সার্থক সেনগুপ্ত
চাকুরিজীবী, সিনেমাপ্রেমী
নিঃসন্তান। স্বামী মারা গেছিলেন অনেকদিনই। মরুভূমির বুক চিরে বসানো জিপসাম প্ল্যান্ট যখন কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে গেল, নেভাডার এম্পায়ার শহরও তখন পাততাড়ি গোটাল। একটা গোটা পিনকোড (জিপকোড) হয়ে গেল বন্ধ, বাজার অর্থনীতির কঠিন শর্ত ‘হয় মুনাফা দাও নয়ত গোল্লায় যাও’ মেনে। ফার্ন, যিনি ঝাঁ চকচকে আমেরিকান স্বপ্নের শহরগুলোর থেকে অনাথ স্বামীর সঙ্গে অনেকদিন আগেই বেরিয়ে এসেছিলেন অধুনা এই বন্ধ হয়ে যাওয়া ম্যাড়মেড়ে মরুশহরে, একলা বেরিয়ে পড়লেন তার পুরনো গাড়িতে, যাতে বসবাস করার করার ন্যূনতম জিনিসপত্র ধরে যায়, সঙ্গে থাকে একচিলতে রান্না, শোওয়া আর টয়লেটের ব্যবস্থা। একসময়ের প্রতিবেশিনীর কাছ থেকে পাওয়া ‘হোমলেস’-এর তকমাতে একটু ক্ষুব্ধই হন ফার্ন, বরং ‘হাউসলেস’ অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে হয় তাঁর। আর ঠিক এই জায়গাতেই এই ছবি নেভাডার প্রান্তর থেকে বেরিয়ে আসে বিশ্বের দরবারে, আমাদের মতো অনেকের কাছে যাদের হয়তো নিজেদের ঘর নেই, কিন্তু ইট কাঠ পাথরের সেই চেনা অবয়বের বাইরে এসে, সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে, এক বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে, একটু অচেনা অর্থে, দেয়া-নেয়ার চিরাচরিত হিসেবনিকেশ ছাড়াও ঘর বা সংসারের সুযোগ আছে।
কখনও অ্যামাজনের ওয়্যারহাউসে কাজকর্ম, কখনও কোনও অ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা রেস্টুরেন্টের ঠিকে কাজ, যাকে হালফিলের পরিভাষায় বলা হয় ‘গিগ ওয়ার্ক’। ফার্ন হয়তো চাকরির বাজারের প্রচলিত ধারণায় অপরিহার্য বা ‘বেস্ট ফিট’ নন, কিন্তু নিজেকে ভালোবেসে ফেললে নিজের জীবনধারণের উপায়গুলোর প্রতিও দায়বদ্ধতা এসে যায়, তাই কাজের অভাব হয় না কখনও।
কিন্তু ‘জার্নি’ ছেড়ে বেরোতে পারেন না ফার্ন। ‘জার্নি’র ফাঁকে ফাঁকে আত্মভোলা ভবঘুরে যুবককে লাইটার উপহার দিয়ে বসেন, সহ-ভবঘুরে বয়স্কা মহিলার বন্ধু হয়ে ওঠেন, ভালোও বেসে ফেলেন হয়তো কাউকে। নিজে ভালোবাসা কুড়িয়েও চলেন। কিন্তু আটকা পড়েন না। কখনও দিনে দিনে বেড়ে চলা ঘরবাড়ি হারানো বা নিজের থেকে ঘরবাড়ি ছাড়তে চাওয়া লোকেদের ক্যাম্প, আবার কখনও কোনও মনের মতন শুনশান জায়গায় গাড়ি দাঁড়ায় ফার্নের। জোশুয়া জেমস রিচার্ডের সিনেমাটোগ্রাফিতে আমেরিকার ঝাঁ-চকচকে বহিরাঙ্গের সম্পূর্ণ বিপরীতের রিক্ততা এ ছবির অন্যতম চরিত্র হয়ে ওঠে। পরিচালক ক্লো ঝাও মুন্সিয়ানার সঙ্গে ফার্নের চরিত্রের খাঁ খাঁ করা অথচ সুন্দর দিকটাকে এই রিক্ততার ফ্রেমের সঙ্গে দেন