অনির্বাণ চন্দ
অজাতশত্রু
বুকু কিছুই পারে না। গায়ে-গতরে তাগড়া নয়। পড়ায় মন নেই। বাইরের লোক তো বটেই, তাকে তার বাপ-মা কেউই পছন্দ করে না। বারো বছর বয়েস, অথচ হাবে-ভাবে যেন অনেক বেশি। কিশোরের বয়েস কখন যে বেড়ে যায়, তারা জানতেও পারে না। বয়স বাড়লে কিশোররা কি বাবা হয়ে যায়?
বুকু সেই কাকভোরে ওঠে। পাশবালিশ নেই তার। মা বাবা কেউ কাছে শোয় না। তাদের আলাদা ঘর। ভাইটাকে জড়িয়ে ঘুমায় রাতে। পাঁচ বছরের ছোট্ট ভাইটার ঘুমন্ত মুখটা সকালে দেখলে তার কিশোর হৃদয় আরেকটু ভিজে যায়। সযত্নে ভাইয়ের মুখ থেকে গড়ানো লাল-ঝোল মুছিয়ে দেয়। বেলা বাড়লেই ভাইটাও তার থেকে দূরে সরে যায়।
কয়েকদিন হল, বুকু শুনতে পাচ্ছে, বাবা মা তাকে নিয়ে কথা বলছে। সব কথা বোঝে না সে। তাও, কাল যখন রাতে বাবা মাকে বলছিল, “আর কতদিন লাগবে? বারো বছর পার হয়ে গেল, এখনও কথা নেই মুখে…”, বুকুর খুব কান্না পেয়েছিল। মাও একটু ফুঁপিয়ে উঠেছিল বোধহয়।
বুকু বোবা। পাড়ার ছেলেগুলো তাকে ক্ষ্যাপায়। ‘গুঁ-গুঁ’ করে পেছনে টিটকিরি মারে। বুকু কাউকে কিছুই বলে না। ক্লান্তভাবে হাসে। চলে যায় দৃশ্যটা থেকে। রোজ।
কয়েকদিন পর থেকে তাকে অন্য ইস্কুলে যেতে হবে। সেটা নাকি হোস্টেল। বুকু সেখানেই থাকবে। বাবা আজ বলেছে। বুকু কিছুই বলেনি। শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিল খানিকক্ষণ। মা কাঁদছিল। মাকে কাঁদতে দেখলে তার খুব কষ্ট হয়।
বাড়ি থেকে একটু দূরেই একটা এঁদো পুকুর। তার গায়েই একটা নারকেল গাছ। এরাই বুকুর একমাত্র বন্ধু। অন্যান্য দিনের মতো আজকেও সে সবার চোখ এড়িয়ে এখানে চলে এসেছে। কয়েকদিন পর থেকে আর দেখা হবে না ওদের সঙ্গে। বুকু গাছটার গুঁড়ির কাছে বসে। ঠেস দিয়ে। পায়ের কাছেই জলের স্পর্শ।
চারদিকে চোখ চেয়ে দেখে নেয় সে, কেউ কোথাও নেই তো? তারপর রোজের মতো জলের আয়নাতে মুখ রাখে। হাসে। প্রতিবিম্বটাও হাসে। সে প্রতিবিম্বের সামনের দুটো দাঁত বেজায় বড়। ঠিকরে বের হয়ে আসে। বড্ড বিশ্রী দেখতে লাগে।
রোজের মতোই জলে হাত দিয়ে ছবিটা ঘেঁটে দেয় ছেলেটা। এক ছুটে দৌড়ে চলে যেতে চায়। পারে না।
বুকুর কান্নার কোনও আওয়াজ হয় না।
একটি নীলাভ মানুষ
মনোহরবাবুর আজ অফিসে শেষ দিন। খুব একটা যে কেমন-কেমন লাগছে তা নয়। তবে খানিকটা আজব তো লাগছে বটেই। এমনিতে মাথায় তেল দেন না। কিন্তু আজ সকালে চান করতে গিয়ে কেন জানি ভুল করে মাথায় তেল দিয়ে ফেলেছেন। সাদা হয়ে আসা একমাথা চুল খানিকটা হলেও চকচক করছে। অনেক জল ঢেলে, শ্যাম্পু মেরেও আড়াল করতে পারেননি আর। আকাশী শার্টটা পরেছেন আজ মনোহরবাবু। অন্যান্য দিনে সাদা শার্ট পরেন। আজ সামান্য সাজুগুজু করাই যায়! যাক গে, লাস্ট ডে। কে আর দেখবে তাঁকে?
