কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
সন্ধের জানালার কাঁচে দপদপ করছে শারদীয়া আলো। একটা গান বাজছে নিচু স্বরে। বসুন্ধরার কৃষ্টিওয়ালা পাড়ায় কেবল বাংলা গান নিচু স্বরে বাজে, দুর্গাপুজোতেও। ভিড়ের আওয়াজ প্রায় নেই।
আবার জ্বলে উঠল আলো। জানালার কাঁচে আবার ফুটে উঠল সেই মুখ যা গত তেতাল্লিশ মিনিট ধরে বসুন্ধরার দিকে তাকিয়ে আছে। দুই গালে শুকনো জলের দাগ, ফোলা চোখ, নিঃসাড় শরীর। শিরদাঁড়া বার করে নিয়ে শরীরটাকে যেন কেউ ছুঁড়ে দিয়েছে চেয়ারের ওপর। ঠিক যেমন বসুন্ধরাও চেয়ারের ওপর পড়ে আছেন হাড়গোড়হীন অ্যামিবার মতো। এই মুহূর্তে যে কেউ এসে পিষে দিয়ে যেতে পারে চাইলেই।
বা অলরেডি দিয়ে গেছে, বসুন্ধরা টের পাচ্ছেন না। বুকের ভেতর মরে যাওয়ার মতোই ফিলিং হচ্ছে বটে।
বেঁচে আছেন কিনা পরীক্ষা করে দেখতে হাতের আঙুল নাড়ানোর চেষ্টা করলেন বসুন্ধরা। কোলের ওপর খোলা শারদীয়ার পাতায় খসখস শব্দ হল। যে উপন্যাসটির শেষ পাতাটিতে শব্দ হল তার নাম ‘বিলম্বিত লয়’, লেখক অপ্রতিম মিত্র। শারদীয়া সাধারণত বসুন্ধরা পড়েন না। কিন্তু পর পর পাঁচজনের মুখে যখন উপন্যাসটার কথা শুনলেন, কিনে আনলেন।
অপ্রতিম বলেছিল, ও যে মাস্টারপিসটা লিখবে, আজ না হোক কাল না হোক পরশু, তার সম্বন্ধে আর কিছু জানা থাকুক আর না থাকুক একটা কথা ও জানে। সেটাতে বসুন্ধরা বসু থাকবেন।
বসুন্ধরা আছেন। নিশ্চিতভাবেই আছেন। গল্পের প্রথম পাতাতে নায়ক নায়িকার প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্ত থেকেই আছেন। গল্পে ঘটনাস্থল হয়ে গেছে বউবাজারের অ্যান্টিকের দোকান, কিন্তু বসুন্ধরা জানেন আসলে জায়গাটা হচ্ছে কলকাতা শহরের এক চকচকে আর্ট গ্যালারি। একজিবিশনের খবরটা দিয়েছিল সুদেষ্ণা।
–আয়না? মিরর?
–মিরর।
সুদেষ্ণা ইংরিজি পড়ায়। বসুন্ধরার সঙ্গে অনেকদিনের বন্ধুত্ব। সুদেষ্ণারও যাওয়ার কথা ছিল। সুদেষ্ণারই যাওয়ার কথা ছিল। বসুন্ধরাই বরং ফ্যাকাল্টি মিটিং সেরে সময়মতো পৌঁছে উঠতে পারবেন কি না দোনামনায় ছিলেন। সুদেষ্ণার আবার একজিবিশন থেকে কোথায় যাওয়ার। সব ঠিকমতো চললে আধঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট দুজনে প্রদর্শনীতে কাটানো যাবে।
–চেষ্টা করে দেখো, সুদেষ্ণা বলেছিল।
চেষ্টা করেছিলেন বসুন্ধরা। আয়না পছন্দ করেন তিনি। দেশেবিদেশে অনেক ঘোরার সুযোগ হয়েছে তাঁর। বাড়ি ফিরে পোস্টকার্ড, ঘোড়া, ময়ূর, আরও যা যা লোকে কেনে তার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকবারই সুটকেস খুলে বসুন্ধরা আবিষ্কার করেছেন একখানা আয়না।
এ পছন্দের মধ্যে কোনও নার্সিসিজম নেই। একখানা কাঁচ আলো শুষে নিয়ে তোমার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে এবং তুমি তাতে ফুটে উঠছ, আছে এই ম্যাজিকটার প্রতি আকর্ষণ।
মিটিং সর্বদাই লেটে শেষ হয়। দেড়ঘণ্টার ঝিমুনি কাটিয়ে উঠে শেষ পাঁচমিনিটে যথাসম্ভব দীর্ঘ এবং অগোছালো উপায়ে মতামতজ্ঞাপনের বান ডাকে। সে সব পেরিয়ে করিডরে অপ্রয়োজনীয় খেজুর সেরে বসুন্ধরা যখন ট্যাক্সি ধরেছিলেন, যথারীতি লেট হয়ে গেছে।
একসঙ্গে পাঁচপাঁচটা মেসেজ এসেছিল গ্যালারির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে। সুদেষ্ণার পরের কাজটার সময় এগিয়ে এসেছে তাই ও আর অপেক্ষা করতে পারছে না। ভেরি সরি।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মেসেজটা পড়ার মুহূর্তের হতাশা এখনও টের পান বসুন্ধরা। আয়নার প্রদর্শনী অভিনব এবং আগ্রহোদ্দীপক, তা বলে একা একা? সুদেষ্ণার সঙ্গে অনেকদিন পর খানিকটা সময় কাটানোর সম্ভাবনাটাই বসুন্ধরাকে বেশি টেনেছিল আয়নার থেকে। আরেকটু আগে মেসেজটা পেলে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি চলে যেতেন।
কয়েকটা মুহূর্ত দ্বিধায় কেটেছিল। তারপর কে যেন বসুন্ধরাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল গ্যালারির ভেতর। নিয়তিই নির্ঘাত।
***
প্রথম আয়না প্রকৃতি দিয়েছিল মানুষকে। টলটলে জল। স্থির। যাতে উঁকি দিলে একটা মুখ ফুটে ওঠে। কেমন ছিল প্রথম দেখার সেই মুহূর্ত? আমি যে আমিই, আর কেউ নয় সেটা চিনতে পারা— মানবসভ্যতার বৌদ্ধিক বিকাশের একটি মাইলফলক— কেমন ছিল? মুগ্ধতা কি তখনই জন্মেছিল? আকুলতা কি তখনই জেগেছিল? তাই কি আগ্নেয়শিলাকে ঘষে ঘষে মসৃণ করে প্রায় জলের মতো করে ফেলা, যাতে আরেকটি বার দেখার ইচ্ছে হলে জল খুঁজতে না বেরোতে হয়? ইচ্ছে হলেই পকেট থেকে বার করে, নিভৃতে কিংবা কোলাহলে, চট করে কিংবা দীর্ঘ অবকাশে, দেখে নেওয়া যায় তার জীবনের একটিমাত্র প্রকৃত প্রেমকে?
