দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী
মার্চ-এপ্রিলে যে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেল তার মধ্যে বাংলার নির্বাচনই সবচেয়ে বেশি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই রাজ্যে বিজেপি ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে ৪২টির মধ্যে ১৮টি লোকসভা আসন ও ৪০ শতাংশ ভোট হাসিল করে চোখধাঁধানো উত্থান ঘটিয়েছিল। এক মাস ধরে আট পর্বে প্রলম্বিত নির্বাচনের পুরো ছকটাই ছিল বিজেপিকে বিশেষ সুবিধা করে দেওয়ার জন্য। সম্পূর্ণ বশংবদ কেন্দ্রীয় সংস্থা, কেন্দ্রীয় বাহিনি এবং বিপুল অর্থবল ও মিডিয়ার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বিজেপির বাংলা জয়ের আয়োজন প্রায় নিশ্ছিদ্র করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু দিনের শেষে দেখা গেল প্রায় নাগালের মধ্যে চলে এসেও বাংলা জয় বিজেপির জন্য সুদূরপরাহতই থেকে গেল। ২০১৯-এর চূড়া থেকে সামান্য নেমে ভোট কমল দুই শতাংশ, আর আসন সংখ্যা আটকে গেল ৭৭এ।
২০১৯-এর হিসাবে লিড পাওয়া ১২১টি আসনের নিরিখে এটা উল্লেখযোগ্য অবনমন হলেও ২০১৬-র ফলাফলের তুলনায় এ অবশ্যই এক বিপুল উল্লম্ফন— ভোট শতাংশের হিসেবে প্রায় চারগুণ (১০.১৬ শতাংশ থেকে ৩৮.১ শতাংশ), আর আসন সংখ্যার হিসেবে পঁচিশ গুণ (৩ থেকে ৭৭)। তার থেকেও বড় ব্যাপার হল বিজেপি এখন বিধানসভার অভ্যন্তরে একমাত্র বিরোধীপক্ষ হিসেবে উঠে এল। বিধানসভার মল্লভূমিতে বিজেপি নিশ্চয় এই ‘নয়া সমীকরণ’ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে, নিজের অবস্থান সুসংহত করবে, আর একে কাজে লাগিয়ে বাংলায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্র করার অপচেষ্টা চালাবে। ওরা ইতিমধ্যেই বাংলার গণরায়কে ‘মুসলিম ভেটো’ তকমা দিয়ে দিয়েছে। রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সি ও রাজ্যের ভিতরে সংঘ-বিজেপি বাহিনির যোগসাজশে গণরায়কে নস্যাৎ করার ও উল্টে দেওয়ার এক মরিয়া অভিযান শুরু হয়ে গেছে।
নির্বাচনের ফলাফলের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যাচ্ছে বিজেপি প্রধানত নির্ভর করেছিল দ্বিমুখী রণকৌশলের ওপর— পরিচিতি-ভিত্তিক সামাজিক কারিগরি আর মুসলমান-বিরোধী মেরুকরণ— প্রথম দিকটির খাপে খাপে দ্বিতীয় দিকটিকে গুঁজে দিয়ে এক সর্বব্যাপী ছক বুনেছিল। এই দুইটি দিকের নিরিখেই বিজেপি ভালো মাত্রায় সফল হয়েছে, কিন্তু নির্ধারক সুবিধা পাওয়ার যে প্রত্যাশা তারা করেছিল তা আর শেষ পর্যন্ত হাসিল করতে পারেনি। টিএমসি প্রায় ১০ শতাংশ ভোট-ব্যবধানে বিজেপিকে আটকে দিতে সক্ষম হয়েছে যা টিএমসির ঝুলিতে এনে দিয়েছে বিজেপির প্রায় তিনগুণ আসন। একদম উত্তরের চারটি জেলা— দার্জিলিং, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি— বিজেপি প্রায় পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে, পশ্চিমের পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাদুটিতে জিতে নিয়েছে অধিকাংশ আসন, আর বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া নদীয়া ও দক্ষিণ দিনাজপুরে জিতেছে অর্ধেক সংখ্যক আসন। বাংলার বাকি অংশে, বিশেষত বৃহত্তর কলকাতায়, টিএমসির বিজয়-ঝড় বয়ে গেছে।
