দনিক সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক শোভা। মানুষের সাংস্কৃতিক যাপন, পরম্পরা, কৃষ্টিতেও লাগছে এমন বিপন্নতার ছোঁয়া। হিমালয়কে উপলক্ষ করে গড়ে ওঠা পর্যটনশিল্প বিপন্ন হলে ধাক্কা খাবে এই অঞ্চলের অর্থনীতি। পরিবর্তন আসবে স্থানীয় কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাতেও। এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের আশঙ্কায় নিজেদের বিপন্ন করে উত্তরাখণ্ডের মানুষ কী পাবে— বিপর্যস্ত মানুষের বুকফাটা হাহাকার আর উদ্বেগাকুল ভবিষ্যৎ!! আমরা কি নাকের বদলে নরুন পাওয়াতেই ক্রমশ অভ্যস্ত হচ্ছি?
উপসংহার
নদীশাসন তথা হিমালয়বাসীর বিকাশের নামে আমরা সত্যি সত্যিই কোন মোক্ষলাভ করতে চলেছি তা জানা নেই। সরকারের তরফ থেকে ঠারেঠোরে বলা হচ্ছে এসবই হল আন্দোলনজীবীদের অপপ্রচার। যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেই এমন সব প্রকল্প রূপায়ণের কাজ চলছে। এসব করে উন্নয়নের গতি রোধ করা যাবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে জলবিদ্যুতের অবস্থান নিয়েও আজ নানারকম প্রশ্ন উঠছে সারা বিশ্ব জুড়ে। জলবিদ্যুৎকে বলা হয় ‘শ্বেত কয়লা’— বহমান শক্তির উৎস। আমাদের ছাত্রপাঠ্য বইগুলিতে লেখা থাকে— ‘জলবিদ্যুৎ একটি পরিশুদ্ধ শক্তি-উৎস, এটি সস্তা, এবং পরিবেশের কোনও ক্ষতি করে না।’ এমন তথ্য নিয়ে ছেলেপিলেরা প্রশ্ন করে না। আসলে আমরাই ওদের প্রশ্নমুখী করি না। কিন্তু উত্তরাখণ্ড তথা হিমালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনা হয়তো আমাদের ধারণার অসারতা প্রমাণ করে দিয়ে গেল চরম প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। বহমান শক্তি-উৎসের সন্ধানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রয়াস আমাদের খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বারংবার। তবু আমরা সেই অলীক মায়ামৃগের পেছনেই ছুটে চলেছি। শেষ করবো বিখ্যাত নদীবিদ প্যাট্রিক ম্যাককুলির একটি মন্তব্য দিয়ে— “নদীবাঁধ নির্মাণের ফলে বহু মানুষ নন, উপকৃত হন তিন শ্রেণির লোক— রাজনৈতিক নেতা, কিছু উচ্চপদস্থ আমলা, আর ঠিকাদাররা।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।