ধুম লেগেছে হৃৎকমলে…

পার্থজিৎ চন্দ

 




কবি, গদ্যকার

 

 

 

 

আধুনিক ‘প্রাগৈতিহাসিক’ অরণ্যে যেন কিছুটা ভুল করেই এসে পড়েছেন এক মানুষ। অথবা কোনও ভাঙা-জাহাজের নাবিক, আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন এমন এক দ্বীপে যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝকঝকে স্টিলের বাঘ-নখ পরা মানুষের দল। চারদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, চারদিকে উৎসবের আলো। সার্কাসের তাঁবু থেকে, সে দ্বীপের শহরের পানশালা থেকে ভেসে আসছে সাইকেডেলিক আলো, রক্তমাখা গানের স্রোত।

এসবের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন যে ‘ভুল-মানুষ’ তিনি বারবার ঝুঁকে পড়ছেন গভীর কুয়োর দিকে, নিজের সত্তার দিকে। চেয়ে দেখবার চেষ্টা করছেন তার শুদ্ধতাটুকু। গূঢ় অভিসন্ধিময় আধুনিকতার আরবান-জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আত্মপ্রশ্নের এই আকুতি তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ ও পাথেয়।

এ প্রসঙ্গে, তাঁর এই সত্তার শুদ্ধতার দিকে তাকানোর সময় মনে পড়তে বাধ্য কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের এক পর্যবেক্ষণ। অলোকরঞ্জন লিখছেন, ‘কবি মুক্তি চান, পৌর পরিচয়ের অতিনির্ধারিত সঙ্কীর্ণতা থেকে, লোকায়তের বিশাল-বিদিত সংজ্ঞা থেকে বৃহত্তর নিসর্গের নির্জনে। তাঁর অভিপ্রেত নয় এই গোপনতাটুকু রাষ্ট্রের হয়ে যায়।’

আধুনিকতার যে সঙ্কট ব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করে চলে, যেখান থেকে অনেক সময় তৈরি এক সংঘর্ষময় পরিস্থিতির এবং যার থেকে জন্ম নেয় অ্যনার্কিজম— শঙ্খ সেই সঙ্কটের একমাত্রিক প্রকাশ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে পেরেছিলেন একদম প্রথম থেকেই। মননের মধু ও আত্মদীপের অপার্থিব শিখা তাঁর মধ্যে জন্ম দিয়েছিল এমন সুউচ্চ দর্শনের ভিত্তি যে তিনি তাঁর নিজের চারদিকে তৈরি করতে পেরেছিলেন এক বর্ম। এই বর্মের আবরণ সরিয়ে তিনি তাকিয়ে ছিলেন চারপাশের পৃথিবীর দিকে। তিনি ক্রিটিক্যাল’ও অনেক সময়েই, কিন্তু অ্যনার্কিজমের পথ তাঁকে গ্রহণ করতে হয়নি কোনও দিন। বাহির ও অন্দরমহলের দিকে তাঁর যাতায়াত ছিল একই রকম সহজ ও সাবলীল।

সময়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আত্মধংসের উপাদান ও সিসিফাসের ভবিতব্য নিয়ে বেঁচে থাকাকে অনুধাবন করলেন তিনি। সমাজ-কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তির ভিন্নস্বর যে ঘাতক হয়ে উঠছে, হরিণের মাংসের মতো তাঁর এই অবস্থান যে তাঁকেই হত্যা করতে উদ্যত হবে একদিন এ বিষয়ে তিনি সংশয়হীন। কিন্তু সমস্ত শ্রান্তি অবসাদ ও বিষাদের পরও তিনি তাকিয়ে রইলেন এক জলের ইশারার দিকে। এই জলের ইশারা ‘জীবনানন্দীয় মরীচিকা’ হয়ে উঠল না শঙ্খর কাছে, বরং এ ইশারা অনেক বেশি রবীন্দ্রনাথের ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’র কাছাকাছি অবস্থান করা।