অন্যান্য অনেক দলের বিপরীতে টিএমসি অনেক বেশি মনোযোগ সহকারে দেওয়ালের লিখন পড়ার চেষ্টা করেছে। দু হাজার উনিশের লোকসভা নির্বাচনের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের চলার পথ প্রয়োজনমতো শুধরে নিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে সচেষ্ট হয়েছে। ক্রমবর্ধমান শাসক-বিরোধী মনোভাবের মুখে দাঁড়িয়ে টিএমসির গণসংযোগ প্রচেষ্টা বহু ক্ষেত্রে বিজেপির অনুপ্রবেশকে প্রতিহত করতে সাহায্য করেছে। টিএমসির কলঙ্কিত নেতাদের বিজেপিতে যোগদানও নিজেদের বোঝা হালকা করতে এবং শাসক-বিরোধী সেন্টিমেন্ট বিজেপির ঘাড়ে চালান করে দিতে তাকে সাহায্য করেছে। যে ডজন খানেক বিধায়ক দল বদলে বিজেপির টিকিটে নির্বাচন লড়েছিল তাদের মধ্যে মাত্র দুজন জিততে সক্ষম হয়েছে। এদের মধ্যে একজন নন্দীগ্রামের শুভেন্দু অধিকারী, যার জয় যথেষ্ট বিতর্কিত এবং ব্যবধান অত্যন্ত সামান্য।
টিএমসির ভেতর থেকে দল ভাঙানোর খেলা চালিয়ে ভোট বাড়াতে সক্ষম হওয়ার বদলে বিজেপির বরং ২ শতাংশ ভোট কমেই গেছে। অন্যদিকে টিএমসি তার ভোট প্রায় ৫ শতাংশ বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। স্পষ্টতই টিএমসির নিজস্ব ভোট ছাড়াও, বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত করতে উৎসুক ভোটারদের উল্লেখযোগ্য অংশকেই টিএমসি নিজের দিকে টানতে পেরেছে। বিজেপি-বিরোধী ভোটের এই মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী অবদান রেখেছে সুসংহত ফ্যাসি-বিরোধী অভিযান। বিহার নির্বাচনের অব্যবহিত পরে সিপিআই (এমএল) সুস্পষ্টভাবে বিজেপিকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার পরই এই বিতর্কের সূত্রপাত হয় এবং #নোভোটটুবিজেপি বা বিজেপি হারাও, বাংলা বাঁচাও স্লোগানের রূপে রাজ্য জুড়ে তা গুঞ্জনের মত ছড়িয়ে পড়ে।
সিপিআই (এম) ও তার পুরনো বামফ্রন্ট শরিকরা, কংগ্রেস এবং সদ্যগঠিত ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টকে নিয়ে গঠিত তৃতীয় শিবির ভোটের ফলাফলে অনেক পেছনের তৃতীয় অবস্থানে। সব মিলে প্রায় ১০ শতাংশ ভোট তারা পেয়েছে এবং একটি আসন জিতেছে। সিপিআই (এম) বা কংগ্রেস নয়, আসনটি পেয়েছে আইএসএফ (যারা আসলে বিহারভিত্তিক একটি দল রাষ্ট্রীয় সেকুলার মজলিস পার্টির নামে নির্বাচনে লড়েছিল)। সংযুক্ত মোর্চা নাম নেওয়া এই জোট পশ্চিমবাংলায় নিজেদের একমাত্র বিকল্প হিসেবে প্রচার করেছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে তাদের জনসভার মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা ছিল: আমরাই বিকল্প, আমরাই ধর্মনিরপেক্ষ, আমরাই ভবিষ্যৎ। বাংলার লড়াইটাকে অন্ততপক্ষে ত্রিমুখী করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই জোট। কিন্তু তার ধারেকাছেও গেল না বাস্তব ঘটনা। প্রায় ৯০ শতাংশ আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত হল মোর্চার।
নির্বাচনের আগে আমরা যখন বিজেপিকে পয়লা নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম, যখন বিজেপির বাংলা দখলের অভিযানকে প্রতিহত করার কথা বলেছিলাম, তখন সিপিআই (এম) যুক্তি দিয়েছিল যে এটা বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে লোকসভা নয়, এবং টিএমসি সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে জনরোষকে কেন্দ্র করেই রাজ্যের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। ‘বিজেপিকে পরাস্ত করতে আগে টিএমসিকে হারাও’— এই ছিল সিপিএমের আহ্বান, যার বার্তাটা ছিল টিএমসিকে হারিয়ে দেওয়াই আশু কর্তব্য। বিজেপি ও টিএমসি আসলে এক ও আঁতাত করে লড়ছে— এই ধারণা থেকে টিএমসি ও বিজেপিকে একাকার করে সিপিএম এক মনগড়া ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব খাড়া করে। আর পার্টির সমগ্র নির্বাচনী প্রচার এই মনগড়া নিশানাকে নিরন্তর আক্রমণ করতে থাকে। এমনকি যখন প্রশ্ন তোলা হয় যে যদি ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হয় তখন দলের অ্যাপ্রোচ কী হবে, তখনও বিজেপি আর টিএমসি মিলে সরকার গড়ুক— এই ছিল তাঁদের উত্তর।
