সাগরিকা শূর
‘হিউমর’। শব্দটা শুনলেই প্রথম মাথায় আসে অপর একটি বহুল ব্যবহৃত ব্যঞ্জনা— ‘সেন্স অফ হিউমর’। যদিও উৎসের দিকে তাকালে দেখব এই ল্যাটিন শব্দটির অর্থ ‘ময়শ্চার’, যা রেনেসাঁকালে মূলত দেহের চারটি ভিন্নতর রস (রক্ত, শ্লেষ্মা, পীত পিত্ত ও কৃষ্ণবর্ণ পিত্ত)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত ‘হিউমর’কে বোঝাতে ব্যবহৃত হত। তারপর কালে কালে ‘হিউমর’-এর সংজ্ঞা অনেকাংশেই বদলেছে। দেহের রসতত্ত্ব ছাড়াও সাহিত্যেও রসতত্ত্বের একটি যোগ রয়েছে। ভারতীয় কাব্যশাস্ত্র অনুযায়ী যে নটি (মতান্তরে দশটি) রসকে মান্যতা দেওয়া হয়, হাস্যরস বা হিউমর তাদের মধ্যে অন্যতম। মোটামুটি অষ্টাদশ শতক থেকে সাহিত্য ক্ষেত্রে হাস্যরস বিষয়টিকে নন্দিত করতে ‘হিউমর’ শব্দের প্রয়োগ চোখে পড়ে এবং তারও অনেক রদবদল হয়ে আজকের ‘সেন্স অফ হিউমর’। যদিও বর্তমান প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে একথা বলাই যায় যে ‘হিউমর’-এর কোনও নির্দিষ্ট পরিসর নেই, জীবনের সবকিছুই হিউমর-এর আওতাভুক্ত হতে পারে।
কথায় আছে ‘দশচক্রে ভগবান ভূত হয়’, হিউমরের ক্ষেত্রেও একথা খাটে। তাই হিউমরও সেই গ্রিক সাহিত্যের চৌকাঠ পেরিয়ে শেক্ষপীর, ‘কমেডি অফ ম্যানারস’ কাটিয়ে আধুনিক যুগের এডওয়ার্ড লিয়ার-রোয়াল্ড ডাল-জেরম কে জেরম বা বঙ্কিম-সুকুমার-হুতোম-ত্রৈলোক্যনাথ-তারাপদ রায়-অচলপত্রের দীকুসা-পরশুরাম-শরৎ পণ্ডিত-শিবরামের চৌকাঠ ডিঙিয়ে আজকের চন্দ্রিল, হিমানীশ গোস্বামীর সহজাত হাস্যরস হয়ে এসে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায়। যেখানে ‘স্যাটায়ার’, ‘উইট’, ‘পান’, ‘আইরনি’, ‘ডার্ক হিউমর’, ‘লাইট হিউমর’— এসব না ভেবেই ‘সেন্স অফ হিউমর’-এর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন অনেকেই। এই লাইট হিউমর আর চটুল হাস্যরস পরিবেশন করে লাইমলাইটে থাকার বাসনাটা কিছু মানুষকে বেশ আসক্ত করে তুলেছে ইতিমধ্যেই, আজকের পরিভাষায় যারা অনেকেই ‘মিমার’, ‘ইউটিউবার’ বলে খ্যাত। বহুক্ষেত্রে ‘মিম’ বা ভিডিও কন্টেন্টে অনাবিল হাস্যরস, বুদ্ধিমত্তার হদিশ মিললেও কখনও কখনও তা একান্তই ব্লান্ট বা গোদা; কোনও কোনও ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক বা অমানবিকও বটে, কারণ মানুষকে হাসানোর জন্য নাকি ‘সব চলতা হ্যায়’। তবে এই আপাত-হিউমর কীভাবে পুরুষতন্ত্রের ভিত আরও মজুবত করে সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
