প্যালেস্তাইনের শত্রুরা

প্রবুদ্ধ ঘোষ

 



প্রবন্ধকার, সাহিত্য-গবেষক, দাবা-প্রশিক্ষক

 

 

 

প্যালেস্তিনীয়দের ওপরে ফের আক্রমণ শুরু করল ইজরায়েল, ৬ই মে ২০২১। ‘ফের’ কারণ, এহেন আক্রমণ প্রায়শই করে শক্তিধর ইজরায়েল; যেটুকু ‘প্যালেস্তাইন’ এখনও টিঁকে আছে গাজা স্ট্রিপ আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে, সেটুকুও দখলের অভিপ্রায়ে। ২০২১-র এপ্রিল মাসে পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারাতে ১৩টি ইহুদি পরিবারকে উচ্ছেদের আদেশ দিল ইজরায়েলের বিচারবিভাগ। বিক্ষোভের সূত্রপাত সেখান থেকেই। তারপর ১০ মে আল-আক্‌সা মসজিদে রমজান পালনের সময় আক্রমণ করে ইজরায়েলি পুলিশ– প্যালেস্তিনীয়দের ছোড়া ইট-চেয়ার-পটকার মোকাবিলায় ইজরায়েলিদের তরফে ধেয়ে আসে টিয়ার গ্যাস, রবার বুলেট ও স্টান গ্রেনেড। ইচ্ছে করেই জিওনিস্টরা রমজানের সময়কে বেছে নিয়েছিল, যাতে সামান্য উস্কানিতেই প্যালেস্তিনীয়দের তাতিয়ে তোলা যায় এবং তাদের ওপরে আক্রমণ নামানো যায়। প্রায় দ্বিশতাধিক প্যালেস্তিনীয় আহত হলেন। ইজরায়েলের অত্যাচারের প্রত্যুত্তর দিতে সেই রাতেই গাজা স্ট্রিপ থেকে হামাস রকেট ছুঁড়ল। পরের দিন থেকে ইজরায়েল গাজা স্ট্রিপে কার্পেট বম্বিং শুরু করল পুরনো অভ্যাসে। দ্বিশতাধিক প্যালেস্তিনীয় মারা গেলেন, আহত অসংখ্য। গাজা স্ট্রিপের বহু গুরুত্বপূর্ণ বাড়ি-অফিস ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। প্যালেস্তাইন বারবার ধ্বংসস্তূপ হয়ে যায়, ফের জেগে ওঠে। বারবার। ইজরায়েল ও প্যালেস্তিনীয়দের মধ্যে যুদ্ধহীন বছর খুব কম গেছে। অবশ্য ‘যুদ্ধ’ না বলে আক্রমণ ও প্রতিরোধ বলা যায় একে। বিপুল শক্তিধর জিওনিস্টদের অত্যাধুনিক অস্ত্রে আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রায় দু’টি ‘দ্বীপ’-এ পরিণত হওয়া প্যালিস্তাইনের বাসিন্দাদের প্রতিরোধ। কিন্তু, তারও তো ইতিহাস আছে। নিজভূমে পরাধীন হয়ে থাকা প্যালেস্তিনীয়দের লড়াই নির্দিষ্ট কিছু শত্রুর বিরুদ্ধে।

#

এভাবেই মরে যাওয়া ভালো—
ধবধবে বিছানায় নরম বালিশে
বন্ধুদের মাঝে মরে যাওয়া ভালো।

যে হাতে শিকল নেই, পোস্টার নেই
যে হাতে যুদ্ধদাগ নেই, প্রার্থনা নেই—
তেমন শূন্য বিবর্ণ হাত বুকের ওপরে রেখে
একবার মরে যেতে সুখ।
শার্টে পোড়া গর্ত থাকবে না
পাঁজরে স্প্লিন্টারক্ষত থাকবে না—
এমন নিশ্চিন্তি নিয়ে যদি মরা যেত।

গালের নিচে ফুটপাত নয়, আদুরে বালিশ
প্রেমের বুকে শান্ত মাথা এলিয়ে আছে
উদ্বিগ্ন ডাক্তার নার্স ঘিরে, কাছে,
বিদায়ের বিষণ্ণ এসরাজ বেজে যাচ্ছে—
আহা! এমন রোম্যান্টিক মৃত্যু যদি হত।

ইতিহাসের বিপন্নতার দিকে তাকিয়ে কী হবে!
এই দুনিয়া যেমন কে তেমনই থাক আপাতত
কোনওদিন কেউ ঠিক বদলে দেবেই সব-
এমন আকাঙ্খায় সুখে মরে যাওয়া ভালো।

–মৌরিদ বার্গৌতি (অনুবাদ: আমি)

প্যালেস্তাইনের লড়াই কাদের সঙ্গে?

