চার নম্বর নিউজডেস্ক
অতিমারির কোপে পড়া বীভৎস এক ভারতবর্ষ। সংক্রমণ, পাল্টা সংক্রমণের জোয়ার। দ্বিতীয় তরঙ্গের রণমূর্তি। নির্বাচনী তথাকথিত ‘প্রয়োজনের’ তাগিদে ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে যাওয়া হিউম্যান লাইভ। পালকের মতো হালকা। গুরুত্বহীন…
অক্সিজেন সঙ্কট। দ্বিতীয় তরঙ্গের অসম্ভব বেশি ফেটালিটি রেটের প্রধান কারণ। সিলিন্ডারের বেআইনি মজুত, সরকারি অব্যবস্থা একধরনের মাস-হাইপোক্সিয়ায় ডুবিয়ে রাখছে প্রজন্মকে। শেষ কোথায়?
এসবের মাঝেই অন্য কিছু গল্প। শ্বাসবায়ু মজুত না, বিতরণের গল্প। সুলভে বা বিনামূল্যে, অসম্ভব দ্রুততায়, প্রয়োজনের সময় ঠিক পৌঁছে দেওয়া পরশপাথরের খোঁজ। আর পেছনে কাজ করা কিছু আলো-মুখ। দিশারী…
মহারাষ্ট্রের শেহনেওয়াজ হোসেন এবং আব্বাস রিজভি। আব্বাসের কাছের এক বোন কোভিডে ভুগে জাস্ট কিছু অক্সিজেন সময়মতো পেল না। অকালে চলে গেল মেয়েটি। প্রাণোচ্ছ্বল। আব্বাস বাঁচাতে পারলেন না। জেদ ধরলেন। অন্য লড়াইয়ের জেদ। পাশে শেহনেওয়াজ, যার ঝকঝকে এসইউভি বিক্রি করে একসময় জোগাড় হল অনেকটা টাকা। বিনামূল্যে কোভিড আক্রান্তদের প্রয়োজনে তুলে দেওয়া হল হাতে। এখনও অবধি দিনে গড়ে দশ কুড়িটা করে মোট আড়াইশো থেকে তিনশ সিলিন্ডারের জোগান। দুদিনের জন্য বিনামূল্যে। অসম্ভব সাধন। দুই বন্ধু, প্রচারের বাইরে থাকা দুই মানুষ, মাইনরিটি ভারতবর্ষ আলো দেখাচ্ছে।
হায়দ্রবাদের হেল্পিং হ্যান্ড ফাউন্ডেশন। অন্যতম প্রতিনিধি মহম্মদ ফরিদ উল্লাহ। জানা গেল দিনে বারো থেকে পনেরোটি করে সিলিন্ডার দিচ্ছেন তাঁরা। চাওয়া বলতে প্রেসক্রিপশন। গত একমাসে এভাবে দেওয়া একশো কুড়িজন রোগীর মধ্যে সেরে উঠেছেন সত্তর। ওই সত্তরজনই ফরিদদের ‘আমরা করব জয়’। উই শ্যাল ওভারকাম। সামডে…
কানপুরের বাবুপুরওয়া এলাকা। সাতজনের একদল দামাল ছেলে। নেতৃত্বে বছর পঁচিশের সাদাকাত উল্লাহ খান। দলের নাম ‘ইনসানিয়াত আভি জিন্দা হ্যায়’। ঘুরে ঘুরে প্রেসক্রিপশন দেখেই বিনামূল্যে অক্সিজেন বিলি করে দিচ্ছেন তাঁরা। চার বছর আগে থেকেই হাসপাতাল, মন্দির, মসজিদ, আশ্রমের গরিবদের বিনামূল্যে খাবার দিয়ে শুরু করা সাদাকাতরা কোভিডের প্রথম তরঙ্গের সময়ও সেই কাজে ব্রতী ছিলেন। এবার আরও কঠিন, পরিশ্রমের, চ্যালেঞ্জিং এক সঙ্কল্প। লখনৌতে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়া টিম ইনসানিয়াতের ছেলেরা মাত্র ৬৩,০০০ টাকা নিয়ে লড়াই শুরু করে। কখনও গ্যাস এজেন্সির দোকানে লম্বা লাইন আর মোটা সিকিউরিটি ডিপোসিটের বিনিময়ে কোনওমতে জোগাড় করা অক্সিজেন একটুও দেরি না করে পৌঁছে যাচ্ছে রোগীর কাছে। প্রাণ বেঁচে যাচ্ছে। প্রাণ। আশ্চর্য এক সম্পদ।
শ্রীনগরের চেস্ট ডিসিস হসপিটালের ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটের সামনে হন্যে হয়ে পড়ে থাকা শিবপোরা অঞ্চলের বাসিন্দা বছর চব্বিশের আজহার মালিক। এবং তাঁর কাশ্মিরি সামারিটান দল। কার রেমডিসিভির লাগবে, কার অক্সিজেন? আজহাররা খবর পেলেই শহর ছুটে বেড়াচ্ছেন। কখনও পারছেন, কখনও পারছেন না। ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের গাড়িতে ক্যারি করে মরণাপন্ন কোভিড রোগীকে হাসপাতাল পৌঁছে দিচ্ছেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ অথবা টুইটার পেজ SOSJK নাম দিয়ে তৈরি করছেন প্ল্যাটফর্ম। সাহায্যের। এবছরের জাকাতের সময় কাশ্মিরি বেশ কিছু শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা চালু করেছেন ‘অক্সিজেন জাকাত’। শ্বাসবায়ুর চেয়ে বড় দান, উদারতর জাকাত আর কিছু হয় নাকি?
অতিমারি একদিন কমবে। জয় আসবে। একধরনের Pyrrhic victory-র মতো অসংখ্য ক্ষতির বিনিময়ে সেই জেতা হয়তো হারারই সমার্থক হয়ে উঠবে। তবু এসব অন্ধকারের মাঝেই মানবিকতা, ইনসানিয়াতের এক পরাকাষ্ঠা হয়ে দেখা দিচ্ছে কিছু স্বপ্নকন্ঠ, মুখ, মাইনরিটি ভারতবর্ষ। এ আলো দীর্ঘজীবী হোক।