অপরাজিতা

অপরাজিতা -- মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় 

 

বিশ্রী একটা ক্যাঁচ আওয়াজ করে দরজাটা খুলে গেল আবার; ধূসর রংচটা, ওপর থেকে কব্জা ঢিলে হয়ে গেছে। নড়বড় করছে। একটা পেঁচি মাতালও তার এলোমেলো পায়ে এক লাথিতে খুলে দিতে পারে দরজাটা, কোনওরকমে খাড়া করে রাখা আছে দেওয়ালের গায়ে। তার দিনে দিনে কেমন রোগা, কুৎসিত হতে থাকা মা, গজগজ করতে করতে রোজ রাত্রে নোড়া দিয়ে কব্জাটাকে ঠোকে, কীভাবে ওটা যেন আটকিয়েও যায় রাত্তিরটুকুর জন্য। ভোরবেলা চটকলে ভোঁ পড়া মাত্র ওঠে… ঘরের মধ্যে তখন পাতলা অন্ধকার। ঘুমচোখে বিড়বিড় করতে করতে কাকে শাপশাপান্ত করতে করতে, হাতড়ে হাতড়ে গিয়ে দরজাটা যখন খোলে, কোনও কোনও দিন নড়বড়ে ভাঙা টিনের দরজাটার কোনও এক চিড়  দিয়ে লম্বা রেখার মতো সূর্যের আলোটা গিয়ে ফোকাস ফেলে দেওয়ালে। একদম গোল… আর রেখাটার মধ্যে সাদা সাদা ধুলোর কণা, নড়ে চড়ে ঘুরপাক খায়… ওদের দেখতে থাকে সে… আবার চোখ বুজে যায়। মাঝে মাঝে নাইটি পরা মায়ের চেহারাটাও দেখতে পায়। মার কাজের বাড়িতে একটা মেয়েলোক পেশেন্ট মরে গেছিল, তখন অনেকগুলো ম্যাক্সি ফেলে না দিয়ে মাকে দিয়ে দিয়েছে। মা আগে পরত না… এখন কাজ থেকে এসেই শাড়ি, ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার খুলে ওই ম্যাক্সি পরে ফেলে। মার ওই পেশেন্ট মুটকি ছিল, ওর ফেলে যাওয়া নাইটির নিচে, মাকে আরও চিমসে, হাড়গিলে মতো লাগে। কোনও কোনও দিন আবার দরজাটা ঝড়াত করে হেলে যায়, ঘুমের চটকা ভেঙে যায়… একবার মনে হয় দরজাটা মার্ মাথায় পড়ল না তো? পাশ ফিরে শোয় সে।

সকালবেলা উঠে, আগের রাতের সবজি থেকে যা থাকে, তা দিয়ে একটা তরকারি চাপিয়ে দেয় মা… রাত্তিরে নিয়ে আসে খালধারের সবজির মাসিদের কাছ থেকে ঝড়তিপড়তি সবজি। কখনও মাছ পেলে একটু মাছ; তখন রাত্তিরে মাছের ঝোল করে, রাত হয়ে যায় খেতে খেতে। মাছের ঝোল কড়াইতে ফোটে, সে থালা বার করে ভাত বাড়তে শুরু করে। ঝোল দিয়ে মাখা ভাতের প্রথম গরাসটা মুখে তুলে দুনিয়া ভুলে যায়… ঝোলমাখা, মাছমাখা প্রত্যেকটা ভাতের দানা যেন পারলে আলাদা আলাদা চিবোয়… মাছের কাঁটাকোটা মুড়ো চিবিয়ে গুঁড়ো করে ফেলে। বোনটাকে খাওয়াতে  খাওয়াতে মা তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তারপর নিজের থেকে ভেঙে দিয়ে দেয় খানিকটা মাছ তাকে। বছর খানেক আগে, মা একটা বড়লোকের বাড়িতে কাজ করত। ওই বাড়ির লোকজনের জন্য বাইরে থেকে গাদা গাদা অনেক খাবার আসত; কত কী খেয়েছে সে সেই সময়, পিজা, প্যাটিস, চপ, মোমো। প্রায় গলে যাওয়া আইসক্রিম, একটু গন্ধ হয়ে যাওয়া বিরিয়ানি। মা তনুকে দিত না, পেট খারাপ করবে বলে… ইশ সে দিনগুলো কি ছিল… সকালের দরজায় ওই ঝড়াত আওয়াজে চোখ খুললেই মনে পড়ত টিফিন বাক্সর মধ্যে আজ দুখানা প্যাটিস। সেই প্যাটিসের মধ্যে মাংস। তার আর তনুর।

তনুকে অবশ্য কোনওদিনই দিত না… তনু তখন কথা তেমন বলতেও পারত না.., এখনও তনুকে তেমন কিছু দেয় না… ওর ভাগের ডিম, মাছ ভাত দিয়ে মেখে অনেকটা খেয়ে নেয়. তনু একটু নির্জীব স্বরে কখনও কখনও বলে “দাও ডিম দাও…”

