প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
–নরেন মাহাতো।
চমকে উঠেছিল জন।
এই হোমে তাকে তো নরেন বলে কেউ ডাকে না। ডাকার নিয়মও নেই এমনকী।
অথচ তাকে আর কেউ নয়, স্বয়ং ফাদার ডাকছেন।
বিস্ময়ের অবধি ছিল না নরেনের। যবে থেকে সে জল খেয়েছে, অর্থাৎ কেরেশ্চান হয়েছে (ধর্ম পালটানোকে ‘জল খাওয়া’ নামেই ডাকত তাদের লোকজন)— তবে থেকে তার এই নাম সে ভুলতে বসেছিল। যে ফাদার তাকে পড়াশোনা শেখালেন, মানুষ করলেন প্রায় বলা চলে, যে ফাদার তাকে ‘নরেন’ থেকে ‘জন’ করে তুললেন— সেই ফাদার ভুলেও তাকে এই নামে ডাকেননি কখনও।
নতুন ফাদার এসেই তাকে এই নামে ডাকলেন প্রথমে?
–তোমাকে হয়তো জন নামেই ডাকব, এখানে সবাই তাই করবে। কিন্তু নিজের আসল নামটা কিন্তু কখনও ভুলে যেও না।
এমন আশ্চর্য কথা ফাদারের মুখে শুনে চমকে উঠেছিল জন, ওরফে নরেন।
আজ নরেনের সব মনে পড়ছে।
ফাদার! ফাদার স্বদেশিদের লোক!
স্বদেশিদের নিয়ে কখনও বিশেষ ভাবেনি সে। দারোগা তাকে জেরা করার সময় বলেছিল স্বদেশিরা ডাকাত!
ডাকাতদের দলে তাহলে নাম লিখিয়েছেন ফাদার?
কিন্তু এরা, এই স্বদেশিরা তো মামুলি ডাকাত নয়। এদের তো একটা উদ্দেশ্য আছে! এই দেশ থেকে এরা ব্রিটিশদের তাড়াতে চায়, তেমনটাই জানে নরেন। ফাদারও তাই চান?
ওই মেয়েটা তো স্বদেশি। তাকে জখম করল কে? ফাদার? তাহলে তিনি কাদের লোক? না কি আদৌ জখম করেনইনি ফাদার ওকে, বরং বাঁচাতে চেয়েছিলেন?
কলকাতা বলে কোথায় গেলেন ফাদার?
রাত শেষ হয়ে আসছে। হাজারও চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে নরেনের মাথায়।
কিন্তু এইসব প্রশ্নের উত্তর নরেনের থেকে বেশ কিছুটা দূরে বসে পেয়ে গেছে লতা।
সে নিশ্চিত, এই ফাদারই সে, যে আহত এবং অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছিল। খেতে বসেছে সে ফাদারের খুব কাছেই, আর সেই তীব্র গন্ধটা পাচ্ছে, যা সেদিন সেই লোকটার গা থেকে পেয়েছিল।
সূর্যবাবু, জয়চাঁদ আর ফাদার এ ঘরে আছে জেনেও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না লতা। দুটো কারণে। মৃন্ময়দাদা কোথায়? সে কি এখানে লুকিয়ে আছে? নাকি সে অন্য কোথাও আছে? এখানে এখন থাকলে সে কোথায়? আর দ্বিতীয় কারণ, মহেশ সেন এই গোটা ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও সনাতন হাজরা অবশ্যই পারছে। এই লোকটার চাহনি প্রথম থেকেই ভাল লাগছে না লতার। জনার্দন যত গর্জাচ্ছে তত বর্ষাবে না, এটা বুঝতে পেরেছে লতা। কিন্তু সনাতন অন্য জাতের ধুরন্ধর। প্রথম থেকেই সে কথা কম বলছে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।
তবে সনাতন হাজরার কথা ভাবলেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে লতা। তার চোখ চলে যাচ্ছে সনাতনের খড়মের ফাঁকের দিকে।
কী আছে ওখানে?