রাজ্যে রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার মরিয়া প্রচেষ্টায় সিপিএম-এর তুরুপের তাস ছিল এবার নবগঠিত দল আইএসএফ। ২৮ ফেব্রুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশে বস্তুত এই নতুন পার্টির লঞ্চিং প্যাডে পর্যবসিত করে দেওয়া হয়। নতুন এই দলকে জোটের তৃতীয় বৃহত্তম অংশীদার হিসেবে জায়গা দিয়ে সিপিআইএম পশ্চিমবাংলার প্রেক্ষিতে আইএসএফকে সামাজিক ন্যায় ও বহুজন উত্থানের একটি মঞ্চ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এখানে এ কথা স্মরণে আনা দরকার যে জোটভুক্ত হওয়ার আগে টিএমসি ও এআইএমআইএম-এর সঙ্গেও আইএসএফ-এর কথাবার্তা চলেছিল। কংগ্রেস কিন্তু আইএসএফকে জোটসঙ্গী হিসেবে ঠিক মেনে নেয়নি, আর আইএসএফও শেষ পর্যন্ত বহু জায়গায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়।
নতুন এই দলটির পারফরম্যান্সের দিকে ভালোভাবে নজর করলে দেখা যাবে, সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করা যে ২০টি আসনে তারা ১০,০০০-এর বেশি ভোট পেয়েছে তার মধ্যে ১৭টি আসনে ২০১৬র নির্বাচনে সিপিএম বা বামফ্রন্টের অন্য শরিকেরা লড়েছিল। এই আসনগুলিতে ২০১৬তে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা মোট ভোট পেয়েছিল ১,২২৩,৮৭১, আর এবছর আইএসএফ/আরএসএমপি পেয়েছে ৭৫৭,৯৭৯ ভোট। দক্ষিণ ২৪ পরগণাতে কেবল দুটি আসনে (ভাঙড়, যেখানে তাদের প্রার্থী শেষ পর্যন্ত জিতেছে; আর ক্যানিং পূর্ব, যেখানে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে) তার ২০১৬ নির্বাচনে বাম প্রার্থীদের পাওয়া ভোটের থেকে সামান্য বেশি ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ, আইএসএফ/আরএসএমপি টিএমসির গণভিত্তিতে কোনও ফাটল ধরাতে পারেনি, পাঁচ বছর আগে বামপন্থীদের পাওয়া ভোটের উপরেই আজ আইএসএফ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আইএসএফের এই ফলাফল অবশ্যই বিজেপিকে হতাশ করেছে। আইএসএফ-এর দ্বারা মোর্চা মুসলমান ভোট ভাগ করে দেবে এবং তার ফলে বিজেপি সুবিধে পাবে— এই ছিল বিজেপির হিসেব। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। নবজাতক আইএসএফ মূলত সিপিআইএম/বাম সাপোর্টের ওপর ভর করে সামান্য কিছু বিস্তার ঘটিয়েছে, মিম কোনও দাগই কাটতে পারেনি, আর কংগ্রেস মুর্শিদাবাদ, মালদা আর উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় তার চিরাচরিত মুসলমান গণভিত্তিকেও ধরে রাখতে পারেনি। মুসলিম ভোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ টিএমসির পক্ষে চলে যাওয়ায় টিএমসির ব্যাপক জয়ের পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে সংযুক্ত মোর্চায় আইএসএফের প্রাধান্যকে বিজেপি তার মত করে কাজে লাগায়, এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফলে দু হাজার উনিশে বিজেপির দিকে চলে যাওয়া বাম ভোটের প্রত্যাবর্তনের আশাও আবার ধাক্কার মুখে পড়ে।
