সোমেন বসু
রাজনৈতিক ভাষ্যকার
পেরিয়ে গেল দুশো দিন। পার হয়ে যাচ্ছে তিনটি প্রধান ঋতু। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা গিয়ে এসেছিল চামড়ায় ফোস্কা ফেলে দেওয়া গরম, আর এখন সময় ঝড়বাদলের। পার হতে চলেছে করোনাভাইরাসের মর্মান্তিক দ্বিতীয় তরঙ্গ। রাষ্ট্র-পরিচালকদের মর্মান্তিক অপদার্থতার নিদর্শন হিসেবে গঙ্গায় বয়ে গেছে সারি সারি মৃতদেহ, আমরা দেখেছি সারি সারি জ্বলন্ত লাশ, গণ-কবর। আর এইসব এত কিছুর মধ্যে দিয়েও পার হয়ে গেল দুশো দিন। বসে আছেন ওঁরা, এখনও। আমাদের অন্নদাতারা। রাজধানীর তিনটি সীমান্তে। কয়েক হাজার ট্রাক্টর এবং কয়েক লক্ষ কৃষক। বসে আছেন, থাকবেনও। কারণ তাঁদের চোখে তাঁদের এই আন্দোলন “পৃথিবীর ইতিহাসের সুন্দরতম অধ্যায়”। কারণ, তাঁরাই জানাচ্ছেন, এই এতদিন হয়ে যাওয়ার পরও কোনও ঢিলেমি তো নেই-ই, উলটে তাঁদের আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে ক্রমশ। রচিত হচ্ছে ইতিহাস।
আবেগে ভাসাই যায়। আবেগ অত্যন্ত ন্যায্য এবং সঙ্গতও বটে। কিন্তু আমরা আপাতত সেই আবেগকে একটু দূরে সরিয়ে দেখে নিতে চাইব এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের অর্জনগুলিকে, রাজনৈতিক তাৎপর্যগুলিকে। এবং দেখে নিতে চাইব তাঁদেরই চোখ দিয়ে। কারণ যে দৃষ্টান্ত ইতিমধ্যেই তাঁরা স্থাপন করেছেন, তারপরে মধ্যবিত্তসুলভ পাণ্ডিত্য প্রদর্শন বা জ্ঞানদান হাস্যকরই নয়, অপরাধও বটে।
ঐক্য
সারা ভারত কিসান সভা (এআইকেএস)-এর কৃষক নেতা রাজস্থানের পবন দুগগল বলছিলেন, “আমাদের এই আন্দোলনের ফলে কৃষক এবং শ্রমিকদের মধ্যে যে ঐক্য অর্জিত হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। ‘কিসান মজদুর একতা জিন্দাবাদ’ এত দিন আমরা কেবল স্লোগানেই শুনেছি, এই প্রথম সেটা অনুভব করলাম।”
প্রকৃতপক্ষে এই কৃষক আন্দোলনের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জটাই ছিল ঐক্য অর্জনের। শ্রমিকদের সঙ্গে ঐক্য অর্জন তো পরবর্তী প্রশ্ন, কৃষকরা নিজেরাই যে একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম, প্রাথমিকভাবে বহু মহলে সন্দেহ ছিল সেই নিয়েই। আমাদের দেশে কৃষকরা কোনও এক শ্রেণিভুক্ত জনগোষ্ঠী নন। সেই শ্রেণিগত বিভেদ ছাড়াও তাঁদের মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক বিভেদ, জাতপাতের বিভেদ, ভাষাগত বিভেদ, লিঙ্গবৈষম্য, এবং রাজনৈতিক-সাংগঠনিক বিভেদ। এই যে সংযুক্ত কিসান মোর্চা আজকের এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে, এর মধ্যে রয়েছে ৫০টিরও বেশি কৃষক ইউনিয়ন। সেই ঐক্য যে কত সুচারুভাবে এবং কত বলিষ্ঠভাবে অর্জিত হয়েছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো আজ আন্দোলনের ২০০ দিন পার করে যাওয়া। হরিয়ানা কিসান সভার প্রবীণ কৃষক নেতা ইন্দরজিৎ সিং বলছিলেন, “নানান প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে আমরা প্রতিবাদস্থলগুলিতে এবং টোল প্লাজাগুলিতে আমাদের আন্দোলন টিকিয়ে রেখেছি। এ আমাদের এক বিরাট সাফল্য। এখন আমরা এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেব।” নিজেদের মধ্যে বজ্রকঠিন ঐক্য অর্জিত না হলে এই প্রত্যয় তো এমনি এমনি আসে না।
পবন দুগগল বলছিলেন, “আমাদের এই আন্দোলনই দেশকে দেখিয়েছে ধর্ম নিয়ে হানাহানি করার ওপরেও লড়াই করার মতো অনেক বিষয় রয়েছে।” বলছিলেন, “এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার মানুষ তাঁদের দীর্ঘদিনের জলবণ্টন সংক্রান্ত বিবাদ দূরে সরিয়ে রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।” এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন একতা উগ্রহন-এর মহিলা শাখার প্রধান হরিন্দার বিন্দুও। তাঁর কথায়— “মনে রাখবেন এই আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে এমন দুটি রাজ্য যাদের মানুষ অতীতে জলবণ্টন নিয়ে বিবাদে বা চণ্ডীগড় কাদের দখলে থাকবে সেই নিয়ে বিবাদে নিজেদের জীবন পর্যন্ত দিয়েছে।”
