ঋতব্রত ঘোষ
রজার ফেডেরারকে আমাদের কেন ভাল্লাগে? প্রশ্নটা রেখেছিলাম কিছু বন্ধুদের সামনে। নিজের কাছেও। বিভিন্ন প্রশংসাসূচক উত্তরের মধ্যে একটা ছিল এ’রকম, ফেডেরার খেলার মধ্যে এমন মুহূর্ত তৈরি করতে পারেন, যেটা দেখার পর মনে হয় এরপর আর বেঁচে না থাকলেও বা কী ক্ষতি? যাহা দেখিলাম জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না। হয়তো গোটা খেলায় একটা র্যালি এবং উইনার, হয়তো বা সেই ম্যাচে রজার হেরেও গেছেন, কিন্তু ওই নির্দিষ্ট মুহূর্তে আমাদের বুকের কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে কী যেন একটা, চোখ ভিজে যায়, আলগা হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণে, এই যে দেখে ফেললাম লাইভ, অদৃষ্টকে ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এই বিষয়টাকেই ডেভিড ওয়ালেস ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় বর্ণনা করেছিলেন ‘ফেডেরার মোমেন্ট’ এবং ‘রিলিজিয়াস এক্সপিরিয়েন্স’ বলে, এবং ২০০৫-এর ইউএস ওপেন ফাইনালে আন্দ্রে আগাসি-র বিরুদ্ধে খেলা একটা শটের ছবি তুলে ধরে বলেছিলেন এই গতিময় সৌন্দর্য্য বা kinetic beauty এবং তার আবেদনকে ব্যাখা করা যেতে পারে মানুষের সঙ্গে তার শরীরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নজির হিসেবে।
এহেন ফেডেরারের সম্পর্কে ২০১৬ উইম্বলডন সেমিফাইনালের পরে লেখা হল, উনি এখন একজন প্রথিতযশা অপেরা শিল্পীর মতো, যিনি আর হাই নোট (উঁচু পর্দা) টাচ করতে পারেন না। তুলনায় অখ্যাত রাওনিকের কাছে হেরেছেন, পাঁচ সেটে ম্যাচ গড়াচ্ছে মানেই হার নিশ্চিত এমনটাই ধরে নেওয়া শুরু হয়েছে, বয়েস মধ্য-তিরিশ পেরিয়ে চল্লিশের দিকে এগোচ্ছে, এত বেশি বয়েসে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার রেকর্ড ওপেন যুগে কেন রোজওয়েল ছাড়া আর কারও নেই, এমনকি যে ফেডেরারের ফিটনেস টেনিস সার্কিটে আলোচনার বিষয় ছিল তাও আজ প্রশ্নের মুখে… এমন সময়েই ফেডেরার ঘোষণা করলেন তিনি অলিম্পিক আর ইউএস ওপেনে খেলবেন না। কারণ, হাঁটুর চোট। তবে কি এভাবেই টেনিস র্যাকেট তুলে রাখতে হবে ফেডেরারকে? সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ টেনিস তারকা কি একটা ‘প্রপার ফেয়ারওয়েল’ ডিজার্ভ করেন না? উদ্বিগ্ন ফ্যানদের এই প্রশ্ন তখন ঘুরপাক খাচ্ছে চারপাশে।
রজার ফেডেরারের পাশাপাশি টেনিসের একটা রাফায়েল নাদালেরও প্রয়োজন ছিল। ফেডেরার যদি হন শিল্পী, তাঁর সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে গেলে আনলিশ করা প্রয়োজন প্রবল শক্তিসম্পন্ন বিস্ফোরণ, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত। টেনিস বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে স্বীকার করেন, নাদালের মতো জোরে শট মারতে কাউকে দেখা