সে একটুখানি ভাত তুলে, এইটুকু আলু দিয়ে মেখে দেয়। রাত্তিরে তনুকে মা খাইয়ে দেয় ঠেসে ঠেসে। আরও ছোট থাকতে কোনও কোনও দিন তনু ঘুমোলে, বেরিয়ে যেত। গলির কোনও মেয়ের সঙ্গে দেখা হলে খেলত। মার কাছ থেকে সরানো পয়সা দিয়ে তাদের রাস্তার মুখ অব্দি গেলে খুব ঝাল আলুকাবলি আর একটা চায়ের স্টলে চা আর নানখাটাই  বিস্কুট পাওয়া যেত। কোনও কোনওদিন ফিরে এসে দেখত তনু চৌকি থেকে পড়ে গেছে… গালের একদিকে কালসিটে বা মাথায় আলু… চিৎকার করে কাঁদত। ওকে উঠে বসিয়ে চুপ করতে বলত, বেশি আওয়াজ হলে বাইরের রকে গিয়ে বসে থাকত যতক্ষণ ও চুপ না করে। এখন অসুবিধে হয়ে গেছে। তনু কথা বলতে পারে। এখন তাকে একটু সবধানে চলতে হয়।

মাস দুয়েক আগে একদিন ও মেঘাদের বাড়ি গেছিল। মেঘাদের অবস্থা তাদের থেকে ঢের ভালো। ওদের বাড়িটা তাদের পাড়াতেই, কিন্তু আলাদা বাথরুম। এবছর মেঘার কাকা জলের লাইন নিয়েছে, কী একটা কারণে ওদের পাইপ দিয়ে সবসময় প্রায় জল পরে…. অনেক জল, তাদের এখানে নিজেদের তোলা জল নিয়ে বাথরুমে  যেতে হয়, একটু দেরি হলেই চিৎকার চেঁচামেচি। মায়ের কাছ থেকে অনেক করে পয়সা চেয়ে দু পাতা শ্যাম্পু কেনে সে। এই গরমে দুপুরবেলা গিয়ে অনেকক্ষণ চান করে… শ্যাম্পুর পাতা থেকে পুরো শ্যাম্পুটা  ঢেলে যখন মাথায় মাখে— কী সুন্দর যে গন্ধ। তখন আর শ্যাওলা পরা আধভাঙা মেঝে, চুনবালি খসা দেওয়ালের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে আছে মনেই পড়ে না। চোখ বন্ধ করে সারা গায়ে মাথায় শ্যাম্পু ডলতেই থাকে। নিজের সমস্ত গাটা কেমন নরম মনে হয়। তারপর জলটা গায়ে পড়তে যে কী আরাম। সেদিনও একটু দেরি হচ্ছিল। আশেপাশে কেউ ছিল না, সেও আর খেয়াল করেনি। যখন ঘরে ফিরে আসে, দরজাটা আধখোলা। সে এক মুহূর্তেই বুঝতে পারে বোন বেরিয়ে গেছে। তাদের ঘরের সামনে থেকে গলির বাঁদিক থেকে বেরিয়ে, আর একটা বাঁ হাত নিলে শেষ মাথায় একটা মুদি দোকান। দানিদাদার। চাল, ডাল, আটা, আলুপেঁয়াজ, খেলনা, ক্যাডবেরি, লজেন্স, স্টিকার। পয়সা হাতে এলে মাঝে মাঝে আসে.. এমনি লজেন্স কি বিস্কুট এসব কেনে। বোন জুলজুল করে দেখে। মাঝে মাঝে এক আধটা লজেন্স ওকে দেয়, যাতে মাকে বলে না দেয়। না, বোন ওখানে নেই। যেখান থেকে এসেছে, ফিরে উল্টো মাথায় এক দৌড়ে পৌঁছে গেলে, একটা মাঠ মতো… আবর্জনায় ভরা, তারপর বড় রাস্তা। ওখানে দেখবে?

সে শুধু ভাবছে। বোনকে না পেলে, মা এসে যখন মারবে— ওই কাঠি কাঠি হাতে মারলে খুব লাগে। তারপর চিল্লাবে গলার রগ ফুলিয়ে। ক্যানক্যানে গলাটা ফেটে যায়। তারপর একসময় ফ্যাসফ্যাসে, মুখের দুধারে থুতু বেরোতে থাকে। লাল লাল চোখগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসছে মনে হয়, আওয়াজটা কানের মধ্যে ঢুকে মাথা যন্ত্রণা করে— ইচ্ছে করে ওই মুরগির মতো গলাটা চিপে ধরতে আওয়াজটা বন্ধ করার জন্য। এসব ভেবে তার কান গাল গরম হতে শুরু করল। তারপর নির্ঘাত এইসবের মধ্যে রান্নার জন্য দেরি হবে, কী রান্না হবেই না। খাবে কী সে?

