সুশীতল
রাজনৈতিক ভাষ্যকার
ভোট ৩৮.১৩ শতাংশ। আসন ৭৭টা। ভোটদাতা ২ কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার ৭১০ জন। এগুলি নিছক পরিসংখ্যান নয়। আতঙ্কের পরিসংখ্যান। কারণ, এগুলি পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দলের দ্বারা প্রাপ্ত সংখ্যা। গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে বিরোধিতা ও বাক্স্বাধীনতা। অর্থাৎ, শাসকের বিরুদ্ধে শাসিতের বিরোধিতার অধিকার এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ন্যায্য অধিকার। আর, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় স্পষ্ট দ্বিদলীয় মেরুকরণ থেকে বোঝা যায় যে, বিজেপি প্রধান এবং ‘একমাত্র’ বিরোধী দল। ২৯২টা আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ৪৭.৮ শতাংশ ভোট ও ২১৩টা আসন নিয়ে শাসকের আসনে বসতে চলেছে। বিজেপি ছাড়া আইএসএফ ১টি ও গোর্খা সমর্থিত নির্দল প্রার্থী ১টি আসন জিতেছে। অর্থাৎ সংসদীয় নির্বাচনী লড়াইতে ২১৩ বনাম ৭৭ পশ্চিমবঙ্গের শাসনকাঠামো ও গণতন্ত্রের অভিমুখ নির্ধারণ করবে। এটা স্বস্তির বিষয় নয়। আবারও উল্লেখ থাক যে, বিরোধিতা ও বাক্স্বাধীনতা গণতন্ত্রকে টিঁকিয়ে রাখে। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায়, সমগ্র ভারতবর্ষের শাসক দল তারা এবং তাদেরই হাতে ভারতবর্ষ তথা ভারতবর্ষের গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। বাক্স্বাধীনতার প্রয়োগ করলেই জনগণকে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া বা ইউএপিএ-তে বন্দি করা কেন্দ্রীয় শাসকের অভ্যাস হয়ে গেছে। কোনও দল বা ব্যক্তি শাসকের বিরোধিতা করলেই তার বিরুদ্ধে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গের ‘প্রধান’ বিরোধী অন্তত ২০২৬ সাল অবধি। কিন্তু, কেন তা আতঙ্কের? কারণ, বিগত লোকসভা (২০১৯) ভোটের পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ও আরএসএস সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ থেকে ভুয়ো খবর তৈরি করা থেকে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ‘ম্যানিপুলেট’ করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা— কিছুরই ত্রুটি রাখেনি তারা। এখন থেকে ওই ৭৭জন বিধায়ক এবং ২০ জন সাংসদ এই কাজগুলোই আরও নিষ্ঠাভরে করবে। তাদের মুঠোয় থাকা ‘অধিকার’ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে গণতন্ত্রকে উদ্বিগ্ন রাখবে প্রতিমুহূর্তে। দ্বিতীয়ত, তৃণমূল-সিপিআই(এম)-কংগ্রেস এই তিন দলের বিধায়ক-পৌরপ্রতিনিধি-সাংসদদের ভাঙিয়ে নিজেদের দলে নিয়েছিল বিজেপি। তৃণমূল থেকে জার্সি বদলে বিজেপি হওয়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিজেপি এই দল-ভাঙানো খেলার আঁটঘাট সব জানে। গত এক বছরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি উত্তেজনাময় ছিল এই দলবদলের খেলা দেখতে। বিপুল অর্থের বিনিময়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও ‘বিখ্যাত’দের কিনে নেওয়ার খেলায় সারা ভারতে বিজেপির মতো দক্ষ দল এই মুহূর্তে কেউ নেই। আগামী পাঁচ বছর বিজেপি এই কেনাকাটির পরিমাণ বাড়াবে। তাদের মতাদর্শগত প্রচার আরও তীব্র করবে। ভাঙনমূলক বিরোধিতায় বিজেপির চেয়ে শক্তিশালী আর কে? এবং তৃণমূলের ওই ২১৩ জন বিধায়কের অধিকাংশের যে কোনও মুহূর্তে জার্সি বদলে নেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আতঙ্ক এই জন্যেই যে, বিজেপির তৈরি করে দেওয়া বয়ান, বিজেপির তৈরি করে দেওয়া খেলার মাপকাঠিগুলি গেঁড়ে বসে যাচ্ছে বাংলার রাজনীতিতে।