সামাজিক বনে নিজেকে আবিষ্কার করার পরও কীভাবে প্রধূমিত অন্তর্জগতকে বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করতে হয় সে গূঢ় পথের সন্ধান পেয়েছিলেন শঙ্খ। যাঁরা বলেন ও প্রচার করেন যে শঙ্খ আসলে ‘দুজন’— একজন সত্তার কাছে ও অপরজন সমাজের কাছে দায়বদ্ধ— তাঁরা ভুল বলেন। শঙ্খ ঘোষ আসলে এই দুটিই— একটি বীজের দুটি প্রণাক্ষের মতো। কোনও একটিকে বাদ দিয়ে তাঁর সমগ্রতাকে ছুঁতে পারা অসম্ভব।

শঙ্খ যে একজন দ্রষ্টা তা প্রমাণিত হয়ে গেছে একটি কাব্যগ্রন্থের হাত ধরে, তিন-দশকের মধ্যেই। এর মানে এই নয় যে শঙ্খর প্রজ্ঞা-মিশ্রিত অন্তর্দৃষ্টি ছিল না তার আগে। কিন্তু এই তিন-দশকের মধ্যে আরও বেশি করে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে শঙ্খ সমাজ ও সত্তার কাছে একইরকমভাবে দায়বদ্ধ। তাঁর ‘দেখা’র পরিধি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক ও যথাযথ হয়ে উঠছে।

১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল শঙ্খর ‘ধূম লেগেছে হৃৎকমলে’। ব্যক্তির সঙ্কট সমষ্টির আগ্রাসন ক্ষমতার আস্ফালন থেকে শুরু করে ‘পোস্ট-ট্রুথ’-এর পৃথিবী কী রকম হয়ে উঠবে তা যেন পূর্বানুমান করতে পেরেছিলেন শঙ্খ।

এই কাব্যগ্রন্থেই রয়েছে তাঁর ‘অন্ধবিলাপ’ নামে দীর্ঘ কবিতাটি, ক্ষমতা যে কীভাবে তার নিজের স্বপক্ষে যুক্তি নির্মাণ করে যায়, কীভাবে ‘অপযুক্তি’র আড়ালে সে নির্মাণ করে তার নিজের ভাষ্য তা ফুটে উঠেছে এই কবিতাটিতে। রাষ্ট্র যে ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রকাশ তা ক্রমশ উন্মোচন করে দিতে দিতে চলেছিলেন শঙ্খ—

তেমন তেমন তম্বি করলে বাঁচবে না একজনার পিঠও
জানিয়ে দিয়ো খুবই শক্ত বল্গাতে এই রাষ্ট্র ধৃত

অসম্ভবের কুলায় আমার পালক দিয়ে বুলিয়ে যাবে
সেই আশাতে ঘর বাঁধিনি, দুর্যোধনরা তৈরি আছে

ধৃতরাষ্ট্র ও সঞ্জয়ের মধ্যে কথোপকথনের ধারাটিকে আশ্রয় করে শঙ্খ তৈরি করেছিলেন এক মহাকাব্যিক প্রেক্ষাপট। তারপর সেই প্রেক্ষাপট জুড়ে তিনি বুনে দিয়ে চলেছিলেন ক্ষমতার চিত্র,

মারব না কি নির্ভূমিকে? নিরন্নকে? নিরস্ত্রকে?
অবশ্য কেউ মেরেছিল সেটাই বা কে প্রমাণ করে!