তিন তলা জুড়ে প্রদর্শনী দেখতে শুরু করেছিলেন বসুন্ধরা, যেমনভাবে তিনি সব বহুতল প্রদর্শনীই দেখতে শুরু করেন, সবথেকে ওপরের তলা থেকে। সে তলায় বিশ্বের আয়না। ইওরোপের, পারস্যের, মিশরের। দোতলায় ভারতীয় রাজাগজাদের মহার্ঘ আয়না। সঙ্গে বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, সমাজে, সংস্কারে আয়নার তাৎপর্য নিয়ে নানা তথ্য, গল্প, মিথ, আকর্ষণীয় করে উপস্থাপিত। আয়নার ইতিহাস, ভূগোল, জড়বিজ্ঞান, প্রযুক্তি গল্পের মতো করে বলা।
নিয়ন্ত্রিত বাতাসে, সন্তুরের মিহি স্রোতে, খাওয়াপরার সংগ্রামের অনুপস্থিতির এবং উচ্চসংস্কৃতিতে বিহারজনিত তৃপ্তির ওমের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছিলেন বসুন্ধরা।
আমরা যাকে আয়না বলে চিনি, খ্রিস্টজন্মের প্রায় ছ হাজার বছর আগেও তার খোঁজ পাওয়া গেছে। সে আয়নার চেহারা অবশ্য এখনকার আয়নার থেকে অনেক আলাদা। তারপর আয়না ক্রমশ সুন্দর ও কার্যকরী হয়ে উঠেছে। তামার সঙ্গে ব্রোঞ্জ মিশিয়ে, রাসায়নিক পলেস্তারা বুলিয়ে ওপারের মানুষটাকে আরও একটু ধরাছোঁয়ার কাছে আনার নিরন্তর চেষ্টা। চেষ্টা যত ব্যর্থ হয়েছে ততই তার ছোঁয়া পাওয়ার একমাত্র মাধ্যমটিকে মানুষ প্রাণ ঢেলে সাজিয়েছে। দশ ইঞ্চি কাঁচের টুকরো ঘিরে দশ হাত কল্কা বুনেছে। সোনায় মুড়েছে, হিরেমুক্তো গেঁথেছে।
ওপারের প্রেমিকটি রয়ে গেছে সমান অধরা, সমান দূরবর্তী।
প্রেম টিঁকে গেছে।
একতলায় গেরস্তবাড়ির আয়না। আয়তাকার কাঁচের টুকরো ঘিরে সোজাসাপটা কাঠের ফ্রেম, গরিবের মনে রাজাগজার ফিলিং জাগরণের জন্য বড়জোর মাথার কাছটায় অল্প কল্কা। ক্ষয়া কাঁচের ওপর ছোপ ছোপ কালো বিন্দু, মেটে কমলা রঙের উন্মুক্ত প্রলেপ। জানালা দিয়ে চৌখুপি আলোর দেওয়ালে ঝোলানোর জন্য লোহার ফাঁস। মলিন আয়না, ভাঙাচোরা আয়না, রাতের অন্ধকারে প্রাণপরিজন নিয়ে ছুটে বেরোনোর বিভ্রান্তির মুহূর্তে সব ফেলে কেবল দেওয়াল থেকে খুলে আনা আয়না। সে আয়নাটুকুও পুরো পথ পেরোতে পারেনি। রিফিউজি ক্যাম্পের মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। আয়নায় সকালসন্ধে মুখ দেখত যারা, তারা পেরেছিল? বসুন্ধরা মনে মনে প্রার্থনা করলেন, যেন পারে।
আয়না থেকে আয়নায় সরে সরে যাচ্ছিল বসুন্ধরার মুখ। যেমন গেছে কতশত মুখ, যারা বুকভরা প্রেম কিংবা ঘৃণা কিংবা দুশ্চিন্তা নিয়ে সকালবিকেল দাঁড়িয়েছিল আয়নার সামনে। উদাসীন আয়না তাদের ছবি জমিয়ে রাখেনি, সরে যাওয়া মাত্র মুছে ফেলেছে।
শেষ ঘরের তিনটি দেওয়াল পেরিয়ে চতুর্থ দেওয়ালের দিকে বাঁক নিয়েছিলেন বসুন্ধরা এবং কোণের আয়নাটির মুখোমুখি পড়ে থমকেছিলেন। এক হাত লম্বা, পৌনে হাত চওড়া। লম্বাটে কাঁচ ঘিরে কালো কাঠের ফ্রেম। ফ্রেমজোড়া লতা, লতার দু পাশ থেকে নিয়মিত দূরত্বে ফুটেছে পাতা, দুয়েকটি ফুল। পাতার শিরা, ফুলের পাপড়ির ভাঁজ স্পষ্ট।
দাড়ি কামানোর জন্য এমন আয়না কামান দাগাই বটে। কিন্তু রোজ সকালে মোহনবাগান লেনের বাড়ির দালানে একটা চেয়ারের ওপর আয়নাটাকে ঠেসান দিয়ে বসিয়ে, সামনে টুল পেতে বসতেন জেঠু। আয়নার সামনে চেয়ারের ফাঁকা অংশটুকুতে জলের বাটি, ব্লেড, রেজার, ফেনা, বুরুশ সাজাতেন। তারপর শুরু হত নানারকম মুখভঙ্গি সহকারে দাড়ি কাটা। ঠোঁট বেঁকিয়ে, গাল ফুলিয়ে, গলা উঁচিয়ে। বড় আয়নায় বসুন্ধরার ছোট্ট মুখও এঁটে যেত, জেঠুর মুখভঙ্গি নকল করে হেসে গড়াগড়ি খেত বালিকা বসুন্ধরা।
জেঠুর আয়নাটা কোথায় গেল? কুশল কি বিদেশে যাওয়ার সময় বাবার দাড়ি কাটার আয়না ঘাড়ে করে নিয়ে গেছে? একমুহূর্তের জন্য বসুন্ধরার ভীষণ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেছিল যে এটাই জেঠুর আয়না।
আর ওই বিশ্বাস থেকেই চতুর্দিকের কড়া অক্ষরের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন আয়নাটার দিকে। উঁকি দিয়েছিলেন।
মোহনবাগান লেনের বাড়ির বারান্দার শ্যাওলা, পাঁচিলঘেঁষা আমগাছ আর গাছের ডালে বাঁধা দোলনা দেখছিলেন বাহ্যজ্ঞান ভুলে, এমন সময় দোলনার দড়ির ফ্রেমে ভেসে উঠেছিল একটা মুখ।
চমকে পিছিয়ে আসতেই ধাক্কা। ফাইল মেঝেতে গড়াগড়ি। কুড়িয়ে দিতে দিতে পুরুষটি বলেছিল, সরি।
উঠে দাঁড়ানোর পর পুরুষটিকে চিনতে পেরেছিলেন বসুন্ধরা। আগের মাসেই এসেছিল বাংলা ডিপার্টমেন্টের কলোকিয়ামে, যেখানে উদীয়মান বাংলা সাহিত্যিকদের নিয়মিত আমন্ত্রণ জানানো হয়।
উপস্থিত ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকশিক্ষিকাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সুপ্রভাদি। অপ্রতিম মিত্র, সম্প্রতি তাঁর তৃতীয় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় থ্রিলারটি অলরেডি সিনেমা হয়ে উঠতে চলেছে, তিন নম্বরটিরও শুধু সময়ের অপেক্ষা।
বসুন্ধরার কেমন যেন ধারণা ছিল লেখকরা বলায় পটু হন না বলেই লেখেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই বিশ্বাসের ব্যতিক্রম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু অপ্রতিম নিঃসন্দেহে সব ব্যতিক্রমকে ফেল ফেলেছিল। প্রায় পেশাদার বক্তৃতাবাজের পটুত্বে আশৈশব সাহিত্যসৃষ্টির আগ্রহ, কঠোর সাধনা, একেকটা রচনার তৈরি হওয়া যে আসলে গর্ভধারণ এবং সন্তানজন্মের সমান— ইত্যাদি ব্যাপারে বলে চলেছিল। কী সহজতায় মিশে গিয়েছিল দল বেঁধে সই নিতে আসা ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে। বয়সে ওদের কাছাকাছি বলেই কি?