১. ইজরায়েল: ১৯৪৮ সালের ১৪ মে স্বীকৃতি মিলেছিল। হিটলারের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বলি ইহুদিদের পুনর্বাসনের জন্যে নির্মিত এক রাষ্ট্র। তবে, প্যালেস্তিনীয় ভূখণ্ডে ইহুদিদের প্রবেশ বহু শতক ধরেই। স্পেন থেকে নির্বাসনের পরে ১৪৯২ সালে অনেকে চলে আসেন প্যালেস্তাইনে। ১৬৯৭ নাগাদ য়েহুদার নেতৃত্বে কয়েক হাজার ইহুদি ফের আসেন প্যালেস্তাইনে। পূর্ব ইউরোপে গণহত্যার শিকার হয়ে ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ফের বহু ইহুদি প্যালেস্তাইনে আশ্রয় নেন। হিব্রু ভাষার পুনরুত্থান করেন তাঁরা। ১৯০৯ সালে গড়ে উঠল তেল আভিভ— আধুনিক হিব্রুভাষী শহর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই জিওনিস্টদের সহায়তায় ব্রিটিশরা দখল করল প্যালেস্তাইন এবং জিওনিস্টদের[1] সশস্ত্র বাহিনি আগানা প্রতিষ্ঠিত হল। যদিও, ইহুদি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৮৯৬ থেকেই। তখনও অবধি প্যালেস্তাইনের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১১ শতাংশ ছিল ইহুদিরা। চতুর্থ আলিয়ার পরে প্রায় লক্ষাধিক ইহুদি অভিবাসন ঘটল প্যালেস্তাইনে। প্যালেস্তাইনের আদি মুসলমান বাসিন্দাদের সঙ্গে ব্রিটিশ মদতপ্রাপ্ত ইহুদিদের সংঘাত চরমে পৌঁছাল ১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি। কারণ, হিটলারের ইহুদিবিদ্বেষের ফলে আরেকটি আলিয়া তথা দলে দলে ইহুদিদের প্যালেস্তাইনে চলে যাওয়া। এই অভিবাসিতদের আগমনে প্যালেস্তাইনের অধিবাসীদের সঙ্গে সংঘাতে আগান ও অন্যান্য সশস্ত্র জিওনিস্ট গোষ্ঠীগুলি কয়েক হাজার প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করে। ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদতে ক্রমাগত ইহুদি অভিবাসনে জিওনিস্টদের উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত শক্ত হচ্ছিল কয়েক দশক ধরেই, যা পূর্ণতা পেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ মদতে প্যালেস্তিনীয়দের সমস্ত আপত্তি নস্যাৎ করে বিপুল সংখ্যক ইহুদি অভিবাসনের মধ্যে দিয়ে। ততদিনে প্যালেস্তাইনের প্রায় ৩১ শতাংশ জনসংখ্যা ইহুদিদের এবং শাসনক্ষমতার দখল নিয়ে নিয়েছে তারা। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইজরায়েলকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাইয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে জিওনবাদীদের উগ্র জাতীয়তাবাদও স্বীকৃতি পেল। ইহুদিদের বারবার ইউরোপে অত্যাচারিত হতে হয়েছে ও দেশছাড়া হতে হয়েছে এটা যেমন বেদনাদায়ক সত্যি, ঠিক তেমনই ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় প্যালেস্তিনীয়দের নিজভূমি থেকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার ইউরোপীয়+যুক্তরাষ্ট্রীয় মদতও নিষ্ঠুর সত্যি। সেই সময় উপনিবেশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে, প্যালেস্তাইন থেকে সরে আসছে ব্রিটিশরা; কিন্তু, জিওনিস্টদের আনুগত্যকে স্বীকৃতি দিয়ে প্যালেস্তাইনের ভেতরেই জাতিরাষ্ট্র ইজরায়েলকে প্রতিষ্ঠা করে তৈরি করে দিল এক না-ফুরনো সংঘাত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমানরা জেরুজালেম দখল করে ইহুদিদের ধর্মমন্দির ধ্বংস করেছিল। নিজ বাসভূম থেকে ইহুদিদের তাড়িয়ে সমস্ত কিছুর দখল নিয়েছিল রোমানরা। মধ্যযুগ জুড়ে প্রায় সমস্ত ইউরোপে ইহুদিদের ওপরে নির্যাতন আর নির্বাসনের ইতিহাস। খ্রিস্টানদের থেকে বাঁচতে নিরন্তর পলায়নের যাপন নিয়ে পোল্যান্ডে দলবদ্ধ বাসস্থান তৈরি করল, কিন্তু অচিরেই সেখানেও তাদের ঘেটোবন্দি করা হল। দাগিয়ে দেওয়া হল বিশেষ পরিচ্ছদে, সংস্কৃতিতে ও চিহ্নে— অর্থাৎ মূল ইউরোপীয় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন তারা! কুখ্যাত ‘ব্ল্যাক ডেথ্‌’ পর্বে সব দোষের ভাগী নন্দ ঘোষ হল সেই ইহুদিরাই— তাদের ইংল্যান্ড থেকে নির্বাসন দিলেন এডোয়ার্ড। তাদের ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রুচি— ধর্মান্ধ খ্রিস্টানদের চক্ষুশূল ছিল। একমাত্র মুসলমান অধ্যুষিত দক্ষিণ ক্রিমিয়ায় জারের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল তারা। ১৬৪৮ সালে কসাকদের ইহুদিনিধন কয়েক লক্ষ ইহুদির জীবন কেড়ে নিল। মধ্যযুগের ইউরোপে ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’-র ধর্মান্ধতা ও অন্ধ বিজাতিবিদ্বেষ ইহুদিদের সন্ত্রস্ত করে রাখলেও ইহুদিরা সবচেয়ে নিরাপদ ছিল কায়রো, কুর্দিস্তান, দামাস্কাস, বসরা ইত্যাদি ইসলাম-অধ্যুষিত অঞ্চলে। আরব ও ইহুদিদের সহাবস্থানে সেই সময় আরবজাতিগুলি এবং ইহুদিরা সংস্কৃতি-শিক্ষা-বিজ্ঞানচর্চায় প্রভূত উন্নতিও করে। আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে যে, তৎকালীন আরব-ইহুদি ঘনিষ্ঠতা এবং ইউরোপীয়-ইহুদি শত্রুতার বাস্তবতা আজ পুরো উল্টে গেছে। ফ্রান্স-জার্মানির বুর্জোয়া আর্থ-সংস্কৃতিতে ইহুদিদের বহুল অবদান থাকা সত্ত্বেও ফ্রান্সে ১৮৯৪ সালে আলফ্রেড ডেফ্রিউসকে বিনাদোষে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং ফের চেগে ওঠে ইহুদিবিদ্বেষ— যার পরিণাম আরেকটি ইহুদিনিধন। রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ব্রিটেন— রাষ্ট্রীয় মদতে ইহুদি গণহত্যায় পিছিয়ে ছিল না কেউই। প্রশ্ন জাগে এখানেই যে, জিওনিস্টদের কোন উপায়ে শক্তিশালী করে এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ চারিয়ে দিয়ে আরব দুনিয়ার সঙ্গে ইহুদিদের সুসম্পর্কের এমন অবনতি ঘটাতে সমর্থ হল আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলি? অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, প্রযুক্তি ও গবেষণায় ইহুদি জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে নিয়ে আরব জাতিগুলির বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সমরনীতি টিঁকিয়ে রাখল তারা। প্যালেস্তাইন ও আরব জাতিগুলির সঙ্গে সৌহার্দ্য, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার ইতিহাস ভুলে গিয়ে প্রথমে প্যালেস্তাইন দেশের ভেতর ইজরায়েল রাষ্ট্র গড়ে এবং পরে সেই রাষ্ট্রকেই জাতিরাষ্ট্র রূপে আগ্রাসনের প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে বিস্তার ঘটিয়ে চলল ইহুদিভূমি ইজরায়েল। ১৯৬৭ সালে ইজরায়েল অতর্কিত হানা দিয়ে সিনাই উপত্যকা, জর্ডন নদীর পশ্চিম ভূভাগ ও গোলান উপত্যকার দখল নেয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের শত ‘অনুরোধেও’ ইজরায়েল সেই দখল ছাড়ে না। কয়েক লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সোভিয়েত ব্লকের পতনের পরে আমেরিকান ব্লক যখন সর্বেসর্বা হয়ে উঠল, ইজরায়েলের এই আরবভূমি দখলের দাপট ও জিওনিস্ট সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ আরও বেড়ে গেল।