এরাজ্যে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নব্বই দশকের পর থেকে গড়ে ৫ শতাংশ ভোট তারা পেয়েছে। ১৯৯১ সালে ১১.৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি, যা এখনও অবধি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (২০১৬ সালে ১০.১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তারা)। ১৯৯১ সালে মোট ৩৫ লক্ষ ১৩ হাজার ১২১ ভোট পেয়েছিল তারা। ওই বছরের বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন থেকেই এরাজ্যে বিজেপির ভোটপ্রচারের ভিত্তি হিন্দুত্ববাদ, মুসলিমবিদ্বেষ ও অনুপ্রবেশ ইস্যু। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই ভিতে সার-জল পড়েছে। ২০২১ সালের নির্বাচন অভূতপূর্ব এইজন্যেই যে, এই নির্বাচন শাসক বেছে নেওয়ার নয় বরং শাসক না-হতে-দেওয়ার নির্বাচন ছিল। ডিফেন্ডিং শাসক তৃণমূলকে ভোট না দেওয়া বা না-দেওয়ার থেকেও বড় ছিল বিজেপিকে ভোট না দেওয়া। ভোটদান সাধারণত হয় ডিফেন্ডিং শাসকের সপক্ষে বা বিপক্ষে; কিন্তু, এইবারের নির্বাচন বিরোধী দল বিজেপিকে ক্ষমতা পাওয়ানো বা ক্ষমতা পাওয়া থেকে আটকানোর জন্যে হয়েছে। বাংলার রাজনীতিতে এই ধারণা নতুন। ওই বিরোধীদল তথা বিজেপিকে ক্ষমতা পেতে দেওয়া হয়নি, আটকানো গেছে। তৃণমূল যতটা না ‘জিতেছে’, তার থেকে অনেক বেশি পলিটিক্যালি কারেক্ট বাক্য— ‘বিজেপি জেতেনি’। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের প্রধান এবং একমাত্র সংসদীয় বিরোধীদল হয়ে গেছে তারা। এই ৭৭টা আসন আর প্রায় আড়াই কোটি ভোট পাওয়া বিজেপির ‘পরাজয়’ তো নয়ই বরং শক্তিবৃদ্ধি ও অতিহিংস্রতার পূর্বলক্ষণ। বিজেপি এই ভোটের ফলাফলে আপাতত দু পা পিছিয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে এক পা এগোনো বা লাফ দেওয়ার সম্ভাবনা কমেনি। জনৈক ব্যক্তি লিখেছেন, “বিজেপি ১টা আসন পাওয়া মানে মানুষ হারছেন। গত দু বছর ধরে যে বিষ আরেসেস ঢুকিয়ে দিয়েছে, তা থেকে বোধহয় এত সহজে পরিত্রাণ মিলবে না। কারণ, আরেসেস শুধুমাত্র ভোটের দিকে তাকিয়ে থাকে না, তাদের শিকড় আমাদের চেতনায় আচরণে চারিয়ে দেয়। হিন্দুত্ববাদ এবং আরেসেস একটা ভোটও পেলে, মানবতার হার হয়। বিজেপি ১টা আসন পেলেও মানুষ হেরে যান। কারণ, বিজেপি মানবতার সমস্ত শর্তকে লঙ্ঘন করে, তাদের উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী-হিন্দুত্ববাদী-পুরুষতান্ত্রিক আস্ফালন মানবতার বিরোধী। তাই, আরেসেস ও ফ্যাসিবাদকে পর্যুদস্ত করা গেলে, তবেই মানুষ জিতবেন।” হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের দল আরএসএসের নির্বাচনী প্রতিনিধি বিজেপি। আরএসএস ভোটে অংশ নেয় না, কোনওরকম গণতান্ত্রিক পরিসরে তাদের আস্থাও নেই। তাদের মুখোশ হিসেবে বিজপে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং তাদের একমাত্র লক্ষ্য আরএসএসের মতাদর্শগত প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেওয়া। দেশের ক্ষমতায় থেকে একের পর এক সাংবিধানিক বিধিকে দুমড়েমুচড়ে এবং সমস্ত আইনি-প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরেসেসের পক্ষে মতামত দেওয়ানোই বিজেপির কাজ। অর্থাৎ, বিজেপি আইনিভাবে আরএসএসের মতাদর্শগত বিজয়ের পথ ত্বরান্বিত করে। কিন্তু, বিজেপি শাসনক্ষমতায় না এলে আরেসেসের মতাদর্শ যে থমকে যাবে বা বাধা পাবে, তা নয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এই আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশে শ্রেণিবোধ ও শাসিতের চেতনাকে দমিয়ে রেখে ধর্মচেতনা আর