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে এখন সিপিআইএম যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করছে তা আগের ব্যাখ্যা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পার্টি এখন মেনে নিচ্ছে যে বাংলার এই নির্বাচনটা ছিল বিজেপি-বিরোধী নির্বাচন এবং টিএমসি ব্যাপকভাবে জয়ী হল কারণ তারাই বিজেপিকে হারাতে পারবে বলে মনে করেছে মানুষ। নির্বাচনের আগে কেন এই বিষয়টি ধরতে ব্যর্থ হল তারা? কেন নিজেদের বিজেপি-বিরোধী দৃঢ় শক্তি হিসেবে তুলে ধরল না? টিএমসি বিগত দশ বছর ধরে বাংলার ক্ষমতায় আছে। যদি এতদিন ধরে জমা হওয়া প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্ষোভকে সে প্রশমিত করে জয়ী হতে পারে তাহলে তার প্রাথমিক কারণ হল নিজেদের বিজেপি-বিরোধী অবস্থান ও বিভিন্ন কল্যাণ প্রকল্পের প্রভাব। টিএমসির এই দুটি শক্তিশালী দিককেই সিপিআইএম এমনভাবে নস্যাৎ করে দেয় যে তাদের বক্তব্য অন্তঃসারশূন্য ও বুলিসর্বস্ব হয়ে ওঠে এবং তা শেষ পর্যন্ত এমনকি নিজেদের কর্মী-সমর্থকদেরও সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
টিএমসি ও বিজেপির মধ্যে আঁতাতের এক মনগড়া ধারণার ওপর ভর করে সিপিআইএম ক্রমাগত ‘ম্যাচ ফিক্সিং’-এর গল্পটা চালিয়ে যায় আর সমস্ত কল্যাণ প্রকল্পগুলিকে নিছক চুরি হিসেবে নাকচ করে দেয়। আরএসএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কমিউনিস্টের কাছে যে মতাদর্শগত দৃঢ়তা ও ধারাবাহিকতা প্রত্যাশিত তা নিশ্চয়ই কেউ টিএমসির কাছে আশা করবে না, কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে টিএমসির বিজেপি-বিরোধী ভূমিকাকে অস্বীকার করা সম্পূর্ণ অবাস্তব। সিপিএম যখন রাজ্যে দীর্ঘ সময় ধরে শাসনক্ষমতায় ছিল তখন তার দুটো প্রধান প্রচার ছিল জনগণের আশু স্বার্থরক্ষা এবং রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা আদায় করা। আজ টিএমসিও নিজের মত করে সেই দুই প্রশ্ন— ফেডেরালিজম আর পপুলিজমের ওপরই নির্ভর করছে। টিএমসির পপুলিজমকে নিছক চুরি এবং প্রকৃত পরিবর্তন ও অধিকারের বিপরীতে সামান্য ভিক্ষাদান প্রকল্প হিসেবে নস্যাৎ করে সিপিআইএম আসলে বিরোধীপক্ষ হিসেবে সরকারকে দায়বদ্ধ করা ও নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার দায়িত্ব থেকেই সরে এসেছে।
ক্ষমতা থেকে নির্বাসিত হয়ে বিরোধী পক্ষের ভূমিকা পালনে সিপিএমের অনীহা বা ব্যর্থতা নিছক মানসিকতার প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা শুরু হয়েছে ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৪ সালে কেন্দ্রে যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরেছিল আর ইউপিএ সরকার গঠিত হয়েছিল, সংসদীয় ক্ষেত্রে সেবারই বামদেরও সবচেয়ে ভালো ফল হয়েছিল। যে দুটি প্রধান কারণে সেবার বাজপেয়ি-আডবানি জমানার অবসান ঘটেছিল তা হল গুজরাট গণহত্যার বিভীষিকা এবং বিজেপি প্রচারিত ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর বিপরীতে কৃষক আত্মহত্যা ও অনাহার মৃত্যুর নির্মম বাস্তবতা। মানুষের দেওয়া এই বার্তাটা কংগ্রেস কিছুটা গ্রহণ করেছিল, আর্থিক সংস্কারের ‘মানবিক মুখ’ ও সুরক্ষাকবচ সুনিশ্চিত করার কথা বলে ইউপিএ সরকার তখন বন অধিকার আইন, কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন বা খাদ্য সুরক্ষা আইনের মতো একপ্রস্থ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পশ্চিমবাংলাতে ঠিক সেই সময়েই সিপিএম উলটো পথে হাঁটতে শুরু করে, তার দৃষ্টি এবং উদ্যোগ তখন কেন্দ্রীভূত হয় শিল্পায়নের নামে জমি অধিগ্রহণ, এসইজেড গঠন আর বৃহৎ পুঁজি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার দিকে।
