ছায়াপাখি — নীল হ্রদের তীরে, পর্ব ১

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ও কোকিলা রে

জানালার শিকে আলগোছে রাখা হাতে রোঁয়া উঠছিল ভোরের বাতাসে। কতদিন এভাবে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ পায়নি লিপিলেখা। যেন সবগুলো বন্ধ কপাট পটপট করে খুলে যাচ্ছে। অবশ্য এই আনন্দের খেসারতে মাথায় এখন কাকের বাসা। কালকেই রিঠা ঘষেছিল। এখন পথের ধুলোয় চুল একদম তছনছ।

দিনের প্রথম ট্রেন, ভিড় পাতলা। বসার জায়গার অভাব ছিল না। জানালা ছেড়ে ভিতরের সিট নিলেই ধুলো এড়াতে পারত। অনায়াসে।

চাইত যদি।

বাবা থাকলে ছায়াজমাট মুখে বলত, লেখি, শুধু শুধু ধুলো খাচ্ছিস কেন, জানালা থেকে ভিতরে সরে আয় না। তাছাড়া—

বাবার তাছাড়া লেখার জানা। তাছাড়া, যদি আর কিন্তুগুলোর চাপেই তো জীবন এতদিন বন্ধ ঝাঁপিতে শীতঘুম দিচ্ছিল। গত কয়েক বছরে যে কয়েকবার বাবার সঙ্গে ট্রেনে চেপেছে, একবারের জন্যেও জানালার কাছে যেতে দেয়নি। কারণ প্ল্যাটফর্মে কতরকমের লোক আছে, কার মনে কী আছে, কেউ যদি কিছু করে বসে? মুখে যদি কিছু ছুঁড়ে দেয়?

কোনওদিন তাদের ট্যাক্সির কাচও নাবে না। অন্তত লেখা সেই ট্যাক্সিতে থাকলে। সেদিন মাসির বাড়ি থেকে ফেরার সময়ও অমনি ব্যাপার। বাইরের পৃথিবীটা জানালা দিয়ে হাতছানি দিচ্ছিল, কিন্তু বাবা কিছুতেই কাচ নাবিয়ে বসতে দেবে না। মায়ের নীরব সম্মতির মোরগপাখির মুখ কোনদিকে লেখার জানা।

বাইরে কোন মাউন্ট এভারেস্টটা দেখা যাচ্ছে শুনি? বাবার কর্কশ ধমকে লেখার চোখে জল ভরে এসেছিল। কিন্তু কারও কি তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে চোখ আছে? বাবা কি তার চোখের জল দেখেছিল? দেখে আর? না হলে কী করে বলতে পারল, চোখের সামনে অত কিছু দেখেও কানে কথা যায় না? যা বলছি মুখ বুজে শোন।

ধারালো শব্দগুলো লেখাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে বারবার। কত আর মুখ বুজে মেনে নেওয়া যায়? বলব না বলব না করেও মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, একটু প্রাণভরে শ্বাস নিতে দাও বাবা। যতটা করুণ গলায় বললে সহানুভূতি আদায় করা যাবে সেই ভঙ্গিতে বলেছিল কিশোরী, রাস্তার গন্ধ পেতে ইচ্ছে করে না বুঝি মানুষের? পাশ দিয়ে সব কিছু পিছনে ছুটে ছুটে চলে যাচ্ছে, দেখতে সেটা ভালো লাগে। লাগে না? সতেরো বছরের জীবনে এইটুকু তো চাওয়া।

উত্তর না পেলেও ক্রমাগত হাত মুঠো করা আর খোলার মধ্যে দিয়ে বাবার অস্থিরতা লেখার অগোচর ছিল না। যেন বলতে চায় মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নিঃশ্বাস নেওয়া। এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় যদি সেটাই খুইয়ে বসিস, কী লাভ? খুব তাড়াতাড়ি কেন এমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছে বাবা? একসময়ের পরিপাটি ফিটবাবু ভাব আর নেই। কতদিন দাড়ি কামাতেই ভুলে যায়। আগের মানুষটার ধংসস্তূপ। বাবার জন্য কষ্ট হয়। কিন্তু নিজের জন্য আরও বেশি।