বর্ণচেতনাকে আধিপত্যমূলক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার কাজ আরএসএস চালিয়ে যাবেই। তাদের লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন, ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন এবং ফ্যাসিস্ট আধিপত্য কায়েম করা। শুধু ভারতবাসী নয়, বাংলার অধিকাংশ মানুষের চেতনাতেও তারা যে অন্তত এই মতাদর্শ ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে, তা অনস্বীকার্য। বিশেষত, শাসকশ্রেণির নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও (বিজেপি বনাম তৃণমূল কিংবা বিজেপি বনাম কংগ্রেস), সার্বিকভাবে শাসকশ্রেণি এই হিন্দুত্ববাদের (উগ্র বা মৃদু) ওপরেই আস্থা রাখে। হিন্দু-আধিপত্যের দেশে নির্বাচনের দায়ে, মেজরিটির দায়ে ও জনতোষের দায়ে সমস্ত শাসকদলই এই অনুশীলন করে চলে।
গত কয়েক মাসে ‘হঠাৎ’ বেড়ে যাওয়া পরমতবিদ্বেষ, ভালো হিন্দু-খারাপ হিন্দু, সহি হিন্দু বয়ান ও ধর্মকেন্দ্রিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া— আরেসেস জিতে যাচ্ছে, গভীর অসুখের মতো চেপে বসছে। বিজেপির ভোটে হারা হয়তো আশু উপশম দিতে পারে, কিন্তু আরেসেসের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়। ২০২০ সালে দিল্লির ভোটে জিতেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে হনুমান মন্দিরে পুজো দিতে যেতে হয়েছিল। ২০২১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভোটে জেতার কিছুক্ষণের মধ্যেই কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিতে চলে যান। কংগ্রেসকে গোবলয়ের ভোটে জিততে প্রতিশ্রুতি দিতে হয় গোশালা বানানোর। ভোটের আগে মদন মিত্রকে ফেসবুক লাইভে পুজো করতে হয় ও ঘোষণা করতে হয় যে, তিনি হিন্দুধর্মে নিষ্ঠাবান। মুখ্যমন্ত্রীকে ভোটপ্রচারে চণ্ডীপাঠ করতে হয় নিজেকে সহি-হিন্দু প্রমাণ করতে। সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকে মন্দিরে পুজো দিতে যেতে হয়। কংগ্রেসের উচ্চশিক্ষিত ও মুক্তমনা নেতাকে মন্দিরের দাঁড়িপাল্লায় হিন্দুপ্রথা মেনে নিজেকে ভেট চাপাতে হয়। সামাজিক মাধ্যমে ও প্রকাশ্য সভায় অ-বিজেপি সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলিকে নিরন্তর প্রচার করে যেতেই হয় যে, তাঁরা কেন বিজেপির থেকে ভালো হিন্দু। শাসনক্ষমতা পাওয়ার লড়াইয়ে মূল প্রতর্ক হয়ে ওঠে ভালো হিন্দু নাকি উগ্র হিন্দু!? বিজেপির উদগ্র রামনবমীর মিছিলের পাল্টা তৃণমূলের হনুমান জয়ন্তী পালন হয়! পাড়ার মোড়ে মোড়ে গজিয়ে ওঠে হনুমান বা রামের মন্দির, নয়া ভারতমাতার পুজোতে তৃণমূল-বিজেপির পতাকা অদলবদল হয়। একদশক আগে লোকাল কমিটির নেতারা পাড়ার মন্দির কমিটির সেক্রেটারি হত, বিজ্ঞানচেতনার বদলে ধর্মাচরণের জনতোষ প্রতিষ্ঠা পেত; এখন তাতে বিষবাষ্প আর বিদ্বেষ বেড়েছে আরও। আর, এইসবের ধারাবাহিকতায় আড়ালে চলে যায় কৃষকদের দুর্দশা, চাপ পড়ে যায় শ্রমিকদের নাভিশ্বাস-ওঠা যাপন। করোনা আর লকডাউনকে হাতিয়ার করে শিক্ষাকে পণ্যায়িত করা হয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল ইন্ডিয়া বনাম ভারতবর্ষের বাইনারি এখন সুস্পষ্ট— তা নজরের আড়ালে। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে, পথে পথে করোনারোগীর মৃত্যু, অক্সিজেন কিংবা হাসপাতালে শয্যার অপ্রতুলতা সব ঢাকা পড়ে যায়। বেসরকারিকরণ আর উদারিকরণের চাপে নিম্নবিত্ত মানুষের যাপন সংকটে। কিন্তু, দেশের সঙ্কটকে অপ্রধান করে দিয়ে রাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদ বিষফোঁড়ার মতো জেগে থাকে। হিন্দু বনাম মুসলমান ধর্মীয় বাইনারি নির্বাচনের আগে বা পরে মেটেনি, বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে। ভুয়ো খবর, ভুয়ো ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়ার খেলা চলছে এবং আগামীদিনে এই খেলা আরও চলবে।