জাতপাতের ভেদাভেদ? ইন্দরজিৎ সিংয়ের কথায়, “আমার মতে আমাদের আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল, এই আন্দোলন জাতপাতজনিত ভেদাভেদির মুখে একটা সজোরে থাপ্পড় কষিয়েছে। … আজ আমরা হিসার-এর কৃষকদের সঙ্গে মিছিল করছি। সেই কৃষকরা সবাই বাল্মীকি এবং নাই সম্প্রদায়ভুক্ত। এরকম আপনারা কখনও ভাবতে পেরেছিলেন আগে?” ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (টিকায়েত)-এর ধর্মেন্দর মালিক বলছিলেন পশ্চিম উত্তপ্রদেশে মুসলিম এবং জাঠদের মধ্যে ঐক্য অর্জিত হওয়ার কথা। এই আন্দোলনই মুজফফরনগর দাঙ্গার পরবর্তীতে তৈরি হওয়া তাঁদের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের অতীত ভুলিয়ে দিয়েছে। যেমন, ঐক্যবদ্ধ হয়েছে রাজস্থানে জাঠ এবং গুর্জর সম্প্রদায়ও।
নারীদের অংশগ্রহণ
এটি বহু-আলোচিত বিষয়। কৃষক আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই যেভাবে নারী-কৃষকরা তাঁদের পুরুষ সঙ্গীদের সঙ্গে প্রতিটি কাজে কাঁধ মিলিয়েছেন তা প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী, এমনকি রাষ্ট্রও। দেশবাসী শ্রদ্ধাবনত হয়েছে তাঁদের প্রতি, আর রাষ্ট্র ভুরু কুঁচকেছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সেই ‘বয়স্ক এবং মহিলারা ওখানে কী করছেন?’ মন্তব্য স্মর্তব্য। হরিন্দার বিন্দু বলছিলেন:
“আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মহিলাদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু এই আন্দোলনে তাঁরা যে এইভাবে বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করবেন, এ আমাদের আশাতীত ছিল। এই প্রথম আমরা দেখলাম মহিলারা যে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন তাই নয়, তাঁরা রীতিমতো নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসছেন। তাঁরা বলছেন, জনগণের গুরুত্ব মোদির চেয়ে অনেক বেশি। … আমি আমার ১৫০০ গ্রামে প্রচার করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আন্দোলন যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, আন্দোলনে মানুষের বিশেষ করে মহিলাদের অংশগ্রহণও ততই বাড়বে। মহিলারা এখনও রিলায়েন্সের শপিং মল বা আদানির গুদামগুলির বাইরে ক্যাম্প করে রয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলির আরও শক্তিবৃদ্ধি হবে।”
জনসমর্থন
ইন্দরজিৎ সিং বলছিলেন, “এই আন্দোলনে আমাদের একমাত্র ক্ষতি— আমাদের অনেক ভাইবোন শহীদের মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁরা হয়তো নিজের নিজের বাড়িতে শান্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারতেন। আর অন্যদিকে, আমরা এটা দেখিয়ে দিয়েছি যে সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো যায়, এবং যদি মানুষ সঙ্গে থাকে তবে সেটা খুব কঠিন কিছু ব্যাপারও নয়।”
এই ‘মানুষ সঙ্গে থাকা’ নিয়ে সিংঘু-টিকরি-গাজিপুর সীমান্তে লাখো মণিমুক্তো ছড়িয়ে রয়েছে। ছড়াচ্ছে আজও— এই ২০০ দিন পার করেও। পবন দুগগল বলছিলেন, “যাঁরা এখনও আমাদের আন্দোলন নিয়ে সন্দিহান, তাঁরা এটা মনে রাখুন যে, সবাই মিলে এই ছ মাস ধরে সীমান্তে বসে থাকে না। যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের পেছনে থাকার অনেক মানুষ লাগে, এবং আমাদের সেই জনসমর্থন অটুট রয়েছে। যখন ঝড় বৃষ্টি শুরু হল, তখন শক্তপোক্ত টেন্ট বানানোর জন্য আমরা মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে টাকা জোগাড় করেছি। তাহলে বলুন, আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে একমত না হলে মানুষ কেন নিজের খাটনির পয়সা আমাদের দেবে?”