প্রথমেই একটি ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। সম্প্রতি এক সদ্যোবিবাহিত বন্ধুর প্রি-ওয়েডিং শ্যুটের ছবিতে চোখে পড়ল। ছবিটা কিছুটা এরকম: বন্ধুটি ও তার হবু বর দুটি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ছবি তুলেছে এবং দুজনেই অপর জনের দিকে তর্জনী নির্দেশ করছে, দুজনের মুখই বেশ হাস্যোজ্জ্বল। এই অব্দি অবশ্যই কোনও সমস্যা নেই, ব্যক্তিগত বিষয়, করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন চলে আসে প্ল্যাকার্ডের লেখায়। ছেলেটির হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা, “My Cook” যা মেয়েটিকে নির্দেশ করে এবং মেয়েটির হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, “My ATM”, যা ছেলেটিকে নির্দেশ করে। এবার এই বিষয়টিকেও অনেকেরই আপাতভাবে খুব সাধারণ ‘হিউমর’ বলে মনে হবে, একটি তরল অথচ নিরীহ মজা। অনেকেই এই বিষয়টিকে “ব্যক্তিগত” বলেও আখ্যায়িত করবেন। কিন্তু নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের বিখ্যাত স্লোগানের প্রতিধ্বনি করেই বলা যায়, “Personal is Political” এবং ঠিক এখান থেকেই শুরু হয় পুরুষতন্ত্রের পাঠ।
কিছুদিন আগে ‘পিএলএফ’ বা ‘পিপলস লিটারারি ফেস্টিভ্যাল’-এ ‘সাহিত্যে কৃষি আন্দোলন’ শীর্ষক একটি আলোচনায় সাদিক হোসেন ফ্যাসিজমকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রাখেন, প্রশ্নটি ফ্যাসিজমের চরিত্র নিয়ে। তাঁর প্রশ্ন ফ্যাসিজম কি হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে, পিস্তল-বোমা-বারুদ নিয়ে পুলিশি কায়দায় আসে নাকি ফ্যাসিজম আসে সকলের অলক্ষ্যে, দৈনন্দিন ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে। ফ্যাসিজম সম্পর্কিত এই আলোচনা বিস্তারিত না করেও বলা যায় পুরুষতন্ত্রের ক্ষেত্রেও এই একই কথা খাটে এবং দিন-প্রতিদিনের ছোট ছোট ঘটনাই মূলত পুরুষতন্ত্রের পাঠ তৈরি করে দিয়ে যায়। ঠিক এই কারণেই প্রি-ওয়েডিং শ্যুটে অবলীলায় একটি মেয়েকে “My Cook” ও একটি ছেলেকে “My ATM” আখ্যায়িত করা যায়, শুধু তাই নয়, তার মধ্যে ‘সেন্স অফ হিউমর’ও খুঁজে পাওয়া যায়, কারণ এটাই পুরুষতন্ত্রের শেখানো লিঙ্গভূমিকা বা ‘gender role’. চারপাশে তাকালে এরকম উদাহরণ নিয়তই চোখে পড়বে।
এবার একটু বিপণণ জগতের দিকে তাকানো যাক। নারীর রূপ বা লাস্যকে ব্যবহার করে বিকিকিনি শতাব্দীপ্রাচীন, একবিংশ শতকের বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় নারী যে বিজ্ঞাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, মেল গেজকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে নারীকে বারংবারই ব্যবহার করা হয় এ নিয়ে জনমানসেও বিশেষ দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকা উচিত নয়, ক্যাটরিনা কাইফের হাস্কি গলায় ‘আমসূত্র’ থেকে ম্যানফোর্সের বিজ্ঞাপন, নারীর ভূমিকা সর্বত্রই। তবে শুধু যৌন আবেদন বা নারীর রূপমহিমাকে ব্যবহার করাই নয়, এক্ষেত্রেও চলে আসে সেন্স অফ হিউমরের প্রশ্ন। সম্প্রতি ওয়াইল্ড স্টোন ট্যাল্কের একটি বিজ্ঞাপন