এমন আমার মনে পড়ে বেদব্যাস যা বলেছিলেন
সৈন্যে শস্ত্র ছুঁড়ছে তা নয়— কোষ থেকে তা আপনি ছোটে

দেখার বিষয়, গোটা কবিতাটিতে সঞ্জয় এক অদৃশ্য শ্রোতার ভূমিকা পালন করে চলেছে এবং ধৃতরাষ্ট্র তার ভাষ্য নির্মাণ করে চলেছেন। ‘তিনদিকে তিন দেয়াল ঘেরা’ গান্ধিমাঠে সাতান্ন রাউন্ড গুলি চলবার ফলে নিরস্ত্র মানুষের রক্তপাত জাস্টিফায়েড হয়ে উঠছে ধৃতরাষ্ট্রের ভাষ্যে।

এই ভাষ্য নির্মাণে ‘মিডিয়া’র ভূমিকা অসীম। শঙ্খ ‘খবর সাতাশে জুলাই’ কবিতা্য লিখলেন,

স্টার
সুপারস্টার
ধুম তাতা তাতা থৈ
কিশোরীর নাকি হাতটান ছিল হাতটান
গায়ে তাই ঢেলে দিয়েছে গরম জল

‘সংবাদ’, যা আসলে প্রতিদিন নির্মিত হয়ে চলেছে, প্রতি ক্ষণে নির্মিত হয়ে চলেছে তাকেই নগ্ন করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন শঙ্খ। এক অপরূপ juxtaposition, যা ক্রমাগত আরও বেশি বেশি করে ঢুকে পড়বে আমাদের অন্দরমহলে নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মিডিয়া-বাহিত হয়ে, তাকে নির্ভুলভাবে চিনতে পেরেছিলেন শঙ্খ। এই কবিতাটি সংবাদপত্রের শিরোনামকে আশ্রয় করে রচিত, শঙ্খ লিখেছিলেন,

দেখামাত্রই গুলি কারফিউ পশ্চিম দিল্লিতে
ভারত হারাল দক্ষিণ কোরিয়াকে

এখানে লক্ষ করার বিষয়, দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ও ভারতের দক্ষিণ কোরিয়াকে হারানোর সংবাদ দুটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই juxtaposition যা ক্রমশ ফিকে করে দিতে শুরু করবে ‘খবরের’ অভিঘাতকেই। এই কবিতাটির সামনে দাঁড়ালে আজ মনে হয় তিনিই তো ক্রান্তদর্শী যিনি এমন নির্ভুলভাবে দেখতে পারেন। যে গ্লোবালাইজেশন ও ড্রয়িং-রুম মিডিয়া-কালচার সারা পৃথিবীকে করে তুলবে অনুভূতিশূন্য মানুষের জীবন্ত কবরখানা তার স্বরূপ চিনতে পেরেছিলেন শঙ্খ।

ব্যক্তির অস্তিত্বের সঙ্কট ও ব্যক্তির দ্বিচারিতা শঙ্খর কবিতার অন্যতম এক উপাদান। সামাজিক পরিসর মুখ ও মুখোশের অনুসঙ্গ বারবার এসেছে তাঁর লেখায়। অভিসন্ধিময় আধুনিকতার এ এক অমোঘ কৌশল। আত্মপ্রতারণা করতে করতে ব্যক্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলে তার সত্তার বিশুদ্ধতা ও মেরুদণ্ড। শঙ্খ এই কাব্যগ্রন্থেরই ‘পোশাক’ কবিতায় লিখেছিলেন,

নাচগান চলছেই চারপাশে
মাঝে মাঝে হিজড়েরাও কোমর বাঁকিয়ে চলে যায়—

কতরকম কাঁকড়াবিছে, তোরণ,
আর অন্ধিসন্ধি

কথা হল, তু্মি ঠিক কেমনভাবে
তোমার মতো হবে।

শঙ্খর মৃদু-বঙ্কিম উচ্চারণ যে বহুমাত্রিকতায় ভরা সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এখানে তা আরও একবার প্রমাণিত, ব্যক্তি-মানুষের নিজের মতো করে ‘হয়ে ওঠার’ একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু শঙ্খ ‘তুমি ঠিক কেমনভাবে/ তোমার মতো হবে’ বলার মধ্যে দিয়ে যেন এক হাজারদুয়ারিকে চিহ্নিত করলেন। ‘ঠিক কেমনভাবে’ শব্দদুটি মুহূর্তে এক কুহক রচনা করল। এই শব্দদুটি বহুধাবিভক্ত গমনপন্থা অথবা ব্যক্তির হয়ে ওঠাকে নির্দেশ করছে। একদিকে ভেঙে পড়া মুকুরের ছায়া আর অন্য দিকে এককের সন্ধানে ‘হয়ে ওঠার’ প্রক্রিয়া।