এরকম শামুকখোল জীবন কাটাতে পারছিল না আর। দুঃখ তারও হয়। একসময় সেও মুষড়ে পড়েছিল, জীবন অন্ধকার লেগেছিল। তার পৃথিবীটার খোলনলচে পাল্টে গেছে একেবারে। কিন্তু দিন কি বদলাবে না? দিন গিয়ে মাস, মাস গিয়ে বছর। চার বছর তো হল। তাহলে?

বাবা মায়ের কষ্ট দুশ্চিন্তা সে যে বোঝে না এমন নয়। দিদির কথা ভেবে মনটা কুটুর কুটুর করে। ভিতর কুড়ে কুড়ে খাওয়া কষ্ট। কিন্তু তার জীবনটাও তো একটা জীবন, তারও তো সাধ আহ্লাদ আছে। ফুটে ওঠার সম্ভাবনা। কতদিন এইভাবে কুঁকড়ে থেকে জীবন কাটাবে? আগে আগে চুপ করে থাকত লেখা। কিন্তু সেদিন মুখিয়ে উঠেছিল, কী হয়ে যাবে বাবা? আর কতদিন এইভাবে মরে মরে বেঁচে থাকব? দিদি সঙ্গে ছিল না বলেই হয়তো বলতে পেরেছিল।

অন্ধকূপের মত ছুটন্ত ট্যাক্সিতে ওরা তিনজন। মা লেখার কব্জিতে চিপুনি দিয়ে শাসন করেছিল, মুখে রা কাড়েনি। বাবাও উত্তর দেয়নি অনেকক্ষন। একসময় চোখের সাদা কমানো দৃষ্টি হেনে থমথমে গলায় বলেছিল, তোমার সামনে জীবনের অনেকটা পথ পড়ে আছে। সেখানে আমরা কোনও বেড়া বাঁধতে যাব না। দেখেছ তো কীভাবে একের পর এক দুর্ঘটনায় ভাসতে বসেছে আমাদের জীবন। দেখোনি কি? উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছিল বাবা, ঠোঁটের কষ ভেজা। লেখার ভয় লাগছিল। বাবা তখনও থামেনি। নিজের চোখের সামনে আর একটা জীবনকেও তছনছ হয়ে যেতে দিতে পারি না। বাবা হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে।

আড়চোখে মায়ের হাত বাবার হাতের পাতাকে ছুঁতে দেখেই ফেটে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছিল সেদিন। কিংবা নিজের মনে ততদিনে ভিত গেঁথেছিল আজকের দিনটার। মাসির সঙ্গে কথা বলেই তো আসছিল সেদিন। একমাত্র মাসি বোঝে ওর কষ্টটা। কতবার মাসির বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে। মাসি একবার বলেওছিল মাকে। লেখাকে একটা স্বাভাবিক জীবন কাটাতে দে না দিদি। দরকার হলে আমার কাছে থেকে পড়াশোনা করুক। আমার উপর ভরসা করতে পারিস দিদি। রেখাও তো আমার কাছে ছিল কতদিন, থাকেনি?

