অভীক ভট্টাচার্য
গুরুগ্রামের রায়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিশুহত্যার খবর সামনে আসার দিনদু’য়েক পরের ঘটনা। কথা হচ্ছিল এক ইংরেজি ইলেকট্রনিক চ্যানেলের প্রাক্তন সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধুটি শোনাচ্ছিলেন বছরকয়েক আগের একটি ঘটনার কথা। এক সন্ধ্যায় ধর্ষণ-সংক্রান্ত একটি খবর ব্রেক করতে যাচ্ছে ওই চ্যানেল। যে সাংবাদিক খবরটি পেয়েছেন, তিনি প্রোডিউসারকে ফোন করে জানতে চাইলেন ধর্ষিতাকে সরাসরি এনে হাজির করবেন কি না স্টুডিওয়। মুখ ‘ব্লার’ করে তাঁকে প্যানেলে রাখার সিদ্ধান্ত তৎক্ষণাৎ ফোনেই জানিয়ে দিলেন প্রোডিউসার। চমৎকার সনসনি টক শো হবে। ঝটিতি প্রোমো লিখে ‘কাটতে’ দেওয়াও (এডিট করাকে টেলিভিশনের লোকেরা কাটতে দেওয়াই বলেন) হয়ে গেল – “লাইভ অ্যান্ড এক্সক্লুসিভ, উইথ দ্য রেপ-ভিকটিম অন ক্যামেরা অল দ্য ওয়ে”। প্রাইম টাইমে ঢোকার আগে থেকেই গমগমিয়ে সে প্রোমো চলতে লাগল প্রত্যেকটা ব্রেক-এ, প্রতিদ্বন্দ্বী চ্যানেলের প্রোডিউসারেরা হাত কামড়াতে লাগল, “কী দেখাবে কে জানে রে বাবা! আজ সন্ধ্যার টিআরপি-টা নির্ঘাৎ ওরাই খেয়ে যাবে।” সঙ্গে ক্রাইম বিট-রিপোর্টারদের উৎকণ্ঠিত ফোনাফুনি, “কী খবর? আমরা কেন মিস করলাম? নিউজ-এডিটরকে কী কৈফিয়ৎ দেব?” ইত্যাদি প্রভৃতি।
এদিকে যে রিপোর্টার খবরটা ব্রেক করবে, সে তো ওই মেয়েটিকে নিয়ে ট্যাক্সি করে ঊর্ধ্বশ্বাসে অফিসে পৌঁছেছে। মাঝারি গড়ন, অতি সাধারণ ছাপা শাড়ি, থুতনি-অবধি ঘোমটা। তাকে সোজা পাঠিয়ে দেওয়া হল স্টুডিওয়। রিপোর্টার তার কানের কাছে মুখ নিয়ে সমানে পড়িয়ে যাচ্ছে, কী প্রশ্নের উত্তরে কী বলতে হবে। খানিক পর প্রোডিউসার এলেন। ঘোমটা তোলার নির্দেশ হল। মেয়েটি কিছুতেই তুলবে না, প্রোডিউসারও দেখবেনই। শেষ পর্যন্ত ঘোমটা সামান্য উঠল। প্রোডিউসার দেখে ঠোঁট ওলটালেন। বিড়বিড় করে জানালেন, “আপ-মার্কেট নহি হ্যায়। শো জমেগা নহি…”
রায়ান স্কুলের ঘটনাকে অবশ্যই তা বলা যাবে না। আপ-মার্কেট শহর, আপ-মার্কেট স্কুলের দেওয়ালে আপ-মার্কেট ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, আপ-মার্কেট ছাত্রছাত্রীদের আপ-মার্কেট বাবামায়েরা, সর্বোপরি স্কুলের ওয়াশরুমে স্কুলবাসেরই কন্ডাক্টরের হাতে ছাত্রহত্যার মর্মান্তিক অভিযোগ – এ স্টোরি না-জমে যাবে কোথায়? অথচ তার দিনদুয়েকের মধ্যেই তেলেঙ্গানার সঙ্গারেড্ডি জেলায় এক বেসরকারি স্কুলে ইউনিফর্ম না-পরে আসার অপরাধে ক্লাস ফাইভ-এর এক ছাত্রীকে শাস্তিস্বরূপ ছেলেদের টয়লেটের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হল; বুলন্দশহরের একটি স্কুলে চার বছরের একটি শিশুকে স্কুলছুটির পর বেশ কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা হল তার কয়েকমাসের মাইনে বাকি পড়েছে বলে – এসব খবরের কোনওটাই তো ন্যাশনাল হেডলাইন হল না! বছরকয়েক আগে ওডিশার এক গ্রামের স্কুলে মিড-ডে মিলের ফুটন্ত কড়াইয়ে পড়ে আট বছরের বনিতা কানহার নামে মেয়েটি যখন মারা গেল, ক’টা ওবি ভ্যান দৌড়েছিল ন্যাশনাল মিডিয়ার? ক’মিনিট এয়ার-টাইম বরাদ্দ হয়েছিল সে খবরের জন্য? সেগুলো স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি নয়? নাকি সেসব খবর যথেষ্ট আপ-মার্কেট ছিল না? বেশি দূরে যেতে হবে না। আমাদের এই কলকাতাতেই কয়েকবছর আগে লা মার্টস স্কুলে যে ঘটনা ঘটেছিল তা যদি মুর্শিদাবাদের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে ঘটত, একই উদ্বেগ দেখাত মিডিয়া?
