সুন্দরলাল বহুগুণা ও সুন্দর ভুবনের গল্প

সুন্দরলাল বহুগুণা | পরিবেশকর্মী

সুরমিতা কাঞ্জিলাল

 



বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রী, পেশায় শিক্ষক

 

 

 

 

২১ মে ২০২১— সুন্দরলাল বহুগুণা চলে গেলেন। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখার এক অনন্য পাঠ যাঁর কাছ শিখে নিতে পারতাম সকলেই। গাছকে, নদীকে এমনকি মানুষকেও পর্যাপ্ত ভালোবাসতে আমরা শিখিনি। হিংসা ঘৃণা বিদ্বেষের সংক্রমণ তুলনায় সহজ। তবে এই ডামাডোলের মাঝে কোনও কোনও মানুষ থাকেন, যাঁরা ভালোবাসতে শেখান। হিংসাগ্রস্ত, মহামারিতে ক্লান্ত এই সময়ে সেসব মানুষের চলে যাওয়া বড় বেশি শূন্যতা আনে। ঠিক যেমন সুন্দরলাল বহুগুণার চলে যাওয়া— প্রকৃতিকে  দেখার অনিন্দ্যসুন্দর এক দৃষ্টির হারিয়ে যাওয়া যেন।

এমনিতে চলে যাওয়ার খবরেই আমরা আছি। গত দেড়বছর যেন ক্রমশূন্যায়মান একসময়। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যেটুকু ঝুলিতে জমেছিল, সব নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে একে একে। কবি, ঐতিহাসিক, অভিনেতা, সাংবাদিক, দার্শনিক। মৃত্যুর ধারাবাহিকতায় নাম জুড়ল সুন্দরলাল বহুগুণারও।

১৯২৭ সালে উত্তরাখণ্ডের তেহরির কাছে মারোড়া গ্রামে জন্মেছিলেন সুন্দরলাল। তাঁর বহুগুণা পদবির সঙ্গে নাকি বাংলা জুড়ে আছে। অনেক যুগ আগের কথা অবশ্য। তাদের সুপ্রাচীন পদবিটি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর হিমালয়ের পাদদেশে বহুগুণের বহিঃপ্রকাশে বন্দ্যোপাধ্যায় বদলে যায় বহুগুণায়। সুন্দরলালের জন্ম পরাধীন ভারতবর্ষে। বড় হয়ে উঠতে উঠতে সুন্দরলাল জড়িয়ে পড়েন শাসকের বিরোধিতায়। তাতে কারাবাসও হয়। গান্ধিজির আদর্শকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন সুন্দরলাল। আজীবন সেই আদর্শকে অনুসরণ করেই পথ হেঁটেছিলেন। স্বাধীনতার পরে রাজনীতির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিলেন স্বাভাবিকভাবেই। তবে তাঁর রাজনীতি সঙ্কীর্ণ অর্থে আখের গোছানোতে আবদ্ধ ছিল না কোনওভাবেই। গাড়োয়াল হিমালয় জুড়ে জাতপাতের বিরুদ্ধে, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন সুন্দরলাল। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এই ভেদাভেদের বিরুদ্ধে। সুন্দরলাল দেখেছিলেন, গাড়োয়ালের গ্রাম জুড়ে কীভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে ওঠে পুরুষেরা৷ রোজগারের বেশিরভাগ টাকা তারা ব্যয় করে ফেলে নেশায়। নেশার বিরুদ্ধে গ্রামের মহিলাদের একত্রিত করেন তিনি। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সাল জুড়ে নেশার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন৷ মানুষকে সচেতন করেন।

গান্ধিজিকে অনুসরণ করে মানুষের জন্যেই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সুন্দরলাল। গাড়োয়াল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর কাজ। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে তা থেকে কীভাবে মুনাফা লোটা যায়, ব্রিটিশ শাসক এদেশের মানুষকে তা ভালোই শিখিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরেও তাতে কোনও লয়ক্ষয় হয়নি। সুন্দরলাল দেখেছিলেন, কীভাবে হিমালয়ের জঙ্গল ক্রমশ খালি হয়ে আসছে। একের পর এক গাছ কাটা হচ্ছে। পার্বত্যপ্রদেশেই জন্ম তাঁর। প্রকৃতির এই ধ্বংস তিনি মেনে নিতে পারেননি। আন্দোলন শুরু হয়েছিল। হিমালয় জুড়ে নানান প্রজাতির সবুজপ্রাণকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। আর এরপরেই তিনি জুড়ে যান ঐতিহাসিক চিপকো আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে উত্তরপ্রদেশে অরণ্যরক্ষার এই আন্দোলন গোটা বিশ্বকেই পরিবেশ-আন্দোলনের এক নতুন দিশা দিয়েছিল। চিপকো আন্দোলনের সাফল্যের মূলে ছিলেন সুন্দরলাল। গান্ধির অহিংস নীতিকে পরিবেশরক্ষার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া বাস্তবিকই অভিনব ছিল।