মাসি ভয়ে ভয়েই বলেছিল। দিদিকে সম্ভ্রম করে। অনেক বড় দিদি, তাছাড়া মাধুরীর উপস্থিতি মাধুর্যময় হলেও নিজের বিবেচনায় বরাবরের কঠোর।

মাধুরী আর সেই রকমটি নেই। জীবনের সবটা নিয়ে একটা তিক্ততা। যদি রতন ভয়ে আর দ্বিধায় কাবু, মা নিজের চারপাশে একটা দেওয়াল তুলে নিজেকে করে ফেলেছে কঠিন। এরকম একটা প্রস্তাবে শুকনো চোখে তাকিয়েছিল ছোট বোন মালিনীর দিকে। মাসির ডাক নাম মাম্পি। শিরিষঘষা গলায় বলেছিল, মাম্পি, শুধু তুই বলে না, আমার আর জীবনের কিছুতেই ভরসা নেই। এই মেয়েটাকে ভালোয় ভালোয় সুস্থমত একটা বিয়ে দিয়ে দিতে পারি, এইটুকুই শুধু চাই ভগবানের কাছ থেকে। তোর কাছে একটাই অনুরোধ, ও বাচ্চা। ওর সামনে এই নিয়ে আর কোনওদিন আলোচনা করিস না।

ব্যস, লেখা ওর আশাভরসা সেখানেই গুঁড়িয়ে যেতে দেখছিল। মাসি তবুও বলতে গেছিল, এইটুকু মেয়ে, কবে বিয়ে হবে, ততদিন কি এইরকম জেলবন্দি জীবন কাটাবে? ওর কথাটা একটু ভাবব না আমরা? কিন্তু মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মা বলল, সন্তানের মঙ্গলের কথা মায়ের চেয়ে কেউ ভালো বোঝে না মাম্পি। তুই অত ভাবিস না। অপমান গিলে নিয়ে মাসি চুপ করে গিয়েছিল সেদিন। মাধুরীর মুখের উপর আগেও কথা বলা যেত না, এখনও না। ফারাক হল আগে মাধুরী ভালোবেসে বুঝিয়ে বলত, এখন কথা বলে যেন সপাং এক চাবুক।

দীর্ঘশ্বাস বুকের গোপনে মিশিয়ে নিয়েছিল লেখা। মা যদি বাবার মত ভেঙে পড়ত, লুটিয়ে পড়ত শিকড় উপড়ানো গাছের মত সেও বরঞ্চ ভালো ছিল। অন্তত তার জন্য জীবনটা সহজ হতে পারত। বাবা কেঁচোর মত জীবন কাটাচ্ছে, দিদি পাথর আর মার চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। লেখার মন বিদ্রোহ করতে চাইত। পালিয়ে যেতে চাইত এই ঘেরাটোপ কেটে উন্মুক্ত জীবনের খোঁজে।

ভয় পায়নি তা নয়, কিন্তু বাড়ি থেকে পালানো ছাড়া আর কোনও পথ খোলা ছিল না।

মাসির সঙ্গে গোপনে কথা বলা শুরু করেছিল। ওরা তো বিশেষ যেত না, মাসিই ঘনঘন আসত। কিন্তু মাসি তার দিদিকে এত ভয় পায়। কোনওদিন দিদির কথার বিরুদ্ধে কিছু করেনি, করবেও না। মাসি লেখার মাথায় হাত বুলিয়েছিল। যত যাই ভাবি লেখি, আমি তো তোকে পেটে ধরিনি। চাইলেও অনেক কিছু করা যায় না।

–আমি কি এইভাবেই মরে যাব মাসি?
–একটু ধৈর্য ধর মা। আর কটা দিন। আঠেরো পুরোলে আইনের চোখে তুই সাবালিকা। তখন কিছু করিস।

আশায় বুক বেঁধে মাসির হাত আঁকড়ে ধরেছিল। তারপর আমি তোমার বাড়িতে এসে থাকতে পারি?

শুকনো মুখে মাথা নেড়েছিল মাসি। চাইলেও পারব না লেখি। তুই আমার কাছে থাকবি, আমার কম সাধ? আমার আর কে আছে বল? কিন্তু তাহলে দিদি আর কোনওদিন আমার মুখ দেখবে না। দিদিরা যে আরও একলা হয়ে যাবে রে! রেখার জন্যেও আমি কিছু করতে পারব না তখন।

মাসির কথাগুলো ছিল সব আশায় জল ঢেলে দেওয়ার মত। তাহলে?