সম্প্রচারিত হচ্ছে, যাতে দেখানো হচ্ছে মেয়েদের ট্যাল্ক ব্যবহার করলে ছেলেরা কীভাবে মেয়েদের মতো আচরণ করতে শুরু করবে। ট্যাল্ক ব্যবহারের সঙ্গে যে আচরণবিধির সম্পর্ক নেই এটুকু বোঝার জন্য খুব গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, সেজন্যই এটি আপাত হাস্যরসের উদ্রেক করে, কিন্তু বাইরের হিউমরের খোলসটির ভেতর যে একটি সূক্ষ্ম পুরুষতন্ত্র ঢুকে আছে তা অনেকসময় চোখ এড়িয়ে যায়। লিঙ্গ অনুযায়ী ট্যাল্ক ব্যবহার করা দোষের নয়, অনেকেই তা করে থাকেন, প্রসাধনে ‘ইউনিসেক্স’ বিষয় কমই আছে; আপত্তি সেখানে নয়, আপত্তি মেয়েদের ট্যাল্ক ব্যবহার করলে “মেয়েদের মতো আচরণ”-এর প্রসঙ্গে, যা পরোক্ষভাবে বলে দেয় ঠিক কোন কোন আচরণ নারীসুলভ আর কোন কোন আচরণ পুরুষের সহজাত, অর্থাৎ ঘুরে ফিরে এই আচরণবিধি পুরুষতন্ত্রেরই হাত শক্ত করে।
আবার ফিরে আসা যাক বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়ায়, যা প্রায় নিয়তই আমাদের জীবনের অনুপুঙ্খ নির্দেশ করে চলেছে এবং এই ধরনের চটুল হাস্যরসের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডারই সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুক খুললেই চোখে পড়ে একাধিক সেক্সিস্ট জোক বা ভিডিও, হোয়াটস্যাপের ইনবক্স ভরে যায় বৌয়ের বাপেরবাড়ি যাওয়ায় স্বামীর দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার আহ্লাদ, ১০ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে নতুন সরকার গঠন হবে নাকি আগের সরকারই থাকবে তার উৎসুক প্রশ্ন কিংবা ম্যারেজ সার্টিফিকেটে এক্সপায়ারি ডেট থাকে না কেন এ নিয়ে তরল হাসাহাসি। সম্প্রতি এই ধরনের কিছু মিম নিয়ে ফেসবুক তোলপাড় হয়েছিল, এতদিনে হয়তো তা সকলেরই জানা। বাম প্রার্থী, দুই তরুণী, দীপসিতা ধর এবং মীনাক্ষী মুখার্জীকে নিয়ে প্রথমে একটি নিম্নরুচির মিম তৈরি হয়। যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য ছোট করে বর্ণনা দেওয়া যাক— মিমটি এরকম, “বাঙালি বাড়িতে যে সব মহিলাদের দেখা যায়”, এই শিরোনামের নিচে শ্রাবন্তী ও পায়েল সরকারের ছবি যাদেরকে “সেক্সি ননদ-বৌদি” বলা হয়েছে, ঠিক তার পাশেই মিমি চক্রবর্তী ও নুসরত জাহানের পাউট করা ছবি, যাদের “স্টাইলিশ দিদি-বোন” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, ঠিক তার নিচেই দীপসিতা ধর ও মীনাক্ষী মুখার্জীর ছবিতে “কাজের মাসি” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই মিম রাজনৈতিক ঈর্ষা বা অসূয়া থেকেই, কিন্তু যা সরাসরিভাবেই লিঙ্গ রাজনীতির প্রশ্নকে উস্কে দিয়ে যায়। তবে এই মিমের প্রসঙ্গ এখানেই শেষ নয়, উপরোক্ত মিমটি ভাইরাল হওয়ার এক থেকে দুদিনের মধ্যেই পূর্বোক্ত মিমের উত্তরে আরও দুটি মিম ভাইরাল হয়, যার