জনসমর্থন কীভাবে তাঁদের পক্ষে আসছে বিভিন্ন ছোটখাটো ঘটনার মধ্যে দিয়ে, বলছিলেন ইন্দরজিৎ। “সরষের তেল এখন বাজারে ২০০ টাকা কিলো। আমরা দেখলাম ফসল সংগ্রহের সময়ে পুরো ব্যাপারটা নিয়েই ধোঁয়াশা তৈরি করে সরষের বেশিটা অংশই বেসরকারি ব্যক্তি-পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া হল। তারপর সেই সরষে যখন দামী তেল হয়ে আবার বাজারে ফিরে এল, সরকার তখন গণবণ্টন ব্যবস্থার তালিকাভুক্ত জিনিসের মধ্যে থেকে সরষের তেল সরিয়ে নিল! সরষের তেল ছাড়া রান্না হয়? এইভাবেই মানুষ এখন সব বুঝতে পারছেন।” এবং সেই উপলব্ধির কথাই বলছিলেন ধর্মেন্দর মালিক— “এই আন্দোলনের সবচেয়ে অভিনব বিষয় হল, আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও মানুষ আমাদের প্রতিবাদের আহ্বানগুলিকে কার্যকর করছেন।”
উত্তরাখণ্ডের তরাই অঞ্চলের কৃষক নেতা জগতার সিং বাজওয়া বললেন, “আমরা অনেক পথ পার হয়েছি। নানান কুৎসা হয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে। আমাদের খলিস্তানি, নকশাল, মাওবাদী বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এরকমও বলা হয়েছে, এ নাকি স্রেফ এক রাজ্যের কৃষকদের আন্দোলন। আমরা আমাদের এই পথ পার হওয়ার পথে সেই সমস্ত অপবাদকেই আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছি। আসলে সরকার এটাই বুঝতে পারেনি যে এই আন্দোলন কোনও সংগঠনের বা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ-নিরপেক্ষ এক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। আর এই বিষয়েও আমরা দৃঢ়, যে আমাদের এই আন্দোলন অবশ্যই শান্তিপূর্ণ থাকবে। নির্বাচনের আগে এবং পরে আমরা আমাদের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য গণতান্ত্রিক পথগুলিকেই হাতিয়ার করব। আগামী ২৬ জুন আমরা গোটা দেশে রাজ্যপাল ভবনগুলির সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছি। সেদিন আমরা আরও একবার আমাদের জনসমর্থন দেখিয়ে দেব।”
সরকারের বিপন্নতা
কৃষকদের এই আন্দোলনকে কি সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না? এরকম একটা মনে হতে পারে, কারণ সংযুক্ত কিসান মোর্চার সঙ্গে সরকারের আলাপ-আলোচনা গত ২২ জানুয়ারির পর আর হয়নি, হবে যে, সেরকম কোনও সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সরকার এখনও পর্যন্ত তাদের অবস্থানে অনড় রয়েছে, এবং এই আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার জন্য, বা নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করার জন্য তার স্বভাবসিদ্ধ কপটাচারগুলি অভ্যাস করে যাচ্ছে। অন্যদিকে, কৃষকরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন— ‘ইয়েস অর নো?’ এই আইন তিনটে বাতিল করছ, না করছ না? এর মধ্যবর্তী কোনও কিছুতেই তাঁরা আগ্রহী নন।
দেখা যাক সরকারের মনোভাব সম্পর্কে কৃষকরা কী ভাবছেন।
পবন দুগগল বলছিলেন, “আমরা ২০০ দিন কাটিয়ে ফেলেছি। ফলে এটা নিশ্চিত যে আমরা খালি হাতে ফিরব না। কিন্তু ভেবে দেখুন গণতন্ত্রের জন্য এটা কী মর্মান্তিক একটা বিষয় যে মানুষ যখন রাস্তায় নেমে এসেছে, শুধু নামেইনি রাস্তাটাকেই রণক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছে, তখনও সরকার বোবা কালা হয়ে বসে রয়েছে।” বলেই তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “সরকারের এই অবস্থান কিন্তু এইজন্য নয় যে তারা আমাদের গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং এটা এই অবস্থার পরিচায়ক যে আমরা সরকারকে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে গেছি যে সেখানে সরকার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। তারা ইতিমধ্যেই আইসিইউতে ঢুকে পড়েছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে তাদের ধাত্রী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ মানুষের এই ব্যাপক ক্ষোভে আতঙ্কিত হয়ে ঘন ঘন মিটিং করে বেড়াচ্ছে।”