–তুই তো বড় হচ্ছিস, একলা থাকবি। আমি তোকে কলকাতায় কলেজে ভর্তি করে দেব। তোর থাকার ঠাঁই খুঁজে দেব। শুধু দিদি যেন কোনওদিন জানতে না পারে। এখনও নয়, পরেও নয়।

মুক্তির জন্য কী না করতে পারে লেখা! তারপর থেকে দিন গুনেছে। আঠেরো বছরের দিকে তীর্থের কাকের মত চেয়ে বসে থাকা। মনে হয়েছিল কতদূর। কতগুলো দিন, মাস, বছর। এ তো তার সুস্থির বসে থাকার বয়স না। তবু থেকেছে।

সেই পথেই চলেছে আজ। হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরিয়েছে গত সপ্তাহে। বাবা মা বলেই দিয়েছিল। তাকে বিদ্যাসাগর কলেজেই পড়তে হবে। পানাগড়ের বাইরে তার যাওয়ার উপায় নেই। বাবা ওখানেই পড়ায়, চোখের উপর থাকবে। প্রফেসারের মেয়েকে কেউ কলেজের মধ্যে বিরক্ত করার সাহস পাবে না। তাদের বাড়িটাও প্রায় কলেজের গা ঘেঁষে। পায়ে হেঁটে বাবার সঙ্গে কলেজ যাবে আর বাড়ি আসবে। এ যেন এক জেলখানা থেকে বেরিয়ে আর একটা জেলখানায় ঢোকা। লেখা কক্ষনও যাবে না ওখানে। কিন্তু মুখে টুঁ শব্দটি করেনি। জানত বলেও কোনও লাভ নেই। তার আঠেরো বছর বয়েস হয়ে গেছে। মুক্তির ছাড়পত্র তার হাতে।

একটাই জীবন। এরকম দম আটকিয়ে বাঁচতে পারবে না। তাই উচ্চমাধ্যমিকের মার্কশিট, মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট এই দুটো হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে আজ। কাজটা অত সোজা ছিল না। কিন্তু সবাই বলে সে নাকি মায়ের ধাত পেয়েছে। মনের জোর। ছোট হলেও তাকে পাশ কাটিয়ে দেবার ক্ষমতা কারও ছিল না। হয়তো সেই জন্যেই নিজের চারপাশে স্বাভাবিক জীবনটাকে দুমড়ে মুচরে যেতে দেখেও মাথা সোজা রাখতে পেরেছে। নিষেধের বেড়াজাল চক্রব্যূহের মত যত তাকে ঘিরেছে, জাল কেটে বেরোনোর জেদ তত শক্ত হয়েছে। নিজেকে বারবার বুঝিয়েছে, তোকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না লেখি, শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই ছিল তার বীজমন্ত্র। তাকে বাঁচিয়ে রাখার, ভাসিয়ে রাখার।

