আশীষ লাহিড়ী
বিজ্ঞানের দর্শন ও ইতিহাসের গবেষক, প্রবন্ধকার, অনুবাদক
১৯০৭ সালে জার্মানিতে পল এর্লরিখ-এর ল্যাবে সংশ্লেষিত হল আর্স্ফেনামিন নামক রাসায়নিক যৌগ; এবং ১৯০৯ সালে তাঁর জাপানি সহযোগী সাহাচিরো হাতা দেখালেন, এটি সিফিলিসের জীবাণু ট্রিপোনিমা প্যালিডামের বিরুদ্ধে অসাধারণ কার্যকর। ১৯১০ সালে ‘স্যালভার্সান’ বাণিজ্যিক নাম দিয়ে এটি বিপণন করল হেক্স্ট কম্পানি।[1] ল্যাব থেকে বাজারে আসতে সময় লেগেছিল মাত্র তিন বছর। সিফিলিসের চিকিৎসায়, বস্তুত জীবাণু-যুদ্ধেই, এল যুগান্তর। এর পর ১৯২৮-এ আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিয়াম নোটেটাম নামক জীবিত ফাঙ্গাস-নিঃসৃত পদার্থের ক্রিয়ায় স্ট্যাফিলোকোকাস জীবাণুর মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করলেন। সেটিই প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু ব্যবহারযোগ্য ওষুধ হিসেবে বাজারে আসতে পেনিসিলিনের আরও চোদ্দো বছর সময় লেগেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির আহত সৈন্যদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে অক্সফোর্ডে এর্নস্ট চেইন এবং হাওয়ার্ড ফ্লোরি সেই কাজটি সম্প্ন্ন করলেন (আর বছরখানেক আগে ওষুধটি বেরোলে রবীন্দ্রনাথ হয়তো বেঁচে যেতেন)। ১৯৩২-এ জার্মানির বেয়ার কম্পানির ল্যাবরেটরিতে গের্হার্ট্ ডোম্যাক (Domagk) তৈরি করলেন প্রোন্টোসিল— অর্থাৎ সালফোনামাইড (সালফা), যা বহু লোকের— তাঁর কন্যারও— স্ট্রেপ্টোকোকাস সংক্রমণ সারিয়ে দিল।[2] জীবাণুদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক যুদ্ধে আরও এক মাইলফলক। বিরাট পুঁজি, বিরাট যুদ্ধ, বিরাট আয়োজন, বিরাট সাফল্য, যা আধুনিক বিগ সায়েন্সের কুললক্ষণ।
জীবাণু-যুদ্ধের ইতিহাসে বিশ শতকের এই তিনটি ঘটনা স্বর্ণাক্ষরে খোদিত। ঠিক ওই পর্বেই একজন বাঙালি রসায়নবিদ ও ডাক্তার শিয়ালদহর ক্যাম্বেল স্কুলে ১০ হাত x ৬ হাত এক ঘুপচি ল্যাবে ১৯১৫ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত কাজ করে ১৯২২ সালে ঘটিয়ে ফেলেছিলেন বিরাট এক কাণ্ড। তৈরি করেছিলেন ইউরিয়া স্টিবামিন নামক এক রাসায়নিক পদার্থ, যা লিশম্যানিয়া পরজীবী-নিধনে পারঙ্গম। তখনও দিগন্তে পেনিসিলিন কিংবা প্রন্টোসিল অনাগত। কিন্তু উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী (১৮৭৩-১৯৪৬)-র সে-কাজের খবর কে রাখে?
একরকম রক্তচোষা বালুমাছি-বাহিত এই লিশম্যানিয়া পরজীবীটি মানুষের দেহে আস্তানা গেড়ে লিশম্যানিয়াসিস নামক অসুখ বাধায়। নামের উৎস উইলিয়াম লিশম্যান, যিনি ১৯০০ সালে কলকাতায় এক রোগীর প্লীহার মধ্যে এই জীবাণু আবিষ্কার করেছিলেন। যকৃত ও প্লীহার লিশম্যানিয়াসিস-এর নাম ভিসেরাল লিশম্যানিয়াসিস, আর তারই অন্য নাম কালাজ্বর; এক সময় দমদম জ্বরও বলা হত।[3] আপামর বাঙালি জানে, সুকুমার রায় ১৯২৩ সালে ওই অসুখে মারা গিয়েছিলেন। ১৯০৭-এর সালভারস্যান, ১৯২৮-এর পেনিসিলিন আর ১৯৩৫-এর সালফা— এই তিনটি বড় আবিষ্কারের বর্গেই তো স্থান পাওয়া উচিত ছিল ১৯২২ সালে ইউরিয়া স্টিবামিন-এর। কিন্তু স্থান দেওয়া হয় কি?