–বয়সের ব্যাপার না। ফ্যানদের সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করা, অটোগ্রাফ, ইন্টার্ভিউ দেওয়া, প্রাইজ পাওয়া, এই ব্যাপারগুলো এতদিন ধরে কল্পনায় এতবার করেছি যে প্র্যাকটিসের ঠাকুরদাদা হয়ে গেছে।
হেসে উঠেছিল অপ্রতিম। আয়নার একজিবিশনে ধাক্কা লাগার একসপ্তাহ পর। হিন্দুস্থান পার্কের নতুন বইয়ের দোকানটার দোতলার কফি খাওয়ার ঘেরাটোপটায় বসে।
অন্তত সেইরকমই তো বসুন্ধরার মনে আছে।
কিন্তু বিলম্বিত লয় তা বলছে না। সুসজ্জিত সুবাসিত প্রদর্শনী হয়ে গেছে বউবাজারের ঘুপচি অ্যান্টিক দোকান। জেঠুর মধ্যবিত্ত দাড়ি কামানোর আয়না হয়ে গেছে ভাঙাচোরা, গালা চটে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক প্রকাণ্ড এক আয়না।
সেই প্রাগৈতিহাসিক, ভাঙাচোরা আয়নায় মুখ মেলে আছে এক প্রাগৈতিহাসিক, ভাঙাচোরা নারী।
এটা প্যারাফ্রেজ নয়। এটা গল্পটার লাইন।
বসুন্ধরা দিনে কতবার তো আয়নার সামনে দাঁড়ান, কখনও তো নিজেকে ভাঙাচোরা দেখেননি। আশা দপদপ করে বসুন্ধরার বুকের ভেতর। হয়তো এই ভাঙাচোরা নারী তিনি নন। হয়তো আয়না, আয়নার সামনে ধাক্কা লাগা ইত্যাদি সবই সমাপতন।
তা হলে দেখা হওয়ার এক সপ্তাহ পরের কফির দোকানও সমাপতন। বসুন্ধরার পাড়ার মোড়ের বিড়ি সিগারেটের দোকান, যেখান থেকে গল্পের ঝকঝকে নায়ক সিগারেট কেনে, চোখ সরু করে ঝুলন্ত জ্বলন্ত দড়ি থেকে ধরায়, ঠোঁটে ঝুলিয়ে পথশিশুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলে আর কুকুরছানার মাথায় হাত বোলায়, সমাপতন। এমনকি কুকুরছানাটাও, যার গোটা শরীর সাদা খালি ডান চোখের ওপর কালো, যার নাম অপ্রতিম দিয়েছিল ‘বিএনডব্লিউ’, যে কালকেও বসুন্ধরার রিকশার পেছন পেছন প্রবল পরিক্রমে দৌড়চ্ছিল, সেও সমাপতন। বসার ঘরে টিভির পাশে জল দিতে ভুলে যাওয়া মানিপ্ল্যান্ট সমাপতন, দেওয়ালে শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবস্থায় বাবার আঁকা চারকোলের মুখ সমাপতন, বসুন্ধরার শোবার ঘর, বিছানা, পূর্ণিমার রাতে যে বিছানা থেকে ওপাশের ফ্ল্যাটের ট্যাঙ্কের মাথায় চাঁদকে বসে থাকতে দেখা যায় তাও সমাপতন।
এতসব সমাপতনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় গল্পের ভাঙাচোরা নায়িকা বনানী। গল্পের নায়ক, বহু যুবতীর কামনার ধন, বন্ধুর সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, কী দেখেছে সে বনানীর ভেতর। রূপ না, যৌবন না, মেধা না। এক ভাঙাচোরা নারীর ভাঙাচোরা আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকার মুহূর্তটিই তাঁর মধ্যে একটা অবসেশনের জন্ম দিয়েছে। একটা অতীত যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে আরেকটা অতীতের। একটা বিলম্ব যেন ঘটে গেছে।
***
বসুন্ধরা উঠে পড়লেন। তিনিই এই ভাঙাচোরা নারী কিনা, চোখ না ঠারিয়ে, মন না ভুলিয়ে সেই সত্যিটা যে তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারে, তিনি দেখতে চান আর না চান— তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
আয়না দেখাল। বসুন্ধরা দেখলেন। চুলের পাক, চোখের কালি, চোয়ালের ভাঙন।
কবে হল এত ভাঙচুর? কবে ঘটে গেল এই লুঠতরাজ? ক্লাসে যখন মগ্ন হয়ে পড়ান, ছাত্রছাত্রীরা এই ধংসস্তুপটাকে দেখে? ফ্যাকাল্টি মিটিং-এ যখন মতামত রাখেন, দরকার বুঝে সমর্থন জানান কিংবা প্রতিবাদ রাখেন, হেসে ওঠেন শিঙাড়ায় কামড় দিতে দিতে, সব শেষে ব্যাগ নিয়ে হাত নিয়ে বেরিয়ে আসেন, সহকর্মীরা মনে মনে, কিংবা কে বলতে পারে একে অপরের উদ্দেশেও (বসুন্ধরা শিউরে উঠলেন) বলে ওঠে, কোথায় গোলমাল হল বল দেখি? এত বিদ্যাবুদ্ধি। এত ডিগ্রি?
–ওই করতে গিয়েই তো সময় চলে গেল। সময়ের কাজ সময়ে না সারলে…
***
যা মানুষকে টানে, তা তাকে ঠেলেও। আয়নার মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে যেমন মানুষ থাকতে পারে না, তেমনি কখনও কখনও আয়নাতে ফুটে ওঠা মূর্তিটাকে মেনে নিতেও তাঁর বুক কাঁপে।
বসুন্ধরা আয়নাকে এতদিন ভয় পাননি। তাই যেখান থেকে পেরেছেন আয়না এনে বাড়ি সাজিয়েছেন। ঘরের দেওয়ালে, ব্যালকনির বাগানের ফাঁকে, সর্বত্র আয়নারা শোভিত হচ্ছে। যেদিকে মুখ ফেরাচ্ছেন আয়না তাঁকে ধরে ফেলছে, একদণ্ড পালিয়ে বাঁচতে দিচ্ছে না।
শেষটা এমন হল, প্রতিটি মানুষের চোখ পরিণত হল একেকটা আয়নায়, অফিসকাছারির দরজায়, গাড়ির জানালার কাঁচে, ছুটন্ত মেট্রোর জানালায় বারংবার ফাঁদে পড়তে লাগলেন বসুন্ধরা। বসুন্ধরা সে সব আয়নায় নিজেকে না চাইতেও দেখে ফেলেন। ভাঙন দেখেন। দেখেন লেট হয়ে যাওয়া।
বাড়ি ফেরার অন্ধকার পথে বিএনডব্লিউ দৌড়ে এলে উবু হয়ে বসেন। অকারণ উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকা শরীরে, গলায়, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ওর চোখে চোখ রেখে জানতে চান। কী দেখিস তুই? কাকে দেখিস?