অন্ধকার থাকতে পথে নেবেছিল। অগ্নিবীণা ধরবে সাড়ে ছটায়। কিন্তু লেখা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল সকাল সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই। বাবা মা ঘুমাচ্ছে। ছটার আগে উঠবে না। উঠলেও লেখার ঘরে তখনই কি আর আসবে? না। এখন পড়াশোনা কিছু নেই, বেলা অবধি ঘুমাতে দেয় তাকে। দিদি খুব সকালে উঠে গান শুরু করে। যেন বাইরের কাউকে নিজের গলাও শুনতে দিতে চায় না। নাহলে সারাদিন বাড়িতে নিজের ঘরেই থাকে, এত সকালে ওঠার দরকারটা কি? দিদিকে অনেকবার বলেছে, কিন্তু পলকহীন চোখে শুধু তার দিকে তাকিয়ে থেকেছে রেখা। কোনও উত্তর দেয়নি, দেয় না। কটাই বা কথা বলে দিদি কারও সঙ্গে? গান না গাইলে দিদির কণ্ঠস্বরই ভুলে যেত লেখা। বাইরের কোনও ওঠাপড়াই আর দিদির কানে যায় না। তবু তানপুরা হাতে গানে মগ্ন দিদির পিছন দিয়ে বেরোবার সময় যতটা সম্ভব সাবধান ছিল। সারা রাত ঘুম হয়নি। উত্তেজনা। তার থেকেও বড় প্রস্তুতি। রাত দুটো নাগাদ উঠে বাইরের দরজার খিল, ছিটকিনি, ঢাউস তালাদুটো চুপি চুপি খুলে রেখে এসেছিল। জানত সকালের দিকে বাবা মার ঘুম পাতলা হয়ে আসবে। সেও তাড়াহুড়োয় আওয়াজ করে বসতে পারে। তাই মধ্যরাতেই চুপিসাড়ে কাজ সেরেছে। প্রথমে খিলটা নাবিয়ে এসেছে। আবার কিছুক্ষণ বাদে ছিটকিনি। সবশেষে তালাদুটো। ডুপ্লিকেট চাবি বানানো তার তিন মাস আগে থেকে। কোনও দিক থেকেই পরিকল্পনায় কোন ত্রুটি ছিল না। না ছিল কোনও দ্বিধা কিংবা পিছুটান। বাবা, মা, দিদি সবাইকে সে ভালোবাসে। কিন্তু স্বাধীনতা খুইয়ে নয়। এখনও যদি আলোবাতাসের একটা ঘুলঘুলি খোলা থাকত, পানাগড়ের বিদ্যাসাগর কলেজই সই। সে নিজের বাড়ি ফেলে কোথাও যেত না। কিন্তু সে আর হওয়ার নয়। বাইরের বাতাসে দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে দেয় লেখা।

এক মুক্ত জীবনের প্রত্যাশায় এতদিনকার প্রস্তুতি। আজ বেরোবার সময় একবারও পিছু হঠার কথা ভাবেনি, একবারও থেকে যাওয়ার জন্য মন কেমন করে ওঠেনি। নিজের বিছানার উপর একটা চিঠি চাবিচাপা দিয়ে রেখে বেরিয়েছে। বিশেষ কিছুই লেখেনি, আড়ম্বরহীন সাদা চিঠি। শুধু লিখেছিল— মা, আমি চললাম। কাছে কাছেই থাকব, চিন্তা কোরো না। আমি বাঁচতে চাই মা, সত্যিকারের। তাই যেতে হল। একাই যাচ্ছি, কারও সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছি না। একদিন ফিরেও আসব। তোমার ছেলে হয়ে। তখন আর মেয়ের ভালোমন্দর জন্য তোমাকে এত চিন্তা করতে হবে না। লেখা।

পানাগড় স্টেশনে একদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসেছিল। ট্রেনে উঠে প্রথম কিছুক্ষণ সন্দিগ্ধ চোখে চারপাশের লোকজনকে মেপেছে।  যদি চেনা কেউ বেরিয়ে যায়, তখন সাতসতেরো গল্প বানাতে হবে। যদিও তাদের চেনার পরিধিটা কমতে কমতে এত ছোট হয়ে গেছে যে সেরকম সম্ভাবনা কম। দুর্গাপুরে থাকতে বাড়িতে কত লোকের যাওয়া আসা ছিল। ছোটবেলায় বাবাকে রাজনীতি করতে দেখেছে। কিন্তু নকশালদের হাতে গুলি খাওয়ার পর নিজেকে সেখান থেকেও সরিয়ে নিয়েছিল। মা অবশ্য বলত অন্য কথা। বাড়ি বানাতে টাকা লাগে না রে? বাজারে কত ধারদেনা। তোরা দুটো হলহলিয়ে বাড়ছিস— রাজনীতি করলে চলবে? তোদের বিয়ের খরচের চিন্তা নেই? তখনও মা দুটো মেয়ের বিয়ের কথা ভাবত।