সরকারের এই বিড়ম্বনাকেই আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তোলাই এখন কৃষকদের লক্ষ্য। দুগগল জানাচ্ছিলেন যে রাজস্থানে একটা ব্যাপক প্রচার অভিযান চালানোর জন্য তাঁরা মোর্চার আহ্বানের অপেক্ষা করছেন। জগতার সিং বাজওয়া জানাচ্ছেন দিল্লি-সীমান্তের ধর্নাস্থলগুলি থেকে কৌশলগতভাবেই যুবকদের উত্তরাখণ্ডের গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে তাঁরা বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার জন্য প্রচার চালাবেন। ধর্মেন্দর মালিক বলছিলেন, উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের সামনে বিজেপিকে ভোটে উৎখাত করা ছাড়া এখন আর কোনও রাস্তাই নেই। “গণতন্ত্রে একটা সরকার যখন মানুষের ক্ষোভের কথা শোনা বন্ধ করে দেয়, তখন আপনি আর কী-ই বা করতে পারেন। মানুষ যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই তাদের ক্ষোভ ব্যক্ত করছে। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির মাত্র ১৮ শতাংশ আসন জেতা।”
শেষ কথা
শেষ করবও কৃষকদেরই কথা দিয়ে। গতকালই (১৮ জুন ২০২১), এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের ২০৪তম দিনে সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতৃমণ্ডলীর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি জারি করা হয়েছে। সেটি তুলে দিচ্ছি—
গতকাল রাতে সংযুক্ত কিসান মোর্চার একটি বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছিল, কৃষক আন্দোলনকে লাঞ্ছিত করার জন্য বিজেপি এবং তার সমর্থকদের প্রচেষ্টা তীব্রতর হচ্ছে। প্রতিবাদকারী কৃষকদের মিথ্যে অপবাদ দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা এবং যে কোনও ছুতোয় তারা এটা করতে চাইছে। তবে তাদের এই ব্যর্থ কৌশলটি অতীতের মত এবারেও আরও একবার অসফলই হবে।
সত্যাগ্রহই কৃষকদের পথ। কৃষি আইনগুলি সম্পর্কে তাঁদের বিশ্লেষণ, বোধ এবং পাশাপাশি তাঁদের আশা, শান্তিকামী মনোভাব এবং দৃঢ়তা এই লড়াইয়ে তাঁদের জয় নিশ্চিত করবেই। কাসার গ্রামের মুকেশের দুর্ভাগ্যজনক মামলাটি নিয়ে বিজেপি সরকার এবং সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের কিছু অংশ বাঁকা খেলা খেলছে। এই ঘটনায় দায়ের করা এফআইআরেও প্রশাসনের একই মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে।
খবরে প্রকাশিত, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং প্রতিবাদস্থলে ‘অনভিপ্রেত ঘটনা’ এবং “আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির” অজুহাতে, কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সংযুক্ত কিসান মোর্চা, আন্দোলনকে এই জাতীয় হেয় করার অপচেষ্টার জন্য সরকারকে সতর্ক করছে। এই জাতীয় প্রচেষ্টায় সরকার অতীতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে, এবং এবারেও ব্যর্থ হবে। কৃষকরা তাঁদের যে জীবিকার অধিকার চাইছেন— তা সংবিধানে সুরক্ষিত মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। তাঁরা কোনওভাবেই অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেননি। সরকার আন্দোলনকারীদের যুক্তিসঙ্গত দাবি মেনে নেবে, গণতন্ত্রে এটাই কাম্য। বিজেপি সরকার তা না করে, আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করছে, আন্দোলনের ওপর মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং আশা করছে যে এর ফলে এই আন্দোলন একদিন ম্রিয়মান হয়ে যাবে। এসকেএম জোর দিয়ে বলছে তাদের এই স্বপ্ন কখনওই সফল হবে না।