#

যেদিন আমি খুন হব,
ওহে ঘাতক, আমার পকেট হাতড়ে পাবে
বেড়াতে যাওয়ার কিছু টিকিট—
একটা শান্তির দেশে, অন্যটা বৃষ্টিনগরে,
আরেকটা টিকিট বিবেকের কাছে যাওয়ার।

প্রিয় ঘাতক, এটুকু অনুরোধ রেখো:
টিকিটগুলো নষ্ট কোরো না প্লিজ
ওগুলো নিয়ে, যেও, ঘুরে এসো

-–সমিহ্‌ অল-কসিম (অনুবাদ: আমি)

২. জিওনিস্ট: ১৮৯৬ সালে থিওডোর হারজল ঘোষণা করেছিলেন, “ফিলিস্তিন আমাদের ঐতিহাসিক বাসভূমি। আমরা স্বাধীন মানুষ হিসেবে সেখানেই থাকব ও শান্তিতে বাস করব।”[2] কিন্তু, অনেকেই যেমন শুধুমাত্র হারজলকে জিওনিস্ট মতাদর্শের প্রবক্তা হিসেবে দায়ী করেছেন, তাতে ইতিহাসের কিছু সূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়— হারজল ইহুদিদের চিরন্তন আকাঙ্খাকে সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু, রোমানদের দ্বারা বিধ্বস্ত হওয়া মন্দিরের দেওয়ালে ইহুদিদের বারবার প্রার্থনার জন্যে ফিরে যাওয়া বরাবরই ছিল। প্যালেস্তাইনের ভূমিতে আরবদের সঙ্গে শান্তিতে সহাবস্থানের নিমিত্ত অভিবাসনের প্রক্রিয়াও ছিল। প্যালেস্তাইনের ঊষর জমিতে স্থানীয় ইহুদিরা আমেরিকান-ইহুদিদের সাহায্যে ও নিজেদের উদ্যোগে চাষবাসে প্রভূত উন্নতি ঘটাল। প্যালেস্তাইনের বৃহৎ সংখ্যক জনগণের সঙ্গে শ্রেণিবৈষম্য তৈরি হল ইহুদিদের একটা অংশের। ১৮৯৭ সালে জিওনিস্টরা তাদের প্রথম সম্মেলনে ঘোষণা করল প্যালেস্তাইনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার জিওনিস্ট নেতা রথস্‌চাইল্ডকে প্রতিশ্রুতি দেন প্যালেস্তাইনে ইহুদি জাতিভূমি তৈরি করার এবং এর পরিবর্তে প্যালেস্তাইন সহ সংলগ্ন আরবভূমিতে ব্রিটিশকর্তৃত্ব স্থাপনে জিওনিস্টদের সহায়তা চান। চুক্তি সফল হয়। ১৯২০-র দশক প্যালেস্তাইন দখলে জিওনিস্টদের ভূমিকার পৌষমাসের দশক। বহু কারণের একটি হল পোল্যান্ড ও রাশিয়া থেকে যে ইহুদিরা অভিবাসিত হলেন, তাঁরা কৃষিকাজ ও শিল্পে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন এবং অপরটি হল আমেরিকান মদতে ‘ইরগুন এতজাইলুওমি’ বা জাতীয় সামরিক সংগঠন তৈরি করে ফেললেন জিওনিস্টরা। ১৯২৫ সালে জেরুজালেমে হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইফাতে একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ও তৈরি হয়ে গেল। হারজল যে আকাঙ্খাকে অভিমুখ দিতে চেয়েছিলেন, ক্রমেই তা আন্তর্জাতিক জিওনিস্ট আন্দোলনের প্রস্তুতির দিকে এগোল। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত আগানা ১৯৪৮ সালে বদলে গেল ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনিতে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হল মোসাদ— সিআইএ-র পরে সবচেয়ে শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক গুপ্তচর সংস্থা। জিওনিস্টদের উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আগ্রাসী রূপ পেতে থাকল জাতিরাষ্ট্র প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই। প্রায় দু হাজার বছর ধরে ইহুদিদের অত্যাচারিত হওয়ার (যার প্রায় সবটাই ইউরোপীয় জাতিগুলির হাতে) বৈপরীত্যে ইহুদিদের উগ্র জাতীয়তাবাদী আকাঙ্খা আমেরিকা ও প্রথম সারির শক্তিধর ইউরোপীয় জাতিগুলির ভরসায় ইসলামবিরোধী ভরকেন্দ্রে পরিণত হল। জিওনিস্টদের জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া (যে ইহুদি নিজেরাই নাজিবাদ ও ফ্যাসিবাদ দ্বারা চরম নিপীড়িত ছিল) অন্যান্য ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলিকে উৎসাহিত করল। তার অন্যতম উদাহরণ ভারতরাষ্ট্র— হিন্দুত্ববাদীরা ভারতকে যে জাতিরাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে, তার অন্যতম প্রচারকৌশল হচ্ছে, অত্যাচারিত ও শোষিত (যা একেবারেই কাল্পনিক বয়ান) হিন্দুদের একত্র হতে হবে এবং মুসলিমনিধন করে হিন্দুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের একাধিক সামরিক চুক্তি, পারস্পরিক হৃদ্যতা এবং ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন আগ্রাসনে ইজরায়েলকে সমর্থন (ঘোষিত ও অঘোষিত দুভাবেই) জিওনিস্টদের রাজনীতিকে মান্যতা দেয়। সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে (১৯৮০)’-র যন্তরমন্তর ঘর মনে আছে? যন্তরমন্তর ঘরের দরজা বন্ধ হলে কোন চিহ্ন নির্মাণ হত? ইজরায়েলের পতাকার সেই ষড়ভুজ! শ্রমিক-কৃষক-প্রতিবাদী সকলেই সেই ঘরে ঢুকে গেলে মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের পরে বেরিয়ে আসত শাসকশ্রেণির নির্দিষ্ট মতাদর্শকে মাথায় নিয়ে। শাসকের পক্ষে থাকা বিজ্ঞানী নিত্যনতুন আবিষ্কার করত মানবকল্যাণে নয় বরং রাষ্ট্রীয় মতাদর্শকে বজায় রাখতে। জিওনিস্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ এভাবেই তাদের মতাদর্শকে মানুষের চেতনায় স্থাপন করত।

