ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেলেন ত্রিপুরার সাংবাদিক শান্তনু ভৌমিক। ইতিমধ্যে চারজন গ্রেফতার। তাঁরা সকলেই না কি ইন্ডিজেনাস পীপল ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা বা আই.পি.টি.এফের সদস্য। যদিও অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলে বসেছিলেন এসবই না কি মানিক সরকারের ‘মাওবাদী’ সরকারের কাজ। যাই হোক, আপাতত অভিযোগের তির আইপিটিএফের দিকেই। আইপিটিএফ তিপ্রাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন করছে। শোনা যাচ্ছে ত্রিপুরার আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-র সঙ্গে তাদের জোট হতে চলেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সিপিএমের উপজাতিদল টি.আর.ইউ.জিপি-র সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হত্যাকারীরা তাঁকে প্রথমে মেরে অজ্ঞান করে, তারপর অন্যত্র নিয়ে গিয়ে খুন করে।
গৌরী লঙ্কেশ খুন হলেন এই মাসের পাঁচ তারিখে। কারা তাঁকে মারল তা এখনও অজানা। কেনই বা তাঁকে মরতে হল, অজানা সেটাও। গতকালের খবর, আততায়ীর ‘ফেসিয়াল প্রোফাইল’ দেখে না কি তদন্তে বিশেষ উন্নতি হয়েছে। তবে সেটা তদন্তের স্বার্থেই কাউকে জানানো সম্ভব হচ্ছে না।
শান্তনু হত্যার পরেই গৌরীর কথা নতুন করে স্মরণ করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই অনুষঙ্গে ভেসে আসছে আরও কয়েকটা নাম। নরেন্দ্র দাবহোলকর, মল্লেশাপ্পা কালবুর্গী আর গোভিন্দ পানসারে। এঁরাও খুন হন আততায়ীর হাতে– সত্যপ্রকাশের দোষে। এঁদের মৃত্যুতে সঠিক কারণেই দেশবাসী উদ্বেল।
এই নিয়ে ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আরও একটা খবর চোখে পড়ল। খবরটা বেরিয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস-এ, ৭ই সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ গৌরীহত্যার দু’দিন পর। খবরে প্রকাশ, আসামের সাংবাদিকেরা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন তুলেছেন– সারা দেশ গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুতে এতটা বিহ্বল হলেও একবারও নজর করল না, দেখল না যে ১৯৮৭ সাল থেকে আসামে রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছেন বত্রিশজন সাংবাদিক? তা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে কেন কোনও ক্ষোভ তৈরি হল না?
গৌরীহত্যার নৃশংসতা ও বীভৎসতাকে কণামাত্র খাটো না করেও বলা যায়– প্রশ্নটা সঙ্গত।
Reporters Without Borders (RSF), for freedom of information বা RSF নামের একটি সংস্থার কাজের বিষয় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার হালহকিকতের খবর রাখা। এঁরা বছর-বছর এই বিষয়ে দেশভিত্তিক রিপোর্টও দিয়ে থাকেন। এঁদের ওয়েবসাইটে ভারতের কিছু তথ্যও আছে।
তার থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালের তালিকায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে মোট ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩৬। ২০১৬-তে ছিল ১৩৩। অর্থাৎ ১৭-তে অবস্থা ১৬-র তুলনায় আরও একটু বেশি খারাপ হয়েছে। ‘Threat from Modi’s Nationalism’-শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে এই সংস্থা জানাচ্ছে – “With Hindu nationalists trying to purge all manifestations of “anti-national” thought from the national debate, self-censorship is growing in the mainstream media. Journalists are increasingly the targets of online smear campaigns by the most radical nationalists, who vilify them and even threaten physical reprisals….”