২
এই নির্বাচনের ফলাফলে যে দ্বিদলীয় মেরুকরণ, তাতে সংসদীয় বামেদের ও কংগ্রেসের আসন শূন্যতে নেমে গেছে। বামফ্রন্টের বৃহত্তম শরিক সিপিআইএমের ভোট শতাংশ ৪.৭৩, মোট ২৮ লাখ ৩৭ হাজার ২৭৬টি ভোট। কংগ্রেস পেয়েছে ২.৯৩ শতাংশ অর্থাৎ, ১৭ লক্ষ ৫৭ হাজার ১৩১টি ভোট। এমনকি নোটা (কোনও প্রার্থীকেই পছন্দ না) অপশনে যে পরিমাণ ভোট পড়েছে (১.০৮ শতাংশ), তা সিপিআই+আরএসপি+ফরওয়ার্ড ব্লক+সিপিআইএমএল-লিবারেশনের প্রাপ্ত সম্মিলিত ভোটের চেয়ে বেশি (০.২০+০.২১+০.৫৩+০.০৩ = ০.৯৭ শতাংশ)[1]। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ২৩ শতাংশ ভোট কমে গেছিল সিপিআইএমের এবং এই নির্বাচনের পরে তা আরও কমে গেল। বাকি সংসদীয় বামদলগুলির অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু, এই ভোটব্যাঙ্ক গেল কোথায়? সংসদীয় বামপন্থীদের একদা ভোটব্যাঙ্ক বিগত দু বছর ধরে দক্ষিণমুখী। বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যে দোদুল্যমান। অর্থাৎ, যে ‘ভরসা’ মানুষকে সংসদীয় বামপন্থীরা একদা দিতে পেরেছিল, সেই ভরসার এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গেছে। এবং সংসদীয় বামপন্থীরা মানুষকে এমন কোনও দিশা দেখাতে পারেননি, যাতে মানুষ তাঁদের ভোট দেন। আর, এই পরাজয়ের সঙ্গে সংসদীয় বামপন্থীদের মতাদর্শগত পরাজয়ও জড়িয়ে আছে। ‘বামপন্থী’ বা ‘কমিউনিস্ট’ তকমা কোনও দলের নামের সঙ্গে ব্র্যাকেটে জুড়ে রাখাই যায়, তাতে আর মানুষকে আকৃষ্ট করা যায় না। এই নির্বাচনের ফলে পরিষ্কার— নির্বাচনী তরিকায় ‘ব্র্যাকেটে মার্ক্সিস্ট’ দলগুলির থেকে দক্ষিণপন্থী দলগুলির গ্রহণযোগ্যতা আপাতভাবে বেশি হয়েছে। ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদীদের আটকানোর জন্যে সংসদীয় বামপন্থীদের থেকে সংসদীয় দক্ষিণপন্থী তৃণমূলকে মানুষ হয়তো বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেছে। আর, উদারনীতি-বেসরকারিকরণের রূপায়ণ করতে সংসদীয় বামেদের দোদুল্যমান অবস্থানের থেকে দক্ষিণপন্থীদের ‘দৃঢ়তা’ আপাতভাবে মানুষ মেনে নিয়েছেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, নয়া-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ও আধা-সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে যে শ্রেনিসংগ্রাম চালানোর কথা ছিল সিপিআইএম বা লিবারেশনের, তা ক্রমেই তরলীভূত (diluted) হয়ে গেছে। সিঙ্গুরে ‘কারখানা ওঁহি বানায়েঙ্গে’ স্লোগান দেওয়া কিংবা নন্দীগ্রামে সেজ-ডাও কেমিক্যালের হয়ে সওয়াল করে যাওয়া সিপিআইএমের মতাদর্শগত দেউলিয়াপনা প্রকট করে। সিপিআইএম কৃত বিগত গণহত্যা বা অপশাসনের বাকি নজিরগুলো বাদ রেখেও একথা বলা যায় যে, ২০২১ সালের নির্বাচনে কোনও শ্রেণি-মতাদর্শগত অবস্থান তারা নিতে পারেনি। উদারনীতি এবং বিশ্বায়নকে সমর্থন করা যায় কি যায় না সেই দোদুল্যমানতায় তাদের নীতি ও কৌশল বিপর্যস্ত। ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এই দিশাহীন দোদুল্যমানতা দিয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থাকে ঠেকানো অসম্ভব। ফ্যাসিবাদ আসলে পুঁজিবাদের এক বিকৃত রূপ এবং পুঁজিবাদের মধ্যে (SEZ ও নয়া শ্রমিক আইন ইত্যাদির মধ্যে) মানবিক মুখ খুঁজতে চাওয়ার ভেতরে কৌশলগত পরিবির্তন নয় বরং নীতিগত অবক্ষয় প্রকট হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় নির্বাচনে ক্ষমতাদখল করে, কখনও যুক্তফ্রন্ট কখনও বামফ্রন্ট কিংবা কখনও সংযুক্ত মোর্চা বানিয়ে পুঁজিবাদ-সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে সাময়িক আপস করা যায়; কিন্তু, আদতে যে তা কমিউনিস্ট মতাদর্শের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে দেয়, সেটা প্রমাণিত। ১৯৬৭-২০২১ এই ৫৪ বছরের মধ্যে বাংলায় সংসদীয় বামেরা শূন্যতে নেমে এসেছে। একদা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দম্ভোক্তি “আমরা ২৩৫ ওরা ৩০। কী করবে ওরা?” ও রেজিমেন্টেড পার্টির ঔদ্ধত্য ধুলোয় মিশে গেছে। ১৯৬৪ সালের সপ্তম কংগ্রেসের দলিলে লেখা, ‘শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের চেষ্টা করা হবে’-র ক্রুশ্চেভীয় মতাদর্শ প্রশ্নের মুখে। ডাঙ্গের পথে চলে সিপিআইয়ের গ্রহণযোগ্যতা এখন তলানিতে। ১৯৭০ দশকে ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থাকে সমর্থন জানানোর মতো অপরাধ (ভাতিন্ডা কংগ্রেসে তার সমালোচনা করলেও গ্রহণযোগ্যতা ফেরেনি) ও পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম চালানোর ব্যর্থতায় সিপিআই ক্রমেই মুছে গেছে। সিপিআইএম জরুরি অবস্থার সময় কখনও জনসঙ্ঘের সঙ্গে জোট বেঁধেছে, কখনও তৃণমূলের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের মতো প্রতিক্রিয়াশীল দলের সঙ্গে জোট করেছে। আর, শুধু জোটই নয়, পার্টির মতাদর্শ ভুলে কংগ্রেসের বিগত সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে ন্যায্যতা দিয়েছে। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতালাভ করতে চেয়ে কৌশলকে যত গুরুত্ব দিয়েছে, শ্রেণিসংগ্রামের নীতিতে এবং গণআন্দোলনে তত গুরুত্ব দেয়নি। ফলে, নীতি কৌশলকে নয়, কৌশল নীতিকে নির্ধারণ করেছে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব তাদের দলিলের পাতায় লেখা থাকলেও আদতে খায় না মাথায় দেয়, সেটা মানুষের কাছে আজ আর স্পষ্ট নয়। কারণ, তত্ত্বের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব বাস্তবে অনুশীলিত হয়নি; অনুশীলিত হয়েছে সেজ্-নীতি, টাটার তাঁবেদারি, কৃষক-বিদ্বেষী নীতি এবং ক্রমদুর্বল শ্রমিক-রাজনীতি। যে নীতি ও মতাদর্শের জন্যে কমিউনিস্ট পার্টি (সংসদীয় ও অসংসদীয়) অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলগুলির থেকে আলাদা ছিল, অনুশীলনে সেই নীতি ও আদর্শ বিসর্জিত হওয়ার ফলেই নির্বাচক জনগণ দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে সংসদীয় বামেদের তফাৎ করতে পারেনি। বিজেপি-আরএসএসকে প্রতিরোধের জন্যে কমিউনিস্টরাই যে সবচেয়ে বলিষ্ঠ শক্তি হতে পারে, সংসদীয় বামপন্থীরা সেই ভরসা অর্জন করতে পারেননি। বিগত দু’টি বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বামফ্রন্টের নির্বাচনী ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি; নিপীড়িত জনগণের থেকে আরও দূরে সরে গেছে তারা। দেশের ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিস্ট পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক, সংসদীয় ও সাংবিধানিক পরিসর আরও ক্ষুণ্ণ হবে; এই সংসদীয় বামপন্থীরা তখন কি আবারও কোনও প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থীকে খুঁজবেন জোট করার জন্যে? আরজেডি বা কংগ্রেস বা অন্য কোনও প্রতিক্রিয়াশীলকে সঙ্গে নিয়ে নিপীড়িত ও শোষিতশ্রেণির/বর্ণের মানুষের কাছে ফের ভোট চাইতে যাবেন কিছু আসন ভিক্ষে পেতে?