প্যালেস্তাইনের ইহুদি ও আরবরা ইংরেজের পক্ষ নিয়ে জার্মানি+ইতালি অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। প্যালেস্তাইনে বসবাসরত ইহুদি আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে প্যালেস্তাইনে আগত ইহুদিদের মধ্যেও শ্রেণিবৈষম্য ও সামাজিক স্তরগত বৈষম্য ছিল প্রবল। স্থানীয় আরবদের সঙ্গে বৈষম্য তো ছিলই। জিওনিস্টদের তৈরি ‘মেক্‌কাবি’রা বহু সন্ত্রাসমূলক অন্তর্ঘাত চালিয়ে প্যালেস্তিনীয়দের কোণঠাসা করে ফেলেছিল। আর, ততদিনে ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা ও আরব শাসকরা প্যালেস্তাইনের কর্তৃত্ব নিয়ে টালমাটাল। আমেরিকার মদতে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আমেরিকাই সবচেয়ে শক্তিধর ও সাম্রাজ্যবাদী দেশ) নবাগত ইহুদিরা এই বৈষম্য আরও বাড়িয়ে নিতে লাগল আর জিওনিস্টদের উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের ব্যাপক প্রচার চলতে লাগল। ফলে, যে আরবদের সঙ্গে দীর্ঘ কয়েক শতকের সহাবস্থান ও দৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল, তা ভাঙ্গল অচিরেই। সর্বোপরি, জিওনিস্টদের দাবিকে মদত দিয়ে জাতিপুঞ্জের সিদ্ধান্তে প্যালেস্তাইন ভাগ হল। প্যালেস্তাইনের আজাদির ওপরে সংগঠিত সাম্রাজ্যবাদের সেই প্রথম আঘাত। প্যালেস্তাইনের সমুদ্রতীরে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হল, অপরদিকে প্রতিষ্ঠা হল জর্ডন। প্রায় দশ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তু হল এই সিদ্ধান্তের ফলে। আর, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের মিশেলে প্রতিষ্ঠা পেল ইজরায়েল রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক জিওনিস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে ইজরায়েলের এই জাতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার প্রকল্পনা অব্যাহত থাকল পরবর্তী দশকগুলিতেও। যার বাস্তবিক প্রমাণ— প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল মানচিত্রের ক্রমাগত বদল। ১৯৪৬ সাল থেকে ২০২১ সাল অবধি দু দেশের মানচিত্র দেখলে দেখা যাবে যে, ক্রমাগত আগ্রাসনে ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ড কীভাবে দখল করছে। আরববিরোধিতার অজুহাতে ইজরায়েল-আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স সম্মিলিত শক্তির সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে প্যালেস্তাইন এখন শুধুমাত্র গাজা স্ট্রিপ আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে টিঁকে আছে। আর, গাজা স্ট্রিপের দখল নিতে ইজরায়েল-আমেরিকা-ব্রিটেন শক্তি প্রায়ই যুদ্ধ চালায়, তার বিপরীতে চলতে থাকে প্যালেস্তিনীয়দের অসম কিন্তু দুঃসাহসী প্রতিরোধ। আন্তর্জাতিক জিওনিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে প্যালেস্তাইনের লড়াই সত্যিই ডেভিড বনাম গলিয়াথের মতো— তবু, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রতিরোধ বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতা।

#

১৯৪৭ সাল থেকে ইজরায়েলিরা আমদের জীবন বিপন্ন করে দিয়েছে। আমি এবং আমার পরিবার সেই ভুল জাতি ও ভুল ধর্মের, যাদের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দিতে চায় এই রাষ্ট্র। কিন্তু, এটাই আমার মাতৃভূমি, এটাই আমার বাসা। আমি এখানেই থাকব। এটা আমার অধিকার, সে আমি প্যালেস্তিনীয় হই আর ইজরায়েলি, ইহুদি বা খ্রিস্টান বা মুসলিম যাই হই না কেন, মানুষ হিসেবে এটুকু আমার অধিকার। হ্যাঁ, আমরা প্রত্যেকে মানুষ!