যায়নি। অথচ ওই পাওয়ারফুল শটের কন্ট্রোল ঈর্ষণীয়, সঙ্গে দোসর বিষাক্ত টপস্পিন। আর অমানুষিক দ্রুততার সঙ্গে কোর্ট কভার করার ক্ষমতার কথা ছেড়েই দিলাম। সাধারণতঃ আমাদের গড়পড়তা একটা ধারণা আছে যে শারীরিকভাবে অত্যন্ত সক্ষম কোনও ব্যক্তির মস্তিষ্ক অতটা সচল হয় না। নাদালের ক্ষেত্রে সেই ভুল করার জো নেই। জন ম্যাকেনরো একবার ইএসপিএনে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, রাফা টেনিসজগতের আইনস্টাইন। নিউইয়র্কে সবে টমি রব্রেডোকে দুরমুশ করেছেন নাদাল, যার কাছে আগের রাউন্ডে হেরেছেন ফেডেরার। ম্যাচের পর ম্যাকেনরো বলেন, ‘রাফার বিশেষত্ব হল ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে, সিচুয়েশানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকে বদলে নিতে জানে। নিজের শ্রেষ্ঠ দিনে ফেডেরারকে হারানোর ক্ষমতা কারও নেই, কিন্তু সময় দ্রুতগামী, সেদিন আর খুব দূরে নয় যখন খুব কম দিনই রজার নিজের শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ায় থাকবে। তখন আমার বিশ্বাস নাদাল বুদ্ধি করে নিজেকে অ্যাডাপ্ট করিয়েই ফেডেরারকে ছাপিয়ে যাবে। এই ম্যাচে ও যেভাবে ফর্মে থাকা রব্রেডোকে হারাল, তা অবিশ্বাস্য। একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের মতোই নিখুঁত পরিকল্পনা করে খেলেছে রাফা।’
কিন্তু বাদ সাধল চোট। হাঁটু, কোমর, কাঁধ, পা– শরীরের এমন কোনও অংশ নেই যেখানে নাদাল চোট পাননি। এছাড়া কোলার ডিজিজ জন্মাবধি তাঁর সঙ্গী। এই রোগ সাময়িক, যেখানে পায়ের নির্দিষ্ট হাড়ে রক্ত সরবরাহ কিছুসময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, ফলে হাড়সংলগ্ন পেশী ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং বেচারা হাড়, তার বেশ কিছুদিনের জন্য বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। শেষমেষ যে ক্লে কোর্ট রাফা’র দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে গণ্য হয়, ২০১৬-য় সেই ফ্রেঞ্চ ওপেন থেকে নাম তুলে নেন কব্জির চোটের কারণে। রজার ফেডেরারের গ্র্যাণ্ড স্ল্যাম জয়ের সংখ্যাকে তাড়া করার প্রসঙ্গে এক ইন্টারভিউতে নাদাল বলেন, ‘আমি ওসব নিয়ে ভাবি না। সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে কাউকে আমার মতো চোটের কারণে বাইরে থাকতে হয়নি। রজারকে হয়নি, নোভাক, মারে, স্ট্যান কারুর সের’ম কোনও সমস্যা নেই। আমি যদি ওদের মতো অত টুর্নামেন্টে খেলতে পারতাম, কী হত কেউ বলতে পারে না।’ হতাশা ঝরে পড়েছিল তাঁর গলায়। সেই চোট কাটিয়ে ইউএস ওপেনে যদি বা নামলেন, ছিটকে গেলেন চব্বিশ নম্বর বাছাই খেলোয়াড়ের কাছে চতুর্থ রাউন্ডে হেরে।
কাট টু জানুয়ারি ২০১৭, মেলবোর্ন।