ব্রহ্মচারীরা আদতে ছিলেন মুখোপাধ্যায়। পিতা নীলমণিও ছিলেন ডাক্তার, পূর্ব রেলওয়ের চাকুরে। ১৮৭৩-এ উপেন্দ্রনাথের জন্মের সময় তিনি জামালপুরে। তাঁর ইচ্ছা পুত্রও ডাক্তার হোক। কিন্তু গণিত আর রসায়নের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রটির ইচ্ছা অন্যরকম। ১৮৯৩ সালে হুগলি মহসিন কলেজ থেকে গণিত আর রসায়নে ডবল-অনার্স নিয়ে দুর্দান্ত ফল করে বিএ পাশ করার পর উপেন্দ্রনাথ পিতার ইচ্ছা আর নিজের ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন রসায়ন নিয়ে এবং মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাবিজ্ঞানে। প্রেসিডেন্সিতে আলেকজান্ডার পেডলার আর প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের তালিমে চলল রসায়ন অধ্যয়ন। ১৮৯৪ সালে এমএ। ওদিকে ১৮৯৯ সালে এলএমএফ, ১৯০০ সালে এমবি, ১৯০১ সালে এমডি। অসাধারণ ভালো ফল সব-কটি পরীক্ষাতে। ১৯০৪-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শারীরতত্ত্বে পিএইচ-ডি। বিষয় রক্তের লোহিতকণিকা কীভাবে ভেঙে যায়, Studies in Haemolysis।[4] প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে উচ্চাঙ্গের রসায়ন আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক সমাপতন ঘটেছিল, যা পরে প্রতিফলিত ও সার্থক হয়েছিল তাঁর গবেষণার মধ্যে।
১৯০১ থেকে কিছুদিন ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে প্যাথলজি আর মেটিরিয়া মেডিকা পড়ানোর পর কলকাতায় এসে যখন উপেন্দ্রনাথ ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুলে শিক্ষক নিযুক্ত হলেন, সেসময় লিশম্যানিয়াসিসে প্রতি বছর হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হচ্ছে। জানা গেল, দক্ষিণ আমেরিকার ব্রেজিলে এক ডাক্তার অ্যান্টিমনি ব্যবহার করে এ রোগে কিছু ফল পেয়েছেন। অ্যান্টিমনিকে ব্যবহার করে রাসায়নিক জীবাণু-যুদ্ধে আরও কতদূর এগোনো যায়, তা নিরূপণ করার কাজে নামলেন উপেন্দ্রনাথ। ১৯০৭ সালে সংশ্লেষিত আর্স্ফেনামিন (স্যালভার্সান) দিয়ে দেখলেন, কোনও ফল হল না। ১৯১৫ সালে কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজের (পরে স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের) প্যাথলজির অধ্যাপক লিওনার্ড রজার্স (১৮৬৮-১৯৬২) টার্টারিক অ্যাসিডের সঙ্গে পটাশিয়াম আর অ্যান্টিমনি মিশিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন, যৌগটা এতই বিষাক্ত যে, জীবাণু যত না কাবু হয়, তার চেয়ে বেশি কাবু হয় মানুষ। রজার্স-এর ওই যৌগে পটাশিয়ামের বদলে সোডিয়াম ব্যবহার করে উপেন্দ্রনাথ দেখলেন, তাতে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কিছুটা কমল বটে, কিন্তু সে ওষুধ ব্যবহার করতে হয় অতি দীর্ঘদিন ধরে, যেটা বাস্তবসম্মত নয়। ‘ধাতব অ্যান্টিমনিকে গুঁড়ো করে ক্লোরোফর্মে মিশিয়ে… তৈরি হল কলয়ডাল অ্যান্টিমনি। এই কলয়ডাল অ্যান্টিমনির দ্রবণে ফর্ম্যালডিহাইড মিশিয়ে রোগীর দেহে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে ভালো ফল পাওয়া গেল।’[5] লান্সেট-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে তিনি জানালেন তিনি একটি সুস্থায়ী কলয়েড তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন যাকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। এগিয়ে চলল তাঁর গবেষণা।
অতঃপর এই লবণের নানান রকমফের নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে তিনি দেখলেন এই যৌগটির ইউরিয়া লবণ কালাজ্বরে চমৎকার কাজ করে, এবং তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া অনেক কম। এই ইউরিয়া সংযোজনটিই উপেন্দ্রনাথের গবেষণার সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্ত। এই যৌগটিরই নাম ইউরিয়া স্টিবামিন। এইটি সংশ্লেষ করে উপেন্দ্রনাথ তার বিবরণ প্রকাশ করলেন Kala-azar: Its treatment শীর্ষক গবেষণা-পুস্তিকায়, যেটি পুনঃপ্রকাশিত হল ১৯২০ সালে। শুধু তাই নয়, ১৯২২-এই তিনি ওই ওষুধের ক্রিয়ায় কালাজ্বর থেকে সেরে-ওঠা রোগীদের দেহে এক বিশেষ ধরনের চর্মরোগের অস্তিত্ব ও চিকিৎসা নিয়েও পেপার লেখেন এবং অভিনন্দিত হন।[6]
