অশোককুমার মুখোপাধ্যায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
এখানে সেখানে
দুপুরের খাওয়া সেরে কখনও শিয়ালদা-সার্কুলার রোডের অস্থায়ী বাস আড্ডা থেকে বালক দুটি তাদের মধ্যতিরিশ মায়ের সঙ্গে উঠে পড়ে সরকারি ছত্রিশ নম্বর বাসে। যাওয়া হবে নারকোলডাঙার ষষ্ঠীতলায়, বড়মামার বাড়ি। আরও দুই মামা থাকলেও, বড়মামা যেখানে, তাকেই মামার বাড়ি বলে জানে দু-ভাই। সারাটা দুপুর হুড়ুদ্দুম করবার পরে বিকেলের রং ধরলে কলাইয়ের কাপে দুধ-চা খেতে যে কী আনন্দ! নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও চায়ের ওই স্বাদ তো কিছুতেই আনা গেল না। সেই কাঁসার থালা, কলাইয়ের থালা-বাটিও তো কোথায় উধাও। যা সে সময় যে-কোনও মধ্যমানের মুদির দোকানের টিনের ক্যানেস্ত্রা উপচিয়ে পড়ে, সেই হাতি-ঘোড়া-কুকুর-বেড়াল-খরগোশ-মাছ-প্রজাপতি আকৃতির বিস্কুটও, চলতি কথায় হাতি-ঘোড়া বিস্কুট (প্রজাপতি বিস্কুট বলিনি আমরা), আমাদের ওই বিকেলের চায়ের আসরের মুখ্য সহযোগী, আর বাজারে নেই। এই বিস্কুট নিয়ে অনেক আগেই একটি এপিটাফ লেখা উচিত ছিল আমাদের। যেমন উচিত ছিল জলছবিকে নিয়ে লেখা। জলছবির ম্যাজিক! বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট গণেশ অ্যাভিনিউ-র মিলনবিন্দুতে এক জলছবি-ওলাকে বসে থাকতে দেখেছি কতদিন। ওর থেকে কিনে খাতার পেছনের মলাটে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জলছবি সাঁটিয়েছিলাম। একবার কাশীপুর অঞ্চলে জলছবি বানাবার কারখানা, মেট্রোগ্রাফ, দেখতে গিয়েছিলাম, কারখানা কিনে নেবার মেজাজে। কিন্তু তার দাঁত বের করা চেহারা দেখে মনে হয়েছিল একটা সনেট লিখে এর দেওয়ালে অবিলম্বে সেঁটে দেওয়া দরকার। মধুসূদন-সনেট লিখেওছিলাম, সাঁটা আর হয়নি।
মামার বাড়িতে চা খাবার পরে বিকেলের আজান শুনলেই মনে হবে, ঘরে ফেরার ডাক। রাস্তায় নেমে, ছেনুদার (শ্রীনাথবাবু) দোকান বাঁ-হাতে রেখে দু-পা এগোলেই বাতাস ঝাঁ-ঝাঁ করে সর্ষের তেলের গন্ধে। নাকের ডগাতেই তেলের ঘানি যে! বৈঠকখানার কৃষ্ণকালী অয়েল মিলের সর্ষের ঝাঁঝ খাওয়া আমাদের রেওয়াজি নাকও একটু উত্তেজিত। রাস্তার গ্যাসবাতিগুলি জ্বলতে-জ্বলতে সন্ধে এগিয়ে আনছে আমাদের দিকে। তারই উলটো স্রোতে, বাস-স্টপের উদ্দেশে পা-চালাতে হবে। বড়মামা সঙ্গে থাকলে কোনও চিন্তা নেই, আমরা ঠিকঠাক ফিরতি ছত্রিশ নম্বরে উঠে পড়ব। ষষ্ঠীতলা রাস্তার চলন ঠিক খঞ্জনা গাঁয়ের অঞ্জনা নদীর মতো, পুরনো শিবমন্দিরের পাশ থেকে বাঁক নিয়ে পড়েছে নারকোলডাঙা মেন