ফ্ল্যাটের চাবি খুলে বনানীর কাছে এসে বসেন বসুন্ধরা। বনানী অবিরাম কাঁদে। একাকিত্ব গিলতে আসে বনানীকে। বসুন্ধরার বুকের মধ্যে একটুখানি আশা জাগে। কোনওদিনও তো একা বোধ হয়নি তাঁর? ক্লাসভর্তি ছাত্র, বাড়িভর্তি বই, রাস্তাভর্তি জ্যাম, মাথাভর্তি ভাবনা, দিনরাতভর্তি পড়াশুনো। সুদেষ্ণার সঙ্গে একটাআধটা নাটক কিংবা কন্সার্টের প্ল্যান পর্যন্ত গোঁজার ফাঁক নেই। বসুন্ধরা তো বরং হাঁপিয়ে ওঠেন ভিড়ের চোটে, দিনের শেষে এই ফাঁকা, শান্ত বাড়িটায় ঢুকে হাঁফ ছাড়েন। এইটুকু শান্তির জন্য, নীরবতার জন্য কপালকে ধন্যবাদ দেন।
বনানীর সঙ্গে এ বাবদে অমিলের সুখ উদযাপন করতে রান্নাঘরের দিকে রওনা দেন বসুন্ধরা। এক কাপ কফি নিয়ে বুককেস থেকে হাত বাড়িয়ে প্রিয় বই টেনে নিতে গিয়ে পাশের আয়নায় চোখ পড়ে যায়।
কী যেন একটা অন্যরকম? কয়েকমুহূর্ত লাগে টের পেতে। উল্টোদিকের দেওয়ালে ঝোলানো গত বছর রোয়ান্ডায় ইউএন-এর সেমিনার থেকে আনা হলুদ, লাল, নীল, সবুজের মেশামিশি ছবিটা আয়নায় দেখা যাচ্ছে না। ঘাড় ঘোরান বসুন্ধরা। ওই তো ছবি। যেমন থাকার তেমনি আছে। আয়নার দিকে ফেরেন।
আয়নার ভেতরে ছবি নেই। মেঝেতে জয়পুর থেকে আনা শৌখিন কার্পেট নেই, এম্পোরিয়াম থেকে কেনা কুশনশোভিত দিওয়ান নেই, দেওয়ালজোড়া বুককেস নেই, বুককেস ঠাসা ছোটবেলা বড়বেলার বই নেই, লতানো মানিপ্ল্যান্ট নেই, পুরী থেকে পাঁচবছর বয়সে কুড়িয়ে আনা ঝিনুকের থলি, পনেরো বছরের কবিতাভর্তি ডায়রি, পঁচিশের মেডেল, পঁয়তাল্লিশের মানপত্র কিচ্ছু নেই।
সব হাওয়া। সব ফাঁকা।
আছে কেবল একটা ভাঙাচোরা ভূত। আয়নার ভেতর থেকে নিঃসাড় চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর এই খাঁ খাঁ অভিশপ্ত বাড়িতে ভূতটা বাসা বেঁধে আছে কবে থেকে, বসুন্ধরা নিজেও জানেন না।
***
কিছু কিছু জরুরি দিনের সবই মনে থাকে। উষ্ণতা, আর্দ্রতা, নিম্নচাপ, কোন শাড়িটা পরেছিলেন, কী খেয়েছিলেন। আয়নার প্রদর্শনী দেখতে যাওয়ার দিনটা এরকম একটা দিন ছিল।
আবার কিছু কিছু জরুরি দিনের কিছুই মনে থাকে না। মাস কয়েক বাদে সেরকম একটা দিন এল বসুন্ধরার জীবনে। সম্ভবত জগদ্ধাত্রীপুজোর আশেপাশেই হবে। কারণ হাওয়া ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। পূর্ণিমা এল ঘোড়ায় জিন দিয়ে। অন্য বাড়ির নিন্দে করল (অন্য বাড়িতে গিয়ে তাঁর নিন্দে যে করে না পূর্ণিমা তেমন কোনও দুরাশা পোষণ করেন না বসুন্ধরা) আগের রাতে না খাওয়ার জন্য বকল, কী রান্না হবে জিজ্ঞাসা করল। বসুন্ধরা যা বললেন সব নাকচ করে ফ্রিজ ঘেঁটে নিজে মেনু ঠিক করে বঁটি নিয়ে যাতায়াতের মাঝখানে ছড়িয়ে বসল।
অন্যের করে দেওয়া চা খেতে সর্বদাই বেশি ভালো হয়। পূর্ণিমার দিয়ে যাওয়া চায়ে চুমুক দিয়ে ‘আঃ’ বেরিয়ে এল বসুন্ধরার। ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে রাখা শারদীয়াটা টেনে নিয়ে একশো বাহান্ন পাতা খুললেন, রোজ যেমন খোলেন।
বসুন্ধরা ‘বিলম্বিত লয়’ পড়তে শুরু করলেন, পূর্ণিমা কথা বলে চলল, কলের জল বাথরুমে বালতি উপচে পড়ল, পাশের বাড়িতে রংমিস্তিরিরা এসে মাথায় ফেট্টি বেঁধে রঙের বালতি নিয়ে ভারায় চড়ল, রাস্তা দিয়ে সবজিওয়ালা হাঁক দিতে দিতে গেল, পূর্ণিমা দৌড়ে গিয়ে পছন্দমতো বাজার করে নিয়ে এল, বসুন্ধরা আনমনা হাত বাড়িয়ে টাকা দিলেন, দরাদরির জয়ে পূর্ণিমার উল্লাসে হুঁ হাঁ সায় দিলেন।
গল্প ফুরোল। এবং বসুন্ধরা প্রথম উপলব্ধি করলেন, গল্পটা কী খারাপ করে লেখা।
***
বসুন্ধরার মগজে এতদিন যে পাঁচশোটা অনুভূতি জট পাকিয়ে বসে ছিল, মায়ের গলা সরু চেনের গিঁট খুলে দেওয়ার সমান যত্ন এবং মনোযোগ দিয়ে বসুন্ধরা তাদের আলাদা করলেন পরের দুদিন ধরে। টেবিলের ওপর পাশাপাশি শোওয়ালেন।
প্রেম, যন্ত্রণা, অপমান, ক্রোধ, প্রতিহিংসা, লজ্জা।
ওরা শুয়ে রইল টেবিলে পাশপাশি। বসুন্ধরা চলতে ফিরতে ওদের দেখেন। দেখেন আলোবাতাস লেগে কেমন ধীরে ধীরে শুকিয়ে উঠছে ওরা। নেতিয়ে পড়ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম গেল প্রেম। বসুন্ধরাকে অবাক করে দিয়ে। পিছুপিছু গেল যন্ত্রণা। অপমানের জ্বালা, প্রতিহিংসার বাসনা— তারাও গেল। একদিন রাগটাকেও আর খুঁজে পেলেন না।
থেকে গেল লজ্জাটা। বাংলা ভাষায় লজ্জা কথাটা নানারকম জায়গায় নানারকম প্রসঙ্গে ব্যবহার হয়। এই লজ্জা ব্রীড়া নয়। এটা যাকে ইংরিজিতে বলে শেম। এত বুদ্ধির ঘট হয়ে তিনি এই রকম একটা কাণ্ড ঘটালেন কী করে ভেবে না পাওয়ার শেম। টেবিলের ওপর জ্বলজ্বল করতে লাগল।
শীত যখন আরও জাঁকিয়ে পড়ল, পূর্ণিমার পাশের বাড়ির কে যেন যেন বহড়ু না কোথায় গিয়ে মোয়া নিয়ে এল, পূর্ণিমা এক হাঁড়ি নিয়ে এল বসুন্ধরার জন্য। হাঁড়িটা নিয়ে এসে নিজের আর সুদেষ্ণার জন্য খানকতক বার করে বাকিটুকু পূর্ণিমার ছেলেমেয়েদের জন্য ফেরত পাঠানোর জন্য ভাগাভাগি করতে বসবেন, অভ্যেসবশত লজ্জার দাগটা বাঁচিয়ে হাঁড়ি রাখতে গিয়ে দেখলেন, দাগটা আর নেই। মিলিয়ে গেছে। টেবিল আর বসুন্ধরার মাথা, দুইই বিলকুল ফাঁকা, ফুরফুরে।