প্রথমটিতে শ্রাবন্তী-পায়েলকে “পিএনপিসি করা, কোনও কাজে না লাগা বৌদি” বলা হয়েছে, মিমি-নুসরতকে বলা হয়েছে “টিকটক করা মামণি” এবং দীপসিতা-মীনাক্ষীর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে “অফিসে বা বাইরে রোদে চাকরি করে, বাড়িতে এসে সংসার সামলানো দুর্গা”, দ্বিতীয় মিমটার বয়ান কতকটা এরকম, যেখানে শ্রাবন্তী-পায়েলকে বলা হচ্ছে, “10th ফেল, সমাজের কোনও কাজে না লাগা, সুন্দরী টিকটক মামণি”, মিমি-নুসরতকে বলা হচ্ছে, “মুখে ১০ কেজি ময়দা মেখে সেই মুখ বাঁদরের মতো করে ছবি তোলা ঝিঙ্কু মামণি” এবং দীপসিতা ও মীনাক্ষীর পরিচয় দিয়ে বলা হচ্ছে, “MA, M.Phil and PhD in Population Studies at JNU (দীপসিতা), B.A., B.Ed (মীনাক্ষী মুখার্জী) করা লড়াকু সমাজসেবী”। বস্তুত, এই তিনটি মিমই সমমানের এবং তিনটি মিমই নিম্নরুচির। প্রথম মিমটি অবশ্যম্ভাবীভাবে আমাদের শ্রেণিগত দৈন্যকে চিহ্নিত করে, যে দৈন্য আমাদের তথাকথিত আপাত সুন্দরী নয় এমন কাউকে “কাজের মাসি” তকমা দিতে বাধ্য করে। পাশাপাশি “কাজের মাসি” শব্দটার মধ্যে যে তাচ্ছিল্য ও উপহাস আছে তাও শ্রেণিবৈষম্যের চূড়ান্ত ফলকেই নির্দেশ করে। পাশাপাশি “সেক্সি, স্টাইলিশ” এই শব্দগুলো আলাদাভাবে দেখলে বিশেষণ হলেও লিঙ্গরাজনীতির প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, কারণ পুরুষতন্ত্র নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে না দেখে রূপ, সৌন্দর্য্য বা যৌন আবেদনের প্রতিভূ হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। ঠিক যে কারণে একটি মেয়ের অন্য অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও আপাত অর্থে সুন্দরী না হলে তাকে ‘বিয়ে কীভাবে হবে’ ইত্যাদি প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করা হয়, ঠিক সেই একই কারণেই “কাজের মাসি” শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ এখানেও সেই মেল গেজকে সন্তুষ্ট করার প্রশ্ন চলে আসে। পরোক্ষভাবে পরের দুটি মিমও একই উদ্দেশ্য সাধন করে, অন্য কারও শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা বোঝাতে গিয়ে নারীসমাজের আর একটি অংশের প্রতি “টিকটক করা মামণি”, “মুখে ময়দা মেখে মুখ বাঁদরের মতো করে ছবি তোলা ঝিঙ্কু মামণি”, “কোনও কাজে না লাগা বৌদি” ইত্যাদি প্রভৃতি মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া হয়। তিনটি মিমই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের অবস্থানটা স্পষ্ট করে তোলে, একদিকে ‘কাজের মাসি’, অন্যদিকে ‘সেক্সি, স্টাইলিশ’, একদিকে শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সামাজিক কাজ, অন্যদিকে ‘পিএনপিসি’, ‘টিকটক’ এই দুই শ্রেণিতে দ্বিধাবিভক্ত করে এককে