লতার প্রতিবেশী রমার বাড়ি, অর্থাৎ রায়বাড়িতে ডাকাতি করেছিল মৃন্ময়দাদা আর আরেকজন। খগেনের থেকে আংটিটা হাতানোর দরকার ছিল, ওই আংটি তাদের স্বদেশি আন্দোলনের কাজে লাগত। রমার থেকে কতবার সেই আকাশি হিরের আংটির কথা শুনেছে লতা! স্বদেশিদের অনেক টাকার দরকার, ওই আংটিটা পেলে…
কিন্তু রমা আর খগেনও যে ওই আংটির ভরসাতেই পালাতে চায়, তা জানত না লতা। সে শুধু ঝোঁকের বশে রমাকে বলেছিল, মৃন্ময়দাদার সঙ্গে সে পালাবে। এতে যে রমার মাথাতেও পালানোর ভূত চাপবে, তা ভেবেও দেখেনি লতা।
রমা আর খগেনের পালানোর চেষ্টার জন্যই সেদিন সব বিগড়ে গেল। ওই আংটি ওদের হাতে এল না।
রমা একবার, একবার নিজের হাতে ওই আংটিটা পড়েছিল। খগেনদা ওকে পড়িয়েছিল। ও যে বর্ণনা দিয়েছিল সেই আংটির, তাতে সনাতনের খড়মের নিচের ওই আলো দেখে ওটার কথাই মনে পড়ে।
সনাতনের কাছে কীভাবে আসবে সেই আংটি?
কীভাবে যে এসেছে, তা সত্যিই এক অলৌকিক ব্যাপার। কিন্তু লতা কোনওদিন জানতেও পারবে না, যে আংটির কথা সে ভাবছে, সেই আংটি আর সনাতন হাজরার খড়মের নিচে যে আংটি, তা এক নয়।
হ্যাঁ, তার খড়মের নিচ থেকে যে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, যা ঘরের বাকিদের চোখে পড়েনি, তা অবশ্যই একটি আংটি, যার মাঝে বসানো একটি আকাশি রঙের হিরে।
অথচ, খগেনের কাছে যে আংটি, যে আংটি ওমানের সূত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের প্রাপ্য ছিল, যা সাহেবি লুটেরাদের কল্যাণে বেহাত হয়ে শেষমেশ আবার ফিরেছিল তাদের কাছেই, কিন্তু যে আংটির সূত্র ধরে খগেনদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম কেনা হয়ে থেকেছে রায়দের কাছে— সেই আংটি, আর সনাতন হাজরার খড়মের নিচে লুকিয়ে থাকা আংটি এক নয়।
এ সংক্রান্ত কিসসায় পরে ঢোকা যাবে। আপাতত লতা এসব ভাবছিল, যখন জয়চাঁদ তাকে খাইয়ে দিচ্ছিল। জয়চাঁদের খাওয়ানোর ধরন দেখে বোঝা যায়, তাতে মমতা আছে। লতাকে যেন জয়চাঁদ চেনে। যাই হোক, লতার এসব চিন্তায় ছেদ ফেলে মহেশ সেন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন। সনাতনের নির্দেশে জয়চাঁদ গেছে তার পেছন পেছন।
লতার মন বলল, নাটকের মোড় ঘুরতে শুরু করেছে।
লতা সকলের মুখের দিকে তাকাল।
ফাদার এমনিতে অচঞ্চল। একটু আগে যখন জনার্দন তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছিল, তখনও তাকে বিচলিত হতে দেখা যায়নি। এখন যেন তার মুখে কিঞ্চিৎ অস্থিরতা। সূর্যবাবুর ছদ্মবেশের আড়ালে তার মুখভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে না। জনার্দন কেবল ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিতই নয় যেন। একমনে মুরগির ঠ্যাং চিবোচ্ছে।
