বিবর্তন ভট্টাচার্য
বিজ্ঞানকর্মী
আমার এতদিন বাদে মনে হচ্ছে যাঁরা পরিবেশ আন্দোলন করেন আন্তরিকভাবে তাঁদের পরিবেশের অর্থনীতি, পরিবেশের রাজনীতি আর বিজ্ঞানীদের লবির চালাকি ভালো করে বুঝতে হবে। যাঁরা এই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক তাঁরা যে গোত্রের হন না কেন সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণে তাঁরা দারুণভাবে সক্ষম। এই কিছুদিন আগে ৫ জুন ২০২১ গেল, হই হই করে সারা বিশ্বে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হল। বিষয়— রিইম্যাজিন, রিক্রিয়েট, রিস্টোর— বাস্তুতন্ত্রের পুনর্গঠন। আমার অবাক লাগে, কোনও মানুষকে তার কিডনির অসুবিধা হওয়ার পর তাকে ডায়ালিসিস দিলে তার কিডনি কি আগের অবস্থায় ফিরে আসে! প্রকৃতির কিডনি বাস্তুতন্ত্র— তার পুনর্গঠন কি আদৌ সম্ভব? তাহলে যাকে অগ্রগতি বলা হচ্ছে তাকে তো থামাতে হবে। আমি জানি না সুকুমার রায় বেঁচে থাকলে তিনি হাঁসজারুর ছবিটি কীভাবে আঁকতেন।
‘যশ’ বা ‘ইয়াস’— ২৬ মে, ২০২১ বিকেল থেকে ঝড় শুরু হয়, সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। ঘূর্ণিঝড়ে যা হওয়ার কথা এবং আবহাওয়াবিদগণ যেমনটি বলেছেন ঠিক তেমন শুরু হল তাণ্ডব। রক্ষা এইটুকু— ১৫৫ কিমি গতিবেগে ঝড় আছড়ে পড়ল ওডিশার বালাসোরে। আসলে আবহাওয়াবিজ্ঞানীদের ধন্যবাদ প্রাপ্য এই কারণে এই বিজ্ঞানসম্মত পূর্বাভাস মানুষের জীবন বাঁচাতে দারুণভাবে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে, সুন্দরবনের মানুষের। এত বড় ঝড়ে মারা গেছেন ১ জন। আর সত্যি পশ্চিমবঙ্গ সরকার অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে ১৫.৪ লক্ষ মানুষকে বিপদের জায়গা থেকে অন্যত্র ফ্লাড সেন্টারে নিয়ে যাওয়াতে খুব ভালো হয়েছে।
১৯৭০ সালে ‘ভোলা সাইক্লোন’-এর সময় এইসব ব্যবস্থাই ছিল না। তাই বহু মানুষ মারা গেলেও তার পরিসংখ্যান রাখার ব্যবস্থাই ছিল না। আসলে সামুদ্রিক ঝড়ের প্রভাব আমরা লক্ষ করেছি ২০০৭ সালের ‘সিডার’ থেকে। ১৫ নভেম্বর, ২০০৭-এ ‘সিডার’ আছড়ে পড়ে। আসলে সামুদ্রিক ঝড়ের মূল কারণ অরণ্য নিধন, জলাভূমি ভরাট, এবং সেসবের ফলে ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ বৃদ্ধি আর সেইজন্যই এই সামুদ্রিক ঝড়। কারও মনে আছে কিনা— প্রত্যেক রাজ্যে ৩৩ শতাংশ জঙ্গল থাকতেই হবে তার নির্দেশ ছিল সরকারিভাবে। আজ সুন্দরবন আর বক্সার জঙ্গল নিয়ে ১৯.৫ শতাংশ জঙ্গল। তারপর বড় বড় হাইওয়ে তৈরির ফলে আরও কমেছে বলে আমার ধারণা। ২০০৭-এর পরে ২০০৯-এর সাইক্লোন ‘আয়লা’ সবারই মনে আছে। আর ওই বছরেই হয় ‘ফিয়ান’ সাইক্লোনও। সামুদ্রিক ঝড় যে বেড়ে চলেছে তা আবহাওয়াবিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারেন ২০১৮-১৯ থেকে ‘ফণি’, ‘বায়ু’, ‘হিক্কা’, ‘কিয়ার’, ‘মহা’, ‘বুলবুল’, ‘পবন’, তারপর ২০২০-তে ‘আমফান’ (উম্পুন)। এক একটা ঝড় আসে, পরিসংখ্যানবিদগণ হিসাব রাখেন, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। পরবর্তী অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটে বলে আমার মনে হয় না।
১৮৭০ সাল থেকে জঙ্গল কেটে বসবাস শুরু হয় সুন্দরবনে। সবই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কৃপা। ১৮৫৩ সালে লর্ড ক্যানিং-এর নামে ক্যানিং স্টেশন তৈরি হয়। আসলে বর্তমানে সরকারি স্পনসর্ড ঠিকাদারদের মতো সুন্দরবনের সম্পদ লুঠ করতেই এই পরিকল্পনা। আসলে সুন্দরবনে যাকে নদী বলা হয় তা প্রায় সবই খোঁড়া। তাই এগুলোকে খাঁড়ি বলা হয়। সমুদ্রের জোয়ারের জল ঢুকিয়ে মাছ উৎপাদনের জন্যই এগুলো তৈরি বহুবছর আগে থেকেই। সাগরদ্বীপ তৈরি হয় ৭টি দ্বীপ নিয়ে। তার প্রায় সব দ্বীপই জলের তলায়।