অন্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়, এবং সর্বোপরি এই তিনটি মিমই প্রমাণ করে যে নারী বস্তুত অবহেলা ও অসম্মানের প্রাপক, তা সে যে অবস্থানেরই হোক; শুধু তাই নয় পুরুষতন্ত্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এই মিম কালচারও এক নারীকে অন্য অন্য নারীর প্রতি তির্যক মন্তব্যে, অসম্মানজনক লঘু ‘হাস্যরস’-এ সামিল হতে বাধ্য করে, অর্থাৎ ‘Divide and rule’-এর মতো এখানেও নারীর হাত ধরেই পুরুষতন্ত্রের ভিত শক্ত হয়।
আলোচনা আর দীর্ঘায়িত না করেও বলা যায়, “পুলিশ কি হাতে চুড়ি পরে বসেছিল?”, “বৌ হারালে বৌ পাওয়া যায় রে পাগলা, মা হারালে মা পাওয়া যায় না” ইত্যাদি সুবিখ্যাত উক্তি কিংবা দৈনন্দিনের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতেও কিন্তু পুরুষতন্ত্র তার জায়গা করে নেয়, হিউমরের মতো একটা আপাত নিরীহ বিষয়ও তার ব্যতিক্রম নয়, তার ভেতরেও সুপ্ত থাকে পুরুষতন্ত্রের সূক্ষ্ম বীজ।
শুধুমাত্র নারী বা পুরুষ নয়, তৃতীয়লিঙ্গের মানুষ, ‘নারীসুলভ পুরুষ’ও যে প্রায়শই পুরুষতন্ত্রের উপহাসের শিকার চারপাশে তাকালে এমন উদাহরণ রাশি রাশি চোখে পড়বে৷ ‘ছক্কা’ ইত্যাদি সম্বোধন বাদ রেখেও দেখা যায় পুরুষতন্ত্র তাকে তার লিঙ্গনির্দিষ্ট আচরণবিধি মনে করিয়ে দিতে চাইছে প্রতিনিয়ত এবং সে কারণেই তার হাঁটা-চলা, কথা বলা কিংবা পরিধান সবকিছুই হয়ে উঠতে পারে ঠাট্টা-ইয়ার্কির খোরাক। এই প্রসঙ্গে ‘ঘোষ এন্ড কোম্পানি’ নামক অনুষ্ঠানে ঋতুপর্ণ ঘোষ ও মীরের কথোপকথন মনে পড়ে যায়, যেখানে ঋতুপর্ণ প্রশ্ন তোলেন ‘সেন্স অফ হিউমর’ নিয়ে বা বলা ভালো হিউমরের লেজিটেমেসি বা বৈধতা নিয়ে। ব্যক্তি ঋতুপর্ণ নিজেকে এই মিমিক্রি থেকে দূরে রেখেও কথা বলেন তাঁর কমিউনিটির পক্ষে, কারণ তাঁর মতে ঋতুপর্ণ ঘোষের ব্যক্তিগতভাবে কিছু না যায় আসলেও এই নকল আসলে আঘাত করে এই ধরনের প্রতিটি মানুষকে, প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় তাদের পরিচয়কে, তাদের স্বকীয়তাকে। এই প্রসঙ্গে আরও একটি অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়ে যান ঋতুপর্ণ— যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি নিয়ে তৈরি হওয়া ‘পান’ (pun), যা আসলে ঋতুপর্ণের মতে স্থূল অশ্লীলতাকেই নির্দেশ করে।
তাই হাসির মতো নিষ্পাপ, সরল, প্রাণবন্ত আর খুব দরকারি জিনিস আরও বেশি সংক্রামিত হোক, কিন্তু তার মধ্যেকার পুরুষতন্ত্র বা ‘মিসোজিনি’কে চিনতে আমরা যেন কখনও ভুল না করি। সবশেষে ‘ঘোষ এন্ড কোম্পানি’র সেই বিশেষ এপিসোডে ঋতুপর্ণ ঘোষের বলা শেষ কথাকটাই মনে করতে ইচ্ছে হয়, “আমরা যদি প্রগতিশীল একটা সমাজের কথা সত্যিই ভাবি, যে সমাজটা সবরকম মাইনরিটিকে এমব্রেস করতে পারে, সেই সমাজে মাইনরিটি বোধটা তৈরি না করতে দেওয়াই বোধহয় ভালো।”