২০০৬ সালে পশ্চিমবাংলায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ জয় অর্জন করেছিল সিপিআইএম। এই বিপুল মাত্রার জয় কী অন্ধ তাত্ত্বিক অহঙ্কার ও চরম দাম্ভিক আচরণের জন্ম দিতে পারে আর দেখতে না দেখতে কীভাবে তা তিন দশকের এক সরকারের পতন ডেকে আনে তা আগামী বহু বছর বামপন্থীদের কাছে শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে। সিঙ্গুরের মাটিতে কৃষকের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ জ্যোতি বসুর মতো প্রশাসককে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমাদের কৃষকসভার নেতারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে!’ অশোক মিত্র অত্যন্ত আন্তরিক আগ্রহে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করেছিলেন সিঙ্গুর মডেলের কু-মন্ত্রণার বিরুদ্ধে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বিকল্প উৎস ও পন্থার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই সব পরামর্শ ও আইডিয়াকে ‘লুডাইট’ ও ‘নারদনিক’ বলে দেগে দিয়ে দাম্ভিকভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন সেদিনের সিপিএম নেতৃত্ব। গণতন্ত্র ও আলোচনার টেবিলে সমাধানের প্রশ্ন সামনে এনেছিল নন্দীগ্রাম। কিন্তু সিপিএম তার জবাব দিয়েছিল ‘দমদম দাওয়াই’ (ষাটের দশকে মুনাফালোভী মজুতদারদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অ্যাকশনের শ্লোগান)-এর নামে পুলিশি নির্যাতন, গণহত্যা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে সমর্থন করে, ‘আমরা ২৩৫ ওরা ৩০’ মার্কা অহঙ্কারে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়ে।
১৯৭৭ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার তাগিদই বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় এনেছিল। জমি বিতরণ ও অপারেশন বর্গার মাধ্যমে, নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে, জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলে বামফ্রন্ট সরকার তার সামাজিক সমর্থনকে শক্তিশালী ও সংহত করে তুলেছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্যায়ে এসে এই সমস্ত অর্জন ধূলিসাৎ হতে শুরু করে, বামফ্রন্টের সামাজিক সমর্থনে ফাটল ধরে, তিন দশক ধরে যে গ্রামীণ গরীব ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী মহলের সমর্থন এই ক্ষমতাকে ধরে রেখেছিল তা সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। এবারের নির্বাচনী প্রচার দেখিয়ে দিল যে সিপিআই (এম) তার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের সংবেদনহীন দাম্ভিকতার জালেই এখনও আবদ্ধ হয়ে আছে।
‘উন্নয়নের সিঙ্গুর মডেল’-এর সঙ্গে এসেছিল এক অদ্ভুত স্লোগান, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি/শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। যে স্লোগান এই পর্বেও সিপিএম আউড়ে গেছে।
যে হুগলি জেলাতে সিপিআইএম সিঙ্গুরকে এক ‘শিল্পসমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ’ হিসেবে তুলে ধরেছিল, সেই জেলারই যে এক উজ্জ্বল ‘শিল্পময় অতীত’ ছিল তা কি আমাদের মনে নেই? পাট, কাগজ, রাসায়নিক ও কারিগরি শিল্প ছাড়াও সেখানে ছিল অটোমোবাইল শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি বড় ইউনিট, বিড়লা গ্রুপের অ্যাম্বাসাডর গাড়ি তৈরির হিন্দমোটর কারখানা ও সাহাগঞ্জের ডানলপ টায়ার কারখানা। এই কারখানাগুলো যেখানে একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে সেখানে শিল্পের নামে জোর করে বহুফসলি জমি দখল করে তাকে শিল্পায়ন ও উন্নয়নের উৎসব হিসেবে মানুষ কী করে মেনে নেবে?