বিজেপির সর্বভারতীয় নেতাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস এখনও বাংলায় বইছে। নির্বাচনের পরে যে বিজেপি-আরএসএস কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের বাড়িতে যাচ্ছে আরএসএস নেতারা। বিভিন্ন ভুয়ো বয়ান তৈরি করছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে। বেশ কিছু জায়গায় প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অ-বিজেপি কর্মীদের পাল্টা মারছে। সাম্প্রদায়িক হিংসার বয়ান তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করানো যায়। নির্বাচনের আগে প্রকাশ্য জনসভায় বদলা নেওয়ার কথা বলা কিংবা শিল্পীদের রগড়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া বিজেপি নেতারা নিজেদের কর্মীদের মার খাওয়ার খবর পেয়ে ধর্নায় বসছে। বহু জায়গায় তৃণমূলের অত্যুৎসাহী নেতা-কর্মীরা ক্ষমতালাভের বাহুবলে অ-তৃণমূল মানুষদের বেছে বেছে মারছে বা হেনস্থা করছে। নির্বাচনের আগে তৃণমূল বা বিজেপি যে পারস্পরিক সংঘাতের আবহ তৈরি করে রেখেছিল, সেই আবহের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস বাস্তবায়িত হচ্ছে! কিন্তু, বিজেপি-আরেসেসের নেতারা প্রতিরোধের কিছু পদ্ধতি (তা বিষাক্ত হলেও) নিলেও, সিপিআইএম তথা মোর্চার নেতাদের প্রতিরোধ কোথায়? প্রকাশ্যে নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের রক্ষা করার তাগিদ কোথায়? শাসকদলের মার ও হেনস্থার পাল্টা প্রতিরোধ সংসদীয় কমিউনিস্ট দলগুলি নিতে পারছেন না। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের সন্ত্রাস ও বিরোধীশূন্য করে দেওয়ার ঘৃণ্য চেষ্টা সর্বজনবিদিত। বস্তুত ওই সন্ত্রাসের পরে সংসদিয় কমিউনিস্ট দলগুলি ‘শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্র’ লাভের দায়ে এবং সংসদীয় জনতোষের দায়ে নীরব থেকেছে, ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। বিজেপি ও আরএসএস সেই শূন্যস্থান ভরাট করে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছিল ২০১৯ সাল থেকে[2]। গ্রামাঞ্চলে অত্যাচারিত অ-তৃণমূল মানুষ অনেকেই ভেবেছিলেন যে, তৃণমূলের সন্ত্রাস থেকে বিজেপিই তাঁদের বাঁচাতে পারে এবং সেই আশু লক্ষ্যেই ২০১৯ সালে বিজেপি ১৮টি আসন পায় ও ২০২১ সালে ৭৭টি আসন। যদিও, পাল্টা প্রতিরোধের সঙ্গে বিজেপি-আরএসএসের সহায় ছিল প্রচুর টাকা, ‘মেশিনারি’ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর কৌশল। সংসদীয় কমিউনিস্ট দলগুলি অবশ্যই এই পন্থাগুলি নেবে না, কিন্তু, গণপ্রতিরোধের কৌশল অবশ্যই নেওয়া উচিত। কর্মীদের মনোবল বাড়াতে ও মতাদর্শগত অনুশীলন চালিয়ে যেতে। দক্ষিণপন্থী শাসকের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের বাঁচাতে যদি নাইই পারে, তাহলে সংসদীয় কমিউনিস্টদের গ্রহণযোগ্যতা কীভাবে থাকবে? নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে সিপিআইএমের গণসংগঠনের বহু কর্মীর হতাশা প্রকাশ্যে এসেছে। বিশেষত এসএফআই ও ডিওয়াইএফআই-র কর্মীদের হতাশা। বিগত তিন-চার মাসে তাঁদের সক্রিয় ভূমিকার জন্যেই সিপিআইএম পার্টির উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল। বিগত দুই সপ্তাহে আশঙ্কাজনক করোনা-পরিস্থিতিতে তাঁরা বিভিন্ন সেবামূলক কাজে জনগণের পাশে থেকেছেন। সিটু সমর্থিত উবার চালকরা কোভিড-রুগীদের জন্যে পরিবহণের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু, নির্বাচনে একটিও আসন না জেতায় তাঁরা হতাশাগ্রস্ত। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু, এই হতাশা একমাত্র অবস্থান হতে পারে না। এই গণসংগঠনগুলির দায়িত্ব পার্টিকে শক্তিশালী করা এবং পার্টির দায়িত্ব গণসংগঠনগুলির মধ্যে মতাদর্শগত রাজনীতি শক্তিশালী করা। তা হয়েছে কি? জনগণের সেবামূলক কাজ নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়, কিন্তু তা কমিউনিস্ট পার্টির একমাত্র কাজ নয়। আর, কমিউনিস্ট রাজনীতির উদ্দেশ্য ভুলে শুধুমাত্র সেবামূলক কাজ করলে তা হতাশা আনতে বাধ্য, কারণ এসএফআই-ডিওয়াইএফআইদের যে কর্মীরা স্বেচ্ছায় এই সেবামূলক কাজ করছেন, তাঁরা আর্থিক ফায়দার জন্যে করছেন না, তাঁদের পার্টিকে ভালোবেসে করছেন। আর, পার্টির রাজনৈতিক অভিমুখ যদি দক্ষিণপন্থার জোটসঙ্গী হওয়ার মধ্যে বা ‘নিষ্ফল কর্মের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, তবে তা হতাশা আনতে বাধ্য। এমনকি আরএসএসের গণসংগঠগুলিও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সেবামূলক কাজ করে। সেখানে ‘ব্র্যাকেটে মার্কসবাদী’ সংসদীয় দল যদি তার গণসংগঠনের কর্মীদের রাজনৈতিক দিশা দেখাতে না পারে, তাহলে কর্মীদের উচিত পার্টির মতাদর্শকে প্রশ্ন করা। মধ্যপন্থাকে ঘৃণা করা চূর্ণ করা প্রয়োজন অবিলম্বে। বহুক্ষেত্রেই তাঁরা হতাশ হয়ে মানুষের ওপরে আস্থা হারাচ্ছেন এবং মোর্চাকে ভোট না-দেওয়ার জন্যে মানুষকে ‘বেইমান’ বলছেন; কিন্তু, এই রাজনীতিহীন অবস্থান ভবিষ্যতে আরও জনবিচ্ছিন্ন করবে তাঁদের। নির্বাচক/ভোটার কোনও দলের গোলাম নয়, তাঁরা তাঁদের সমস্যার সুরাহা পেতে ভোট দেন। বিরোধী হিসেবে সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলি যদি সেই সুরাহা না দিতে পারে, যদি নিজেদের নীতি-কৌশলগত অবস্থান দিয়ে জনগণের প্রয়োজনকে উদ্দেশ্য করতে না পারে, তা’লে ভোট প্রত্যাশা করাও অনুচিত। জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ— এই নীতিবাক্যকে ধারণ করেই মানুষের কাছে অনুশীলনে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। সেই অনুশীলনস্থল ফেসবুক-টুইটার নয়, শুধুমাত্র কলেজ রাজনীতির সংক্ষিপ্ত পরিসর নয়। শাসকবিরোধিতা শুধু বাৎসরিক একটি ব্রিগেড আর দু’টি মিছিল দিয়ে হয় না, এই পদ্ধতির অনুশীলন অবিচ্ছিন্নভাবে চালাতে হয়— তার যথাযোগ্য নীতি, অভিমুখ ও প্রস্তুতি জরুরি। আর, রাজনীতির দায়বদ্ধতায় পার্টিকে প্রশ্নজর্জর করা প্রয়োজন যে, ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কি এখনও সংসদীয় খুড়োর কলে বিশ্বাস এনে দেয়? প্রয়োজনীয় ও শক্তিশালী নিরন্তর গণআন্দোলন ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা মানুষ কীভাবে বুঝবেন? রণনীতি ও রণকৌশলের প্রকৃত প্রস্তাব ছাড়া ফ্যাসিপ্রবণ শাসকের বিরুদ্ধে লড়া যায় কি?