রোডে। সেই মোহনায় দাঁড়িয়ে ডান-বাঁ দেখে নিয়ে যেই রাস্তা পেরোনো, সামনেই কে হোড়ের মহাভৃঙ্গরাজ তেলের সাইনবোর্ড লাগান রকমারি দোকান, তার পাশেই, তুলনায় অনুজ্জ্বল দোকান মুরারির, যার গুড়ের মুড়কির কোনও তুলনা নেই। ওই দোকান থেকেই তো বড়মামা মুড়কি কিনে মার হাতে ধরিয়ে দেবে। অবশ্য গুড়ের খোঁজখবর বংশমর্যাদা জেনে তবেই মুড়কি কেনা।
রাজাবাজারের দিকে রাস্তায় গ্যাসলাইট জ্বলে উঠেছে। বাস যখন রাজাবাজার-নারকোলডাঙার পুল পেরোচ্ছে, গ্যাসবাতির স্তম্ভগুলি ঝলমল। সে কী আলোর কুরকুট্টি! বাসের বাঁ-দিকের জানালা দিয়ে তাকালেই— ওই যে ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির ট্যাঙ্ক উপরে, অর্থাৎ গ্যাসে ভরে গেছে আধার, গ্যাস ফুরোলেই যা নেমে আসবে মাটিতে। পর্যায়ক্রমে এই ওঠানামার খেলা চলে দিনভোর, এ-কথা জানা আমাদের। কিন্তু যা পরে জেনেছি, ওইখান থেকেই প্রথম ভারতীয় ‘এরোনট’ রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর নিজের বেলুন ‘সিটি অফ ক্যালকাটা’ চেপে একা-একা আকাশে উড়েছিলেন— ৪ মে, ১৮৮৯। লোকে টিকিট কেটে দেখেছে সেই রগড়।
গ্যাস কোম্পানির পাইপ ডালপালা ছড়িয়েছিল মধ্য কলকাতার অনেক পাড়ায়। অনেক বাড়িতেই তোলা উনুনের পাশাপাশি রান্না হয় পাইপে আসা কোলগ্যাসে। একটি বর্ণও ভুল লেখা হবে না, যদি বলি আমাদের স্কট লেনেও সেদিন গ্যাসবাতি। একটি লোক কাঁধে মই নিয়ে দৌড়ে-দৌড়ে আসে গ্যাসবাতি জ্বালাতে। রাত গভীর হলে সেই সবুজাভ আলো রাস্তায় রূপকথা বুনে দেয়। যদি বলি ওই গ্যাসের আলোর পরিবেশে পায়ের পাতা থেকে তাড়াতাড়ি ঘুম উঠে আসে চোখে, মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না। এ নিশ্চয় ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫-র মধ্যেকার কথা, আমরা ক্লাস থ্রি-ফোর-ফাইভ-সিক্স। গ্যাসবাতি এবং বিজলি পাশাপাশি জ্বলছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সদরের সামনের গ্যাসবাতিগুলি বহুদিন শোভা দিয়েছে। যা খবর পাওয়া গেল, ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯-এর মধ্যে ক্রমশ শহরের রাস্তার গ্যাসবাতি উধাও। তবে পাইপের গ্যাসে রান্না তো আরও কিছুদিন ছিল। আমাদের এক আত্মীয়া ওই গ্যাসের আগুনে নুন ছিটিয়ে সোডিয়ামের ধর্ম বুঝিয়েছিলেন। ভূগর্ভের পাইপ কোথাও না কোথাও ছ্যাঁদা হবে, সেই রন্ধ্রপথে গ্যাস বেরোবেই। এমন খবর যার আঙুলের ডগায় খেলা করে বেড়াত সেই টুপাই চিনিয়েছিল পাইপের দুর্বল জায়গাটি। অতএব কালীপটকা ফাটাবার