***
ফাঁকা টেবিলে বসে গল্পটা আরেকবার পড়লেন বসুন্ধরা। আয়নার দোকান থেকে শুরু করে যেখানে বনানী ‘আমার তো সব ফুরোলোই’ বলে নবীন নায়ককে পৃথিবীর কোলে মুক্ত করে দিচ্ছে, সেই আবেগ-থরোথরো শেষ প্যারাগ্রাফ পর্যন্ত।
তাঁকে নিয়ে লিখবি, লিখবি। তা বলে আরেকটু ভালো করে লিখবি না? নতুন রকমের একটা রাগ মাথা তুলল বসুন্ধরার ভেতর। রাগের মাথাতেই সম্ভবত সিদ্ধান্তটা নিয়ে বসলেন বসুন্ধরা।
গল্পটা যখন তাঁর জীবন নিয়েই লেখা, তখন কি তাঁরই গল্পটা লেখা উচিত নয়? দিনদুয়েক ইউনিভার্সিটি যাতায়াতের পথে ভাবনাটা নিয়ে লোফালুফি চলল, তারপর বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ টেনে টাইপ করতে শুরু করলেন।
যত শক্ত হবে ভেবেছিলেন, তত হল না।
আয়নার দোকানকে ফের বানিয়ে দিলেন আয়নার প্রদর্শনী, বনানীর নাম রাখলেন বিশাখা। লেট করে পৌঁছনোয় বন্ধু চলে গেছে, একা একা প্রদর্শনীর তলায় তলায় ঘুরতে ঘুরতে একটি মুখচেনা আয়নার ভেতর উঁকি মেরে বিশাখা ছোটবেলার বাড়ির দাওয়া, দাওয়ায় আমগাছ, গাছের ডালের দোলনা দেখছে এমন সময় আয়নার ভেতর থেকে একটা মুখ বেরিয়ে এসে বিশাখাকে চমকে দিল।
মুখটার নাম বসুন্ধরা রাখলেন সাগ্নিক। এমন নয় যে খুব ভেবেচিন্তে রাখলেন। নামটা যে তাঁর খুব পছন্দ তেমনও নয়। তবু ওই নামটাই মাথায় এল, রেখে দিলেন। নামের মতো, লোকটাকে নিয়েও মাথা ঘামাতে হল না বসুন্ধরার। সে আয়নার ভেতর থেকে রক্তমাংসের মানুষের থেকেও জীবন্ত হয়ে বিশাখার মুখোমুখি দাঁড়াল। সংবেদনশীল, মিতভাষী।
বিশাখা আর সাগ্নিকের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন বসুন্ধরা। তাদের নিজস্ব মত দিলেন, নিজস্ব ভাবনা দিলেন, একাকিত্বের মুহূর্ত দিলেন, শেকড় দিলেন, মায়া দিলেন। আনন্দ, শোক, দ্বিধা, প্রেমে পরিপূর্ণ করে তুললেন দুজনের জীবন।
রাগের জায়গা নিল কৌতূহল, সৃষ্টির আনন্দ। ছাদের রোদ্দুরে পা মেলে বসে থাকা, আমগাছের দোলনায় দোল খাওয়া এক শান্ত আখ্যান দুটো লোকের জীবন ঘিরে নদীর মতো বইল।
বসুন্ধরা লিখলেন, কাটলেন, জুড়লেন, আবার লিখলেন। আবার কাটলেন, আবার জুড়লেন। যখন সব মনোমত হল, ঘোর ভেঙে দেখলেন হাউসিং জুড়ে শারদীয়া আলো ঝলমল করছে, হেমন্তের গলায় বাজছে স্বর্ণযুগের গান। আবার একটা পুজো এসে গেছে।
***
লেখা শুরু করার আগে এবং লেখা চলাকালীনও যে কথা মগজেও স্থান পায়নি, সেই কথাটা বসুন্ধরাকে রাতের ঘুম কেড়ে নিল। তিনি ছাড়া আর কেউ এই গল্প কেউ পড়বে না, চিনবে না বিশাখা আর সাগ্নিককে, হেঁটে যাবে না ওদের সঙ্গে শহরের পথ ধরে, এটা ভাবতে তাঁর বুক ভেঙে গেল। একদিন দরজার মুখ থেকে ফিরে এসে প্রিন্ট আউটের তাড়াটা ব্যাগে ঢুকিয়ে আবার দৌড়ে বেরোতে যাবেন, দরজার পাশের কনসোল টেবিলের ওপর টাঙানো ডিমের মতো আয়নাটার দিকে চোখ পড়ে গেল।
বসুন্ধরা দম বন্ধ করলেন। গত প্রায় বছরখানেক আয়নার সামনে দাঁড়ানোর কথা মনেই পড়েনি তাঁর। দাঁড়ালেও দাঁড়িয়েছেন অন্যমনস্কতায়, বিশাখা আর সাগ্নিকের কথা ভাবতে ভাবতে।
আতঙ্কের স্মৃতিরা দল বেঁধে এল। শ্বাস নিয়ে বুক বাঁধলেন বসুন্ধরা।
দেখাও, কী দেখাবে।
ব্যস্ত, বিরক্ত একটা মুখ আয়নার ভেতর থেকে বসুন্ধরার দিকে তাকিয়ে রইল। ভূত নয়, দিব্যি রক্তমাংসের মুখ, তাড়ার মুখে পিছু ডাকার বিরক্তিতে টইটম্বুর। বসুন্ধরা ঘড়ি দেখলেন। সুদেষ্ণা বসে থাকবে। লেট করা চলবে না। আয়নার মুখটার থেকে মনোযোগ সরিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন বসুন্ধরা।
***
কফি খেতে খেতে এ বিষয়ে ও বিষয়ে কথা এগোল। বসুন্ধরা অর্ধেক শুনলেন, অর্ধেক শুনলেন না। কথোপকথনের বিরতিতে ব্যাগের ভেতর থেকে প্রিন্ট আউটের তাড়াটা বার করে টেবিলে ছড়ানো কাপপ্লেটের ফাঁকে গুঁজে দিলেন।
–এটা কী? তাড়াটা হাতে তুলে নিল সুদেষ্ণা। পড়তে শুরু করল।
বসুন্ধরা অপেক্ষা করলেন। সুদেষ্ণা পাতা উল্টোল। গোটা একটা চ্যাপ্টার পড়ল। তারপর নিজের ব্যাগ খুলে পুরল ম্যানুস্ক্রিপ্টটা। হাত নাড়ল বিলের জন্য।
***
মাসতিনেক পর একদিন অফিসে হাজির। বসুন্ধরা তখন সবে টিফিন শেষ করে কমলালেবু ছাড়াতে শুরু করেছেন। এক কোয়া মুখে পুরে ব্যাগ থেকে কাগজের তাড়া বার করল সুদেষ্ণা। বসুন্ধরার হৃদপিণ্ড লাফ মারল।
লালে লাল পাণ্ডুলিপি।
–তিনমাস ম্যাক্সিমাম। এডিটগুলো ইনকরপোরেট করে বা না করে ফেরত দেবে।
একটি পরিচিত পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশ পেল বসুন্ধরা বসুর প্রথম উপন্যাস। খুব বেশি লোকজন পড়ল না বোধহয়। যারা পড়ল তাদের মধ্যে কেউ কেউ পত্রিকার দপ্তরে চিঠি লিখে বা ফোন করে জানাল অনেকদিন পর এইরকম একটা উপন্যাস পড়ে তাদের মন ভালো হয়ে গেছে। আজকাল এমন উপন্যাস বেশি লেখা হয় না।