ফেডেরার প্রায় ছ’মাসের বিরতি থেকে ফিরলেন কোর্টে, নাদাল ইউএস ওপেন খেলেছেন বটে, কিন্তু চোট ভুগিয়েছে প্রায় গোটা সিজন। এই অবস্থায় প্রবল আশাবাদী কোনও টেনিসপ্রেমিকও ফেডেরার-নাদাল ফাইনালের পক্ষে বাজি ধরার সাহস করতেন না। ২০০৬-২০১১ এই সময়ে চব্বিশটা গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে উনিশটা ভাগ করে নিয়েছেন তারা নিজেদের মধ্যে, কিন্তু ২০১১-র পরে ইয়ারা নদী দিয়ে কম জল তো বয়ে যায়নি। সেমিফাইনালে দিমিত্রভকে পাঁচ সেটের টানটান লড়াইয়ের পর নাদাল যদি বা জিতলেন, ওয়্যারিঙ্কা-র সঙ্গে ২-০ সেটে এগিয়ে থেকেও যখন চতুর্থ সেট হারলেন ফেডেরার, ম্যাচের ভবিতব্য নিয়ে আমাদের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। ৩৫ বছর বয়সে সর্বোচ্চ পর্যায়ের টেনিসে পাঁচ সেটের ধকল যে কী জিনিস, তা অনুমান করতে নিজে টেনিস খেলার প্রয়োজন হয় না। সেদিন শেষ অবধি যারা টিভি চালিয়ে রেখেছিলাম, ফলাফল বিপক্ষে যাওয়া নিশ্চিত জেনেও মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম একটা মির্যাকলের, আমরা জানি, কিছু কিছু রূপকথা সত্যি হয়।
যাঁরা এই লেখা পড়বেন, ফাইনালটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বুঝবেন ওই ম্যাচ নিয়ে বিস্তারিত কিছুই বলার থাকতে পারে না। ফাইনালে কাউকে একটা জিততেই হত, এবার ফেডেরার জিতেছেন। নাদাল তীব্র লড়াই করেছেন ফোর্থ সেট পর্যন্ত, তিনিও কি জেতেননি?
টেনিস-ঈশ্বরের দুই বরপুত্র যেভাবে বিভিন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, বয়সজনিত সমস্যা, সমালোচকদের গালমন্দ তাঁদের পরিচিত ভঙ্গিমায় ক্রসকোর্ট ফোরহ্যাণ্ডে উড়িয়ে দিয়েছেন, সেটাই যথেষ্ট। কে না জানে, প্রদীপ দপ করে জ্বলে ওঠে নিভে যাবে বলেই, কিন্তু ওই যে ক্ষণিকের টাইম র্যাপ, সেই যেবার উইম্বলডন ফাইনাল সন্ধেয় দেখতে বসে উঠলাম সেই মাঝরাতে, খাবার টেবিলে চাপা দেওয়া ছিল, পাছে ফেডেরার হেরে যায় তাই সোফা ছেড়ে উঠিনি, হাতের নখ পেরিয়ে চামড়া উঠে গিয়েছিল শুধু, সেবারের মতোই… আর একবার, ঠাকুর, আর একবার!
ওভারঅল টেনিসের জন্য এ বড় সুখের সময় নহে। সেই মাপের বা মানের খেলোয়াড়ের বড্ড অভাব, ছেলেদের মধ্যে হোক বা মেয়েদের। সেই কারণেই আরও প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া ‘ফেডাল মোমেন্টস’গুলোকে। পঁচিশ বছর টেনিস দেখছি, বরিস বেকার-পিট সাম্প্রাস-আন্দ্রে আগাসি-স্টেফি গ্রাফ, তারকা নেহাৎ কম দেখিনি, কিন্তু এটুকু বুঝেছি এদের মতো আর হবে না। খুব শিগগিরি তো নয়ই।
ওহ হ্যাঁ, এবারের ফ্রেঞ্চ ওপেনে নিয়মমাফিক চ্যাম্পিয়ান হয়েছেন নাদাল, সেন্টার কোর্টে শেষ হাসি হেসেছেন ফেডেরার। বুড়ো গাছের পাতায় পাতায়, সবুজ কিন্তু আজও মাতায়… এখনও। আর কটা দিন, আসুন, প্রাণভরে দেখে নিই দুজনকে, পড়ন্ত বিকেলের আলো ছুঁয়ে যাক আমাদের পুরনো চিলেকোঠা।
তারপর, অস্তে গেলা দিনমণি, আইলা গোধূলি।