–মহম্মহ ওমর[3] (অনুবাদ: আমি)

৩. বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদ: উন্নয়নশীল দেশের মুষ্টিমেয় ধনী ও বড় পুঁজিপতিদের গ্রাস করে নিয়ে তাদের নিজেদের দেশে তাদের দিয়েই বৃহত্তর পুঁজিপতি গোষ্ঠীর জন্যে বাজার তৈরি করানো। আর, এই কাজের ধারাবাহিকতায় জনগণের দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও দুর্বিষহ জীবনের বিনিময়ে আরও বেশি মুনাফা লুঠে নেওয়া। আরবদেশের সম্পদের সবথেকে বড় মূলধন হচ্ছে খনিজ তেল। এই তেলের খনির লোভে আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো দুই বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী দেশ যুদ্ধ আর মতানৈক্য জিইয়ে রাখে। নিজেদের পক্ষে তৈরি রাখে কিছু পারিষদ-দেশ, যারা সময়মতো পারস্পরিক যুদ্ধহুমকিতে সায় দেবে। ইজরায়েল আমেরিকা ও ইউরোপীয় ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর সেই ঘুঁটি যাকে ভরকেন্দ্র করে আরব দেশগুলির ওপরে নিরন্তর দখলদারির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া যাবে। সাম্রাজ্যবাদ মানে ইজরায়েলের জন্যে বরাদ্দ আরও অর্থ এবং আরও অস্ত্র! সাম্রাজ্যবাদ মানে অন্যান্য মহাদেশের বন্ধুশক্তিগুলিকে দিয়ে ইজরায়েলের আগ্রাসনকে মর্যাদা দেওয়ানো। ১৯৪৮ থেকে ২০২১ অবধি যতবার ইজরায়েল আরবভূমি দখল নেওয়ার চেষ্টা করেছে, ততবার তার নামে জয়ধ্বনি উঠেছে আমেরিকা ও তার মিত্রদেশগুলির তরফে, কারণ ইজরায়েলের আগ্রাসন ও যুদ্ধজয় মানে আরব জাতিগুলির সঙ্ঘবদ্ধতার পরাজয়। আরব জাতিগুলিকে ‘ইসলাম মানেই সন্ত্রাসবাদ’ এই সমীকরণে নিরন্তর আক্রমণে বিধ্বস্ত করা গেলে মুক্তি আন্দোলনের বয়ানকে দমিয়ে রাখা যাবে। জিওনিস্টদের উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ইজরায়েলের সঙ্গে বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের আঁতাত এইজন্যেই। প্রত্যেকবার ইজরায়েল রাষ্ট্রের আগ্রাসন এবং প্যালেস্তাইনের প্রতিরোধ চলার সময় সাম্রাজ্যবাদী শিবিরগুলি জিওনিস্টদের ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্রের পক্ষে সাফাই দেওয়া শুরু করে। চাপা পড়ে যায় উদ্বাস্তু হওয়া অসংখ্য প্যালেস্তিনীয়র শোক, তাঁদের প্রতিমুহূর্তের অনিশ্চিত যাপনের গ্লানি। সেই পথ ধরেই প্রচুর অর্থ আর অস্ত্র আসে জিওনিস্টদের পক্ষে, ইজরায়েলের অস্ত্র গবেষণায় বিনিয়োগ হয় প্রচুর অর্থ। আবার, ইজরায়েল থেকে সেই অস্ত্র কেনে ভারত ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ। রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট— যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা যে দলের হাতেই থাকুক, যুদ্ধোৎসাহ থামে না। তেলের খনি দখলের লড়াই চলে, নয়া উপনিবেশ গড়ার চেষ্টা চলে এবং গণতন্ত্রকে হত্যা করে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপ্রধানদের জোট তৈরির চেষ্টা চলে। জো বাইডেন— ট্রাম্পকে হারানোর পরে যাকে নিয়ে ভারতীয় লিবেরাল ও সংসদীয় বামেদের উদ্দীপনার অন্ত ছিল না, সেই বাইডেন ২০১৯ সালেই সাফ জানিয়ে দিয়েছিল ধর্মীয়-সন্ত্রাসবাদী জিওনিস্টদের প্রতি সমর্থনের কথা— “Israel has a right to defend itself against terrorist threats.” ইজরায়েলের সমরাস্ত্র উৎপাদন, আয়রন ডোম প্রযুক্তির প্রতি সমর্থনের কথা প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বাইডেন। বিশ্বের সামনে বড় ক’রে তুলেছিলেন ইজরায়েলের নাগরিকদের আক্রান্ত হওয়ার কথা কিন্তু একবারও বলেননি যে, গাজা স্ট্রিপের বাসিন্দারা ধ্বংসস্তূপে আক্রান্ত জীবন যাপন করেন। বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদ জিওনিস্টদের সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করে নেয় নিজেদের স্বার্থেই।