সময় আমাদের আর মোমবাতির দরকার হত না, স্রেফ গন্ধের আন্দাজে দেশলাই জ্বালালেই আগুন, সেই আগুনে ধরিয়ে নাও কালীপটকার চাল, নিজস্ব ছন্দে আওয়াজ করতে থাকবেন তারা। একবার হরিণঘাটার দুধের বোতলে হাউই বসিয়ে কায়দা করে ওই কোল গ্যাসের আগুন দিতেই বোতল উল্টে গেল। হাউই ছুটল রাস্তার ধারের নালার সমান্তরালে। সামনের গ্যারাজের মুখে দাঁড়িয়ে একজন আড্ডা মারছিল, তাকে সতর্ক করতে চিৎকার করা হল, কিন্তু শব্দ পৌঁছোবার আগেই পৌঁছে গেছে হাউই এবং লোকটির পশ্চাদ্দেশে ধাক্কা খেয়ে কেৎরে পড়েছে। তেমন কিছু হয়নি লোকটির, একটু পেছন পুড়ে গিয়েছিল, এই যা। মুখ তো পোড়েনি!
এই ধরনের দুষ্টুমিতে আমাদের গুরু ছিল যে, সেই দাদা, রাঙাপিসির ছেলে, থাকত সোনারপুরে। তখনও সোনারপুর কলকাতার হাতের নাগালে আসেনি। ওইখানে যাওয়া মানে, হেমন্তকালে, ছোটখাট সুটকেস গুছিয়ে বেশ আড়ম্বর করে ট্রেনে চেপে যাওয়া। টাটকা খেজুর রসে চুমুক দিয়ে ভোর হয় সেই পুরীতে। দাদার ওপর আমাদের বাবার ঘরানার প্রচুর প্রভাব— শরীরচর্চাতে সব সমস্যার সমাধান। স্টেশনের ফটকের সামনের এক আখড়ায় মুগুর ভাঁজত সকালে, বিকেলে বাদাম-মাঠে খেলা হত ফুটবল। রাইট আউট খেলতে হবে আমাকেই। তো, এই দাদা একবার টার্গেট প্র্যাকটিস করতে গিয়ে, মনের মতো লক্ষ্য না খুঁজে পেয়ে ওর জ্যাঠামশায়ের টাকমাথার উদ্দেশে এয়ারগান চালিয়েছিল। যেহেতু জ্যাঠার বাড়ি আর ওদের বাড়ির মধ্যে এক পুকুরের ফাঁক, যেহেতু এয়ারগানের টোটা অতীব নিরামিষ এবং, যেহেতু জ্যাঠার টাকটি বহু পুরনো, ফলে রোদে-জলে শক্ত, টোটা চামড়ার উপরিভাগে আটকে ছিল শুধু। ‘মাথার পিছন দিকটা চুলকোচ্ছে কেন’ বলতে-বলতে তিনি টোটা আবিষ্কার করেছিলেন, ফলত আমাদের দীপুদার কঠিন শাস্তি জুটেছিল। এই সন্দেশ দিতে-দিতে রাঙাপিসি প্রতিবার হেসে ফেলত। বোঝা যেত না, দাদার দুষ্টুমিটা লাই পাওয়ার না কানমোলার। দিনের-দিন সোনারপুর থেকে ফেরবার থাকলে, রাঙাপিসি কী অবলীলায় প্রাইমাস স্টোভ জ্বালিয়ে লুচি-তরকারি বানিয়ে বিকেলের জলখাবার করে ফেলবে। দোকানের সন্দেশ রসগোল্লাও থাকবে তাতে। তা খেয়েই স্টেশনে ছোটা, ফিরতি ট্রেন ধরতে। ট্রেনের দুলুনিতে ঘুম এসে যাবে অনিবার্য। শিয়ালদা ঢোকবার মুখে আশুকাকু জাগিয়ে দেবে আমাদের। দ্বারিক ঘোষের দোকান ডান-দিকে, আদর্শ হিন্দু হোটেল বাঁ-দিকে রেখে বৈঠকখানা বাজারের মধ্য দিয়ে পথ কেটে যতক্ষণে স্কট লেনে ঢোকা, গ্যাসবাতিগুলি মিটমিট করছে।