বাবা রাজনীতি ছেড়ে ছাত্র পড়ানোয় মন দিয়েছিল। দিন দিন ছাত্রের সংখ্যা বাড়ছিল। কিন্তু শানুদার ব্যাপারটার পর মা কিছুতেই বাড়িতে ছাত্রদের আসতে দেবে না। বাবা পড়ানোর জন্য বাইরে একটা জায়গা নিল। কিন্তু হওয়ার থাকলে কিছু আটকানো যায়? সেই তো সাজানো জীবন ওলটপালট হয়ে গেল। ছোটবেলার বাড়ি ছেড়ে পানাগড়ে চলে আসতে হল। এখানে তাদের বাড়িতে কেউ সেভাবে কখনও এসেছে এমন তো লেখার মনে পড়ে না। ছাত্র পড়ানো বন্ধ। লেখাকে স্কুল যেতে হয়, সেটুকুই বাকি ছিল। আর সব কিছুই জীবন থেকে সরে গেছিল। এমনকি নাচ শেখাও। দুর্গাপুরে থাকতে ঝর্ণাদির কাছে ওড়িশি শিখত। পানাগড়ে এসে মাধুরী এসবের খোঁজ নিয়েও দেখেনি। তাহলে কে আর লেখাকে চিনবে এই ভোরের ট্রেনে? যদি না স্কুলের কোনও টিচার এই সকালের ট্রেনে ওঠে। অথবা বাবা মা চিঠি দেখে স্টেশন চত্বরে পৌঁছে যায়। এই ভাবনায় শেষ মুহূর্ত অবধি দমচাপা হয়ে বসেছিল। ট্রেন ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছাড়াতেই মনের গভীরে ভরা কোটাল। আকাশ ছুঁয়ে ফেলার আনন্দ।

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগোচ্ছিল। এতক্ষণে বাবা মা নিশ্চয় জেনে গেছে। পড়ে ফেলেছে চিঠিটা। কী করছে তারপরে? দিদি কিছু বলল? শুরুতে এই ভাবনা মাথায় ঘাই মারছিল। কিন্তু ট্রেন পানাগড় থেকে যত দূরে সরে আসছিল, লেখার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। উৎকণ্ঠায়, উত্তেজনায়। বুঝতেই পারেনি কখন ট্রেন হাওড়া স্টেশনে ঢুকে পড়ল।

লেখা এত দূর থেকে একা একা আসছে। মালিনী স্টেশনে ট্রেন ঢোকার অনেক আগে থেকেই হাজির। ভিড়ের মধ্যেও জানালা দিয়ে নয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মাসিকে দেখতে পেয়ে গেল লেখা। তাঁতের শাড়ি, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা; সব নিয়ে মাসির উপস্থিতিতে এমন বিশিষ্টতা আছে যে লোকের ভিড়েও চট করে খুঁজে নেওয়া যায়।

লেখা ট্রেন থেকে নেবে ছুটতে ছুটতে এসে মালিনীকে জড়িয়ে ধরল। এসে গেছ মাসি? আমার কী ভয় করছিল, নেবে যদি তোমাকে দেখতে না পাই।

–দুর পাগলি! আমি কিনা পারলে মাঝরাত থেকেই এসে দাঁড়িয়ে থাকি! তারপরেই গলার সুর পাল্টে বলল, দ্যাখ না কপাল। নিজের এত বড় বাড়ি থাকতে তোর থাকার ব্যাবস্থা করেছি কেমন একটা ঘুপচিতে।
–তাতে কী হয়েছে মাসি? আমার আর কতটুকু জায়গা লাগে। বলতে চেয়েছিল আমার আকাশ লাগে অনেকটা মাসি, শুধু সেটা দাও। সেই খুশিটাই গান হয়ে গলায় গুনগুনিয়ে উঠল, নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়। ওর গলায় গান শুনে উদ্বিগ্ন মালিনীর মুখে হাসি ছড়াল। আহা! প্রজাপতি যেন আবার করে গুটি কেটে বেরোচ্ছে।

লেখা জ্বলজ্বলে চোখজোড়া মাসির চোখে বিঁধিয়ে জিজ্ঞেস করল, মেসো বুঝতে পারেনি, মাসি?