#

তুই যদি বৃষ্টি না হোস, বাবু,
তবে গাছ হয়ে যা, প্রচুর ডাল-পাতাওয়ালা ঝাঁকড়া গাছ!
যদি গাছ না হোস, বাবু,
পাথর হয়ে যা, বাষ্পে ভরে ওঠা কোনও আর্দ্র পাথর।
আর, পাথরও না হোস যদি, তবে,
চাঁদ হয়ে যা, তোর চাহ্‌নেওয়ালার স্বপ্নে মাখানো চাঁদ।

(এভাবেই এক মা মন্ত্র পড়ল তার সন্তানের শেষকাজে)

–মাহমুদ দারউইশ (অনুবাদ: আমি)

৪. আরব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি: আরব পুঁজিপতিরা এর ধারক এবং তাদের স্বার্থেই আরব সঙ্ঘগুলি কাজ করে। বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বন্দ্বে যে শিবিরভাগ, তাতে শক্তিধর শিবিরে (আমেরিকা ও সঙ্গীরাষ্ট্র) নেই আরব সঙ্ঘ। কিন্তু, বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা রয়েছে আরব পুঁজিপতিদের— যাদের মধ্যে তেল ব্যবসায়ী, বেনিয়া, সামন্তপ্রভু, শেখ, প্রচুর-জমির-মালিক সকলেই অন্তর্ভুক্ত। নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের সঙ্গে এদের কোনও যোগ নেই। অপর সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে এরা শোষিত নিপীড়িত আরব জাতিগুলিকে পাশে পেতে চায় কিন্তু তা সম্পূর্ণই পুঁজিবাদের একচেটিয়া বিকাশের স্বার্থে। অন্যদিকে, ধর্মের খুড়োর কল দেখিয়ে এরা শাসিত জনতার সম্মতি আদায় করে নেয়। স্বাভাবিকভাবেই, প্যালেস্তাইনের[4] আজাদির এরা ততদূর পাশে, যতদূর অবধি এদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। বহুক্ষেত্রেই এদের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা ও প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্ত আরব জাতিগুলির মুক্তি আন্দোলনের পরিপন্থী। লোকশোনানো বক্তব্যে প্যালেস্তাইনের আজাদি আন্দোলন সমর্থন করলেও আদতে এরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে কখনওই ছিল না। আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সকল মানুষের স্বার্থে প্রয়োগ করা নয় বরং কতিপয় আমিরের মুনাফার স্বার্থে বানিয়ে নেওয়াই এদের উদ্দেশ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে প্যালেস্তাইনের সামন্তশক্তি জিওনিস্টদেরই একমাত্র শত্রু ঠাউড়ে নিয়েছিল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে নিরপেক্ষ ভাবার ভুল করেছিল। পরে শোষিত জনগণের প্রগতিশীল অংশ সচেতন হয় যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে জিওনিস্টদের ব্যাবহার করে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা টিঁকিয়ে রাখতে চাইছে। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মিশর আরব জাতিগুলিকে নেতৃত্ব দিয়ে ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, এতে আরব শক্তিগুলির ধর্মীয়-সংহতি প্রকাশ পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ড উদ্ধার হয়নি, কোনও উদ্বাস্তু তাঁর বাসভূমি ফিরে পাননি। আরব দেশগুলি জোটবদ্ধ হয়ে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে সারা বিশ্বে তেল-সঙ্কট তৈরি হয়, ফলে সোভিয়েত ব্লক ও আমেরিকান ব্লককে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ১৯৭৭ সালে মিশর সহ অনেকগুলি আরবরাষ্ট্র ইজরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় নিজেদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে। ইজরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বন্ধ করে না[5], কিন্তু আরব রাষ্ট্রনেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থভূমিকা স্পষ্ট হয়ে গেছে। একটি দেশের ভূখণ্ড কেড়ে নিয়ে এবং বাসিন্দাদের উদ্বাস্তু করে তারপর তাদেরই শান্তিরক্ষার জন্যে চাপ দেওয়া— প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদ এভাবেই হাতে হাত রেখে চলে শোষিত মেহনতি মানুষের বিরুদ্ধে। প্যালেস্তাইনের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সফল হলে এবং প্যালেস্তাইন সত্যিই আজাদি অর্জন করতে সমর্থ হলে ইজরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বিপদে পড়বে ওই তেলখনির মালিক, শেখ, জায়গিরদাররাও। আর, প্রতিক্রিয়াশীল আরব রাষ্ট্রনেতাদের স্বস্তি-শান্তিও বিঘ্নিত হবে।