মিলিয়ে। জানিয়ে রাখা ভালো, এই ছবির বেশিরভাগ অভিনেতা অপেশাদার, সত্যিকারের ভবঘুরে, অথবা কেউ ভবঘুরে গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। যেমন বব ওয়েলস। অসম্ভব উদাসী অথচ তীব্রভাবে জীবন-আসক্ত এক চরিত্র। ঠান্ডা শীতের রাতের এক বনফায়ার, কিছু কনফেশন— প্রিয় দর্শক আপনাকে কাঁদিয়ে ছাড়বে। এবং শেষমেশ ববের সেই কথাগুলো। কখনও ফাইনাল গুডবাই বলতে নেই। বলা ভালো, সি ইউ অন দ্য রোড। ওই রাস্তায় কখনও না কখনও আত্মঘাতী সন্তানের সঙ্গে, মৃত স্বামীর সঙ্গে দেখা হবে…
মাঝে মাঝে পিছুটান। বোন আর তার স্বামী। যে বোনের চোখে ছোটবেলার রূপকথার ডাকাবুকো নায়িকা ছিলেন ফার্ন। হোম মর্টগেজ ব্যাঙ্কার ভগ্নিপতির সঙ্গে বোনের সুখের সংসারে ফার্ন কিন্তু অনাহুত ছিলেন না কখনওই। কিন্তু ফার্ন যেন এই নিশ্চয়তার জীবনে একেবারেই অনভ্যস্ত ও অনিচ্ছুক। দু-চার কথায় উঠে আসে আমেরিকার আর্থিক ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়, হাউজিং বাবল বার্স্ট (২০০৮)। সেখান থেকে নৈতিক প্রশ্ন ওঠে সাধারণ মানুষের ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে ব্যবসা করা উন্নত দেশের অর্থনীতিকে। ক্লো ঝাও এইভাবে গোটা ছবি জুড়ে প্রশ্ন করে গেছেন ঘর বা ঘর বাঁধা নিয়ে আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারণার। যে ভবঘুরে গোষ্ঠীর গল্প এই ছবির পরতে পরতে, তাদের সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে বড় উত্থান হয় ২০০৮-এর পরপরই। ষাট বা সত্তর দশকের শুরুতে জন্ম নেওয়া অসংখ্য আমেরিকান, চাকরির শেষবেলায় এসে হারাতে বাধ্য হন বাঁধা চাকরি, স্থায়ী ঘর, অথচ শরীর বা সাধন (ক্যাম্পার, ভবঘুরেদের বাসস্থান ও যানবাহনের মিলিত ব্যবস্থা) কোনওটাই খুব পোক্ত অবস্থায় নেই সময়ের নিয়মে। এ ছবির গল্পের অবলম্বন, জেসিকা ব্রুডারের নন-ফিকশন ‘নোমাডল্যান্ড’ এই কঠিন সময়েরই ডায়েরি।
ভালোবাসাও আসে। ওই যাকে বলা যায় প্রেম। সহ-ভবঘুরে ডেভ। কিন্তু ডেভ শেষ বয়সে এসে বাঁধা পড়েন ছেলের সংসারে, সদ্যোজাত নাতির হাত ধরে। ফার্ন দেখা করতে আসেন। ছবির মতো বাড়ি, সংসার, ভালোবাসার হাতছানি, শিশুর জড়িয়ে ধরা হাতের আঙুল। ফার্ন বাঁধা পড়বেন? তাহলে যে অস্থায়িত্বের গল্প (নাকি গর্ব) এ ছবি করছিল তার কী হবে? এ উত্তর না হয় অনুচ্চারিত থাক এই লেখায়।
উত্তর পেতে, সুযোগ পেলেই দেখে ফেলুন নোমাডল্যান্ড। ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ড-এর ফার্ন অভিনেত্রীর জীবনের সম্ভবত সেরা সম্পদ হয়ে থাকবে। সেরা ছবি, সেরা পরিচালক ও সেরা অভিনেত্রীর অ্যাকাডেমি পুরস্কার এই ছবির অলঙ্কার নয়, প্রাপ্য।