এখানে দুটো বিষয় স্পষ্টভাবে বলে নেওয়া ভাল। প্রথম কথা, রায়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ঘটনাটা ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ বলে প্রমাণ করা কখনওই এ-লেখার উদ্দেশ্য নয়। স্কুল-পরিসরে যেভাবে খুন হতে হয়েছে ফুটফুটে, নিরপরাধ শিশুটিকে, সে নৃশংসতার কোনও ক্ষমা হতে পারে না। স্কুল-কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, প্রশাসনিক গাফিলতি, এবং সর্বোপরি প্রমাণলোপের অপচেষ্টার জন্য শুধু কঠোরতম নিন্দাবর্ষণই নয়, আইন-অনুসারে কঠিনতম সাজাও প্রয়োজন। দৃষ্টান্তমূলক সাজা। কিন্তু সে সাজা চাওয়ার সময় এ-কথা মনে না-আনাই ভাল যে, একজন রায়ান পিন্টো বা একজন অশোককুমারকে সাজা দিলেই স্কুলে ছাত্র-নিগ্রহের সমস্যার একেবারে মূলোৎপাটন সম্ভব হবে। ঘটনার দিন-দুয়েক পরে একটি ইংরেজি ইলেকট্রনিক চ্যানেল যে প্রাইম টাইম-এ #অ্যারেস্টরায়ানপিন্টো নামে টুইটার ক্যাম্পেন চালু করে দেশব্যাপী পায়রা উড়িয়ে দিল, তা নিছক হাঁটু-ঝাঁকানো নাটকীয়তা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাতে হয়তো শোর মচানো যায়, সনসনি হয়, সেনসেশন হয় (লক্ষ করুন শব্দদুটি ধ্বনিগতভাবেও কত কাছাকাছি!), সর্বোপরি টিআরপি কামানো যায়; কিন্তু তার বেশি আর কিছুই হয় না। মাঝখান থেকে সংবাদমাধ্যমের নাটুকেপনার ধাক্কায় মূল সমস্যাটির ওপর থেকেই নজর সরে যেতে থাকে।
আর এখান থেকেই সরাসরি পৌঁছে যাওয়া যেতে পারে দ্বিতীয় বিষয়টিতে। শিশুদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সচরাচর যত খবর আমরা দেখি, শুনি ও পড়ি, তার মধ্যে শিশুরা কতটুকু? আর একটু বিশদ হওয়া যাক। এই যে রায়ান স্কুলের ঘটনাটা নিয়ে এত শোরগোল হচ্ছে চারদিকে, তার মধ্যে পিন্টো পরিবারের ঠিকুজি-কুষ্ঠী পুনরুদ্ধার রয়েছে, সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়া শেষ পনেরো মিনিটের ফুটেজের চুলচেরা বিশ্লেষণ রয়েছে, স্কুলের প্রশাসনিক প্রতিনিধিদের বক্তব্য রয়েছে, ইংরেজি টেলিভিশনের স্বঘোষিত পোস্টার বয়ের গলার শিরা ফুলিয়ে ধমাকেদার চিৎকার রয়েছে, কিন্তু কতটুকু রয়েছে এই তথ্য যে, এমন ঘটনা, আর যাই হোক, ভারতে এই প্রথম ঘটল না? একই ঘটনা অন্য যে কোনও শহরের যে কোনও স্কুলে যে কোনও দিন ঘটতে পারত, ঘটতে পারে? অভিজাত বেসরকারি স্কুলে না-ঘটে গ্রামগঞ্জের যে কোনও সরকারি স্কুলেও ঘটতে পারে (বস্তুত শিশু-নিগ্রহের কত ঘটনাই তো ঘটেও নিত্যদিন)? সম্ভাব্য সেসব ঘটনার মোকাবিলায় স্কুল কর্তৃপক্ষ কতদূর প্রস্তুত, সে প্রশ্ন কি উঠল? স্কুলে শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশিকা রয়েছে, জাতীয় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের নির্দেশিকা রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও নজরদারির সুব্যবস্থা নেই কেন, উঠল কি তা নিয়েও কোনও প্রশ্ন? খবরের কাগজে দেখা গেল হেডলাইন হচ্ছে, “গলায় ছুরির কোপ নিয়েও হামাগুড়ি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল প্রদ্যুম্ন”; কিন্তু দেখা গেল না তো স্কুলে শিশু-সুরক্ষা নিয়মাবলি ঢেলে সাজা ও তার নিয়মিত নজরদারির আশু প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনও সংবাদ-শিরোনাম?