৫. অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র: বিগত দু দশকে ইজরায়েল পৃথিবীর অন্যতম অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ করেছে। পশ্চিম এশিয়ায় নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী ব্লকের মূল ঘুঁটি যে ইজরায়েল ও জিওনিস্ট সন্ত্রাসবাদ, তা আলোচনা করেছি। ফলে, ইজরায়েলের যে কোনও সমস্যায়, প্রকৌশল ও বিজ্ঞানের গবেষণায় এবং প্রতিরক্ষা-গুপ্তচর ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে এই ব্লকের পুঁজির প্রবহমানতা থেকেছে। তাছাড়াও, আলিয়া বা অভিবাসনের পর্যায়ে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে আগত ইহুদিরা কৃষি-শিল্প-শিক্ষা সবক্ষেত্রেই প্যালেস্তাইনে বসবাসরত মুসলিম ও ইহুদিদের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে ছিল; পুঁজির অভাবও যে তাদের হয়নি এবং শ্রেণিবৈষম্য টিঁকে ছিল, সে আলোচনাও করেছি। এই সমস্ত কিছুর মিলিত প্রভাবে ইজরায়েল আর্থিক অবস্থানে ও সমরাস্ত্রে অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র। সম্প্রতি তাদের নির্মিত ‘আয়রন ডোম’ সমস্ত বিশ্বের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যতিক্রমী নিদর্শন। এছাড়াও, তাদের বিমানবহর ও অত্যুন্নত মিসাইল প্যালেস্তাইনের থেকে অনেক এগিয়ে। অস্ত্রব্যবসায় উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে অন্যতম প্রধান অস্ত্রবিক্রেতা। ২০০৫ সালে ইজরায়েল অস্ত্রশিল্প বেসরকারিকরণের পর থেকে আমেরিকার সহায়তায় তাদের ব্যবসাবৃদ্ধি হয়েছে কয়েকগুণ। এছাড়াও রয়েছে মোসাদ, যাদের গুপ্তচরবৃত্তি বহুচর্চিত। আর, মোসাদের সঙ্গেই জুড়ে আছে আমান ও শিন-বেট— ইজরায়েলের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার গুপ্তচর বিভাগ। ১৯৬৭ সালে মাত্র ছ দিনের যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলিকে পরাস্ত করার মূল কৃতিত্ব মোসাদের। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া জুড়ে জিওনিস্টদের মতাদর্শগত ও সামরিক দাপটের কৃতিত্বও মোসাদের। আরব দেশগুলিতে নিয়মিত আভ্যন্তরীণ অশান্তির সুযোগ নেওয়া, ইয়াসের আরাফতকে একাধিকবার খুনের চেষ্টা, প্যালেস্তিনীয় মুক্তি মোর্চার বিরুদ্ধে লাগাতার সন্ত্রাস এবং শরণার্থী শিবিরগুলিতে হামলা চালিয়ে প্যালেস্তিনীয়দের হত্যা করা— মোসাদ এই সব কাজেই দক্ষ। প্যালেস্তাইনের উপরোক্ত বাকি শত্রুগুলির প্রত্যেকটির সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক এদের।

#

জন্মভূমি কী? এই ঘরে কুড়ি বছর ধরে যে চেয়ারদুটি আছে, সেটাই? ওই টেবিলটা? এই ময়ূরের পালকটা? দেয়ালে ঝুলছে ওই যে জেরুজালেমের ছবি, ওটা? এই তালাটা? ওই ওক্‌ গাছ? ওই বারান্দাটা? মাতৃভূমি কী? আমাদের কল্পনায় ওই অবয়ব ফিরে ফিরে আসা? পিতৃপুরুষেরা? তাঁদের সন্তানেরা? ওই যে তাঁর ভাইয়ের ছবি দেয়ালে ঝুলছে, ওটাই? জন্মভূমি কী? এমনিই, জিজ্ঞেস করছি শুধু…

–-গাসান কানাফানি, (অনুবাদ: আমি)

প্রতাপান্বিত এত শত্রুবেষ্টিত হয়েও, মানুষ কি সহজাত প্রতিরোধ ভুলে যেতে পারে? ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা[6] সংঘটিত হয় প্যালেস্তাইনের শরণার্থী শিবির থেকে। ইজরায়েলের শোষণে অবমানবায়িত হতে হতে প্যালেস্তাইনের তরুণ-তরুণীদের কাছে দ্রোহ ছাড়া অন্য পথ খোলা ছিল না। কিন্তু, জাতিরাষ্ট্র ইজরায়েলে ইহুদি ছাড়া অন্য জাতিগুলির (বিশেষত ইসলাম-বিদ্বেষ) জীবনযাপনই অনিশ্চিত, সেখানে দ্রোহচেষ্টা তো ‘অপরাধ’! তাই সেনা ও পুলিশ প্রয়োগে হত্যা করা হয় অনেককে, গ্রেপ্তার হন প্যালেস্তিনীয় বহু তরুণতরুণী। মানবাধিকারের দাবি কবেই বা মেনেছে ইজরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র? তবু, তরুণ-তরুণীদের সশস্ত্র গণপ্রতিরোধ দমানো যায়নি। ২০০০ সাল থেকে নতুন উদ্যমে মুক্তি আন্দোলন শুরু করেন তাঁরা। শান্তিদূতরা, যাঁরা ইজরায়েলকে নয় বরং শান্তিরক্ষার জন্যে শষিত প্যালেস্তাইনকেই চাপ দিয়েছে বারবার, তাঁদেরও নস্যাৎ করে দিয়েছেন এঁরা। সঙ্গত কারণেই। ১৯৬৭ সালে মেহনতি মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে বাস্তবায়িত করতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল– পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবেরাশন অব্‌ প্যালেস্তাইন। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি, যাঁরা সন্ত্রাসবাদী জিওনিস্ট-জোটের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গণপ্রতিরোধে বিশ্বাসী। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে চিনে নিয়ে মেহনতি মানুষের জোট, শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রের জোটবদ্ধতা। লড়াই ও আত্মরক্ষার অভিঘাতেই জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন, বুঝেছেন উপরোক্ত পাঁচ শত্রুর বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা। আর, পরাধীন জাতিসত্তার কাছে ‘শান্তি’ শব্দটির বিলাসিতা বোধহয় থাকে না। নিজেদের বাসভূমি অন্য রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়া এবং সেই রাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হওয়া বা শরণার্থীর জীবন যাপন করা শান্তির বার্তা নাও বহন করতে পারে। ২০১২ সাল থেকে ইজরায়েল ফের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়েছে। গাজা স্ট্রিপে বাড়িঘরের ধ্বংস্তূপ, অস্থায়ী ত্রাণশিবির আর অসহায় মুখের ছবি। সত্যিই অসম লড়াই। তবু, প্রতিরোধ ভুলে যাওয়া যায় না। যতক্ষণ একজন প্যালেস্তিনীয়ও বেঁচে আছেন এবং যতক্ষণ আজাদির স্বপ্ন এক মুহূর্তের জন্যেও ঝলসে উঠছে, ততক্ষণ প্রতিরোধ টিঁকে থাকবেই। যুক্তরাষ্ট্র-ইজরায়েল যতই তাকে সন্ত্রাসবাদ[7] নাম দিক (জিওনিস্টদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ কার্যকলাপ ভুলে গেলে চলে এবং এই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপেই তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রেখেছিল উনিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক।) তাদের দোসর রাষ্ট্রগুলি যতই প্যালেস্তিনীয়দের অধিকার কেড়ে নেওয়ার পক্ষে সায় দিক বা প্রচার করুক, স্বাধীনতার সংস্কৃতি প্রবহমান থাকেই। ইটের পাঁজর ফাটিয়ে বটের চারা যেমন বেরোয়, ধ্বংস্তূপের মধ্যেও যেমন প্রিয় বিড়ালকে আঁকড়ে বসে থাকে কোনও যুদ্ধধ্বস্ত অনাথ শিশু, তেমনই স্বাধীনতার আকাঙ্খা। হিটলারের ইহুদিনিধন যেমন অপরাধ, তেমনই ইজরায়েল দ্বারা প্যালেস্তিনীয়নিধন অপরাধ। আর্যরক্তের দম্ভে ইহুদিদের নির্বাসন দিয়ে, তাদের ওপরে অত্যাচার করে ইউরোপীয় জাতিগুলি যে অপরাধ করেছিল, সেই একই অপরাধ আজকের জাতিরাষ্ট্র ইজরায়েল করছে প্যালেস্তিনীয়দের অধিকার কেড়ে নিয়ে ও গণহত্যা করে। আমরা যারা এই সংঘাতের প্রত্যক্ষবাস্তবের বাইরে অবস্থান করছি, তাদের পক্ষ বেছে নেওয়ার প্রয়োজন। আর, অনুভব করা জরুরি যে, দ্রোহী প্যালেস্তিনীয়দের গণপ্রতিরোধ এক প্রয়োজনীয় সংস্কৃতি।