উল্টো দিকের রাস্তায় বোনকে খুঁজে বের করার বদলে প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে পরে সে। মার ট্রাঙ্কের একদম নীচে একটা কচি কলাপাতা জরির শাড়ির ভাঁজে আছে টাকা। হাত চালিয়ে একটা কুড়ি টাকার নোট বার করে নেয়…। যদি কোনও কারণে খাবার না জোটে, তাহলে এই টাকা দিয়ে চাউমিন খেয়ে নেবে। তারপর দরজাটা টেনে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল। উল্টো দিকের রাস্তাটা গিয়ে পড়েছে বড় রাস্তায়; তার ঠিক আগে একটা ছোট মতো মাঠ, ওখানে বিকেলে ছেলেরা বল খেলে। রাত্রে ঘুগনি, গাঁজা সব পাওয়া যায়, একটা দিক আবর্জনায় ভরা… এই দিকেও মাঝে মাঝে আসে তারা। এই রাস্তা  দিকে গেলে মার কাজের বাড়ি। ওই তো তনু, ওই মাঠের ধরে বসে আছে, ওখানে কতগুলো ছেলে বল পেটাচ্ছে।

“এই তনু।” শুনতে পেল না… পাশে গিয়ে প্রথমেই হাতটা মুচড়ে ধরল। কেঁদে উঠল ব্যথায়, তবে ওর গলা দিয়ে তেমন আওয়াজ বেরোয় না…

–কাকে বলে বেরিয়েছিস হারামজাদি? চল মা এলে তোর হচ্ছে।

মা এলেই এমনভাবে শুরু করবে, যাতে মার তনুকে পেটানো ছাড়া বিশেষ কিছু মনে না থাকে।

রাত্রে  মারধর, কান্নাকাটি, রান্না সব মিটে যেতে, পাশে শুয়ে, মার শির বের করা খড়খড়ে হাত বোনকে জড়িয়ে তার পিঠের ওপর দিয়ে ঘোরে। বোন মায়ের শরীরের মধ্যে প্রায় ঢুকে যায়… অন্ধকারে ফুঁপিয়ে ওঠে মা একটু। সেই সময়টাতে, ওই তরল অন্ধকারে তার একটা বোধ আসে— সে অনেক কিছু বুঝতে পারে না। এই যে মারধর, কান্নাকাটির পর মা আর বোনে দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছে, তার কখনও এমন ইচ্ছে হয় না… কেটে গেলে বা ব্যথা না লাগলে তার কখনও কান্না পায় না। মা বকলে বোনের মুখটা কেমন হয়ে যায়, ঠোঁট ফুলে ওঠে, চোখে জল চলে আসে, তার কিচ্ছুটি  হয় না। এক একদিন মা দেরি করে ফেরে, তনু দরজার কাছে ঘুরে ঘুরে যায়, মুখটা ছোট হয়ে যায়, কখনও খুনখুন করে কাঁদে; মাকে দেখলে ওর চোখমুখে যেন আলো জ্বলে ওঠে…. তার বসে বসে ঢুলুনি আসে, ভাবে রান্না করতে কত দেরি হবে। মা যখন তার কাজের বাড়িতে টিভি দেখতে নিয়ে যায়, টিভিতে দেখা সিনেমা, সিরিয়াল দেখে মা কাঁদে, কাজের বাড়ির মাসিমা কাঁদে, বৌদি কাঁদে। তার কিছু মনে হয় না… সে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কাজের বাড়ির বৌদি তাকে বলে “কী রে তোর কষ্ট হয় না?”

মা চোখ মুছতে মুছতে বলে, “না গো বৌদি, ওর কীরকম একটা ধারা। ওকে পেট কেটে বার করে নিয়েছিল তো ডাক্তাররা, আমার সঙ্গে নাড়ির টান নেই। ছোট থেকেই। আর তনুকে দ্যাখো…”

বৌদি হাসে।

–তুমি কী যে বলো মাসি!

তার কান্না পায়? পায় না তো! কেন? সে শুধু হাওয়া শোঁকে— ওদের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা, ঘুগনির গরমমশলার গন্ধ। তার মুখে জল কাটে। কখন এক বাটি  ঘুগনি পাবে সে… গায়ে ফুরফুর করে ভেসে আসা পাখার হাওয়া, আরাম পেতে ইচ্ছে করে… শুধু আরাম। সে কেমন অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। সে ঠিক অন্যদের মতো নয়, আশেপাশে যাদেরকে সে দেখে তাদের কারও মতো নয়। ইদানিং তার এখনও অপরিণত মস্তিষ্কে, কুয়াশার আড়াল থেকে উঁকি দেয়। আর এই দুঃখ, ব্যথা, আনন্দ, ভালোবাসা না পাওয়াটা তার জন্য ভালোই। ওটা তাকে অনেক কিছু এনে দেবে। সে এই নারকেলডাঙার বস্তির একটা ঘরের মধ্যে আটকে থাকার জন্য আসেনি। কিছুতেই না।

***

 

চকলেট ফ্রস্টিংয়ের শেষটা কেকের ওপর ভালো করে ছড়িয়ে দিল সে। আড়চোখে দেখে নিল বাটির একপাশে, ছুরিতে এখনও অনেকটা ফ্রস্টিং লেগে আছে— মুখটা জলে ভরে যাচ্ছে। সেই তখন থেকে অপেক্ষা করছে, যখন থেকে চকলেট, ক্রিম, চিনি আরও কীসব মেশানোর পর দিদি বলল ফেটাতে। চকলেটের সঙ্গে ক্রিম; তার মধ্যে চিনি মিশে যাচ্ছে— তার বন্ধ মুখের মধ্যে জিভটাও নড়ে উঠছে যেন নিজে থেকেই। মাসিমা টিভির দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন— দিদি রান্নাঘরের থেকে নিজের ঘরের দিকে যেতেই, একবার ফেটানোর কাঁটাটা তুলে চেটে নিল। আহ চকলেট, চিনি মুখের মধ্যে গলে মিশে যাচ্ছে।