আজ তো গুজরাটেও সেই ন্যানো গাড়ি আর তৈরি হচ্ছে না, টাটারা নিজেরাই সেই প্রকল্পকে এক ভ্রান্ত আইডিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে, অথচ সিপিআইএম আজও সেই ‘সিঙ্গুর সিন্ড্রোমেই’ আটকে রয়েছে। আজ কৃষি গভীর সঙ্কটে এবং সেই সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে সরকার কৃষি বিপণন ও উৎপাদন এবং সেই সুবাদে ব্যাপক ভূমি সম্পদকে কর্পোরেট হাতে তুলে দিতে মরিয়া, অন্যদিকে এর বিপরীতে কোম্পানি রাজের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ব্যাপক কৃষক জাগরণ। বেসরকারিকরণ প্রতিরোধ আজ আর শুধু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অ্যাজেন্ডা নয়, ব্যাপক সামাজিক প্রশ্ন। এমন অবস্থায় সকলের জন্য স্বাস্থ্য, সকলের জন্য শিক্ষা, সব হাতে কাজের দাবিতে দেশজোড়া এক বড় আন্দোলনের পথে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রযুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার বিপরীতে সিপিএম এবারের নির্বাচনেও সেই ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যত’-এর ফাঁপা বুলিতে আটকে রইল।
নির্বাচন পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ আজ এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। ছলেবলে কৌশলে বাংলা দখল করার বিজেপির উদগ্র অভিযানের বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলা এক জোরালো রায় দিয়েছে। কিন্তু বিজেপি এই রায় মেনে নিতে রাজি নয়। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সঙ্ঘ-বিজেপির আগ্রাসন আরও উগ্র চেহারা নিয়েছে। ‘হিন্দু-বিরোধী হিংসা’ ও আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মিথ্যা রব তুলে এবং যাবতীয় কেন্দ্রীয় সংস্থাকে নির্লজ্জভাবে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে বিজেপি বাংলাকে অস্থির করে তুলতে বদ্ধপরিকর। রাজ্যপাল রাজ্যের বিজেপি নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে হাত মিলিয়ে এই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পশ্চিমবাংলার বামপন্থীদের এই গেমপ্ল্যানটা বুঝতে হবে এবং চোরা পথে বাংলার গণরায়কে উলটে দিতে বিজেপির এই শয়তানি ছকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। রাজ্য সরকারকে অবশ্যই তার প্রতিশ্রুতি পালনে দায়বদ্ধ করতে হবে, কিন্তু তা করতে হবে বাংলার মাটিতে সর্বভারতীয় ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধের মজবুত ঘাঁটি গড়ে তুলেই।