এসবই ঘটে গেছে ১৯২৩-এর আগে। সুতরাং সুকুমার রায়ের চিকিৎসকদের এসব তথ্য জানবার কথা। তাঁরা যে ইউরিয়া স্টিবামিনের খবর রাখতেন তার আরও একটি পরোক্ষ প্রমাণ হল, সুকুমার রায়ের মৃত্যুর মাত্র দশদিন পর ২০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩-এ ক্যালকাটা মেডিক্যাল ক্লাবের এক সভায় নীলরতন সরকার এ ওষুধের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, জার্মানরা তাদের ক্রুপ কামানের জন্য, কিংবা ফরাসিরা তাদের নৌবহরের জন্য যতখানি গর্ববোধ করে, উপেন্দ্রনাথ-আবিষ্কৃত ইউরিয়া স্টিবামিনের জন্য বাঙালিদের ঠিক ততখানিই গর্ববোধ করা উচিত।[7] যে-ওষুধ নিয়ে প্রকাশ্য সভায় আলোচনা হচ্ছে ২০ সেপ্টেম্বর, সেটা নিশ্চয়ই মাত্র দশদিন আগে তৈরি হয়নি; হয়েছিল তার কিছুকাল আগেই। প্রশ্ন হচ্ছে, চিকিৎসকরা কি সুকুমারের ওপর এই নতুন ওষুধ প্রয়োগ করেছিলেন? যদি না-করে থাকেন, কী তার সম্ভাব্য কারণ? প্রশ্নটা বেশ জটিল। ঔপনিবেশিক জ্ঞান-ক্ষমতার প্রয়োগের প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত।
উপেন্দ্রনাথকে কেউ বলেনি এ নিয়ে গবেষণায় নামতে। খানিকটা তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন আর খানিকটা সমস্যার দুরূহতার প্ররোচনা, এ দুইয়ের টানেই তিনি গবেষণায় নেমেছিলেন। ক্ষমতার কাছাকাছি যাঁরা রয়েছেন তাঁরা খুব বেশি গুরুত্ব দেননি এ গবেষণাকে। একটা অদ্ভুত ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন রাজিন্দার সিং: বিশের দশকে নব-নির্মিত বিজ্ঞান কলেজে উপেন্দ্রনাথকে গবেষণার জন্য ঘর ও অন্যান্য ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সি ভি রামন চাইলেন, সে-ঘর ছেড়ে দেওয়া হোক এক্স-রশ্মি গবেষণার জন্য। শুধু তাই নয়, ব্রহ্মচারী যখন প্রস্তাব করেন, অধ্যাপকদের উচিত আরও কাজের দায়িত্ব নেওয়া, তখনও তাঁকে আক্রমণ করেন রামন![8] অগত্যা তাঁর প্রত্যাবর্তন ক্যাম্বেলে স্কুলের সেই ঘুপচি ল্যাবে।
ল্যাবের টেস্ট টিউবে লিশম্যানিয়া জীবাণু অনেকখানি কাবু হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেল। এবার তো চাই মানুষ-রোগীর উপর পরীক্ষা। তার জন্য চাই যথেষ্ট সংখ্যক রোগী এবং সংগৃহীত উপাত্ত বিশ্লেষণের উপযোগী বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো। তখন আবার মাথা চাড়া দিল সেই ঔপনিবেশিক ক্ষমতা-জ্ঞানের অহমিকা। সদ্য-স্থাপিত কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন হতে পারত এ-পরীক্ষার আদর্শ প্রতিষ্ঠান, কিন্তু সেখানকার কর্তারা, বিশেষত একই বিষয়ের দুই প্রসিদ্ধ গবেষক, লিওনার্ড রজার্স এবং এল নেপিয়ার, তাঁর এই আবিষ্কারকে পাত্তাই দিলেন না। তাঁদের যুক্তি, উপেন্দ্রনাথ-নির্দেশিত পথে ইউরিয়া স্টিবামিন-এর সুস্থায়ী যৌগ তৈরি করতে গিয়ে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন, সুতরাং ও-পন্থা পরিত্যাজ্য। তাতে অবশ্য শাপে বর হল। উপেন্দ্রনাথ সরাসরি অসমের চা-বাগানে মরণাপন্ন কালাজ্বর-রোগীদের ওপর ইউরিয়া স্টিবামিন প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। অভাবনীয় ফল মিলল। অতঃপর তিনি নিজেই বানিয়ে নিলেন নিজের গবেষণার অবকাঠামো। নিজেই সে ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়লেন। সরকারি সহায়তার ওপর ভরসা না করে ১৯২৪-২৫এ কলকাতায় স্থাপন করলেন ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট। বিপুল অর্থ উপার্জন করলেন। সেই অর্থে চলল আরও গবেষণা।