কিন্তু যে কথা বলার, বহিরঙ্গের এই আলোড়িত পৃথিবীর থেকে দূরে, বহুদূরে অবস্থান করা এক ‘শঙ্খ’ রয়ে গেছেন। সে ‘শঙ্খ’ও সমান সত্য। জলের ইশারা ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর কবিতায়, সে ইশারা তাঁকে মেঘের মতো সজল করে তুলেছে দিনে দিনে।

যে শঙ্খ ‘অন্ধবিলাপ’-এর মতো রাজনৈতিক কবিতা লেখেন তিনি এই কাব্যগ্রন্থেই লিখেছিলেন ‘ভালোবাসা অর্ধেক স্থপতি’র মতো কবিতা,

যখন কোষগুলির মধ্যে চিৎকার শোনা যায় বলো তাহলে বলো এইবার কোন পথ

আর বাকি রইল অবাধ আস্তরণের সামনে

ঠিক তখনই স্বপ্নের চেয়েও মিথ্যে এই ভ্রষ্ট সচলতার দিকে তাকিয়ে আজ খুঁজে

বেড়াই অন্য আরও অর্ধেক, কেননা

ভালোবাসা অর্ধেক স্থপতি!

এই শঙ্খর কাছে, সত্তার খুব কাছে পড়ে রয়েছে এক অনন্ত কূপ ও তার ভিতর অবিরাম ঘুরে ঘুরে ঝরে পড়ছে হলুদপাতার সার। বালুতটকে আর্দ্র রাখতে বারবার আছড়ে পড়েছে ঢেউ, সে ঢেউ প্রেমের ও সজলতার,

অনেকদিন মেঘের সঙ্গে কথা বলোনি তাই এত শুকনো হয়ে আছ। এসো তোমার

মুখ মুছিয়ে দিই

সকলেই শিল্প খোঁজে রূপ খোঁজে আমাদের শিল্পরূপে কাজ নেই আমরা এখানে

বসে দু-একটি মুহূর্তের শস্যফলনের কথা বলি

শঙ্খ অনিবার্যভাবেই এক ভুল মানুষের অরণ্যে চলে এসেছিলেন, চলে এসেছিলেন এক ভয়ঙ্কর দ্বীপে। সেখানে হয়তো রাত্রি হলে বেরিয়ে পড়ে ক্যানিবালের দল। তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজের মতো এক বর্ম। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে বর্ম ‘একক’-এর, সঙ্ঘহীনতার বর্ম। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি নিজের পরিসরটুকু নির্মাণ করে নিতে পেরেছিলেন। বারবার এসে দাঁড়িয়েছিলেন অনন্ত বৃষ্টিধারা ও জলের কাছে।

হায়নার সমবেত উল্লাসের মধ্যে সত্তাকে আর্দ্র রাখবার এ তাঁর মৌলিক ও গূঢ় উদ্ভাবন।

এই প্রবণতা ও প্রক্রিয়া সারাজীবন লালন করে চলেছিলেন তিনি।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. এখনো বেঁকেচুরে স্বস্তিক নিজেকে প্রতিপাদ্য অস্থির চেষ্টায়,
    সময়ের সাথে সাথে আরামও বেশ বদলায়,
    কবিদের কথা কবিদের কথা থেকে সাদায় কালোয়,
    মানুষের ভিতরে খাদ কেটে বিবর বানায় – সে কবি –
    কিন্তু আসলে কথা ছিল ফুল ফোটানোর – ফুল ফোটানোর শুধু –
    এতো রক্ত কেন প্রস্তর যুগের কালে শেষ বার বলে !

আপনার মতামত...