বড়পিসি-মেজপিসি-বড়পিসেমশায়-রবিকাকুর সঙ্গে, পিসিদের কনসাল গাড়ি চেপে, যাওয়া হল পিকনিক করতে। কল্যাণী। বেশ জল-জঙ্গলের জায়গা। পাখি প্রচুর। বেশিরভাগই স্নাইপ পাখি। চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট পিসেমশায়ের দো-নলা বন্দুক। টিপ খুব ভাল। অনেক ব্যাপারেই তাঁর মিল বন্ধু শচীন্দ্রনাথ (মনা) গুহর সঙ্গে। শচীন্দ্রনাথ মানে বুদ্ধদেব গুহর বাবা। দুই পিসি প্যাকিং বাক্সের আড়ালে প্রাইমাস স্টোভ জ্বেলে যতক্ষণে খাবার তৈরি করলে, পিসেমশায়ের অনেকগুলি শিকার হয়ে গেছে। একটা করে গুলির আওয়াজ হয়, আর রবিকাকু ছুটে যায় শিকার আনতে। হঠাৎ তারও শখ হল ট্রিগার টেপবার। রাস্তার পাশেই টেলিগ্রাফের তার, স্তম্ভে কান পাতলে শোঁ-শোঁ শব্দ শোনা যায়। সেই টেলিগ্রাফের তারের ওপর বেশ কয়েকটি পাখি। লক্ষ্য স্থির করে ট্রিগার টিপতেই, গুড়ুম। সব পাখি উড়ে গেল। গুলি লেগেছে টেলিগ্রাফের তারে। সেই অত বছর আগেও, ১৯৬১-৬২ হবে, অল্প সময়ের মধ্যে এসে গেল পুলিশ। পিসেমশায় ইনকাম ট্যাক্স কমিশনার। সামলালেন ওদের। তবে ভণ্ডামি হবে যদি না বলি স্নাইপ পাখির মাংস অতীব স্বাদু।
যে মেজমাসির বাড়িতে, কোনও সন্ধেবেলায় জন্ম স্কট লেনের এই বালকের, সেই সিমলা-হাউস বাড়ির মালিক ডব্লু সি ব্যানার্জি, সাধারণ জ্ঞানের বই অনুযায়ী, কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি। একান্নবর্তী পরিবার যে কাকে বলে, ওইখানেই দেখা এবং জানা। তুত দাদা-দিদিদের সঙ্গে রান্নাঘরে চাটাই পেতে খেতে বসা, তার আগে খোলা আকাশের নিচে, ছোটখাট পুকুরের মতো চৌবাচ্চা থেকে বালতি দিয়ে জল তুলে মাথায় ঢালা, গামছা দিয়েই শরীর মার্জনা, শুধু বড় বাথরুম করতে গেলেই একটু যা ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হয়! সে অবশ্য কানপুরে খাটা-পায়খানা দিয়ে শৈশব শুরু করায়, খুব কিছু অসুবিধা হয়নি। তখন অবশ্য ওই বাড়িতে তিনটে কি চারটে আলাদা রান্নাঘর, আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা, তবু, তখনও যা ছিল কম কী! সবাই মিলে একসঙ্গে থাকা তো! বিশেষত যাবতীয় ভৃত্যকুলের শোয়া সদর দরজা লাগোয়া একটি খুব-ছোট-নয় এমন হলঘরে। ওরা সবাই শতরঞ্চি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। কেউ বেশি রাতে বাড়ি ফিরলে ওরাই দরজা খুলবে। বাড়ির পাশেই ডেকরেটরের গুদাম। বাঁশ তো বটেই, ভাঙা হলুদ চেয়ারও পড়ে সেখানে। প্রথম সংস্করণের কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। চেয়ারের ঠ্যাংকে হকিস্টিক বানিয়ে খেলার সূত্রপাতও বোধহয় ওই ডব্লু সি ব্যানার্জির বাড়ির দাদাদের হাত