যেমন— লোহাচোনা, বেচপুর, সুপারিভাঙা, চুপসা— এইসব দ্বীপের কথা সুন্দরবনের প্রাচীন মানুষেরা মনে রাখলেও বর্তমান প্রজন্মের হয়তো অজানা। এছাড়া ঘোড়ামারা দ্বীপটি কিছুদিনের মধ্যে জলের তলায় তলিয়ে যাবে। মৌসুমি দ্বীপের অবস্থাও ভালো নয়। আর দ্বীপ মানে তো ফাঁকা দ্বীপ নয়। এই জনবসতি কোথায় যায় তার পরিসংখ্যান রাখবার কোনও ব্যবস্থা নেই। যেমন মানিকতলা বস্তি উচ্ছেদের পর বাসিন্দারা কোথায় সরকার জানেন না।
‘ইয়াস’-এর পর সুন্দরবনের এই বাঁধ পুনর্গঠনের জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পনা শুরু করেছেন তাতে টেকনোক্র্যাটগণ থাকলেও সাধারণ মানুষের কোনও মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না সরকার। বড় কাগজে বড় বড় করে লেখা হচ্ছে সুন্দরবনে কংক্রিটের বাঁধ করলে আর কোনও ঝড় সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে পারবে না।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী ৫৪টি দ্বীপে বসতি আর ১০২টি দ্বীপে জঙ্গল। কিন্তু নদীবিশেষজ্ঞগণ বলছেন ৩৩টি দ্বীপে বসতি আর ১১৫টি দ্বীপে জঙ্গল। বাঁধের হিসেবেও গোলমাল। মাটির বাঁধ ৩,৫০০ কিমি কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানে ২০০০ কিমি। তাই কংক্রিট বাঁধ কোথায় দেওয়া হবে, বা তা কতটা ঠিক এ নিয়ে আলোচনার কোনও অবকাশ নেই— ২০,০০০ কোটি টাকার এস্টিমেট হয়ে গিয়েছে। কংক্রিট বাঁধ তৈরি করতে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি জলের প্রয়োজন কেন না নোনা জলে কংক্রিট ভালো হয় না। তাই ৬০টি পাইপ দিয়ে মিষ্টি জল তুলে কংক্রিট দেওয়াল তৈরি হবে— এর মধ্যেই একটু খবর নিলে জানা যাবে সুন্দরবনের মানুষের পানীয় জলের অভাব শুরু হয়েছে। এছাড়া বিগত ১০ বছরে জলস্তর ১০ মিটার নিম্নগামী। তাই বাঁধের জন্য জল বোধহয় কলকাতা থেকে যাবে না। এছাড়া ‘যশ’ ঝড়ের সময় আমরা অনেকেই টেলিভিশনে দেখেছি জলোচ্ছ্বাস একটি নারকেল গাছের মাথার ওপর দিয়ে অতিক্রম করছে। তাই বাঁধের উচ্চতা গ্রাউন্ড লেবেল থেকে কতটা হবে আর ‘যশ’ পরবর্তী সামুদ্রিক ঝড় তা অতিক্রম করবে কি না, তা সরকার বলতে পারছে না।
ম্যানগ্রোভ লাগানোর পরিকল্পনাও বাস্তবসম্মত নয় কারণ এ সমতলে বনসৃজন প্রকল্পের মতো বিষয় নয়। যে ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছে তার কত শতাংশ জীবিত, তার কোনও হিসেব নেই। আসলে গাছ— ম্যানগ্রোভ— নাটবল্টু নয় যে, একটা নাটবল্টু খুলে গেছে লাগিয়ে দিলাম— এরকম বিষয় নয়। তাই বিষয়গুলো করবার আগে সুন্দরবনকে যাঁরা সত্যি ভালোবাসেন এই ধরনের পরিবেশবিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিয়ে পুনর্গঠন প্রয়োজন।
কংক্রিটের বাঁধ একদমই নয়, যে অঞ্চলের বাঁধ ভেঙেছে তা জরুরি ভিত্তিতে রিপেয়ারিং অত্যন্ত জরুরি। সুন্দরবনে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা একদম ঠিক নয়।
চাষের পরিবর্তন করা জরুরি। যেমন প্রচুর পরিমাণে নারকেল গাছ লাগানো যেতে পারে যাতে জমিতে নোনা জল ঢুকলেও খুব একটা অসুবিধা নেই। আর এই গাছ বজ্রনিরোধক। যা সুন্দরবনের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে। আর যেসব দ্বীপ বর্তমানে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সেখানে এই ডেভেলপমেন্টের টাকা দিয়ে নতুন নগরী নির্মাণ করে সুন্দরবনের মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি। এতে সরকারের প্রতি বছর ত্রাণ আর বাঁধের জন্য টাকা খরচের প্রয়োজন হবে না। মানুষের আশীর্বাদও বর্ষিত হবে।
খুব উপযোগী লেখা।