এ এক বিচিত্র ঘটনা। একজন বিজ্ঞানী ল্যাবে গবেষণা করছেন, গবেষণার ফলাফল ল্যাবে এবং মানুষ-রোগীর উপর পরীক্ষা করছেন, সাফল্য পাচ্ছেন, ডাক্তার হিসেবে প্র্যাকটিস করছেন, তারপর কম্পানি খুলে নিজেই সে ওষুধ তৈরি ও বিপণন করছেন (বাথগেট কম্পানি মারফত)। সবই নিজে! এদেশে এমন ঘটনা বিরল; বিদেশেও। ইউরোপের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবার্ট্ কখ-এর আহ্বানে পল এর্ল্রিচ প্রথমে যোগ দিয়েছিলেন বার্লিনের সংক্রামক রোগ গবেষণা কেন্দ্রে। সেখান থেকে গয়টিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তাঁর আবিষ্কৃত যৌগটি বিপণন করেছিল হেক্স্ট কম্পানি। ফ্লেমিং কাজ করেছিলেন সেন্ট মেরিজ সরকারি হাসপাতালে; বিপণনের কল্পনাও ছিল না তাঁর, তিনি এমনকী এর পেটেন্ট্ও নেননি। পরে ওষুধ-নির্মাণে অপারগ যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেনের গবেষক চেইন আর ফ্লোরির অক্সফোর্ডের ‘ল্যাবরেটরি-কারখানা’ থেকে পেনিসিলিন তৈরির প্রযুক্তি কার্যত ছিনতাই করে নিয়েছিল আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ ঔষধ-নির্মাণ সংস্থা ই মার্ক্। যারা গবেষণা করে বার করল পেনিসিলিন, তাদের কোনও বাণিজ্যিক অধিকার রইল না তার ওপর; সে-অধিকার রইল বৃহৎ মার্কিন সংস্থার! এর নাম একচেটিয়া পুঁজি-শাসিত বিজ্ঞান। এখানে কেউ মরে বিল ছেঁচে কেউ খায় কই! আর সালফা আবিষ্কারক ডোম্যাক তো খোদ বেয়ার কম্পানিরই ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করেছিলেন, তারাই তাঁর আবিষ্কারের মালিক। এর পাশে কলকাতার ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইন্সটিটিউট ঔপনিবেশিক ভারতীয় মানদণ্ডে যতই সফল হোক, আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজির দাপটের কাছে তৃণসম। উপেন্দ্রনাথ যদি স্বয়ং ওই পদার্থ তৈরি না-করে, ধরা যাক, হেক্স্ট কিংবা বেয়ার কিংবা ই মার্ক প্রমুখ বহুজাতিকের হাতে তুলে দিতেন, তাহলে ঘটনাক্রম কোনদিকে গড়াত সেটা কৌতূহল জাগায়। উপেন্দ্রনাথ কি ‘জাতীয় বুর্জোয়া’ হওয়ার মাশুল গুনলেন?
বাস্তবে তাঁর তৈরি ওষুধ যখন হাজার হাজার রোগীর প্রাণ বাঁচাচ্ছে, তখন সরকারি চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠানগুলিতে এক অদ্ভুত বিরোধিতা-তথা-অনীহা লক্ষ করা গেল। কেউ লিখলেন, ইউরিয়া স্টিবামিন যৌগটি অস্থায়ী, তাকে সুস্থায়ী অবস্থাতে সংগ্রহ করাই সম্ভব না। ঘুরিয়ে বলা হল, উপেন্দ্রনাথ মিথ্যা দাবি করছেন। ট্রপিক্যাল স্কুলের বিরূপ সমালোচনার কথা আগেই বলেছি। অসাধারণ অধ্যবসায়ের পরিচয় দিয়ে ১৯৩৯ সালে বিলেত থেকে প্রকাশিত ব্রিটিশ এনসাইক্লোপিডিয়া অব মেডিক্যাল প্র্যাকটিস-এ ভারতে কালাজ্বরের চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রবন্ধে লিওনার্ড রজার্স ১৯২২ সালে সংশ্লেষিত ইউরিয়া স্টিবামিনের ভূমিকার কোনও উল্লেখই করলেন না, নিন্দাচ্ছলেও না।[9] ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা অনেকেই এর দ্বারা প্রভাবিত হলেন। ক্ষমতা-জ্ঞানের প্রভাব এতখানিই। লড়াকু উপেন্দ্রনাথ অবশ্য প্রত্যেকটি অভিযোগের অকাট্য স-সাবুদ উত্তর দিতে কসুর করতেন না। কিন্তু তাতে আন্তর্জাতিক চিঁড়ে খুব বেশি ভিজেছিল বলে মনে হয় না।
হয়তো এই সরকারি বিরোধিতা-তথা-অনীহারই বলি হয়েছিলেন সুকুমার রায়। সুকুমারের মৃত্যুর তিন বছর আগেই তো প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল ইউরিয়া স্টিবামিন। সুকুমার যখন অসুস্থ, ক্যাম্বেল হাসপাতালে রোগীদের উপর তখন এ ওষুধের প্রয়োগ চলছে, ‘তার রিপোর্ট তিন বছর ধরে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চে বার হচ্ছে সাত খণ্ডে। ১৯২২ সালের অক্টোবরে … আটটি রোগীর ক্ষেত্রে ইউরিয়া স্টিবামিন প্রয়োগে সাফল্যের রিপোর্ট লিখেছেন উপেন্দ্রনাথ।’[10] তবু সুকুমার কেন পেলেন না এ ওষুধ? কুলি-মজুরদের অসুখ যে-ওষুধে সারে, ভদ্রলোকদের অসুখও কি সে-ওষুধে সারবে— এরকম কোনও বেয়াড়া দ্বিধা কি কাজ করেছিল কলকাতার বড় বড় হাসপাতালের চিকিৎসকদের মধ্যে?
