ব্রজ রায়— এক অন্তহীন জীবন

ব্রজ রায় | মানবাধিকার কর্মী

তপন কাইত

 



বিজ্ঞানকর্মী, ‘গণদর্পণ’ সংস্থার কার্যকরী সংসদের সদস্য

 

 

 

 

ব্রজ রায়। জন্ম ১৯৩৬ সালের ৩০ নভেম্বর ২৪ নম্বর গোবিন্দ বোস লেন, ভবানীপুর-এ। বাবা নিরঞ্জন রায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। মা বঙ্গলক্ষ্মী রায়। খুবই অনটনের সংসার না হলেও নটি সন্তান নিয়ে বঙ্গলক্ষ্মী হঠাৎ করোনারি থ্রম্বোসিসে স্বামীহারা হলেন। ব্রজ রায়ের ছোটবোনের বয়স তখন মাত্র এক বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে কালোবাজারি, মন্বন্তর রমরমিয়ে বাড়ছে। বড়ভাই মানব তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। পড়া ছেড়ে বাবার চাকরিতে গ্লুকোনেট কোম্পানিতে ঢুকলেন। সাউথ সুবার্বন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ব্রজ রায়কে ভর্তি করা হল। মেজ ভাই সন্তোষও সামান্য বেতনে মার্কেন্টাইল ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি পেল। আর সেজ সমীর চলে গেল মিলিটারিতে। বড় ভাই মানবের খামখেয়ালিপনায় কলেজের বন্ধু সন্তোষের সান্নিধ্যে কলকাতা ছেড়ে গোবরডাঙ্গায় ভাড়াবাড়িতে চলে এল। গোবরডাঙ্গায় জিকেএইচ স্কুলে ব্রজ রায় আর তার ছোট ভাই ভর্তি হলেন।

আচমকাই বঙ্গলক্ষ্মীর জীবনে আরেক বিপদ এসে হাজির হল। মানব কর্মসূত্রে মাদ্রাজে গিয়ে পন্ডিচেরিতে অরবিন্দের সান্নিধ্যে এসে চাকরি ছেড়ে আশ্রমবাসী হয়ে গেলেন। মার মাথায় হাত। এতগুলো পেট চলবে কী করে? ব্রজ রায় তখন মাত্র দশ বছরের ছেলে।

শুরু হল জীবনসংগ্রাম। ছোলা বিক্রি করা দিয়ে হাতেখড়ি। স্কুলের টিচাররা ব্রজ রায়কে খুব ভালোবাসতেন। ছাত্রদের বললেন ব্রজর কাছ থেকে ছোলা কিনতে‌। বাড়িতে ঠোঙা বানাতেন দিদিদের সঙ্গে। ছোটভাইকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খাঁটুরায় যেতেন ছোলা বিক্রি করতে‌। কোনওক্রমে ছাতু খেয়ে দিন কাটত সবার। অপুষ্টিজনিত রোগ আস্তানা গাড়ল ঘরে। মায়ের কালো ছেলে ব্রজ ম্যালেরিয়ার কৃপায় আরও কালো হলেন।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মায়ের করুণ মুখ দেখে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন গান্ধিকে হত্যা করা হয়েছে। নেনুদার (মানবের বন্ধু সন্তোষ) কাছে জানতে পারে ধর্মের কারণেই গান্ধিকে খুন করা হয়েছে। তার মগজ তোলপাড়— এর আগে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কথা শুনেছে, কিন্তু হিন্দু হিন্দুকে মারছে?

বঙ্গলক্ষ্মীর মা-এর একান্ত ইচ্ছায় বঙ্গলক্ষ্মী তার ভাইয়ের বাড়ি ভবানীপুরে ১৯৪৮ সালের জুন মাসে চলে এলেন সমস্ত সংসার নিয়ে। ভাইয়ের বাড়ি উঠলেও রান্না, খাওয়া আলাদাই করতেন। ব্রজ রায় নিজের আর তার ছোট ভাইয়ের ভর্তি ফি মকুব করার আর্জি জানিয়ে স্কুলে দেখা করলেন ঐ কিশোর বয়সেই। স্কুলের প্রেসিডেন্ট আশুতোষ মুখার্জির ছেলে রমাপ্রসাদ মুখার্জি, সেক্রেটারি বিরাজ মজুমদারের সই সংগ্রহ করে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হলেন। এমনকি ছোট বোন-এর ছ বছর বয়সে দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়ার পর ক্যালকাটা ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি করানো, চিকিৎসা সবই ওইটুকু ছেলে ব্রজ রায় সামলেছেন। সহজে তিনি হাল ছাড়তেন না।