[1] জিয়ন হল জেরুজালেমের একটি পাহাড়, ইহুদিদের পবিত্র ধর্মস্থান। জেরুজালেম হল, ইহুদি বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈশ্বর-প্রতিশ্রুত বাসভূমি। জিওনিস্টরা সেই ‘পৌরাণিক’ স্থানে জাতিরাষ্ট্র বানাতে বদ্ধপরিকর ছিল। আর, প্যালেস্তাইনের আদি নাম ছিল ক্যানান। হিব্রু জাতি ক্যানানের আদি অধিবাসী ছিল না। স্থানীয় ক্যানানবাসীদের সঙ্গে হিব্রুদের ভাষা-সংস্কৃতি-রক্তের পার্থক্য ছিল।
[2] হারজল পরে তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, “আমরা অতি-রাষ্ট্রিক জেরুজালেম গড়ে তুলতে চাই যাতে তা সবার হয় এবং সব ধর্মের বিশ্বাসীরাই এর পুণ্যময় স্থানগুলির অধিকারী হবে।”
[3] Omer Mohammed, Shell-Shocked: Dispatches from a War, 2015
[4] জাতিপুঞ্জ ও আমেরিকার যৌথ প্ররোচনায় ইজরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে পাঁচটি দেশ মিশর, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডন ও ইরাক সম্মিলিতভাবে ইজরায়েলকে আক্রমণ করে কারণ তারা ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু, আমেরিকা-ইজরায়েল যৌথশক্তির কাছে এরা পরাজিত হয়। ১৯৫৬ সালে ফ্রান্স-ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলকে আর্থিক-সামরিক সাহায্য করলে মিশর সোভিয়েতের থেকে সাহায্য পায় ফলে আরব জাতীয়তাবাদ বনাম ইহুদি জাতীয়তাবাদের যুদ্ধ শুরু হয় ফের। কিন্তু, আরব জাতীয়তাবাদ প্যালেস্তাইনের শোষিত জনগণ বা শরণার্থীদের মুক্তির দিশা দেখাতে পারেনি কখনওই।
[5] ১৯৮২ সালে ইজরায়েল লেবানন আক্রমণ করে এবং অসংখ্য প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীকে হত্যা করে। প্যালেস্তাইন মুক্তি মোর্চা দক্ষিণ লেবানন থেকে ইজরায়েলে গেরিলা হামলা প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র-ইজরায়েল যৌথ বাহিনি স্থলপথ ও বায়ুপথে লেবানন ও প্যালেস্তাইনকে আক্রমণ করে। কিন্তু, প্যালেস্তাইন মুক্তি মোর্চা ও লেবাননের যোদ্ধাদের অসমসাহসী প্রতিরোধে পরাস্ত হয় ইজরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র। আরব পুঁজিপতিদের ও রাষ্ট্রনেতাদের প্রতিক্রিয়াশীলতাকে পাত্তা না দিয়ে মেহনতি-নিপীড়িত মানুষের এই প্রতিরোধ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
[6] “The Palestinian Intifada.” In The International Encyclopedia of Peace. Edited by Nigel Young. New York and Oxford: Oxford University Press
[7] সন্ত্রাসবাদ শব্দটিই বিতর্কিত। শোষিত ও শোষক— এই দুয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা পাল্টায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েল এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তি ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের সমার্থক বলে প্রচার করে। যেকোনও দেশের মেহনতি মানুষের সশস্ত্র গণপ্রতিরোধকেই ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দেয় তারা। কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদী শিবির ক্ষমতা-অর্থ-অস্ত্রে সন্ত্রস্ত করে রাখে নিপীড়িত মানুষকে। মানবতার প্রাথমিক শর্তগুলি প্রায়শই লঙ্ঘন করে তারা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির তাণ্ডবে আজ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ মারা গেছেন। তাহলে, সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞানুযায়ী, এরা সন্ত্রাসবাদী নয় কেন?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...