সুকুমার রায়ের চিকিৎসা করতেন তাঁরই মণ্ডা ক্লাবের সদস্য, নামকরা বিলেতফেরত ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র (১৮৭৮-১৯৫০)। তিনি মরণাপন্ন সুকুমারের ওপর সে-ওষুধ প্রয়োগ করলেন না, মোটের ওপর ‘হাওয়া বদলে’র পাশ-কাটানো চিকিৎসা করেই ক্ষান্ত হলেন। হয়তো সরকারি হাসপাতালের প্রথম বাঙালি সুপারিন্টেন্ডেন্ট হওয়ার দরুন কিছু বাধ্যবাধকতা তাঁর ছিল। সেই ঔপনিবেশিক যুগে সামান্য ঝুঁকি নিয়ে কর্তাদের অনুমোদন-বিহীন কিন্তু বাস্তবে পরীক্ষিত ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা সরকারি হাসপাতালের একজন বাঙালি সুপারিন্টেন্ডেন্টের পক্ষে কি সম্ভব ছিল? ঝুঁকিবিমুখ হলে নিশ্চয়ই না। আর ঝুঁকি নিলে সেটা কতটা, তা আমাদের পক্ষে আজকে অনুমান করা শক্ত। সুতরাং দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে দোষী সাব্যস্ত না-করে বরং তাঁকে ঔপনিবেশিক ক্ষমতা-জ্ঞানের অসহায় শিকার হিসেবে দেখাটাই মনে হয় যুক্তিসম্মত।
তাহলে সুকুমার রায় কেবল লিশম্যানিয়া জীবাণুর বলি হননি, হয়েছিলেন ঔপনিবেশিক জ্ঞান-ক্ষমতার দম্ভের, যাকে বাড়িয়ে তুলেছিল ঔপনিবেশিক সরকারের ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্য।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, উপেন্দ্রনাথের মতো হিসেবি ও বাজার-সচেতন পুঁজিপতি কিন্তু ইউরিয়া স্টিবামিনের পেটেন্ট নেননি। কারণ বোঝা মুশকিল। অনেকে মনে করেন, নিছক আইনঘটিত অজ্ঞতাই এর কারণ। জগদীশচন্দ্র কিংবা আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের মতো কোনও আদর্শবোধ যে এ সিদ্ধান্তের পিছনে কাজ করেনি, তাতে সন্দেহ নেই। প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর মাস্টারমশাই, বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা প্রফুল্লচন্দ্রর কাছ থেকে তিনি রসায়ন শিখেছিলেন বটে, কিন্তু দেশমঙ্গলের পাঠ নেননি। তাঁর ব্রিটিশ-ভজনায় কোনও খাদ ছিল না। তাই তাঁর ওষুধের পেটেন্ট না-নেওয়াটা খুবই আশ্চর্যের ঘটনা। এর ফলে, আরও অনেকেই ওই ওষুধ একটু এদিক-ওদিক করে বাজারে ছাড়তে লাগল। অথচ নিজের ব্র্যান্ডের একচেটিয়া অধিকারের দাবিতে পেটেন্ট-হীন উপেন্দ্রনাথ এ নিয়ে মামলাও করেছিলেন। জাতীয় পুঁজি বিকাশের পথে এ-ও কি এক প্রতিবন্ধক— এই আধা-পুঁজিতান্ত্রিক অ-পেশাদারি মনোভাব?