গৌরীর মৃত্যুর পর কিছু মানুষ এই বলে আক্ষেপ করছিলেন যে দেশটা পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের জানিয়ে রাখি– ২০১৭ সালে পাকিস্তান ছিল একশো উনচল্লিশ নম্বরে, অর্থাৎ ভারতের থেকে খুব নীচে নয়। আরও জানিয়ে রাখি– পাঁচ বছর আগে পাকিস্তান ছিল একশো উনষাট নম্বরে আর ভারত একশো চল্লিশ নম্বরে। সেখান থেকে যথাক্রমে একশো উনচল্লিশ ও একশো ছত্রিশ-এ পৌঁছে কে বেশি উন্নতির স্বাক্ষর রেখেছে তা আলাদা করে বলে দেবার দরকার মনে হয় নেই।
Committee to Protect Journalist (CPJ)-নামক আরও একটি সংস্থার দেওয়া হিসাবে দেখতে পাচ্ছি, ১৯৯২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত আমাদের দেশে খুন হওয়া সাংবাদিকের সংখ্যা একাত্তর। এই একাত্তর জনের মধ্যে একচল্লিশ জনের ক্ষেত্রে খুনের কারণ জানা গেছে। আমরা এই একচল্লিশ জনকে নিয়ে কথা বলব।
এখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভালো। উৎস যেহেতু আলাদা, তাই সংখ্যাতে তারতম্য হতেই পারে। আর পাঠক বুঝবেন, সংখ্যার অভ্রান্ততা প্রতিষ্ঠা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য সার্বিক অবস্থাটা বুঝতে সাহায্য করা।
CPJ-র বক্তব্য, এই একচল্লিশ জন সাংবাদিকের মধ্যে খুন হয়েছেন আঠাশ জন (বিপদের ঝুঁকি ছিল এমন কোনও কাজ তাঁরা করছিলেন না), আর তেরো জন মারা গিয়েছেন ‘dangerous assignment’ কভার করতে গিয়ে (তাঁরাও খুনই হয়েছেন)। এই একচল্লিশ-এর কুড়ি জন মারা গিয়েছেন কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের হাতে। অপরাধী দলের হাতে প্রাণ দিয়েছেন মাত্র আট জন।
এর থেকে একটা কথা মনে হয় বুঝতে পারছি। সাংবাদিকদের মূল বিপদ রাজনৈতিক দলগুলো। আর মৃত্যুর মূল কারণ রাজনীতি।
২০০২ সালে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার তালিকায় ভারতের স্থান ছিল আশি, যা ২০১৭-এ এসে দাঁড়িয়েছে একশো ছত্রিশ-এ। CPJ আর RSF – এই দু’টো উৎসের পরিসংখ্যানকে যদি একসঙ্গে দেখা যায়, তবে তার থেকে একটা বিষয়ে কিছুটা হলেও ধারণা হয়, যে আমাদের দেশে সাংবাদিকদের ওপর রাজনৈতিক অপরাধ বেড়েই চলেছে।
একটা বিষয় দেখবার। হিংসার বলি হচ্ছেন যারা, তাঁদের প্রায় সকলেই অ-ইংরেজি মাধ্যমের সাংবাদিক। আততায়ীরা কি ধরে নিয়েছে, যে স্থানীয় ভাষায় নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশিত হলে তাদের পক্ষে সেটা বেশি বিপজ্জনক?
এ তো গেল হত্যা। মৃত্যু তো চূড়ান্ত শাস্তি। কিন্তু যেসব সাংবাদিক বা আলোচক সত্যকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন, জীবদ্দশাতেও কি তাঁদের কম শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়? এ-প্রসঙ্গে সাম্প্রতিকতম উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে একটি বহুলপঠিত পত্রিকার, যাতে আমাদের দেশের একটি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মলঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। এই অপরাধে সেই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ওই পত্রিকার বিরুদ্ধে এত বিরাট অঙ্কের মামলা রুজু করবার ভয় দেখায়, যে পত্রিকাটা পিছু হটে ও সেই সাংবাদিক, ঘটনাচক্রে যিনি সেই পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন, চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
একদিকে নির্ভীক সাংবাদিকতার উপর আক্রমণ, আর অন্যদিকে ‘পেইড নিউজের’ উলঙ্গ নাচের মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। আক্রমণ শুধুই যে সাংবাদিকতার উপর, তা আর বলি কী করে। পাঠক, স্মরণ করুন কিছুদিন আগের কথা, যখন সেন্সর বোর্ড অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের উপর একটি তথ্যচিত্রে ‘গোরু’ ও ‘গুজরাট’ এই দুই শব্দের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিলেন। আমাদের দেশের সামনের সারির সাংবাদিক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের কী ধরণের গালিগালাজের সম্মুখীন হতে হয়, ট্যুইটারে থাকা যে-কেউ তা জানবেন। সাধারণ ‘ফলোয়ার’-রা গালি দিয়েই ক্ষান্ত হয়। সংসদের সদস্য লেখিকাকে জীপের সামনে বেঁধে কাশ্মীরের রাস্তায় ঘোরানোর পরামর্শ দেন। নানান অপকর্মের প্রতিবাদে সরকারি পুরষ্কার ফিরিয়ে দিতে চাওয়া লেখকদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী নির্দ্বিধায় বলেন– লেখকেরা লিখতে না পারলে আগে লেখা বন্ধ করুক, তারপর আমরা দেখছি। সেই মন্ত্রীর কোনওরকম শাস্তি হওয়া তো দূর, অন্যান্য নতুন পদের আভূষণে তাঁকে বরং আরও সাজিয়ে তোলা হতে থাকে। গৌরীর মৃত্যুর পর যারা উল্লাসে মাতেন, তাঁরা সরকারের উচ্চতম মহলের নজরে থেকেই সেই কাজগুলো সম্পন্ন করেন। এরপরও যদি সত্যভাষী সমালোচক আক্রান্ত না হন তবে আর কী করলে হবেন?