আর লতা ছাড়া আরেকজন বাকি সকলকে নিরীক্ষণ করে চলেছে। সনাতন হাজরা।
তার চোখে তীব্র দৃষ্টি।
কিছুক্ষণ পর জয়চাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে ঘরে ঢুকলেন মহেশ সেন। কোনওক্রমে কেদারা অবধি নিয়ে যাওয়া গেল তাকে। কেদারার ওপর প্রায় লুটিয়ে পড়লেন মহেশ সেন। সনাতন দৌড়ে গেল সেদিকে।
লতা বুঝতে পারল নাটকের পরিকল্পনাটা।
মহেশ সেনকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। আর বেশিক্ষণ তিনি নেই।
গভীর হচ্ছে রাত। ক্রমশ তাদের গন্তব্যের কাছাকাছি আসছে গোবিন্দরাম ও শাজাহান।
ওবাড়িতে ঢোকার আগে দুজন হাবিলদারের সঙ্গে তাদের দেখা হবে। গোবিন্দরাম মুখ বাড়িয়ে গাড়োয়ানকে বললেন, ‘সামনে লোক থাকবে। লক্ষ রেখো।’
গাড়োয়ান নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
গোবিন্দরাম গাড়ির পর্দা আবার টেনে দিয়ে তাকাল শাজাহানের দিকে।
–যদি এটা প্রমথরঞ্জনের ছক হয়, অর্থাৎ কিনা আমাদের কলকাতা থেকে দূরে রাখা, তাহলে আমরা কেন এত আয়োজন করছি বুঝছি না। স্বদেশি ধরার জন্য লোক ওখানে গেছে। আমাদের গিয়ে লাভ নেই। আর তোমার কি মনে হয় যে স্বদেশিদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রমথরঞ্জন সশরীরে ওখানে উপস্থিত থাকবে?
শাজাহানের মুখের ভাবভঙ্গি হঠাৎ কেমন পালটে গেছে।
–কী ভাবছ? প্রশ্ন করল গোবিন্দরাম।
–আপনি কি জানেন স্যার, অনাদি চৌধুরী, যিনি এই বাড়িটার মালিক ছিলেন, তার বাড়িটা একজন জজসাহেব কিনে নিয়েছেন এখন।
–তা তো জানি।
–এই কেনাবেচার ব্যাপারটা সামলেছিলেন অনাদির এই আত্মীয়, যিনি খুন হলেন।
–হুম তাও জানি।
চোখ চিকচিক করে উঠছে শাজাহানের।
–জজসাহেব ওখানে থাকেন না। যারা ওই বাড়ির তদারকি করছে, তাদের জজসাহেব নিয়োগ করেছিলেন এই আত্মীয়র সূত্রেই।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল গোবিন্দরাম।
–দেখো, আমি শুনেছিলাম ওবাড়িতে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। কোনও এক পুজোর সময়। তারপর ওবাড়িতে আরও নানা কিছু ঘটে। কানাঘুষো আছে, সেইসব ঘটায় অনাদির এই আত্মীয়। যাতে অনাদি বাড়ি ছাড়ে।
উত্তেজিত হয়ে ওঠে শাজাহান।
–তার মানে তার কিছু স্বার্থ ছিল এ বাড়িতে। আবার তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল প্রমথরঞ্জনের।
–কী বলতে চাইছ শাজাহান?
–হতেই পারে, আমাদের কলকাতা থেকে দূরে রাখার জন্য স্বদেশিদের ঠিকানায় আমাদের পাঠাচ্ছে প্রমথরঞ্জন। কিন্তু উলটোটাও হতে পারে। অর্থাৎ, প্রমথরঞ্জনের ও বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু দরকার আছে।
–কী দরকার?