সরকারের এমএসপি-র মিথ্যা প্রতিশ্রুতি (জুমলা)-গুলিতে কোনও বাস্তব সমাধানের অস্তিত্ব নেই বুঝতে পেরে, সারা ভারতজুড়ে কৃষকরা দাবি করছেন যে— তাঁদের সকলের জন্য এমএসপি-র নিশ্চয়তাযুক্ত একটি আইন তৈরি হওয়া উচিত। গতকাল, মহারাষ্ট্রের ২০টি জেলার কৃষকরা সর্বভারতীয় কৃষক সভার আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রতি লিটার দুধের জন্য কমপক্ষে ৩৫ টাকা মূল্যের নিশ্চয়তার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। কোভিড মহামারি এবং লকডাউনের কারণে দুধের দাম লিটার প্রতি প্রায় ২০ টাকায় নেমে এসেছে।
এদিকে, বেশ কয়েকটি রাজ্যসরকার কৃষকদের দাবির প্রতি সদর্থক সাড়া দিচ্ছে এবং কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়াচ্ছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে তিন কৃষি আইন বাতিলের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। খবরে প্রকাশিত, মহারাষ্ট্র তার নিজস্ব রাজ্যে আইন সংশোধন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যাতে কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের কুপ্রভাব থেকে তাদের রাজ্যের কৃষক রক্ষা পান। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবাদী কৃষকদের দাবি পূরণের জন্য বলে আসছেন। অন্যান্য কয়েকটি রাজ্যে অন্যান্য দলগুলির নেতৃত্বাধীন সরকারগুলি কৃষকদের আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে এবং আন্দোলনকারী কৃষকদের দেশব্যাপী কর্মসূচির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। এমনকি বিজেপির নিজস্ব নেতারাও কেন্দ্রীয় সরকারকে কৃষকদের সমস্যা সমাধানের জন্য বলে আসছেন। সরকারের উচিত আন্দোলনকে অপবাদ দেওয়া ও আন্দোলনকারী কৃষকদের লাঞ্ছনা করার চক্রান্তে লিপ্ত না হয়ে, বিভিন্ন মহল থেকে আন্দোলনকারী কৃষকদের দাবি মেনে নেওয়ার যে যুক্তি উঠে আসছে, তাকে অগ্রাধিকারের সঙ্গে মর্যাদা দেওয়া।
ক্রমাগত অসংখ্য কৃষক বিক্ষোভস্থলগুলিতে আসছেন এবং প্রতিবাদকারীদের সংখ্যা হাজারে হাজারে বেড়ে চলেছে। গতকাল উত্তরাখণ্ডের জসপুর থেকে কয়েকশো কৃষক গাজিপুর সীমান্তে পৌঁছেছেন। বিকেইউ (টিকায়েত)-এর নেতৃত্বে একটি বিশাল দল পাঁচ দিন পায়ে হেঁটে আজ গাজিপুর সীমান্তে পৌঁছেছেন।
অতএব, ইতিহাস ইতিমধ্যেই বিরচিত, এখন চলছে তাতে নতুন নতুন গৌরবময় পৃষ্ঠা সংযোজনের কাজ। আসুন, আমাদের অন্নদাতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে “পৃথিবীর ইতিহাসে এই সুন্দরতম অধ্যায়”-এর সাক্ষী থাকি এবং সাধ্যমতো শরিক হই!
ঋণস্বীকার: নিউজক্লিক
সোমেনদা, দরকারি লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। আমার অভিজ্ঞতায় এই আন্দোলনের আরেকটি অসাধারণ অর্জন মনে হয়েছিল কৌম জীবনের শিক্ষাকে রাস্তার আন্দোলনে বাস্তবায়িত করা। প্রয়োজনভিত্তিক আদান-প্রদানের শিক্ষায় জারিত কৌমচেতনার শক্তিতে আন্দোলনটিকে দীর্ঘস্থায়ী রাখার ক্ষেত্রে কৃষকেরা যে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছেন তাতে মুগ্ধ হতে হয়।
এই প্রবন্ধের জন্য লেখক এবং চার নম্বর প্ল্যাটফর্মকে অনেক ধন্যবাদ। মূল মিডিয়ায় কৃষক আন্দোলনের খবর কোথায়? অল্টারনেটিভ মিডিয়াকেই এইভাবে উঠে আসতে হবে সঠিক ও প্রাসঙ্গিক খবরের উৎস হিসেবে।