সুন্দরলাল বুঝেছিলেন, হিমালয়ের প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে কর্পোরেটের। মানুষকে সচেতন করতে কোহিমা থেকে কাশ্মির পর্যন্ত পদযাত্রা করেন সুন্দরলাল। গ্রামের পথে পথে মানুষকে সাবধান করেন। সচেতন করেন। বহুযুগ ধরে ভারতের উত্তরদিক জুড়ে থাকা পাহাড়, নদী, অরণ্য কীভাবে মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, দেশকে রক্ষা করেছে, মানুষকে বারবার সেকথা বলেন তিনি। হিমালয়ের ক্ষতি হলে যে দেশের প্রতিটি মানুষেরই ক্ষতি দেশের সরকারকে সেকথা বোঝাতে চেয়েছিলেন সুন্দরলাল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। গাছ-কাটা তাতে বন্ধ হয়েছিল কিছুকাল। কিন্তু আমাদের দেশের কোনও সরকারই শেষপর্যন্ত প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধ হতে পারেনি।

জল-জঙ্গল-জমিকে মানুষের জীবনের একমাত্র আধার হিসেবে দেখতেন সুন্দরলাল। ইকোলজিকেই অর্থনীতির মূল ভিত্তি করে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতিকে পুঁজির সঙ্গে তুলনা করে যেভাবে তার শোষণ হচ্ছে দেশ জুড়ে— সুন্দরলাল বারবার তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।

তেহরির বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সুন্দরলালের আন্দোলন সার্বিকভাবেই বাঁধের রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করেছিল। দিল্লির মানুষকে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে যে বাঁধ তাতে নদীর সমূহ ক্ষতি। নদীতীরবর্তী গ্রাম ও গ্রামীণ মানুষের সর্বনাশ। সুন্দরলাল অনশনে বসেন দীর্ঘ দীর্ঘদিন, গান্ধিজির আদর্শ অনুসরণ করেই। প্রাথমিকভাবে বাঁধনির্মাণ বন্ধ হয়। কিন্তু লক্ষকোটি টাকা যেখানে বরাদ্দ, মুনাফার এত সুযোগ যেখানে, তা কি থেমে থাকে? ভাগীরথীর তীরে সুন্দরলাল ফের অনশনে বসেন। এবারে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তবে থেমে থাকেননি সুন্দরলাল। হিমালয়ের নদনদী শত শত বছর ধরে বয়ে চলেছে। আমাদের দেশের মানুষ সেসব নদনদীর কাছে ঋণী। তাদের গতিপথ রোধ করলে বন্যা থেকে শুরু করে, একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় অনিবার্য। শুধু তাই নয়, জঙ্গল ধ্বংসের দরুণ আদিবাসী সমাজের ওপর নিরন্তর আক্রমণও ঘটে চলেছে। তাঁদের এতদিনের বাসভূমি, জঙ্গলের অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। আজীবন সুন্দরলাল সেকথা বোঝাতে চেয়েছেন। পরবর্তীতেও প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার নানা আন্দোলনে  সুন্দরলাল সামিল হয়েছেন। অবশ্যই নিজের আদর্শকে বজায় রেখেই। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে কখনওই অহিংসার পথ থেকে তিনি সরে যাননি।

তবে, প্রকৃতির ওপর অত্যাচার, প্রকৃতি ধ্বংস করে ‘উন্নয়ন’— এসবের সঙ্গে আমাদের দেশ আজ পরিচিত। প্রকৃতি রক্ষার, জলাভূমি রক্ষার, জঙ্গল বাঁচানোর কোনও লড়াইকেই দেশের সরকার ভালো চোখে দেখেনি, দেখবেও না। বরং পরিবেশবিদ বা আন্দোলনকারী জনতাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে জেলে পুড়তে পারলে সরকার তথা কর্পোরেটের ষোলোকলা পূর্ণ হয়। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এদেশে ছিল। প্রকৃতি বাঁচানোর কথা কোনও সরকারই ভাবেনি, ভাবেও না— এর থেকে আক্ষেপের বিষয় আর কীই বা হতে পারে। ফলাফল আমাদের সামনেই রয়েছে। প্রতিবছর নিয়ম করে সাইক্লোন, তাতে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাওয়া— সমস্তটাই আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। আমরাও ভ্রূক্ষেপহীন। সরকারও নিরুদ্বেগ। এখন লাক্ষাদ্বীপে স্মার্টসিটির অপেক্ষায় দিন গোনা যেতে পারে।

প্রকৃতিকে বুঝতে শেখা, তাকে ভালোবাসতে শেখা জীবনের অন্যতম শিক্ষা তো বটেই। সুন্দরলালের নদী-জমি-অরণ্যকে ভালোবাসতে পারার সেই ক্ষমতার উত্তরাধিকার যদি আমরা পেতাম, আজ হয়তো হিমালয়ের ছবিটা অন্যরকম হত। গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা বা এখানকার বিদ্যাধরী ইছামতী মাতলা আজও হয়তো কলকল করেই বয়ে যেতে পারত। জলাজমি বুজিয়ে, পুকুর বুজিয়ে, গাছপালা কেটে যে বেআইনি নির্মাণ— মহামারির সময়েও তা অব্যাহত। প্রকৃতি রক্ষায়, নদী পরিচর্যায় অর্থের টানাটানি পড়ে এদেশে। অথচ সেন্ট্রাল ভিস্তায়, নির্বাচনে, মূর্তি তৈরিতে লক্ষকোটি টাকা ওড়ে। এটাই পরিস্থিতি। সুন্দরলাল এই বাস্তবতা দেখেছেন। তবে, তিনি ছিলেন, প্রকৃতি-নিধন করে উন্নয়নের মিথ্যা গল্প-শোনানো সমাজটার বাইরে একটা অন্যস্বরও ছিল। আজ সেটারও বড় অভাব যে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...