তাই বলে একথা বললে ভুল হবে যে উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কার কোনওই বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি পায়নি। বরং উলটো। নীলরতন সরকারের প্রশস্তির কথা আগেই বলেছি। ব্রিটিশ কালাজ্বর-গবেষক এইচ ই শ্রট লিখেছিলেন, ‘এ এক নাটকীয় সাফল্য; ৯০ শতাংশ মৃত্যুহার রাতারাতি রূপান্তরিত হয়ে গেল ৯০ শতাংশ নিরাময়-হারে।’ ১৯৩২ সালে শ্রট-এর সভাপতিত্বে গঠিত ভারত সরকারের কালাজ্বর কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী ফ্রান্স, গ্রিস, চিন আর ব্রিটিশ শাসনাধীন সুদানের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, নিওস্টিবোসান নামক অন্য একটি চালু ওষুধের তুলনায় ইউরিয়া স্টিবামিন ঢের বেশি কার্যকর। অসমের জনস্বাস্থ্য আধিকারিক ১৯৩৩-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে লেখেন: ‘ … ১৯২৩ সালের পর থেকে বর্তমান বছরের শেষ পর্যন্ত অন্ততপক্ষে ৩২৮,৫৯১ জন লোককে এই ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছে। এতটুকু অতিরঞ্জন ছাড়াই বলা যায়, এ রাজ্যে প্রায় ৩.২৫ লক্ষ মূল্যবান প্রাণ এর ফলে রক্ষা পেয়েছে।’[11]
এতসবের পরেও দেশের শ্বেত-বাদামি উভয় বর্ণের একশ্রেণির ডাক্তারের মনে যে কী দ্বিধা কাজ করছিল, বলা মুশকিল। অথবা ঔপনিবেশিক জ্ঞান-ক্ষমতার তত্ত্ব মাথায় রাখলে, এর কারণ বোঝা একটুও কঠিন নয়।
ফলে অদ্ভুত এক অবস্থার সৃষ্টি হল। একদিকে দেখা যাচ্ছে, ইউরিয়া স্টিবামিন ব্যবহার করলে শতকরা ৯০ ভাগ কালাজ্বর কেস সেরে যাচ্ছে; অন্যদিকে ভারতে কালাজ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে: ১৯২৫-এ ছিল ১৬,৭৬৬; ১৯৩৮-এ ২১,৬৪২। ‘তারপর সামান্য কমলেও ১৯৪৪-৪৫ সালে আবার বেড়ে যায়।’[12] এই বিচিত্র পরিসংখ্যান-প্রহেলিকার সমাধান কিন্তু খুব সহজ। যারা ওই ওষুধ পাচ্ছে, তাদের ৯০ শতাংশ সেরে উঠছে; কিন্তু প্রশ্ন, কতজন পাচ্ছে ওই ওষুধ? বেশিরভাগই পাচ্ছে না, কারণ ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলি সক্রিয়ভাবে ভারতের মানুষকে ওই ওষুধের সুফল থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল।
আরও প্রশ্ন, ইউরিয়া স্টিবামিন ছাড়াই ভারত থেকে কালাজ্বর প্রায় উৎখাত হল কী করে? এর উত্তর খুব সহজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় ব্রিটিশ-মার্কিন সৈন্যরা ভারতের নানা জায়গায় ঘাঁটি তৈরি করার সময় ম্যালেরিয়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ ডিডিটি ছড়িয়েছিল। তাতে ম্যালেরিয়ার মশা যেমন সাফ হল, তেমনি কালাজ্বরের বালুমাছিও মরল। ফলে লুপ্ত হল কালাজ্বর, ইউরিয়া স্টিবামিন-ও গুরুত্ব হারাল। এ যেন রোমাঞ্চকর এক নাটকের আচমকা এক অপ্রত্যাশিত পরিণতি, অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স!
এ থেকে অবশ্য প্রমাণ হল, সরকার যদি জনস্বাস্থ্য–সচেতন হয়ে যুদ্ধ-সদৃশ তৎপরতায় পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে, তাহলে এ ধরনের মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়া খুব কঠিন নয়। এর আরও জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ চিন। লিশম্যানিয়াসিস-এরই মতো শিস্টোসোমিয়াসিস এক সময় চিনের কোটি কোটি মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। উনিশশো পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে মাও সেতুং-এর নীতির দ্বারা প্রণোদিত হয়ে বৃহৎ সাংহাই অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ সচেতন মানুষ ওই রোগের জীবাণুবাহী শামুক-বংশ ধ্বংস করার গণ-আন্দোলনে সামিল হন; একই সঙ্গে গবেষণামূলক পদ্ধতির প্রয়োগে এগিয়ে আসেন ডাক্তাররা। বিজ্ঞান আর গণ-অংশগ্রহণ— এই অসামান্য মণিকাঞ্চনযোগ সুফল ফলিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে সাংহাই অঞ্চলে ওই জীবাণু-বাহী একটি শামুকও খুঁজে পাওয়া যায়নি; ১৯৫৮ সালের পর জাত একটি শিশুর মলেও তার কোনও চিহ্ন মেলেনি।[13] এতটা একটা পর-পদানত দেশে আশা করা অবাস্তব; ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত ভারতেও কি সম্ভব?