সংসদীয় বামপন্থী নেতৃত্ব সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে যতটা সওয়াল করেছিলেন, কিংবা তাঁরা ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র পক্ষে/বিপক্ষে যতটা সওয়াল করেছিলেন, তার সিকিভাগও তাঁরা শ্রেণি-রাজনীতির পক্ষে করেননি। ধর্মবিদ্বেষের বিজেপীয় বয়ানের বিরোধিতায় ধর্মের ‘সঠিক’ ব্যখ্যা করা নিয়ে যতটা মনোযোগী ছিলেন, শ্রেণি-রাজনীতি দিয়ে ধর্মদ্বেষকে কীভাবে প্রতিস্পর্ধা জানানো যায়, তা ভাবেননি। শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করার কথা বলেননি কিংবা কৃষিবিদ্রোহের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেননি। সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতাদখল করে বিপ্লবের কথা বলে তাঁরা নিজেদের মতাদর্শকে আরও নিষ্ক্রিয় তরলীভূত করে ফেলেছেন। সংসদীয় ব্যবস্থায় অংশ নিয়ে তারপর শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত করা যে দিবাস্বপ্নের সামিল, আগামীদিনে হয়তো আরও বেশি করে তাঁরা টের পাবেন। কিন্তু, ততদিনে অনেক দেরি না হয়ে যায়। যে সংসদীয় ব্যবস্থাকে ‘ব্যবহার’ করে বিপ্লবের অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে তুলতে গেছিলেন তাঁরা, সেই সংসদীয় ব্যবস্থা তাঁদের ব্যবহার করে ছিবড়ের মতো ফেলে দিয়েছে। ভারতবর্ষের মতো দেশে বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গের রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী থেকে শ্রেণি-রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েই যে ফ্যাসিস্ট ও দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব, সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলির সেই বোধ হওয়া আশু প্রয়োজন। আগের লেখাতেই একথা বলেছিলুম, ছাত্রছাত্রীযুবদের সব মিছিল শান্তির পায়রা উড়িয়ে ঘরে ফিরতে নাও চাইতে পারে। সমস্ত শ্রমিক-কৃষক সংসদীয় আপসের রাস্তায় হেঁটে মধ্যবিত্ত তত্ত্বানুশীলনের ঘেরাটোপে বন্দি হতে নাও চাইতে পারে। নিষ্ঠভাবে যাঁরা লাল পতাকায় বিশ্বাস রাখেন, তাঁরা সবাই দক্ষিণপন্থী শাসকের হাতে মার খেয়ে নেতাদের সুবিধাবাদের স্বার্থে দিগ্ভ্রান্ত হতাশার ভান নাও করতে পারেন। এঁরা প্রত্যেকে গণপ্রতিরোধের দিশা চান। ফ্যাসিস্ত আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে এবং দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংসদীয় কমিউনিস্টদের প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ ভোট দিয়েছেন (বামফ্রন্ট ও লিবারেশনের প্রাপ্ত ভোট নিয়ে), এই মানুষগুলির প্রত্যাশার প্রতি দায়বদ্ধ থাকা সংসদীয় কমিউনিস্ট দলগুলির কর্তব্য। আর, এই কর্তব্য শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত দোদুল্যমান আকাঙ্খায় সম্ভব নয় কিংবা জোট-নির্বাচন-আপসের লক্ষ্যপূরণের সীমাবদ্ধতায় সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গ কোনও দক্ষিণপন্থী শাসক বা উগ্র-দক্ষিণপন্থী বিরোধী দলের হাতে সুরক্ষিত নয়; দুর্যোগের মেঘ আরও ঘনীভূত। কমিউনিস্টদের হয়ে উঠতে হবে বিরোধী রাজনীতির সমার্থক। যে ‘ব্র্যান্ড অফ্ পলিটিক্স’ কমিউনিস্টদের রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করত, এই বাংলায় বা দেশে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছিল, সেই ‘ব্র্যান্ড’ বা বিশেষত (শ্রেণিসচেতন রাজনীতি ও সেই রাজনীতির অধীনে নির্বিত্ত-মধ্যবিত্তকে সঙ্গে নিয়ে অবিরাম রাষ্ট্রবিরোধী গণআন্দোলন) সংসদীয় কমিউনিস্টরা হারিয়ে ফেলেছে বা ডাইল্যুট করে ফেলেছে; তাকে পুনঃজাগরিত করা সময়ের দাবি। কিন্তু, বিধানসভার আসনে বসে বা শোধনবাদের বুলি আউড়ে তা আর সম্ভব নয়।
[1] তবে, নোটার বোতাম টেপার অপশন ২৯৩টা আসনে ছিল। অন্যদিকে, আরএসপি- ১১, সিপিআই- ১০, ফরওয়ার্ড ব্লক- ১৮, সিপিআইএম-এল লিবারেশন- ১২ এবং সিপিআইএম- ১৩৭ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল।
[2] ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, বাইনারি ভাঙার চেষ্টা, তারপর…?, সুশীতল, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১