ধরে। খেলতে-খেলতে মারামারিটাও রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ধার্মিক হওয়ার উপায়ও হাতের নাগালে। সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই রাধাকান্ত জিউয়ের মন্দির। সামনে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট থাকলে অনেকেই তখন ঠাকুরবাড়ির চৌকাঠ ডিঙোয়। ভালো করে ঘুড়ি ওড়ানো শেখাও তো ওই বাড়ির মনুদার হাতে। শিখলেও, নার্সারির গণ্ডি আর পার হতে দেয়নি দাদারা। সে তুমি যত ভালোই মাঞ্জা দাও, কি যতই ভালো লাটাই ছাড়, তুমি এখনও নার্সারি, খুব বেশি হলে কেজি ওয়ান। বিশ্বকর্মা পুজোর সময় এ বাড়ির দাদার হাতে ও-ছাদের ঘুড়ি কাটা পড়লে আমাদের কাজ ছিল ধুয়ো দেয়া— ভো কাট্টা, এবং সশব্দে কাঁসর-ঘণ্টা বাজান। মামার বাড়ি সদ্য দোতলা হবার পর ছাদ থেকে ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম একবার। পূর্ণ স্বাধীনতায়। অন্য ঘুড়ি কাটা নয়, টানামানি করে প্রতিপক্ষের ঘুড়ি এনে ফেলেছিলাম এ-বাড়ির ছাদে। গণ্ডগোল জমকালো হবার আগেই বড়মামা আসরে ঢুকে পড়ে এবং আগুনে জল ঢালে। প্যাঁচ খাওয়া সুতো ছাড়িয়ে ঘুড়ি ফেরৎ দেওয়া হয় শত্রুপক্ষকে। দাদুর গান্ধিবাদী নীতি নিশ্চয়ই বড়মামার মধ্যে চারিয়ে গিয়েছিল কিছুটা।
সন্ধে ঘন হলে ডব্লু সি ব্যানার্জির রাস্তা দিয়ে, স্কট লেনের মতোই, কুলপিওলা যায়। বড়দের জন্য পাওয়া যায় সিদ্ধি-মিশেল কুলপি, যা খেতে এবং খাওয়াতে মেজ মেসোমশাইয়ের পরের ভাই পরমদেববাবুর খুব উৎসাহ। আমাদেরও দেওয়া হত, তবে তা ভাং-ছুট কুলপি।
সিমলা-বাড়ি থেকে সকালবেলায় ট্রামে চেপে স্কুল যেতে কী মজা! টিফিনে থাকে পাউরুটি, ডিম আর নকুড়ের কড়াপাক সন্দেশ অথবা মহাদেবের অমৃতি (যা আমাদের মুখের কথায় অমিত্যি)।
সিমলা বাড়িতেই কোমরে তোয়ালে গুঁজে, হাতে বালতি ধরে পরিবেশন করবার সহজপাঠ হয় আমাদের। প্রথম পাঠ কলাপাতার কোণে লেবু-নুন সাজান, যা খাওয়া শুরু হবার আগেই সম্পন্ন করতে হবে। অতিথি বসতে আরম্ভ করলেই ডান দিকে রাখা মাটির গেলাসে ভরে দিতে হবে জল। পিতলের জগ থেকে জল ঢালা যত সহজ মনে হয়, কাজটি তত জলবৎ নয়। অবধারিতভাবে কিছু গেলাসের তলায় ফুটো থাকবে, যেখান থেকে জল বেরিয়ে ভিজিয়ে দেবে টেবিলের কাগজ। তখন গেলাস পালটাও, কাগজ পালটাও। এবং সবই করতে হবে হাসিমুখে। পরিবেশনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নতি করা গিয়েছিল। লুচি-ডাল-বেগুনভাজা থেকে শুরু করে মাংস-চাটনি-পাঁপড়-দই অবধি দেওয়ার দায়িত্ব বর্তেছিল আমাতে!