–দেবী ফ্রিজ থেকে খাবারগুলো বার করে রাখিস তো। মাসিমা এদিক ফিরে বলতেই কাঁটা ফিরে গেল বাটিতে, হাত চলতে লাগল তার, বাঁ হাতের পিছন দিয়ে মুখটা সন্তর্পণে মুছে নিল।

ওবেলা চিতলমাছ হয়েছিল। এখনও দু-তিনটে পিস আছে। ভাবতেই হাসি ফুটে উঠল মুখে। সে জানে কী হবে। দেখেছে অন্যদিন। দিদি একটুখানি খাবে কেকের টুকরো। তারপর আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখবে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখবে। পেটের মাংসে খিমচি দিয়ে, নিজের পেছন চোদ্দবার করে দেখবে। তারপর রাত্রে খেতে বসে মুখটা কুঁচকে বলবে “তুই খেয়ে নে দেবী, আমি খাব না।” আর তার ভাগ্য যাবে খুলে। তার তো সাতশো মজা… ওহ নরম তুলতুলে মাংস মুখে মিলিয়ে যায়… নাক বন্ধ হয়ে আসে গন্ধে। কেকের মতো কী যেন সব মিষ্টি, নরম ক্রিম, টক মিষ্টি ফল, বাদাম, চকলেট… কী দারুন সব গন্ধ… কিছু চেনা, বেশিরভাগই অচেনা। আজ ওই তেলতেলে চিতল মাছের পেটি নাচছে তার কপালেই। সে জানে।

ভাগ্যিস মায়ের সঙ্গে জেদাজেদি করে এই কাজটা নিয়েছিল। মা একটা সারাদিনের কাজ পেয়েছিল, তনুকে সঙ্গে নিয়ে গেলে তাদের কোনও আপত্তি নেই। এই কাজটার সন্ধান তার মায়ের বান্ধবী মিনতি আনতে সে ঝুলে পড়ল। তার বস্তি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বেশ উঁচু উঁচু বিল্ডিং চারপাশে। তিনটে শোবার ঘরের দারুন সুন্দর ছড়ানো ছেটানো ফ্ল্যাট। সবে তিনমাস হয়েছে সে এখানে এসেছে। সে যেন এখন অন্য দেবশ্রী। আগে তার নিজের নামটা চিনতে পারত না, মা তাকে দেবী বলে ডাকে, পাড়ার সবাই প্রায়। তার নামটা শুনে মাসিমা আর দিদি দুজনেই বেশ হেসেছিল।

–দেবশ্রী রায়কে চিনিস?

চেনে তো সে। দু- তিনটে বই দেখেছে— তবে অনেক দিন আগে। বেশ সুন্দর দেখতে। এ বাড়িতে আসার পর, বাড়ির দিদিকে, মন দিয়ে লক্ষ করত। বেশ হাঁ করে তাকিয়ে থাকত, দিদি খেয়াল করলে একেক সময় বলে উঠত,

–কী দেখছিস?

আসলে দিদির মতো মেয়ে সে সামনে দেখেনি। বেশ  টিভির মেয়ের মতো… বিছানার গোলাপি চাদর, সাদা পর্দা থেকে আসা রোদ… এসি ঘরে বসে থাকে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে। মাথায় বাদামি-কালো চুল, চকচকে গাল, মুখ, ঢোলা জামা আর ছোট প্যান্ট— টি শার্ট বলে, আর শর্টস। অর্ধেক থাই বার হয়ে থাকে। কম্পিউটার কোলে। কানে কী দেওয়া থাকে। অর্ধেক সময় কিছু শোনে না, শুনতে পায় না। কখনও কখনও ওকে বলে নখ ঘষে দিতে, পা ম্যাসাজ করতে। রাতে খেতে বসে ফেলা ছড়া করতে থাকে, নষ্ট হওয়ার ভয়ে ইয়া বড় রুই মাছ, চিকেনের পিস, তাকে দিয়ে দেয় মাসিমা। আজকাল এসির ঠান্ডা হাওয়াতে অর্ধেকদিন রাত্রে দেবী ঘুমোয়। দুপুরবেলা মাসিমা ঘুমিয়ে পড়লে, লিভিংরুমের সোফায় শুয়ে শুয়ে ওর টেবিল থেকে চুপিচুপি তুলে নিয়ে যায় ফোন। কতরকমের ভিডিও, কতরকমের খেলা, সোফার নরম গদির মধ্যে খাপে খাপে যেন তার ছোটখাট শরীরটা ঢুকে যায়, ফ্যানের হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়তে থাকা নিজের শ্যাম্পু করা চকচকে চুলের গন্ধ নাকে এসে চোখদুটোকে বন্ধ করে দেয়।

ইদানিং মা যখন টাকা নিতে আসে, বোন তার দিকে কেমনভাবে যেন তাকিয়ে থাকে, যেন চেনে না। আজকাল ঢলঢলে জামা পরা, খিঞ্জি চেহারার বোনকে কোলে নিতে তার কেমন গা ঘিনঘিন করে। বোনটাও তার গা ঘেঁষে না, মার আঁচল ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মার চোখ ছলছল করে, বলে,