সুর তবু লেগেছিল
নোবেল-পুরস্কারের জন্য নাম-প্রস্তাবনার নেপথ্য-ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন রাজিন্দার সিং। তিনি লক্ষ করেছেন, চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা শারীরবিজ্ঞানে কোনও ভারতীয় নোবেল পুরস্কার পাননি, এমনকী এ ক্ষেত্রে বেশি নাম প্রস্তাবিতও হয়নি। উপেন্দ্রনাথ সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। দু-দুবার তাঁর নাম ওই পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল। প্রথমবার ১৯২৯ সালে। প্রস্তাব করেছিলেন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের রসায়ন ও শারীরবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুধাময় ঘোষ। অবাক কাণ্ড এই, ওই ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারিতেই কলকাতার ট্রপিক্যাল স্কুল অব মেডিসিনের যে-তিনজন গবেষক ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এ উপেন্দ্রনাথের দাবি খণ্ডন করে পেপার প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা হলেন সুধাময় ঘোষ, রামনাথ চোপড়া এবং নীহাররঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের মতে, উপেন্দ্রনাথ-নির্দেশিত পথে ইউরিয়া স্টিবামিন-এর সুস্থায়ী যৌগ তৈরি করা যায় না।[14] অথচ সেই সুধাময় ঘোষ সেই একই সময়ে উপেন্দ্রনাথের নাম নোবেল পুরস্কারের জন সুপারিশ করছেন। এ এক রহস্য।
রহস্য আরও ঘনীভূত হয়, যখন দেখি, ১৯৪২ সালে আবার কলকাতা থেকে যে-পাঁচজন তাঁর নাম প্রস্তাব করেন, এই সুধাময় ঘোষ তাঁদের অন্যতম। অন্যরা হলেন: ইউ পি বসু (মেডিক্যাল কলেজ, মেডিসিনের অধ্যাপক), এম এন বসু (কারমাইকেল কলেজ, অ্যানাটমির অধ্যাপক), সুবোধচন্দ্র মহলানবিশ (কারমাইকেল কলেজ, ফিজিওলজির অধ্যাপক), সি সি বসু (কারমাইকেল কলেজ, প্যাথলজির অধ্যাপক)।[15] এঁরা সকলেই বাঙালি এবং একজনও ডাক্তার নন। কলকাতার বাইরে, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে তাঁর নাম-প্রস্তাবকের সংখ্যা এতই কম ছিল যে, তাঁর ওই পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা কখনওই খুব উজ্জ্বল ছিল না।
সে তুলনায় ঢের বেশি চাঞ্চল্যকর এবং শিক্ষাপ্রদ তাঁর রয়্যাল সোসাইটির ফেলো না-হওয়ার বৃত্তান্ত। উপেন্দ্রনাথকে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো করবার উদ্যোগটি গ্রহণ করেন মেঘনাদ সাহা, যিনি ডাক্তার নন, শারীরবৃত্ত কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানেরও লোক নন, এবং মতাদর্শগত দিক থেকে উপেন্দ্রনাথের একেবারে বিপরীত মেরুর মানুষ। বহু কষ্টে বীরবল সাহনি ও কে এস কৃষ্ণণ প্রমুখ দেশি বিজ্ঞানীর দ্বিধা আর বিদেশি বিজ্ঞানীদের বাধা কাটিয়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে সে-কাজে প্রায় সফল হয়েছিলেন তিনি। বিদেশি বাধাটাই ছিল প্রবল। ১৯৩৯ সালে, যখন উপেন্দ্রনাথের ফেলো হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছিল, ঠিক তখন ট্রপিক্যাল স্কুলের উদ্যমী উপেন্দ্র-বিদূষক লিওনার্ড রজার্স নেচার কাগজে লিখলেন এক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত প্রবন্ধ। ১৯৪০ সালে ব্রহ্মচারী প্রতিটি মিথ্যা অভিযোগ খণ্ডন করলেন ওই পত্রিকায় চিঠি লিখে। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীদের মনের খচখচানি কমল না। তাঁরা মেনে নিলেন, উপেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে রজার্স-আনীত অভিযোগগুলি মিথ্যা; কিন্তু উপেন্দ্রনাথের কাজকে বৈজ্ঞানিক অর্থে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হল না তাঁদের। কিন্তু যে-ওষুধ কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে তার গুরুত্ব এত কেন কম হবে? অদম্য মেঘনাদ এই বিষয়ের অন্য অনেক বিশেষজ্ঞকে দিয়ে এইসব ব্যাখ্যার গলদ কোথায়, রয়্যাল সোসাইটিকে তা বোঝাতে উঠেপড়ে লাগলেন। প্রায় রাজি করাতেও সক্ষম হলেন। এমনকী প্রাথমিক একটা নোটিসও বেরিয়ে গেল সেই মর্মে। আর ঠিক তখনই ১৯৪৬ সালে মৃত্যু হল ডাঃ ব্রহ্মচারীর। রাজিন্দারের অনুমান, বেঁচে থাকলে তিনিই হয়তো হতেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে রয়্যাল সোসাইটির প্রথম ভারতীয় ফেলো।[16] তবে এখানে উল্লেখযোগ্য, রয়্যাল সোসাইটির ফেলো না হলেও, উপেন্দ্রনাথ কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদাবান রয়্যাল সোসাইটি অব মেডিসিন-এর ফেলো হয়েছিলেন। সেটা কি সান্ত্বনা পুরস্কার?