***
নাটক দেখতে বহুদিন পর গেলেন বসুন্ধরা। নন্দনের পেছনের দোকানে দাঁড়িয়ে চা আর আলুর চপের প্লেট হাতে নিয়ে অপ্রতিমের সঙ্গে আসার দিনগুলো মনে পড়ে গেল। ওই সাড়ে পাঁচ মাসের স্মৃতি কেমন জীবনভর ছড়িয়ে পড়েছে। বেদনা ছাড়া সেই দিনগুলোর দিকে তাকাতে পারলেন বসুন্ধরা, এইটা ভালো।
ছেলেমেয়ের একটা দল হইহই করে ঘিরে ধরল। সুদেষ্ণার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। কেউ নাটক করে, কেউ পত্রিকার অফিসে চাকরি, কেউ ব্যাঙ্কের পরীক্ষায় বসছে, কেউ কোথায় বসা যায় ভাবছে। কাউকে কাউকে বসুন্ধরা চিনতে পারলেন। আপনার উইমেন ইন কালচার অ্যান্ড মিডিয়া-র ক্লাসটা আমি অডিট নিয়েছিলাম, ম্যাম। বসুন্ধরা চপের প্লেট হাতে ধরে মাথা নাড়লেন। এরকম কিছু কিছু পরিস্থিতিতে বসুন্ধরা বারংবার পড়েছেন, যেগুলো তাঁর সন্দেহ তাঁর সিএ, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বন্ধুদের পড়তে হয় না। ছাত্রছাত্রীরা মাস্টারমশাইদের মানুষ বলে মনে করে না। ম্যাম চপ খাচ্ছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা মারাত্মক অদ্ভুত ব্যাপার প্রতিভাত হবে তাদের কাছে। যুগে যুগে হয়ে এসেছে। বসুন্ধরাদের আমলেও হত। ইউনিভার্সিটির এক মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে বসুন্ধরার দেখা হয়েছিল পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে। আজীবন শার্টপ্যান্ট পরিহিত স্যারকে হাফপ্যান্ট পরে মেয়ে জামাইয়ের গলা জড়িয়ে ছবি তুলতে দেখে বসুন্ধরা আরেকটু হলেই পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন।
যেমন এসেছিল, তেমনি কলকল করতে করতে ঢেউয়ের মতো চলে গেল ছেলেমেয়েগুলো। এত বছর হয়ে গেল, তবু এদের শব্দ উৎপাদনের ক্ষমতা বসুন্ধরাকে এখনও অবাক করে।
–অপ্রতিমের গত বছরের শারদীয়ার গল্পটা নিয়ে সিনেমা বানানো হচ্ছে, শুনেছ?
বসুন্ধরার সন্দেহ অপ্রতিমের সঙ্গে তাঁর যে একটা কিছু ঘটেছিল সেটা সুদেষ্ণা আঁচ করেছে। জিজ্ঞাসা করেনি, বলা বাহুল্য। সুদেষ্ণা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে শারদীয়া পত্রিকা বাংলা সাহিত্যের শনি, তাই গল্পটা নিশ্চয় পড়েনি। পড়লে কি ধরে ফেলত বনানীই বসুন্ধরা? সুদেষ্ণা বাংলা সিনেমা নিয়েও সমান নাকউঁচু কাজেই সিনেমাটা দেখতে যাবে না। চেনা অনেকে যাবে নিশ্চয়।
অম্বল হবেই জানা সত্ত্বেও বসুন্ধরা আরেক কাপ চা অর্ডার করে ফেললেন।
***
অসময়ের বৃষ্টি নামল বিকেল নাগাদ। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন বসুন্ধরা। ঝোড়ো হাওয়া উঠল। চুল উড়িয়ে, ছাতা ঘুরিয়ে। সোজা করার প্রাণপণ সংগ্রামের মাঝপথে একটা হাত এগিয়ে এসে ছাতাটা নিয়ে নিল। কাবু করে ফেলল সহজেই।
ছেলেটাকে চেনা চেনা ঠেকল বসুন্ধরার। প্লেস করতে পারলেন না কিছুতেই।
–সরি, তুমি কোন ব্যাচ বলো তো?
–আমি আপনার ক্লাসে ছিলাম না। ছেলেটা সুদেষ্ণার ডিপার্টমেন্টের। এতক্ষণে বসুন্ধরার মনে পড়ল ছেলেটাকে কোথায় দেখেছেন তিনি।
–অ্যাকাডেমিতে এসেছিলে না তোমরা সেদিন?
বসুন্ধরার গাড়ি এসে গেছে। ছেলেটার গন্তব্য পথেই। গাড়িতে বসে বসুন্ধরা বললেন, তুমি নাটক করো বোধহয়?
–নাটক করে সৌভিক। আমি চাকরি করি, পত্রিকার নাম বলল ছেলেটা। বসুন্ধরা কৌতূহলী হলেন। এই পত্রিকাতেই বেরিয়েছে তাঁর উপন্যাস।
ছেলেটা, যার নাম স্যমন্তক, হাসল। জানি। আমিই এডিট করেছি।
বসুন্ধরা হাঁ করলেন। তুমি ওইরকম কেটেকুটে রক্তারক্তি করে পাঠিয়েছিলে ম্যানুস্ক্রিপ্টটা?
–লাল পেনের একটু দাগই অনেক লাগে। আপনি অন্য ম্যানুস্ক্রিপ্ট দেখেননি। তাছাড়া কন্টেন্ট তেমন কিছু এডিট করার দরকার হয়নি। ওই কমা, সেমিকোলন।
আধঘণ্টার বৃষ্টিতে শহরের ট্র্যাফিক নট নড়নচড়ন। শরীর জুড়ে ভ্যাপসানি। জানালা তুলে এসি চালাতে বললেন বসুন্ধরা। সিগন্যাল, সাইনবোর্ড, সারা শহরের আলো জানালার কাচ বেয়ে গলে গলে নামছে।
–আর কিছু লিখছেন না?
বসুন্ধরা স্বীকার করলেন। ভাবছেন আরেকটা উপন্যাসের কথা। তেমন করে এখনও কিছু দানা বাঁধছে না।
–যতদিন না বাঁধছে অন্য কিছু লিখুন। ছোটগল্প। বড়গল্প।
ঝোলার ভেতর থেকে একটা পত্রিকা বার করল স্যমন্তক। চাকরির বাইরে যে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত ও তার সাম্প্রতিকতম সংখ্যা।
–আমাদের এখানে একটা গল্প দিন না।
***
বসুন্ধরা একটা ছোটগল্প লিখলেন। সুদেষ্ণাকে পড়ালেন। সুদেষ্ণা চাইল। বসুন্ধরা জানালেন এটা অলরেডি কমিট করা হয়ে গেছে।
–তোমার ছাত্রকেই।
একটা একটা করে বেশ কয়েকটা ছোটগল্প লেখা হল। কয়েকটা ছাপা হল স্যমন্তকদের পত্রিকায়, কয়েকটা সুদেষ্ণা এদিকসেদিকের পত্রিকায় পাঠাল। একদিন কফিশপে বসে বলল, এবার একটা ছোটগল্প সঙ্কলন হোক। বসুন্ধরা অট্টহাস্য করলেন। হাসি অগ্রাহ্য করে সুদেষ্ণা স্যমন্তককে জিজ্ঞাসা করল, তোর কাছে কটা আছে?