–দেবী বাড়ি যাবি না?
–যাব। আমি গেলে এখানে খুব অসুবিধা। পুজোতে যাব।
–সে তো অনেক দেরি রে।

সে বলে, “দাঁড়াও ওকে একটু কেক দিচ্ছি। আমি বানিয়েছি।”

বোন আর মা একই প্লেট থেকে ভেঙে ভেঙে খায়… মুখে কেমন হাসি ফুটে ওঠে, ও বোঝে এদের সঙ্গে তার আর কোনও সম্পর্ক নেই… গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। মা বারবার পিছনে ফিরে হাত নাড়ে, দেবীর মনে হয়… এদের সঙ্গে আর না দেখা হলেও ঠিক আছে।

একেকটা রাত্তিরে অন্যরকম কিছু হয়। দিদির একটা বয়ফ্রেন্ড আছে, সোমদা, বেশ দেখতে, দিদির সঙ্গে বেশ মানায়। বাড়িতে আসে, ফোনে রাত্রিবেলা অনেক রাত অব্দি গল্প করে। সোমদা  খুব বাইরে যায়… সেই সময় রাত্রিবেলা দিদির ঘরে শুলে দিদির ল্যাপটপে দিদি আর সোমদা মিলে কীসব যেন করে… গল্প করে প্রথমে, ঝগড়া করে, দু চারদিন সে শুনেছে ঘুমের ভান করে। ওদিক থেকে সোমদার গলা শোনা যায়… দিদির আওয়াজ কেমন হয়ে যায়… দিদির  জামাকাপড় থাকে না প্রায় গায়ে। তার খুব ইচ্ছে হয়, এদিক ফিরে দেখে কী হচ্ছে। খুব ভালো লাগে এসব… শরীরে কেমন হয়। ও এটাও বোঝে যে, দিদি জানে যে সে জেগে আছে, তাতে দিদির কোনও অসুবিধা লাগে না… দিদির ওসব কিছুই নেই… দিদি খানিকটা ওর মতো। দিনগুলো এরকমই চলছিল, কিন্তু ঝড়ের মতো মুম্বাই থেকে এল দিদির মাসতুতো বোন— রিয়া দিদি। দিদি যদি টিভির মেয়ে হয়, রিয়াদিদি তাহলে দীপিকা পাড়ুকোন। যবে থেকে দেবী এই বাড়িতে আছে, এই রিয়ার কথা খুব শুনেছে। রিয়া দারুন নাচে, ছোটদের ডান্স ইন্ডিয়া ডান্স-এ নাকি অনেক দূর গেছিল। এখন বড়বেলাতেও কী গ্রুপের সঙ্গে নাচে। নিজের স্কুল আছে, গ্রুপ আছে— অনেক টাকা রোজগার করে। দেবীর মনে আছে, রিয়াদিদির জুতোজোড়া। কেমন বাঘের চামড়ার মতো প্রিন্ট, আর সে কী হিল! মনে হচ্ছে দুটো সরু কাঠের টুকরো লাগানো আছে। এটা পরে রিয়াদিদি হাঁটে কী করে? কী সুন্দর থোকা থোকা চুল কাঁধ অব্দি, কেমন বড় বড় পালকে ছাওয়া নীল চোখ। তবে পরে দেখেছে প্রায় সব নকল। চোখের পাতা, আঙুলের নখ… এমনকি নীল চোখ। চোখের মণির মধ্যে লেন্স না কী পরে। বাড়িতে চশমা। রিয়াদিদির ঘরে থেকে থেকেই উঁকিঝুঁকি মারে সে। দিদি লেন্স পরে, লেন্স খোলে, চশমা হারিয়ে ফেলে, চুলের রোলার এদিক ওদিক ফেলে রাখে— সে হাতে হাতে গুছিয়ে দেয়। রিয়াদিদির স্যালাড, দই তৈরি রাখে। রিয়াদি টাকা দেয়, ক্রিম দেয়, নিজের পছন্দ না বলে দুটো লিপস্টিক দিয়েছে।

সোমদাও খুব যাতায়াত শুরু করল… তিনজন দারুন ঘোরাঘুরি খাওয়াদাওয়া হাসাহাসি রাত্তির করে ফেরা, এসব চলতে থাকল। তারপর সোমদা অনেকসময় আসে, যখন দিদি কলেজে। রিয়াদিদির ঘরে আড্ডা চলছে, দরজা বন্ধ। কোনওদিন দুপুরে হয়তো মাসিমা ঘুমোচ্ছেন, ও চা দিতে গিয়ে মাসিমাকে বলল।

–সোম এসেছে? কোথায়?
–রিয়াদিদির সঙ্গে গল্প করছে।

মাসিমার ভুরু একটু কুঁচকে গেল।

–এরপর থেকে দুপুরে সোম এলে আমাকে বলবি তো!
–আপনি তো ঘুমোন।
–তাতে কী? ডেকে তুলবি!

