কণিষ্ক চৌধুরী
প্রাবন্ধিক, শিক্ষক
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না (১৮৭৬-১৯৪৮)। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির মত তিনিও ছিলেন কাথিয়াবাড় (গুজরাট)-এর এক বণিক পরিবারের সন্তান। শিক্ষাগত দিক থেকে উভয়েই ছিলেন আইনের ছাত্র। পেশাগতভাবে আইনজীবী এবং রাজনৈতিক নেতা। এসব সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্য যে প্রচুর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গান্ধির প্রগতিশীলতা ‘ওরা-আমরা’ বিভাজনকে অতিক্রম করতে পারেনি। সে দিক থেকে ১৯৩০-এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত জিন্নাকে এই বিভাজনের শরিক বলে অতিনিন্দুকেও গাল দিতে পারবে না। জিন্না সম্বন্ধে গোখেলের সেই বিখ্যাত মন্তব্যটি স্মরণ করা যেতে পারে: “জিন্না হলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত।” (Singh, Jaswant. 2009 : 95)। শুধু গোখেলই নন, সরোজিনী নাইডুও জিন্নাকে একই উপাধিতে ভূষিত (apostle of Hindu-Muslim unity) করেছিলেন। (Lal, Chaman. 2016 : 88)। চিন্তার উদার ও আচরণে ভদ্র মহম্মদ আলি জিন্না নামাজ পড়তেন না। আবার ‘পানীয়’ গ্রহণে তার আগ্রহ কিছু কম ছিল না। (পূর্বোক্ত)। একজন সচেতন সুশিক্ষিত মানুষ যুক্তিবাদ ও মানবতার পথকে গ্রহণ করবেন— সেটাই স্বাভাবিক। দেশ ও দশের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে পৌঁছে দেয় তরুণ বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের কাছে। তিনি ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ কেন্দ্রীয় আইনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে ভগৎ সিং সম্পর্কে বলেন:
The man [ভগৎ সিং] who goes on hunger-strike, has a soul. He is moved by that soul and he believes in the justice of his cause; he is not an ordinary criminal who is guilty of cold-blooded, sordid, wicked crime.”
(Jinnah in Noorani, 1996 : 273)
অর্থাৎ অনশনরত ভগৎ সিং একজন হৃদয়বান মানুষ। এই হৃদয়ই তাঁর পরিচালক। তিনি বিশ্বাস করেন যে কাজ তিনি করেছেন তা ন্যায্য ও সঠিক। তিনি কোনও ঠান্ডা মাথার খুনী বা কোনও হীন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত কোনও অপরাধী নন।
আইনসভার এই বক্তৃতাতে জিন্না যথেষ্ট জোরের সঙ্গেই ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডদের অনশন ধর্মঘটের দাবিগুলির প্রতি সমর্থন জানান। ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত ২৪ জুন ১৯২৯-এ লাহোর সেন্ট্রাল জেল থেকে স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে একটি চিঠিতে তাঁদের দাবিগুলি উল্লেখ করেছেন:
১. রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে আমাদের আরও ভালো খাবার প্রাপ্য এবং আমাদের খাবারের মান হবে অন্তত ইউরোপীয় বন্দিদের খাবারের তুল্য। (অর্থাৎ একই খাবার নয়, আমরা চাই একই মানের খাবার)।
২. অতিরিক্ত পরিশ্রমের বা অমর্যাদাকর কোনও কাজ আমাদের দিয়ে করানো চলবে না।
৩. নিষিদ্ধ বই ছাড়া অন্য যে কোনও বই এবং লেখার সরঞ্জাম আমাদের দেওয়ার ব্যাপারে কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করা চলবে না।
৪. প্রতিদিন অন্তত একটা গ্রহণযোগ্য মানের সংবাদপত্র প্রত্যেক রাজনৈতিক বন্দিকে দিতে হবে।
৫. প্রতিটি জেলে রাজবন্দিদের জন্য একটি বিশেষ ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। ওই জেলের সমস্ত রাজবন্দিকে ওই ওয়ার্ডে একসঙ্গে থাকার সুযোগ দিতে হবে। ওই ওয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা ইউরোপীয় বন্দিদের তুল্য হতে হবে।
৬. স্নানাদি ও শৌচাগারের প্রয়োজনীয় জিনিস দিতে হবে।
৭. কাপড়-চোপড়ের মানও উন্নত করতে হবে।(সিং, ভগৎ। ২০১২ : ৭৩-৭৪)
আইনি ভাষাতেই জিন্না তাঁর বক্তৃতায় ভগৎ সিংদের এই দাবিগুলিকে সমর্থন জানিয়ে বলেন:
At any rate, before they are released or sentenced, give them proper treatment. What treatment do they want? What is it that bothers them? Do they want spring mattresses? Do they want dressing tables? Do they want a set of toilet requisites? No, Sir, they for nothing but bare necessities and a little better treatment.