এই সন্ধিক্ষণে এই দায়িত্ব পালন করতে বামপন্থীদের অবশ্যই শুধু বিজেপি নয়, বরং আরএসএস-এর বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সমাজের যে বঞ্চিত অংশের মাঝে ও প্রত্যন্ত এলাকায় আরএসএস ঘাঁটি গাড়তে চাইছে সেখান থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিরুদ্ধে কার্যকর রণনীতির বেশ কিছু উপাদান আমরা এই নির্বাচনেও প্রত্যক্ষ করেছি। এই উপাদানগুলিকে বিকশিত ও সংহত করা আজ সময়ের দাবি। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিসমাবেশ অনেক দুর্বল হয়ে গেলেও, বিজেপির কর্পোরেটমুখী ধনিকপ্রেমী স্বরূপকে উন্মোচিত করে ব্যাপক গরীব মেহনতি মানুষকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। বিজেপির নারীবিদ্বেষী রাজনীতির বিরুদ্ধে মহিলারা এই নির্বাচনে যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন, নারীর সম্মান, স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রশ্নে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তুলে সংঘ বাহিনিকে প্রতিহত করতে হবে।
এই নির্বাচনে বিজেপিকে রুখে দিতে জোরালো ভূমিকা রেখেছে বাংলার প্রগতিশীল ও বহুত্ববাদী ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের প্রাণবন্ত ধারা। মতাদর্শের ময়দানে সংঘবাহিনীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিদ্বেষমূলক বিষাক্ত অভিযানের বিরুদ্ধে বাংলার বামপন্থী চেতনা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস আজও শক্তিশালী প্রতিরোধের প্রাচীর। নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে এই সমস্ত উপাদানকে সমাবেশিত ও সমন্বিত করে বাংলার মাটিতে বিজেপিকে আবার বিচ্ছিন্ন করতে হবে। বিধানসভার বাইরে জনগণের যাবতীয় সঙ্কটে ও গণতন্ত্রের প্রতিটি প্রশ্নে গণ-উদ্যোগ ও গণ-আন্দোলনের ময়দানে বামপন্থীদের সংগ্রামী ভূমিকাকে উজ্জীবিত করে তুলে বিধানসভায় বামপন্থীদের অনুপস্থিতিকে ছাপিয়ে যেতে হবে।
তিনু দালাল
কাল কালীঘাট খুলেছে, আজ দক্ষিণেশ্বর। ইস্কুল খুলবে না, পরীক্ষা হবে না। বেসরকারী অফিস খুলেছে, পরিবহন নেই। বাপ লরিতে গাদাগাদি করে রোজগার সেরে ফিরছে দশ ফুট বাই দশ ফুটে। মা বাজারে চূনোমাছ কিনছে। মন্দির মসজিদ খুললেও গরীবের ভাগ্য ফিরছে না। অস্বচ্ছ তালিকায় শিক্ষক নিয়োগ।
*
২০১২ আর ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষার নিয়োগ যদি ২০২১এ হয়, সে সরকারের ব্যর্থতার সাইনবোর্ড দরকার নেই। নয়ত অমৃতাভ চৌধুরীর মত স্মৃতিভ্রম। ৬০টাকার তেল দাদা পেট্রলে ১০০, দিদি সর্ষেতে ২০০। Evilএর কোন greater lesser হয় না। ঘুষের তালিকার মেধা ভিত্তিক পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
*
দুধওয়ালা গোবিন্দ হাজরা তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান হয়ে কয়েক শো কোটির মালিক হয়ে গেলেন। ভাইপোর দোস্ত অমিত মিশ্র কয়লা আর গরু পাচার করে ভানুয়াতুরে বাস করেন। ভাইপোর প্রাসাদ শান্তিনিকেতন। দশ বছর দূর্নীতির সাগরে ডুবেও গরীবগুলোকে প্রশান্ত কিশোর ভেল্কি দেখিয়ে দিলেন।
*
মমতা কখনও মোদীর বিকল্প নন। যেদিন সিবিআই রাজীব কুমারের পেটের ভিতর থেকে লাল ডাইরি, পেন ড্রাইভ বার করে আনবে, সেদিন বুঝবেন, দাদা দিদি দুই ডালে। তার আগে দুই ফুলে কোন ভুল নেই। নারদের মামলা কোথায় হবে তা ঠিক করতেই ৫বছর কেটে যাবে। দাদা-দিদির দুর্বৃত্তরাজ চলবে।