পনেরো বছর বয়সে স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতা বাপি চ্যাটার্জির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৫৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে গণনাট্যের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য গ্লুকোনেটের চাকরিটা চলে যায়।

১৯৫৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। কয়েক মাস পরে ডাক বিভাগের চাকরিতে যোগদান করেন। সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ১ মে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। মনোযোগ দিলেন নাটকে‌। তৃপ্তি চৌধুরীর সহায়তায় ১৯৬৬ সালের ১৩ই অক্টোবর ক্লেম ব্রাউন মঞ্চে “ওরা অন্ত্যজ” নাটক দিয়ে শুরু। মায়াকোভস্কি (সাম্যবাদী তো সেই/ যে পোড়ায় পিছু হটবার অসহ্য সেতুটাকে!) আবৃত্তি করতে করতে তৃপ্তি চৌধুরীর হাতটা নিজের হাতের অঞ্জলিতে নিয়ে তিরিশ বছর বয়সে যৌথ জীবন শুরু করেছিলেন। তখন ব্রজ রায়-এর চিন্তাভাবনা আরসিসিআই-কে নিয়ে। সংগঠনের তহবিল বাড়িয়ে দুনিয়া বদলের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৬৬ সালের ১ জুলাই অনন্ত সিং-এর নেতৃত্বে পার্ক স্ট্রিটের কাছে পোস্টলে ক্যাশ ভ্যান ডাকাতিতে প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ করেন।

আমেরিকান লাইব্রেরির জন্য বরাদ্দকৃত পার্সেল বোমা কলকাতা জিপিও-তে বিস্ফোরণের কারণে ১১ নভেম্বর ১৯৬৯ ব্রজ রায় আর তৃপ্তি চৌধুরী গ্রেফতার হন‌। এপিডিআর-এর সম্পাদক দেবাশিস ভট্টাচার্যের সঙ্গে জেলে বসেই সখ্য হয়। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭৭ (বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর) মুক্তি পান। জেলে থাকাকালীন ভুল স্বীকার করে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেতে রাজি হননি কখনও। এমনকি আইনজীবীর সাহায্য ছাড়াই নিজের মামলার নিজেই কৌশলী হয়ে লড়েছেন‌।

এপিডিআর-এর একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে ১০ ডিসেম্বর ১৯৭৮ ওই সংগঠনের মিছিলে পা মেলান। কখনও কোষাধ্যক্ষ, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে সংগঠনকে নেতৃত্ব দেন।

১৯৮৫ সালে বিজ্ঞানী জে বি এস হলডেনের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে তৃপ্তি চৌধুরী, রতন দাস, মালা রায়, দীপা দাস ও ব্রজ রায়— এই পাঁচজন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারের মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি ও কলা ও প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের আন্দোলনের সূত্রপাত করেন‌। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা ‘গণদর্পণ’কে পুনরুজ্জীবিত করেন।

১৯৮৬ সালের ৫ নভেম্বর জে বি এস হলডেনের ৯৫তম জন্মদিনে সুবর্ণ বণিক সমাজের সভাকক্ষে ৩৪ জন অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষর করে গণদর্পণের মাধ্যমে সরকারের পক্ষের ডাঃ কালিকিঙ্কর ভট্টাচার্যের হাতে অর্পণ করা হয়। এছাড়াও তিনি নর্মান বেথুন জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, উৎস মানুষ, পিআরসি, পরিবেশ আন্দোলন, জন বিজ্ঞান আন্দোলন, সিসিটিভি-সহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ও বৃহত্তর বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে সমস্ত আন্দোলনের শরিক ছিলেন।

তিনি মনে করতেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রথার বিলোপ এবং জীবনের প্রতিক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদ প্রয়োগই সুন্দর শোষণহীন সমাজব্যবস্থার প্রাথমিক শর্ত।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...