দিদি রাত্রে কিছু খেল না, সে রিয়াদিদির ঘরে খাবার দিয়ে এল।

পরদিন সন্ধেবেলা রিয়াদিদি ছিল না, দিদি তাকে ডেকে অনেক প্রশ্ন করল।

–দেবী শোন সোম ঠিক কটায় ঢুকেছে রে কাল?
–কী জানি, মাসিমা শোওয়ার পর…

দিদির চোখটা একটু লাল। ওর কানে হেডফোন নেই, ও সামনের শোকেসটার দিকে তাকিয়ে আছে।

–কী পরেছিল?
–কে?
–কে মানে? রিয়া ইডিয়ট!
–ওই তো কাপ্রি না কী আর হাতকাটা গোলাপী  শার্ট।
–কী করছিল?
–জানি না তো। দরজা বন্ধ ছিল।
–তুই কী করছিলি ইডিয়ট? গাধা একটা। যা এখান থেকে বেরো। ফ্যাসফ্যাসে গলা। দিদির মুখ থেকে থুথু ছিটে এল ওর মুখে। গাটা ঘিনঘিন করে উঠল।

দিদি বোধহয় কাঁদতে শুরু করবে। আজকাল ও লোকের মুখ দেখলে বুঝতে পারে। রাত্রে রিয়াদিদি ফেরার আগেই দিদি ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন ও খেয়াল করল দিদির ড্রেসিংটেবিল পরিষ্কার করতে গিয়ে। কসমেটিক ছড়িয়ে ফেলে যায়, ঘরের মেঝেতে ছড়ানো ছেটানো থাকে ছাড়া জামাকাপড়, তখনই দেখল। বালিশের পাশে পড়ে আছে দিদির ফোন। দিদি ফোন ফেলে গেছে? ফোন তো প্রায় দিদির হাতের সঙ্গে সেলাই করা… ফোনটা নিয়ে খাটের ওপর বসল দেবী— ওর চোখ কান খুব খোলা, ও দিদির ফোন আনলক করতে জানে। দিদির আঙুল কীভাবে চলে দেখে নিয়েছে… একবার দুবার দিদি বাথরুমে গেলে খুলে দেখেছে।

ছবি তুলতে আর ভিডিও তুলতে ওর খুব ভালো লাগে। দিদির ছবির গ্যালারিতে কত ছবি… আরে এগুলো কী? দেখতে দেখতে শরীর কান গরম হয়ে উঠতে লাগল। দিদির আর সোমদার ছবি, ভিডিও।

ফোনটা নিজের কাছে রেখে দিল সে…

সেদিন দুপুরে সোমদা এল, দরজায় বেল বাজায়নি। রিয়াদি ড্রইংরুমে বসেছিল, ফোন হাতে, মনে হয় টেক্সট করেছিল। উঠে দরজা খুলে দিল। তারপর দুজনে রিয়াদিদির ঘরে। রিয়াদিদি ওকে বলল,

–বিকেলে তোকে আইসক্রিম খাওয়াব। যা টিভি দ্যাখ গিয়ে।

রিয়াদিদি যে ঘরে থাকে ওটা দরজাটা ঠিক করে বন্ধ হয় না কোনওদিন। একটু বাদে দরজার কাছে গিয়ে দেখতে পেল ওদের; রিয়াদিদি আর সোমদা। ঠিক দিদির ভিডিওর মতো করছে ওরা, দেখা যাচ্ছে বিছানার একটু। রিয়াদিদির খালি পিঠ দেখতে পেল সোমদার হাত জড়িয়ে আছে… কীরকম যেন আওয়াজ আসছে। ওর গলা কীরকম যেন শুকিয়ে এল… পেটের মধ্যে খালি। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে দিদির ঘর থেকে ফোনটা নিয়ে এল।

সেদিন সোমদা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই দিদি ফিরল।

–দেবী আমার ফোনটা কি বাড়িতে?
–হ্যাঁ, ফেলে গেছ! তাকে প্রায় ধাক্কা মেরে ঢুকে এল দিদি। কিছুক্ষণ বাদে জলের গ্লাস নিয়ে ভেতরে ঢুকল সে, খাটের ওপর বসে আছে দিদি, হাতে  ফোনটা। তার দিকে তাকাতেই মুখটা লাল, চোখের জলে মাখামাখি—
–এটা কী?
–কী?

উঠে এসে এক ঝটকায় তার চুলের মুঠিটা পাকিয়ে ধরল! এত হঠাৎ– উঃ চুলের গোড়াসুদ্ধ উপড়ে নেবে মনে হচ্ছে। মুখের সামনে ওর মুখটা। ঠোঁট গাল কাঁপছে, চোখ পাকানো।

বড্ড লাগছে মাথার গোড়ায়। ইচ্ছে হচ্ছে ওর চোখদুটোতে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে।

–কে তুলেছে এই ভিডিও? তুই? তুই? খুন করে ফেলব তোকে। যা যা বলছি এখান থেকে।

প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এল সে। কোনও দিকে না তাকিয়ে লিফট বেয়ে নেমে এল।

সন্ধে প্রায় শেষ হয়ে এল। সামনে একটা পার্কের ধারের পাঁচিলে বসে ছিল ও। মশা কামড়াতে শুরু করেছে। কী করবে এখন? আর কি ওই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না? ওপরে কী হচ্ছে? ক্ষিধে পাচ্ছে, বাথরুম পেয়েছে। বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। এমন সময়ে দেখতে পেল রিয়াদিদিকে। গেটের থেকে বেরিয়ে আসছে। এদিকেই। হাতে যে সুটকেসটা নিয়ে এসেছিল সেটা, টানতে টানতে। এখান থেকেই যেতে হয় মেন গেটের দিকে। তাকে দেখতে পেয়েছে রিয়াদিদি। তার দিকে এগিয়ে এল, একটু কাঠ হয়ে গেল সে। রিয়াদিদি কী করবে তাকে?