–গোটা সাত আট।
গুনে দেখা গেল এদিকওদিক মিলিয়ে গোটা কুড়ি মতো ছোটগল্প জমা হয়েছে। বসুন্ধরা অবাক হলেন। এত কবে লিখলেন তিনি? আজকাল ইউনিভার্সিটির পর বাড়ি গিয়েই লিখতে বসেন বটে তিনি। একটা নেশার মতো হয়েছে। প্লট, চরিত্র, প্রেক্ষাপটেরা মাথার ভেতর ঘোরাফেরা করে। কিন্তু তারা যে এত দ্রুত এবং নিয়মিত শরীর ধারণ করে বসুন্ধরার ল্যাপটপ থেকে পত্রপত্রিকার মাঠে খেলতে নামে সেটা বসুন্ধরা কল্পনা করেননি।
আরও একটা জিনিস কল্পনা করতে কষ্ট হয় বসুন্ধরার। মাঝে মাঝে চিঠি পান তিনি। ইমেল। ক্বচিৎকদাচিৎ দুয়েকটা জমায়েতে সশরীরেও কেউ কেউ জানিয়ে যায়। আপনার উপন্যাসটা পড়লাম। ভালো লাগল।
বসুন্ধরা প্রতিবারই চমকান। উপন্যাসটা লিখতে বসার আগের ঘটনাগুলো আগের জন্মের বলে বোধ হয়।
স্যমন্তকদের লিটল ম্যাগাজিনের অফিসে এর মধ্যে বারদুয়েক এসেছেন তিনি। গল্প দিতে বা নিতে, বা স্যমন্তককে তুলে নিয়ে তাঁর, স্যমন্তকের আর সুদেষ্ণার ক্রমশ নিয়মিত হয়ে ওঠা কফিশপের আড্ডায় যাওয়ার পথে। সেদিন স্যমন্তক হাতের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে, কোণের চেয়ারটেবিল থেকে একটি মেয়ে উঠে এল। প্রাথমিক পরিচয়সূচক হাসিবিনিময় এবং যাবতীয় আরও যা যা ভণিতা পরিহার করে বলল, বিশাখা, সাগ্নিকের কী হল খুব জানতে ইচ্ছে করে। আপনার অন্য গল্পও পড়ি, ভালো লাগে, কিন্তু ওই গল্পটা পড়তে ইচ্ছে করে খুব।
বাইরে বেরিয়ে স্যমন্তক বলল, সেকেন্ড পার্ট লেখার আইডিয়াটা মন্দ নয় কিন্তু।
মোড়ের মাথায় পার্ক করা গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলেন দুজনে।
–একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ভেবেছি অনেকদিন। আপনি যে চরিত্র সৃষ্টি করেন, পুরোটা কল্পনা থেকে? নাকি কাউকে দেখে?
একটা ঝাঁকড়া গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে এলেন দুজনে। স্যমন্তকের মুখেচোখে চুলে রোদ ঝিকমিক করে উঠল।
সেই ছাতা-উল্টোনো ঝড়ের বিকেল থেকে যে অস্বস্তিটা হচ্ছিল বুকের ভেতর মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। স্যমন্তককে অবশেষে প্লেস করে ফেললেন বসুন্ধরা।
***
–শুনেছেন?
ক্লাস থেকে বেরিয়ে মিসড কল দেখে ফোন করার পর একবার রিং হতে না হতে তুলল স্যমন্তক।
–কী?
বসুন্ধরার উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের একটি রীতিমত চেনা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে।
***
–চুরি তো করোনি, উপন্যাস লিখেছ। সে উপন্যাস লোকের ভালো লেগেছে, তোমাকে প্রাইজ দিচ্ছে, তুমি নেবে। নাকি মার্ক টোয়েনের পরামর্শমতো পুরস্কার নেওয়ার বদলে না নিয়ে বেশি হইচই সৃষ্টির ফন্দি আঁটছ?
নির্দিষ্ট দিনে দুই বন্ধু সহযোগে বসুন্ধরা যথাসময়ে উপস্থিত হলেন পুরস্কার বিতরণী ভেনুতে। সুদৃশ্য হোটেলের সুবাসিত হলের দরজা ঠেলে ঢোকা মাত্র তাঁর প্রতিবিম্ব চারদিকের আয়না মোড়া দেওয়ালে, সিলিং-এ ধাক্কা খেয়ে খান খান হয়ে পড়ল। বসুন্ধরা বুঝে গেলেন ভুল হয়েছে। নিজেকে সামলানোর প্রচেষ্টায় বাথরুমে গেলেন, দেওয়ালজোড়া আয়নারা তাঁকে গিলে ফেলল।
–আপনি ঠিক আছেন তো? অস্বস্তি হচ্ছে কিছু? স্যমন্তকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে চোখের কোণা দিয়ে অস্বস্তিটাকে হলের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখলেন বসুন্ধরা।
অপ্রতিম মিত্র। সাবলীল, সপ্রতিভ, উজ্জ্বল। আগে পিছে অনুরাগীর জটলা।
বসুন্ধরা বসুর এত লেটে সাহিত্যের জগতে পদার্পণ এবং এত লেট সত্ত্বেও এমন অসামান্য আত্মপ্রকাশের অকল্পনীয়তায় বারংবার শিহরণ প্রকাশ করে সঞ্চালক উপস্থিত বিখ্যাত বর্ষীয়ান সাহিত্যিককে অনুরোধ করলেন বসুন্ধরার হাতে পুরস্কার তুলে দিতে। সেই সাহিত্যিক বসুন্ধরার মাস্টারমশাইও বটে। তিনি বসুন্ধরার উপন্যাস নিয়ে বলার সঙ্গে সঙ্গে বসুন্ধরার ছাত্রীজীবন নিয়েও বললেন। আরও কয়েকটি ভূয়সী প্রশংসামূলক বক্তৃতার পর সামনের সারিতে বসা উদীয়মান, প্রতিশ্রুতিমান এবং জনপ্রিয় সাহিত্যিক অপ্রতিম মিত্র মাইক চেয়ে নিল নিজেই।
লেখার মূল্যায়নের দায়িত্ব কেবল পাঠক এবং মহাকালের, তাছাড়া এত গুণী ব্যক্তি বলে যাওয়ার পর আর কীই বা বলার যোগ্যতা আমার থাকতে পারে ইত্যাদি সেরে বসুন্ধরার দিকে উজ্জ্বল হাসিমুখ ফেরাল অপ্রতিম। তবে বসুন্ধরাদি সম্পর্কে ব্যক্তিগত গল্পের স্টক আমারও কিছু আছে।
–আপনারা হয়তো অনেকেই আমার বিলম্বিত লয় উপন্যাসটি পড়েছেন। সে উপন্যাসের নায়িকা আর কেউ নন, আজ সন্ধেয় যাঁকে উদযাপনের উদ্দেশ্যে আমরা সবাই জড়ো হয়েছি, সেই বসুন্ধরা বসু।
সামনে রাখা নিজের নাম খোদাই করা চকচকে ফলকে নিজের মুখ দেখছিলেন বসুন্ধরা। দেখছিলেন সাফল্য কেমন দেখতে হয়। আর তাকে ঘিরে ফুলেফেঁপে ওঠা কদর্য মাৎসর্য আর নিষ্ফল ক্রোধকেও।
***
চড়িয়ে মুখ লম্বা করে দিতে হয়, সুদেষ্ণা বলল। স্যমন্তক কিছু বলল না। বসুন্ধরা বললেন, আহা, রাগ হওয়াটা তো অস্বাভাবিক নয়। কত সিরিয়াসলি লিখছে কতদিন থেকে। আর আমি খেলা খেলা লিখতে নেমেই প্রাইজটাইজ।
–ওর তো প্রাইজ কিছু কম পড়েনি। সিনেমার কন্ট্র্যাক্ট, অটোগ্রাফ। কাল সন্ধেতেও মিনিমাম পঞ্চাশখানা দিতে দেখেছি।
কফির কাপে চিনি গুলতে গুলতে বসুন্ধরার ঠোঁটের কোণে হাসি এসে গেল।
–ক্লাসে কিছু স্টুডেন্ট থাকে না, হায়েস্টের থেকে দেড় নম্বর কম পেলে টিচারের পেছন পেছন দৌড়য়? অপ্রতিম নির্ঘাত ওই টাইপ ছিল।
সুদেষ্ণা হাসল না। স্যমন্তক হাসল।
–আপনি কোন টাইপ ছিলেন?