অথচ শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমাদের দেশে বিরল ঘটনা তো নয়। সরকারি তথ্যই বলছে, গত একদশকে সারা দেশে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৫০০ শতাংশ। যদি সংখ্যার হিসেবে দেখি, ২০০৫-এ যেখানে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছিল ১৪,৯৭৫টি, ২০১৫-য় তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪,১৭২-এ। ওই একই সময়কালে শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের হার (অর্থাৎ, প্রতি এক লক্ষ শিশু-পিছু অপরাধের সংখ্যা) বেড়েছে প্রায় ১৫ গুণ। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র ২০১৫ সালের তথ্য বলছে, শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের অর্ধেকেরও বেশি নথিভুক্ত হয়েছে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লি – এই চার রাজ্যে। আর, শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের হারের নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে দিল্লি ও হরিয়ানা। এই সূচকে জাতীয় গড় যেখানে ২১.১, দিল্লিতে তা ১৬৯.৪, আর হরিয়ানায় ৩৫.১। এর চেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হল, এনসিআরবি-র ওই একই বছরের তথ্য-অনুসারে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন-নিগ্রহ, ধর্ষণ, অপহরণ প্রভৃতি পকসো আইনের আওতাধীন অপরাধের প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ও অপরাধীরা ছিল শিশুদের পূর্বপরিচিত। যার সহজ অর্থ দাঁড়ায়, যাদের হাতে শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব, তাঁদের একটা বড় অংশই শিশু-সুরক্ষার প্রতি সম্পূর্ণ অসচেতন, অনির্ভরযোগ্য, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো বা অপরাধমনস্কও।
এমনটাও তো নয় যে, এ-বিষয়ে আইনকানুন আদৌ কিছু নেই। স্কুলে শিশুদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে জাতীয় শিশু অধিকার কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশনামা রয়েছে। বিদ্যালয়ে ছাত্র-নিরাপত্তার বিষয়টি আঁটোসাটো করার জন্য কর্তৃপক্ষকে কী-কী ব্যবস্থা নিতেই হবে, তার সুনির্দিষ্ট তালিকাও রয়েছে গোয়া, পাঞ্জাব, চণ্ডীগড়, কর্নাটক, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যের শিক্ষা দফতরের। কিন্তু নির্দেশিকা থাকা, আর তা পালন করা কি এক? উল্লেখ করা দরকার, ‘গাইডলাইন্স ফর সেফটি অফ চিলড্রেন ইন স্কুল্স’ নামে ৪২ পাতার সবিস্তার নির্দেশিকা রয়েছে গুরুগ্রাম পুলিশেরও – সেই গুরুগ্রাম, যেখানে প্রদ্যুম্নর মৃত্যুর ঘটনা স্কুলে ছাত্র-নিরাপত্তার মস্ত বড় ফাঁকগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। চাইল্ডলাইন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন-এর এক সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের প্রায় ১২ লক্ষের বেশি বিদ্যালয়ের মাত্র ১০ শতাংশে রয়েছে নিজস্ব শিশু-সুরক্ষা বিধি। এ থেকেই বোঝা যায়, কী বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী রোজ স্কুলে যাচ্ছে কার্যত কোনও নিরাপত্তার আশ্বাস ছাড়াই।
কিন্তু, আফশোস, সেই বৃহত্তর ছবিটা উঠে আসতে দেখা গেল না কোনও সংবাদমাধ্যমে। ন্যাশনাল মিডিয়ার টিআরপি লোটার নাটকে মোহিত হয়ে আমরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম প্রদ্যুম্নর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে আরও একটা ক্রাইম থ্রিলার বানাতে। আর আমাদের অগোচরেই রায়ান স্কুলের ওয়াশরুমের দেওয়ালে রক্তের দাগ শুকিয়ে আসতে লাগল।
কে না জানেন, রক্তের দাগ শুকিয়ে গেলে তা প্রায় পানের পিকের পুরনো দাগের মতোই দেখায়?
Bah!! Atmobislesonmulok Lekha chapche!!! Mediar samalochona!! Porer lekhata chpbe to?