(Jinnah in Noorani. 1996 : 280)
জিন্নার সাফ সাফ বক্তব্য হল, রাজবন্দির মর্যাদার দাবিতে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তরা যে অনশন ধর্মঘট চালাচ্ছেন, তা যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ। তাঁদের মুক্তির বা শাস্তির আগে, তাঁদের সঙ্গে সরকারকে যথাযথ আচরণ করতে হবে। তাঁরা সরকারের কাছে কী চাইছেন? তাঁরা বসানো গদি বা ড্রেসিং টেবিল বা স্নানের প্রসাধন সামগ্রী চাইছেন? না, তাঁরা এসব চাইছেন না। চাইছেন সামান্য কটি জিনিস, আর একটু ভালো আচরণ। তাঁদের দাবি তাই মোটেই বেশি নয়। ব্রিটিশ এই সামান্য বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে দেখে জিন্না তাঁর বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তর মতো সমাজতন্ত্রবাদী বিপ্লবীদের প্রতি জিন্নার এরকম সমর্থন ও সহানুভূতি বিস্ময়কর মনে হতে পারে। জিন্নার রাজনৈতিক ধারণা ভগৎ সিংয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রথমত, ভগৎ সিং সশস্ত্র বিপ্লবী রাজনীতির সমর্থক, হিংসাত্মক কার্যকলাপ যার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অন্যদিকে জিন্না ছিলেন ব্রিটিশ আইনের শাসনের (Rule of Law) একান্ত ভক্ত। তিনি যে পরিবর্তনের কথা বলেন, তা শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে পরিবর্তন। তাঁর কার্যকলাপ নরমপন্থী কংগ্রেসের কার্যকলাপেরই পুনরাবৃত্তি। দ্বিতীয়ত ভগৎ সিং সুস্পষ্টভাবেই সমাজবাদী। জিন্নার ওপর কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী উদারনৈতিক চিন্তার প্রভাবই প্রধান। তৃতীয়ত, শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিশোষণের অবসান ঘটিয়ে ভগৎ সিংয়ের স্বপ্ন শ্রমিক-কৃষকদের প্রাধান্যযুক্ত ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠা করা। জিন্না স্বাধীনতা বলতে সাবেকি উদারবাদ-সম্মত স্বায়ত্তশাসন ও সরকারকেই বুঝতেন। চতুর্থত, ভগৎ সিং ছিলেন কট্টর নাস্তিক। ঈশ্বর-আল্লার কোনও স্থান তাঁর জীবনে ছিল না। এদিক থেকে জিন্নার অবস্থান অনেকটাই ভগৎ সিংয়ের কাছাকাছি। জিন্না নিরীশ্বরবাদী না হলেও, তিনি ছিলেন ‘a casual votary of Islam.’ (Singh, Jaswant. 2009 : 99)। কোট-টাই পরা পাক্কা সাহেব। শোনা যায় মদ্যপান ও নিষিদ্ধ মাংসের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত। তাঁর স্ত্রী রট্টনবাইয়ের পারিবারিক ধর্ম জরাথুষ্ট্রীয় হলেও বিশ্বাসের দিক থেকে অজ্ঞেয়বাদী। এই দিক থেকে দেখলে জিন্না জীবনের এই পর্বে কোনও ধর্মীয় গোঁড়ামির দ্বারা পরিচালিত হননি। বরং সেকুলারবাদই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম অবস্থান ছিল বললে ভুল হবে না। ভগৎ সিংয়ের মানবতাবাদী চিন্তা ও দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়নি। সে কারণেই হয়তো দ্বিধাহীনভাবে তিনি ভগৎ সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন।
আইনসঙ্গত কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের আস্থাশীল জিন্না ভগৎ সিংয়ের সশস্ত্র বিপ্লবের কার্যাবলি/মতাদর্শ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেও তাঁর প্রতি সহানুভূতিকে গোপন রাখেননি। তিনি আইনসভার বক্তৃতায় বলেন, আজ ভারতের যুবক-যুবতীরা ঠিক বা ভুল— যেভাবেই হোক, গভীরভাবে উত্তেজিত, তাদের এই ধরনের অপরাধ করা থেকে আটকানো যাবে না। সে যতই আক্ষেপ করা হোক বা বলা হোক যে এরা বিপথগামী। আসলে এই জঘন্য সরকারি ব্যবস্থাই সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুলেছে। আইনসভায় বক্তৃতা দিয়ে অনেককে প্রভাবিত করা যাবে ঠিকই, কিন্তু তার বাইরেও রয়েছে হাজার হাজার যুবক-যুবতী, যারা এই একই পথ অবলম্বনের অপেক্ষায় আছে। শুধু যুবক-যুবতী কেন, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরাও খুব একটা পিছিয়ে নেই। ভারতবর্ষ ছাড়া অন্যান্য দেশেও দেশের প্রতি দুরন্ত ভালোবাসা ও আবেগের থেকে এই ধরনের কাজ করতে এগিয়ে এসেছেন তাঁরা। (Jinnah in Noorani. 1996 : 273)। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও বিপ্লবীদের প্রতি এই ধরনের সহমর্মিতা ও সহানুভূতি যাঁরা দেখিয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। তবুও ভগৎ সিং সম্পর্কে জিন্নার এই মনোভাবের কথা প্রায় অনুল্লেখিতই থাকতে দেখা যায়। এখানে বিষয়টি উল্লেখ করা হল এইজন্যই যে, জিন্নার মতো একজন সংস্কারপন্থী মানুষও ভগৎ সিংয়ের বিপ্লবী দৃঢ়তা ও মহান দেশপ্রেমকে অস্বীকার করতে পারেননি, বরং স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সততার সঙ্গে।