–হায়েস্ট পাওয়া টাইপ, ন্যাচারেলি।
***
বাপের জন্মে এমন বর্ষা দেখেনি, সকালবেলা ঘোষণা করে গেল পূর্ণিমা। বৃষ্টি না থামলে যে সন্ধেবেলা আসার কোনও অ্যাটেম্পট ও নেবে না সেটাও।
বাপের জন্ম কি না জানেন না, নিজের জন্মে এমন বৃষ্টি বসুন্ধরা বেশি দেখেননি। গত তিনদিন ধরে চলছে। কমেছে, বেড়েছে, কিন্তু থামেনি।
গল্প সঙ্কলনের ফাইন্যাল ড্রাফটটা শেষবারের মতো চোখ বোলানোর জন্য স্যমন্তক তাঁকে দেবে বলেছিল পরশু, যেদিন তাঁর, স্যমন্তক আর সুদেষ্ণার কফিশপে দেখা হওয়ার কথা ছিল। সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি নামল। স্যমন্তক জিজ্ঞাসা করেছিল বাড়ি এসে পৌঁছে দিয়ে যাবে কি না। তাড়া তো নেই। কাল দিও। বলেছিলেন বসুন্ধরা। কাল বৃষ্টি থামার বদলে বাড়ল। ঠিক হল আজ বসা হবে। আজ পরিস্থিতি কালকের থেকে সামান্য বেটার হলেও, রাস্তায় বেরোনোর উপযোগী নয়।
এই বইটা নিয়ে স্যমন্তক আর সুদেষ্ণার উৎসাহের কণামাত্র বোধ করছেন না বসুন্ধরা। লিখেছিলেন ফাঁক ভরাতে, লেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগ উঠে গেছে। বইয়ের নাম রেখেছে দুজনে শলা করে, প্রচ্ছদ করিয়েছে নিজেদের পছন্দমতো, ফোনটোন করে লোক ধরে ব্লার্ব লিখিয়েছে। বই নিয়ে দুজনের উত্তেজিত আলোচনা আজকাল কফি খাওয়ার সময়টুকু ছেয়ে থাকে।
বসুন্ধরা হুঁ হাঁ করেন, মোটের ওপর সবেতেই সায় দেন। স্যমন্তকদের লিটল ম্যাগাজিনের অফিসের গম্ভীর মেয়েটির মুখ মনে ভাসে। কেমন হয় উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড লিখলে? বারবার মনে পড়ে উপন্যাসটা লেখা হওয়ার কয়েকমাসের আনন্দের কথা। একটা কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেওয়ার তৃপ্তি। বিশাখা আর সাগ্নিকের সঙ্গে এই ক্রমশ অচেনা হয়ে ওঠা শহরের পথে পথে হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছে করে। রোদটা আজকাল বড় গায়ে মাখতে ইচ্ছে করে।
এই তিনদিনের বৃষ্টি সে চাওয়া বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে ট্যাক্সিটাকে কম্পাউন্ডে ঢুকতে দেখলেন বসুন্ধরা। ট্যাক্সির হেডলাইটের আলোয় আলোকিত বৃষ্টির ছাঁট। দরজা খুলে নেমে এল একজন। হাতের ফাইলটা মাথায় চাপা দিয়ে মুখ তুলে তাকাল বসুন্ধরার বারান্দার দিকে, তারপর দৌড়ল।
দরজা খুললেন বসুন্ধরা।
স্যমন্তকের চুল, কপাল বেয়ে জলের ফোঁটা। শার্টের জায়গায় জায়গায় ভেজা।
স্যমন্তক চোখ নামাল।
–আসলে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া এ বৃষ্টি কবে থামবে তো ঠিক নেই।
করিডরের ওই প্রান্তের টিউবটা দপদপ করছে। সাধারণত বসুন্ধরাদের হাউজিং-এ এ সব জটিলতা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সারিয়ে ফেলা হয়, কিন্তু এখন ক্রাইসিস।
কাচের ওপারে অন্ধকার। দপদপানির মধ্যে কাচের গায়ে ফুটে উঠছে একটা দরজা, দরজা ছুঁয়ে একটা হাত, শরীর, মুখ।
মুখটা চেনা চেনা লাগল বসুন্ধরার। ভয় লাগল না, বরং ‘বন্ধু’ শব্দটা এল মাথায়। মনে হল এই এক নিমেষের দেখাতেই, এই মুহূর্তের গভীর সংশয়টা একে বলে ফেলা যায়।
–অনেক লেট হয়ে গেল, না?
–কে বলল? বিস্তর সময় আছে। গভীর প্রত্যয় এবং আশ্বাসের হাসি হাসল উল্টোদিকের বন্ধু।
হাসিটার ছায়া মিলিয়ে যাওয়ার আগেই স্যমন্তকের দিকে মুখ ফেরালেন বসুন্ধরা। দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন।
–এসো।
সুখপাঠ্য গল্প। ভাষা, বিন্যাস টেনে রাখে। লেখকের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই উপস্থির। সিগনেচার লেখা।
পাঠকের ভালো লাগা আর জানানো ছাড়া খুব কিছু করার নেই – তাকে গল্পের মধ্যে আর একটা গল্প খোঁজার কাজ দিলে ভাল হত।
আরে থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী। লোককে পরিশ্রম করানোরও পরিশ্রম আছে, এবং কেরামতি। দেখব চেষ্টা করে।
লেখার স্টাইলটাই আটকে রাখে পাঠককে। যেন শিশুর হাঁটার মতো চলতে থাকা শব্দ, এই পড়ে যাচ্ছে করে তৈরি হয়ে যাচ্ছে একটি বাক্য। বাক্যের পর বাক্য যেন শিমুল তুলোর মতো উড়তে থাকে এরপর। লেখকের প্রতি শুভকামনা রইল।
এই রকম শুভকামনা পেলে দিনগুলো যাবতীয় জুম মিটিংকে কাঁচকলা দেখিয়ে রংচঙে হয়ে ওঠে। কৃতজ্ঞতা জানবেন, শৈলেন।
এত ভালো লেখা আমি আজকাল কমই পাই। বিশেষত সমাজমাধ্যমে। আপনার লেখার গুণমুগ্ধ হয়ে রইলাম।
আরে, থ্যাংক ইউ। ভালো লাগল।