মাসির চোখে ষড়যন্ত্রের চপলতা ঝিকমিক করে উঠল। পাগল? তোর মেসোকে বললাম এক নতুন গুরুজির সন্ধান পেয়েছি। সকাল সকাল তার কাছে যাচ্ছি। এত বছর সংসার করছি, এখনও বরকে ধোঁকা দিতে না পারলে কবে দেব আর?

বাচ্চার জন্য একসময় অনেক গুরুজি আর গুরুমার দোরে দোরে ঘুরেছে মালিনী। তাই এই কথাটা বিশ্বাস না করার কোনও কারণ থাকবে না। কিন্তু এতক্ষণে নিশ্চয় মার ফোন এসেছে বাড়িতে? প্রশ্নটা না করে পারল না লেখা।

মাসি হেসে উড়িয়ে দিল। কাজের লোকের কাছেও এটাই শুনবে। প্রশান্তকে অফিসে ফোন করলেও তাই। সেসব দেখা যাবে পরে।

–বাড়িটা কোথায় মাসি?

মালিনী একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। দিদিকে কী বলবে সেই ভাবনা থেকে নিজেকে টেনে বের করে আনল। হাজরা মোড়ে। তোর কলেজ থেকে কাছে। দরকারি সব কিছু হাতের নাগালে, তোর অসুবিধা হবে না। আমাদের বাড়ি থেকে খুব কাছেও নয়, দূরেও নয়। মেয়েদের একা ভালো থাকার জায়গা তো তেমন নেই। এটা বেশ ছিমছাম। আলাদা নিজের ঘর। বাইরে একটা দারোয়ান বসতে দেখেছি। অফিসে একজন মহিলা।

–কত টাকা নিচ্ছে মাসি? কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল।
–তোর তাতে কাজ কী? টাকা রেখে আমি করব কী লেখি? আমাদের আর কে আছে? মালিনী একটু ক্ষুণ্ণ হল। সেটা দেখে লেখা তাড়াতাড়ি জড়িয়ে ধরল মাসিকে। শুধু জানতে চাইছি মাসি, আমি কি আর দিতে পারব? এই দেখো না কেবলমাত্র দুটো কাগজ হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি, সঙ্গে একটা সুতোও নেই। তুমি ছাড়া এখন আমার আছেই বা কে?

মালিনীর মুখে আবার হাসি ফুটল। হাসলে মাসির গালে আজও টোল পড়ে, মাসিকে বড্ড বেশি বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে লেখার। মালিনী পায়ের কাছের স্যুটকেসটা দেখিয়ে বলল, এই যে সব এখানে। আগের বার এসে তুই দুটো সেট রেখে গেছিলি। সেগুলো আছে। আমি দুটো স্কার্ট, টপ আর ম্যাক্সি রেখেছি। আমার কটা শাড়ি। রেখার কিছু পুরনো জামাকাপড় আমার কাছে পড়েছিল, তার থেকেও দুটো এনেছি। ব্রা রেখেছি দুটো, কিন্তু কাপ সাইজটা সিওর ছিলাম না। দেখে বলিস। আরও টুকটাক সাবান, পেস্ট, শ্যাম্পু এই সব রাখা আছে। জামাকাপড় বেশি কিনিনি, সেসব তুই নিজের পছন্দে কিনবি। এসেই তো আর বাজারে নিয়ে যেতে পারি না। তাই যেটুকু না হলেই নয়—

মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে লেখার মন ভালোবাসায় কানায় কানায় ভরে উঠছিল। টপ করে মাসিকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে দিল। মালিনী খুশিতে গলতে গলতে শশব্যাস্ত হয়ে বলে উঠল, আরে রাখ রাখ। এক স্টেশন লোকের সামনে…।

–তোমার বুকে আশ্রয় নিলাম মাসি। তার জন্য লোকে যা ভাবে ভাবুক। আমার ক্যাঁচকলা হয় তাতে। আমার জীবন, আমার মতন হবে। বলতে বলতেই লেখা অনুভব করছিল তার গলা দিয়ে যেন অনেকদিনের হারিয়ে যাওয়া সুর বেরিয়ে এসেছে আবার। এই তো সেই লেখি যাকে সে গত কয়েক বছর ধরে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল। মাসির জন্যেই দেখানোর সাহস পেল আবার। মালিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কথা দিল লেখা। মাসিকে কোনওদিন কষ্ট দেবে না সে। কোনওদিন না।

হলদে রঙের তেতলা বাড়িটা এমন কিছু আহামরি না। কিন্তু লেখার কাছে মনে হল প্রাসাদ। আর একদম রাস্তার উপরে। হাজরা মোড় সকাল এগারোটায় লোকে লোকারণ্য। ট্যাক্সি থেকে নেবে রাস্তা পার হতেই কত ধাকাধাক্কি। বড় ভালো লাগল লেখার। জীবন আবার তাকে ছুঁচ্ছে। পৌঁছে গেছে হাতের গোড়ায়। সারি সারি দোকান, দেওয়ালে দেওয়ালে রাজনৈতিক লিখন, বাস ট্যাক্সির হর্ন, সব কিছু জানান দিচ্ছিল জীবন যদি কোথাও আছে তো এইখানে।

একতলার অফিস ঘরে রেজিস্টারে সই করে চাবি নিয়ে নিল। নিচের ভদ্রমহিলার নাম কল্পনা পাল। খরখরে গলা। মালিনী যখন বলল, একা থাকেনি কক্ষনও, একটু দেখবেন। কল্পনা বলে উঠল, আজকালকার মেয়ে, আমাদের আর দেখতে হয় না। ওরাই আমাদের দেখে নেবে। শুধু বোনঝিকে বলে দিন, কাউকে যেন ঘরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে। আমাদের নিয়ম নেই।

–আমি একবার যেতে পারি না? গুছিয়ে দিতাম।
–যা নিয়ম তাই নিয়ম। একবার ছাড় দিলে আর এই হস্টেল আমাকে চালাতে হচ্ছে না।

মালিনী এর সঙ্গে আর তর্কে গেল না। ছোট স্যুটকেস হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে একলাই উপরে চলল লেখা। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে যখন ঘাড় ঘুরিয়ে মাসিকে টা টা করতে গেল, মালিনী তখন আঁচলে চোখ মুছছে।

লেখার ঘর দোতলায়। সবুজ কাঠের দরজায় একটা বড়সড় রকমের তালা। তালা খুলে দরজা খুলতেই ভক করে একটা গুমোট ঘরের গন্ধ পেল লেখা। এই দমচাপা গন্ধ তার চেনা। এর থেকেই তো পালিয়ে আসা। স্যুটকেসটা মাটিতে নাবিয়ে তাড়াতাড়ি বন্ধ জানালার ছিটকিনি খুলে দিল।

চিলতে জানালার বাইরে একমুঠো আকাশ। মেঘ কেটে গিয়ে এখন রোদের ফুলঝুরি। এ আমার আকাশ। জোরে জোরে নিজেকে বলল লেখা। এই আকাশ আমার কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। সকাল থেকে এই প্রথম ওর চোখের কোল জলে ভরে উঠছিল। কিন্তু মুছল না।

 

(ক্রমশ)


হেডার ছবি: দেব ব্যানার্জী

ছায়াপাখি-র সব কটি পর্বের জন্য ক্লিক করুন: ছায়াপাখি – বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...