সামনে দাঁড়াল তার… সে খুব আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। চোখ আটকে গেছে রিয়ার চোখে। সুন্দর টানা টানা সবসময় প্রায় মাস্কারা আইলাইনার পরা চোখ… চকচক করছে চশমার আড়ালে লেন্স না পড়া কুচকুচে কালো চোখের মণি… তার দিকে তাকিয়ে আছে, ভুরুগুলো একটু কোঁচকানো…. কী বলবে রিয়াদিদি। থাপ্পড় টাপ্পর মারবে না তো, নিশ্চয়ই জেনে গেছে। চারদিকে অন্ধকার। রাস্তার পাশের লাইট সোজা পড়েছে। চোখের মণির মাঝখানে একটা বেগুনি মতো বিন্দু যেন জ্বলছে। দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, কাটতে থাকল পল অনুপল। চমক ভেঙে রিয়া কেমন এক অপ্রস্তুত গলায় বলে উঠল,

–এই দেব, আমার সঙ্গে যাবি মুম্বাই?
–মুম্বাই?
–হ্যাঁ তুই দিব্যি চালাকচতুর। আমি বাড়ির কাজ দেখার সময় পাই না, তাছাড়া স্টুডিওর জন্যও। চল চল… ওখানে ভালো থাকবি। এ বাড়ি তোর জন্য নয়… তোর পেয়ারের দিদি তো মনে হচ্ছে সুইসাইড করবে সোমের দুঃখে। এদের যে কী হয় বুঝি না।

না। সেও বোঝে না।

সে ঘাড়  নাড়ল। এবার ওপরে গিয়ে আস্তে করে জামাকাপড় আর টাকাটা চেয়ে আনবে।

***

 

–এটা মোটামুটি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল, কী বলেন?
–হ্যাঁ, সে আর বলতে? রিসোর্স ফুরিয়ে আসতে আর বছর কুড়ি। তারপর তো সহজ থিওরি— টিঁকে যাবে তারাই, শক্ত যারা, আর জিতবে যারা।
–আমি মাঝে মাঝে ভাবি, সেই সময় জিন এডিটিং যদি ভেতরে ভেতরে এত উন্নতি করে না ফেলত… কোথায় থাকত বলুন তো এই এপি-০১ প্রজেক্ট? দ্বিতীয়জন বলে উঠলেন।

কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধতা। একসঙ্গে একটা শ্বাস ফেললেন দুজন, একটা সম্মিলিত স্বস্তির মুহূর্ত।

–সত্যি বলতে কি তুমি যখন এই উপমহাদেশের মেয়েদের প্রেজেন্ট করেছিলে আমরা বেশ অবাক হয়ে বসেছিলাম অনেকক্ষণ, ডেটা দেখে। সবাই ভাবছিলাম এ কী বলার চেষ্টা করছে? এদের নিয়ে? প্রথমজনের গলায় পরিতৃপ্ত একটা স্মৃতিচারণের সূচনা।

দুজনেই কয়েক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে।

সামনে একটা পর্দা— ত্রিমাত্রিক। যেন প্রায় তাদের দুজনের মধ্যেই অবস্থান করছে। স্ক্রিনটা  বিশাল— অনেক ছোট ভাগে বিভক্ত। আঙুলের ডগায় একটা অংশকে  কাছে আনলেন প্রথমজন। তাতে এয়ারপোর্টের দৃশ্য। সেখানে দেবী আর রিয়াকে দেখা যাচ্ছে। একটা নীল ফাইবার গ্লাসের চেয়ারে বসে, দেবী একটু আড়ষ্ট হয়ে বসে চারপাশে দেখছে। তার চোখদুটো  শুষে নিচ্ছে  চারপাশের সবকিছু। রিয়া পায়চারি করতে করতে তার ফোন থেকে কারও সঙ্গে কথা বলছে।

পর্দার দিকে চোখ রেখেই দ্বিতীয়জন বললেন,

–হ্যাঁ। এই উপমহাদেশের মেয়েদের ওপর হওয়া রেপ, ভায়োলেন্স, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, অ্যাসিড অ্যাটাক।  আর একটা ডেটা সেট তো আরও খারাপ ছিল— কীভাবে সবেতে পিছিয়ে এরা। পুষ্টি, শরীরের বৃদ্ধি, পড়াশোনা, স্কুল ড্রপআউট, বিয়ের বয়স। এখনও মনে আছে আপনাদের মুখগুলো। বিরাট প্রশ্নচিহ্ন— এরা? এরা কেন?