ওয়্যার পত্রিকা খবর দিল নরোত্তম মিশ্রের। তিনি না কি বিয়াল্লিশটি পেইড নিউজের সাহায্যে ২০০৮-এ মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং রাজ্যের মন্ত্রীও হন। পরবর্তীতে তিনি মিডিয়া খরচের উৎসের সন্তোষজনক কারণ না দেখাতে পারার জন্য নির্বাচন কমিশন দ্বারা দোষী সাব্যস্ত হন। তাতে অবশ্য তাঁর মন্ত্রিত্বে হাত পড়েনি। শুধু এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হয়নি।
কিন্তু এই খবরের কাগজ নেহাতই চুনোপুঁটি স্থানীয় কাগজ। আমাদের দেশের রাঘব বোয়ালেরাও এই অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন। সংবাদপত্রের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্ত হয়েছে বেনেট কোলম্যা্ন আর জি নিউজের মতন গ্রুপ। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কোম্পানির গুণগান করেছেন। শুধু কোম্পানিই বা কেন। বড় রাজনৈতিক দলেরাও আছেন এই তালিকায়।
আমাদের লোকসভায় যত সাংসদ আছেন, তাদের মধ্যে চৌত্রিশ শতাংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আছে। এর আগের লোকসভায়, ২০০৯-এ, এঁরা ছিলেন মোট সংখ্যার ত্রিশ শতাংশ। তারও আগের লোকসভায় চব্বিশ শতাংশ। অর্থাৎ, দশ বছরে আমরা লোকসভায় অপরাধে অভিযুক্তের সংখ্যা বাড়িয়েছি দশ শতাংশ। বিনোদ দুয়ার বক্তব্য থেকে জানলাম – ফৌজদারি মামলা আছে এমন প্রার্থীর জেতার সংখ্যা নিরপরাধ প্রার্থীদের থেকে আঠেরো শতাংশ বেশি। এই অভিযুক্ত প্রার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই প্রভাবশালী, নয় তো রাজনৈতিক দল তাঁদের প্রার্থী করবে কেন? এঁদের প্রভাবের একটা বড় অংশ প্রভাবিত করছে সংবাদমাধ্যমকে। বলা হয়, আগে সংবাদপত্র চালাতেন সম্পাদক। এখন চালান কাগজের মালিক।
এই প্রসঙ্গে শ্রী লালকৃষ্ণ আডবানির একটা পুরনো গল্প না বললেই নয়। ইমার্জেন্সির পর তিনি না কি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন– “You were asked to bend. You chose to crawl ”।
এই সমস্ত সংবাদপত্র সমস্ত সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের হত্যার আসল অপরাধী।
এই লেখা শেষ করবার একটু আগে খবর পেলাম, স্পাইসজেটের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর শ্রী অজয় সিং এন.ডি.টি.ভি-র চল্লিশ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছেন, এবং সম্পাদকীয় অধিকারেরও মালিকানা পাচ্ছেন। এই কথাও বলে রাখা ভালো, যে শ্রীযুক্ত সিং শাসকদলের অগ্রণী সমর্থক, এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রচারে ওই দলের হয়ে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল।
এইসব দেখেশুনে শ্রীপরশুরাম-বর্ণিত রায়মঙ্গলের কয়েকটি পংক্তি স্মরণ করি—
ছাগল শুয়ার গরু, হিন্দু মুছলমান,
প্রভুর উদরে যাঞা সকলে সমান।
পরম পন্ডিত তেহ ভেদজ্ঞান নাঞি,
সকল জীবের প্রতি প্রভুর যে খাঁঞি।
দোহাই দক্ষিণরায় এই কর বাপা-
অন্তিমে না পাই যেন চরণের থাপা।