–সেটাই প্রশ্ন। এমন হতেই পারে, ও বাড়িতে প্রমথরঞ্জনের কিছু রয়ে গেছে।
একবার ভুরু কুঁচকে আবার সোজা হয়ে গেল গোবিন্দরামের। মুখে হাসির রেখা দেখা দিল।
–তুমি কি এই কেসে আগ্রহ পাচ্ছ শাজাহান? আমার তো মনে হত, স্বদেশিদের কেস থেকে তোমাকে সরিয়ে রাখার জন্য তুমি মনঃক্ষুণ্ণ।
ম্লান হাসে শাজাহান। এভাবে সে কতদিন হাসেনি।
–আগে আগ্রহ ছিল না স্যার। এখন আপনার সঙ্গে থেকে থেকে মাথা খাটাতে বেশি ভালো লাগে। আগে রাগ ছিল খ্যাপা ষাঁড়ের মতো। এখন মনে হয় মাথা ঠান্ডা না রাখলে প্রমথরঞ্জনের মতো অপরাধীদের ধরব কী করে? তাছাড়া, ওই স্বদেশিদের নিয়ে আমার আর তেমন আগ্রহ নেই।
শাজাহানের দিকে তাকিয়ে হাসলেন গোবিন্দরাম।
গাড়ি হঠাৎ থেমে গেল।
পর্দা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে গোবিন্দরাম দেখলেন, দুজন হাবিলদার এগিয়ে আসছে এদিকে।
–চলো, নামতে হবে।
শাজাহান আর গোবিন্দরাম নামলেন ঘোড়ার গাড়ি থেকে। হাবিলদার দুজনের একজনের হাতে লণ্ঠন। দুজনেই তড়িঘড়ি এগিয়ে আসছে ঘোড়ার গাড়ির দিকে।
সামনে এক বিস্তীর্ণ মাঠ। সেই মাঠের মাঝে দেখা যাচ্ছে অনাদি চৌধুরীর পরিত্যক্ত বাড়ি।
নিশুতি রাত। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই বললেই চলে।
–পুকুরে যে কালীমূর্তি উঠে এসেছিল, তা জেনেশুনেই পুকুরে ফেলা হয়েছিল। আর অনাদি চৌধুরীর ছোট মেয়েকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ছাদ থেকে। এসব করা হয়েছিল, যাতে অনাদি চৌধুরী বাড়ি ছাড়ে। এসব কাজ যে করেছে, পুলিশ তাকে শাস্তি দেয়নি। দিয়েছি আমি। তার গলাকাটা লাশ এখন পড়ে আছে শোভাবাজারের বাড়িতে।
গোবিন্দরাম আর শাজাহানের হাত পা অসাড় হয়ে গেছে। দুজনেরই। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না বিষয়টা।
কথাগুলো বলছে তাদের গাড়োয়ান। যে কলকাতা থেকে এতটা পথ নিশ্চুপে তাদের নিয়ে এসেছে।
গাড়োয়ান তার মাথার পাগড়ি, গোঁফ, দাড়ি একে একে খুলে ফেলল।
অনেকের জবানবন্দি থেকে পুলিশের চিত্রকরদের আঁকা ছবিতে প্রমথরঞ্জনকে বারবার দেখেছে গোবিন্দরাম ও শাজাহান। তার একটি ফোটোগ্রাফও ছিল, যখন সে প্রথম ধরা পড়ে, পুলিশেরই এক সাহেব ফোটোগ্রাফার সে ছবি তুলেছিল। খুবই অস্পষ্ট ছবি। সে ছবিও দেখেছে তারা।
এই প্রথম প্রমথরঞ্জনকে চাক্ষুষ দেখছে তারা। ভয়ঙ্কর খুনি, এক দিনে কলকাতার ত্রাস হয়ে ওঠা প্রমথরঞ্জনের সঙ্গে তাদের প্রথম মোলাকাত হচ্ছে গভীর রাতে, এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গায়।
হাবিলদার দুজন এসে পড়েছে ওদের পেছনে।
দুজনে প্রায় একযোগে বলে উঠল ‘সেলাম সাহেব।’
চলবে
তারান্তিনোর সব পর্ব দেখার জন্য ক্লিক করুন: তারান্তিনো – প্রিয়ক মিত্র