দ্বিতীয়জনের গলাতে ট্রাম্প কার্ড ফেলার আনন্দ।

–তারপরেই তো আনলাম আসল ডেটা। এবার দেখুন… যাই করা হয়ে এসেছে এদের সঙ্গে…

এক একটা করে আঙুল গুনে বলতে থাকলেন দ্বিতীয়জন—

–ঠিক করে খাবার না দিন, শিক্ষা না দিন, তাড়াতাড়ি বিয়ে দিন, সন্তান নিতে বাধ্য করুন, ঘরে বাইরে হাজার কাজ করান— যাই করে নিন কোনও কিচ্ছু এদের দমাতে পারছে না। চড়চড় করে বাড়ছে উন্নতির গ্রাফ। পরীক্ষার রেজাল্ট, চাকরি, ব্যবসা সবকিছুতে। গ্রামে, শহরে। সব লেভেলে। তাহলে এরাই নয় কেন?

একটা নিশ্বাস ফেললেন প্রথমজন।

–অবশ্যই। প্রাণশক্তিটাই তো আসল।

সামনের স্ক্রিন থেকে দেবীর দু-তিনটে চেয়ারের পরে বসা একটি মেয়েকে স্ক্রিনের ওপর আঙুল দিয়ে কাছে আনলেন তিনি।

–এই মেয়েটিও তো? জিজ্ঞাসা করলেন দ্বিতীয়জন।

সবুজ টি শার্ট আর জিন্স পরা মেয়েটি বসে আছে দেবীর তিনটে চেয়ার ছেড়ে। হাতে একটা ক্যামেরা, মন দিয়ে দেখছে।

–হ্যাঁ। ঐদিকে দেখো ওই মেয়েটিও।

সরিয়ে নিয়ে গেলেন আর একটি উইন্ডোতে, যেখানে কফি স্টলে মন দিয়ে একটার পর একটা কাপে কফি ঢালছে আঁটোসাঁটো করে অ্যাপ্রন পড়া মেয়েটি। তারপর এক এক করে কাপগুলো এগিয়ে দিচ্ছে কাস্টমারের দিকে। তার ভিডিওটা স্টিল করে দিলেন। স্ক্রিন জুড়ে এখন মেয়েটির মুখ; কাস্টমারকে কফি দিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের মণিতে দুটি বেগুনি বিন্দু।

–হুমম। চোখগুলোতেই একমাত্র বোঝা যায়, ওই বেগুনি রশ্মিটা।
–হ্যাঁ, এটা থেকে এরা নিজেদেরকেও চিনে নেবে। বললেন প্রথমজন।

দ্বিতীয়জন হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলেন।

–কী টেকনোলজি! কুচ কুচ কুচ… কেটে বের করে নাও ফালতু রাগ, করুণা, স্নেহ, ভয়, লজ্জা, অনুতাপ এই সব ইমোশন ব্রেনের হিপ্পোক্যাম্পাস, অ্যামিলগাডা, হাইপোথ্যালামাস রিজিওন থেকে। তারপর আর কী? এদের আটকাবে কে? খাবার না দিলে ঠিক খাবার খুঁজে বের করে নেবে। এদের অত্যাচার করবে? গায়ের ব্যথা ঠিক হলেই, এরা চাঙ্গা। নিজেদের রাস্তা নিজেরা খুঁজে নেবে। যেভাবে পারে।

প্রথম মানুষটি মমতা ভরে তাকিয়ে আছেন স্ক্রিনের দিকে।

–এই অপরাজিতারা জন্ম দেবে ঠিক তাদের মতোই মানুষ।

দ্বিতীয়জন উঠে এসে দাঁড়ালেন প্রথমজনের পাশে।

দুজনেই তাকিয়ে থাকলেন স্ক্রিনের দিকে। দেবী আর রিয়া হেঁটে চলেছে সিকিউরিটির দিকে। কফি স্টলের মেয়েটার শিফট শেষ হয়ে এল। ক্যামেরা কাঁধে মেয়েটা চেয়ারে বসে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ও ক্লান্ত। ওর গর্ভে সেকেন্ড জেনারেশন। এয়ারপোর্টের বাইরে রোদ বাড়তে  থাকা এক ব্যস্ত শহর; কাছের একটা মলের ডিপার্টমেন্ট স্টোর খুলে গেল; ইউনিফর্মের ওপর গলায় আইডেন্টিটি ব্যাজ পরে নিচ্ছে নতুন চাকরি পাওয়া বউটি, আর একটু দূরে টেকনোলজি পার্কের এক বিল্ডিঙে ঝাঁ চকচকে স্বচ্ছ ক্যাপসুল লিফটের মধ্যে তরুণী এক্সিকিউটিভ, আরও একশো কিলোমিটার দূরের গ্রামের রাস্তায় বাবার সাইকেলে বসে রোগা রোগা পা দোলাচ্ছে কিশোরী— শহরের বাইরে ছড়িয়ে থাকা মফস্বল, গ্রাম, অন্য শহরের  রাস্তায়, গলিতে, বস্তিতে, ক্লাসে, বাসে, দোকানে, হোটেলে, ল্যাবে, জলের লাইনে, হাসপাতালে, খদ্দেরের বিছানায়, বিউটি পার্লারের চেয়ারে, শাড়িতে, স্কার্টে, সালোয়ার কামিজে, জিনসে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে এরা।

একটু একটু করে।

ভবিষ্যৎ।

আত্মকেন্দ্রিক, একাগ্র, সহানুভূতিহীন।

অপরাজিতা ভার্সন ০১।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...