একান্নবর্তী বিয়েবাড়ির রান্নাঘরে সংযমের পরীক্ষা হয়। ফিশফ্রাই হচ্ছে, খেতে পাবে না। সদ্য উনুন থেকে নামান হয়েছে মাংস, চাখতে পাবে না, তোমাকে প্রাণপণে উচ্ছেসেদ্ধর কথা ভেবে যেতে হবে। আশপাশে দাদারা-দিদিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে না! সিমলা বাড়িতেই মেজদার বিয়েতে ডিমের ডেভিল হয়েছিল। সে এক বৈপ্লবিক ব্যাপার। সে সময় কারুর বিয়েতে এমন হুট বলতে ডেভিল হবার কথা নয়। আসলে মেজদা ছিল গিরিশ পার্ক-সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-র নিরঞ্জন আগারের গুণগ্রাহী। ওদেরই পাচক এসে বানিয়ে দিয়েছিল ডেভিল। খাঁটি ডিমের মধ্যে খাঁটি পাঁঠার মাংসের পুর ভরা নির্ভেজাল, সত্যি ডেভিল। মেজদার মেজাজ বরাবরই রাজকীয়। কোনও দিদির বিয়ে। বরপক্ষের এক ফচকে ছোকরা হঠাৎ বলল, ‘অনেক লোকের মাথা খেয়েছি, দইয়ের মাথা তেমন করে খাইনি।’ বোঝাই যাচ্ছে চাপ তৈরি করবার জন্যই এমন কথা বলা, যা বরযাত্রীরা হামেশা করে থাকে। কিন্তু সবাই তো চুপচাপ মেনে নেয় না। বিশেষত মেজদা, যে নাকি নামজাদা আর্কিটেক্ট। অনতিঅতীতের ইউনিভার্সিটি ওয়াটারপোলো টিমের ক্যাপ্টেন ভাইয়ের উদ্দেশে ব্যারিটোন গলায় হাঁক পাড়ল, ‘লিচু আমার দইয়ের হাঁড়ি…’
দইয়ের হাঁড়ি এল। মাথা কেটে দেওয়া হল লোকটিকে। আবার এল হাঁড়ি। আবার মাথা কাটা হল দইয়ের। আবার, আবার, আবার…। এর শোধ নেওয়া হয়েছিল বউভাতে। মেজদার নির্দেশে সবাইকে মাছ খাওয়ার টার্গেট বেঁধে দেওয়া হল। আমাদের মতো এলেবেলেদেরও কমপক্ষে এক ডজন মাছ খেতে হবে। খেলা শুরু। লুচি বেগুনভাজা কোনওরকমে নামিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল আসল লক্ষ্যে। অতএব, যা হওয়ার ছিল— মাছ শেষ! এইখানেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার কথা। হল না। দিদির শাশুড়ি এসে পরিবেশনকারীদের বলে গেলেন, ‘অ্যাই দেখে শুনে দেবে, কেউ যেন খাবার নষ্ট না করে।’ ‘হোয়াট ডাজ সি মিন?’ মেজদা তেতে উঠল, ‘আমরা খাবার নষ্ট করছি…?’ নির্দেশ এল, ‘এইবার মাংসটা শুরু কর…।’
ক্রমশ
কলকাতা, নয়…-এর সব পর্বের জন্য ক্লিক করুন: কলকাতা, নয়… – অশোককুমার মুখোপাধ্যায়