উপসংহার
দুঃখের ও বেদনার কথা এই যে এত বড় এই বাঙালি বিজ্ঞানীটি ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উগ্র, দ্বিধাহীন সমর্থক। বিপ্লবীরা, জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন তাঁর চক্ষুশূল। শিক্ষিত অগ্রসর বাঙালিদের মধ্যে উপেন্দ্রনাথের মতো এমন উৎকট ও প্রকাশ্য ব্রিটিশ-ভজনার নিদর্শন আর আছে কিনা সন্দেহ। অথচ কঠিন পরিহাসের ব্যাপার এই যে, যাঁদের ‘কীর্তনে কৃতার্থ দোহার’ হয়ে তিনি সারা জীবন কাটালেন, তাঁদেরই, অর্থাৎ ব্রিটিশ উপনিবেশপন্থী বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ তাঁর প্রাপ্য সম্মান হতে তাঁকে বঞ্চিত করেছিলেন! আর হয়তো তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই বিভিন্ন সরকারি চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় বিজ্ঞানীদের, বিশেষত চিকিৎসকদের, একটা অংশ তাঁর প্রতি কিছুটা উদাসীন ছিলেন। খানিকটা আশ্চর্যের ব্যাপার এই, প্রভুপদে নিবেদিত-প্রাণ এই মানুষটি কখনও বিলেত যাননি। অনেকের মতে, জগদীশচন্দ্রের পথ অনুসরণ করে বিলেত গিয়ে সেখানকার চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদদের মহলে নিজের কাজের বিবরণ পরিষ্কার করে মেলে ধরলে, এই বিড়ম্বনার হাত থেকে তিনি রেহাই পেতেন।
তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিক থেকে এসবই গৌণ; আসল গৌরবময় বিষয়টা হল, আধুনিক রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও পদ্ধতি তিনি নিবিড়ভাবে আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন, ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাকে তুলে দিয়েছিলেন এক আন্তর্জাতিক মানে। তাই কলকাতার যে-ট্রপিকাল স্কুলের মেডিসিনের প্রধান এভেরার্ড নেপিয়ার (১৮৮৮-১৯৫৭) একদা ১৯২২-২৩ সালে ইউরিয়া স্টিবামিনের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন,[17] তিনিই উপেন্দ্রনাথের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে মৃত্যু-স্মরণিকা লিখলেন নেচার পত্রিকায়।[18] সেখানেও অবশ্য উপেন্দ্রনাথের প্রগাঢ় রাজভক্তির পরাকাষ্ঠার কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি তিনি। তা হোক, এইখানেই সম্ভবত বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথের সবথেকে বড় জিত: আধিপত্য-কামী প্রতিপক্ষকেও প্রণত করতে পেরেছিলেন তিনি। ক্ষমতাকে ছাপিয়ে উঠেছিল জ্ঞান। এখানেই হয়তো বিজ্ঞানেরও মাহাত্ম্য।
[1] https://en.wikipedia.org/wiki/Paul_Ehrlich
[2] https://en.wikipedia.org/wiki/Prontosil#:~:text=Prontosil%20is%20an%20antibacterial,because%20better%20options%20now%20exist.
[3] নারায়ণচন্দ্র চন্দ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস, লেখনী প্রকাশন, ২০০৪, পৃ্ষ্ঠা ২৭৪
[4] কৃষ্ণা রায়, ‘আলোকপ্রবাহে একটি জ্যোতিষ্ক: স্যার ইউ এন ব্রহ্মচারী’, Hooghly College 175, Hooghly Mohsin College 175th Anniversary Volume, 2011, পৃ্ষ্ঠা ২০৭
[5] ওই, পৃষ্ঠা ২০৮
[6] Rajinder Singh, ‘U N Brahmachari: Scientific Achievements and Nomination for the Nobel Prize and the Fellowship of the Royal Society of London’, Indian Journal of History of Science, March 2019
[7] স্বাতী ভট্টাচার্য, চক্রব্যূহে বৈজ্ঞানিক, মিত্র ও ঘোষ, ২০০৫, পৃষ্ঠা ২৭
[8] Rajinder Singh
[9] কৃষ্ণা রায়, পৃ্ষ্ঠা ২১০
[10] স্বাতী ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ১৯
[11] Rajinder Singh
[12] স্বাতী ভট্টাচার্য্, পৃষ্ঠা ৩১
[13] দ্রষ্টব্য Dr Joushua Horn, Away with All Pests, Monthly Review, London, New York, 1971, pp. 94-106
[14] স্বাতী ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ২৭
[15] https://www.nobelprize.org/nomination/archive/list.php?prize=3&year=1942
[16] Rajinder Singh
[17] কৃষ্ণা রায়, পৃ্ষ্ঠা ২১০
[18] Nature, 399, April 17, 1946
ইউরিয়া স্টিবামিন তথা ব্রহ্মচারীকে নিয়ে একটি চমৎকার লেখা। বিভিন্ন পরতে উপনিবেশকালে জ্ঞান-ক্ষমতার যৌগপদ্যের সুন্দর বিশ্লেষণ।
বলার কথা, স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের শিক্ষক গবেষক নেপিয়ের (যিনি নিজেকে Kala-Azar Research Worker বলে পরিচয় দিতেন) তিনি ১৯২৬-এর এপ্রিল মাসে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেটে “Urea Stibamine” শিরোনামে চিঠি লেখেন। সেখানে ব্রহ্মচারীর কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এরপরে ১৯২৮-এর ১৩ ফেব্রুয়ারী ইউরিয়া স্টিবামিন নিয়ে আরও কিছু পরীক্ষার ফল সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করেন।
ফলে উপনিবেশিক অবহেলার বিষয়টিকে একমাত্রিক না দেখাই ভালো।
আমি সেভাবে দেখছি না। কেবল ঔপনিবেশিক শাসক মহলের নিজস্ব দ্বন্দ্ব গুলো মাথায় রাখছি।
অসাধারণ লেখা। তবে মন-খারাপ-করা লেখাও বটে।