চার নম্বর নিউজডেস্ক
অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গ। মারণ ভাইরাস তার আক্ষরিক অর্থেই ‘মারণ’রূপ দেখাচ্ছে। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু, প্রিয়জন— এই দ্বিতীয় তরঙ্গ কেড়ে নিচ্ছে এক এক করে। পিক কবে উঠবে? কবে নামবে? শেষ কোথায়? জানা নেই…
গ্রামীণ ভারত। এই দ্বিতীয় তরঙ্গে ছাড় নেই গ্রামগুলিরও। বলা ভালো, বিশেষত এই গ্রামীণ ভারতই দ্বিতীয় তরঙ্গের সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় শিকার। এসবিআইয়ের একটি সমীক্ষা বলছে, গত মার্চের হিসেবে গ্রামীণ ভারতের ৩৬.৮ শতাংশ সংক্রমণ বেড়ে গিয়ে মে মাসে উঠে এসেছে ৪৮.৫ শতাংশতে। এই রুরাল পেনিট্রেশন স্বভাবতই প্রচণ্ড উদ্বেগজনক।
এর বাইরেই অন্য গল্প। অন্য গ্রাম। অন্য ছবি। বিহারের সুপাউল জেলার কাতাইয়া গ্রাম। সদর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে একজনও পজিটিভ হননি। গ্রামের মধ্যেই একটি কমিটি তৈরি করেছেন কিছু যুবক। গড়া হয়েছে কৃত্রিম ব্যারিকেড। অতি-আবশ্যিক প্রয়োজনে যাঁরা বাইরে যাচ্ছেন, ফিরে আসার পর টেস্ট করানো হচ্ছে প্রত্যেককে। নেগেটিভ রেজাল্ট না হওয়া অবধি গ্রামে ঢোকা নিষেধ। ঢুকলে অবশ্যই স্যানিটাইজড করে এবং ঠিকমতো মাস্ক পরে তবেই। পজিটিভ বেরোলে তাঁদের কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে গ্রামের বাইরের নিরাপদ কোনও স্থানে। প্রতিটি বাড়িতে কমিটির পক্ষ থেকে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে রোজ। সামাজিক আচার অনুষ্ঠান হলেও তার জন্য জমায়েতের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আপামর ভারতবাসীর বিহার সম্পর্কিত অতিসরলীকরণের অনেক বাইরের এই ছবি। শেখার ছবি।
অসম। পশ্চিম কার্বি আংলং জেলার শিকদামাখা গ্রাম। দেশের অন্যতম পরিষ্কার গ্রামের তকমা জুটেছে এই গ্রামের। স্বভাবতই কোভিড পরিস্থিতিতেও একইরকম সক্রিয় গ্রামবাসীরা। এই গ্রামের বাসিন্দাসংখ্যা ৬০০, যার মধ্যে একটিও পজিটিভ কেস হয়নি এখনও পর্যন্ত। প্রধানত চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত বাসিন্দারা নিজেরাই প্রত্যেকদিন জীবাণুমুক্ত করছেন নিজেদের ঘর। মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরোনো একধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। অতি আবশ্যিক প্রয়োজন ছাড়া কেউই গ্রামের বাইরে বেরোচ্ছেন না। তাই, ভালো আছে, ভালো থাকুক শিকদামাখা…
উত্তরপ্রদেশ। রাজ্যের ভয়াবহতার বাইরেও অন্য এক গ্রাম। ব্যতিক্রম। আজমগড় জেলার সেমারি গ্রাম। জেলাশহর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত স্থানীয় একটি নদীর তীরবর্তী এই গ্রামের বাসিন্দা হাজারের একটু বেশি। শারীরিক দূরত্ববিধি, মাস্ক, জীবাণুমুক্তকরণ— সেমারি এগিয়ে আছে অনেকের চেয়ে। গ্রামের কেউ বাজার করলে নিয়ে আসছেন পড়শিদের জন্যেও। এতে সংক্রমণ এবং জমায়েতের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। কামারাদেরি, মানবিকতায়, পাশে দাঁড়ানোয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে সেমারি।
ওড়িশা। গাঞ্জাম জেলার কারাঞ্জারা গ্রাম। ২৬১টি পরিবারের মোট ১২৩৪ জন বাসিন্দা নিয়ে তৈরি এই গ্রামেও অতিমারি ঢোকার সাহস দেখায়নি। স্থানীয় যুবকদের নেতৃত্বে প্রতিদিনের স্বচ্ছতা অভিযানের পাশাপাশি সাহায্যে এসেছেন আশা, এএনএম এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরাও। লাগাতার প্রচারে সচেতন হয়ে এগিয়ে এসেছেন গ্রামের মানুষ। গ্রামে আচার অনুষ্ঠানে জমায়েত নিষিদ্ধ। অতি-আবশ্যিক কারণ ছাড়া বাইরেও বেরোচ্ছেন না কেউ। বেশ কিছু অভিবাসী শ্রমিক মুম্বইতে কাজ করলেও গত বছর গ্রামে ফিরেছেন এঁদের মধ্যে খুব কম জনই। এবং, তাঁরাও, সরকারি সেফ হোমে কোয়ারেন্টাইন থেকে তবেই গ্রামে ঢুকেছেন।
এবং কেরল। গোটা ভারত থেকে কয়েক কদম এগিয়ে থাকা কেরল। এই কেরলেরই প্রথম আদিবাসী গ্রামপঞ্চায়েত এড়ামালাক্কুডি। ইড়ুক্কি জেলায় মুন্নার পার্বত্য অরণ্য অঞ্চলের অন্তর্গত এবং মুন্নার থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামেও কোনও কোভিড-কেস নেই। ২৮টি ছোট ছোট সেটলমেন্টের ৩০০০ আদিবাসীর এড়ামালাক্কুডি গ্রামে বাইরে থেকে আসা গ্রামবাসীদের কঠোর কোয়ারেন্টাইন ছাড়া প্রবেশের অনুমতি নেই। নিষ্ঠা ও সচেতনতার পাশাপাশি এসেছে দুর্গমতার প্রসঙ্গও। গ্রাম থেকে বাকি রাজ্যের যোগাযোগ সড়কটি অরণ্যাকীর্ণ। ট্রেকিং ছাড়া এই পথ ধরে সাধারণ মানুষের যাওয়া আসা মুশকিল। ২০২০-র অতিবৃষ্টি ও ধ্বসের ঘটনায় এই নামমাত্র রাস্তাতেও ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। স্বভাবতই শাপে বর হয়েছে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যেটুকু যোগাযোগ ছিল, ধূলিসাৎ তাও। ফলত, সংক্রমণ থাবা বসানোর সুযোগটুকুও পায়নি।
সবটুকুই কি সাময়িকতা? সবটুকুই কি অনিশ্চয়তার সুতোয় বোনা? বাসরঘরের যেকোনও ছিদ্রেই ঢুকে পড়তে পারে কালনাগিনী? ছড়াবে পরিবার, পড়শি, গ্রাম? তবু, গত এক বছরের লড়াই, নিষ্ঠা এগিয়ে রেখেছে মানুষগুলিকে। গ্রামগুলিকে। অন্ধকারেও আলো ছড়াচ্ছেন তাঁরা। স্বল্প পরিসরে হলেও ক্ষতি কি?