একটা ওয়েসিসের মতো একলা মানুষ মনোহরবাবু। বিয়ে-শাদি করেননি। তিন কুলে কেউ আছে কি না, মনেই নেই। অফিসেই একমনে কাজ করতেন। কাজের মেয়েটা একবেলায় দুবারের রান্না করে যায়। বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার ক্লাবে একবার ঢুঁ মারেন। কয়েক দান তাস, দু-এক কাপ চা, গোটা তিনেক সিগারেট, সামান্য কিছু কথাবার্তা। তারপর বাড়ি। জামাকাপড় ছেড়ে সে সব ধুয়ে ফেলে, পরের দিনের প্যান্ট-জামা রেডি করে, খাবার গরম করে খেয়ে নেন। তারপর শুয়ে পড়েন। বিশেষ কিছু পড়াশোনার শখ নেই। কাগজটাই সম্বল। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েন। এই রুটিনে সামান্যই বদল হবে কাল থেকে। একা মানুষের রুটিন বদলে গেলেও জানা যায় না সহজে।
দিনটা বেশ আচমকাই কেটে গেল। একতোড়া ফুল, একটা সোনালী হাতঘড়ি, একটা বড় গিফট আর অনেক শুভেচ্ছা নিয়ে সন্ধে ছটায় ফেরার বাস ধরবেন ভাবলেন মনোহরবাবু। ধরলেন না। হাঁটা দিলেন। আজ দেরি হলেই বা কী!
আপনমনে হাঁটতে-হাঁটতে কখন যে অনেকদূর এসে গেছেন, বুঝতেও পারেননি। জায়গাটা বেশ ফাঁকা। একটা মাঠ দেখতে পাওয়া যায়। তার মাঝখানে একটা একলা গাছ। ঝুপঝুপে রাত হয়ে এসেছে। রাস্তার আলোগুলো বেশ টিমটিমে। রাতের নীল আকাশে উঁকি দিচ্ছে জ্যোৎস্নাময় চাঁদ।
আজ পূর্ণিমা নাকি?
মনোহরবাবু সেই গাছটার দিকে এগোলেন। কেউ কোথাও নেই। গাছটার গুঁড়িতে বসলেন।
পকেট থেকে বের করলেন একটা পুরনো কাগজ। ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে অনেকটাই, তাও বয়ান তাঁর মুখস্থ। মনে-মনে পড়তে লাগলেন। অপার চিঠি। তাঁর অপরাজিতার।
“যেদিন আমরা দুজনেই বুড়ো-বুড়ি হয়ে যাব, সেদিন আকাশময় নীল জ্যোৎস্না লেগে থাকবে। কালো বলে আজ মেনে নিল না কেউ, কিন্তু সেইদিন এই কালো অপাকেই দেখবে কেমন নীল লাগে…!”
অপরাজিতার ছুটি হয়েছে কি না, মনোহরবাবু জানেন না। তিনি চিঠিটা কুটি-কুটি করে ছিঁড়ে ফেললেন। উড়িয়ে দিলেন নীলচে জ্যোৎস্নায়। টুকরো-টুকরো স্মৃতিগুলো বাতাসে ফরফর করে ভাসতে লাগল।
মনোহরবাবু মৃদুস্বরে বললেন, “হ্যাপি বার্থডে, অপা…।”
মাল্যদান
সূর্য ডুববে-ডুববে, কিন্তু পুরো সন্ধে নামেনি। ডিফিউজড আলোয় ভিজে আছে চারদিক। অবিনাশবাবু বাজার যাচ্ছেন।
অবিনাশ মিত্রের রাস্তার ওপারেই বাড়ি। দক্ষিণ কলকাতার বুকে খাস উত্তর কলকাত্তাই স্টাইলে ভাঙাচোরা বনেদি বাড়ি। দরজায় প্রায় ঘোলাটে হয়ে আসা একটা নেমপ্লেট লাগানো আছে, ‘অবিনাশ মিত্র ও পরিবার’।
কাল রাতেও পারমিতার সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে বিস্তর। অক্টোবরের শুরু, শীত লাগে খুব। নিচতলা থেকে উপরে উঠে গেছিলেন পারমিতার কাছে, বহুদিন পর…
কে যেন মোবাইলে গান বাজাচ্ছে:
“যা পেয়েছি আমি তা চাই না/যা চেয়েছি কেন তা পাই না?”
অবিনাশবাবু এক মিনিট দাঁড়ালেন। খামোখাই চশমাটা খুলে নিয়ে ঘষে-ঘষে মুছতে লাগলেন।
চোখে দিতেই স্পষ্ট হল চারদিক।
ট্রামলাইন পেরোতে হবে। ওই ফুটে বাজার। গানের শব্দগুলো ঝেড়ে ফেলে অবিনাশবাবু রাস্তার ডান-বাম দেখে পেরিয়ে ট্রামলাইনে উঠলেন।
‘টিং টিং টিং’।
একটা ট্রাম হুস করে সামনে দিয়ে চলে গেল।
বাজার সেরে নিতে আধঘণ্টার বেশি লাগল না। কী ভেবে একগোছা বেলীফুলের মালা কিনে ফেললেন অবিনাশবাবু। পারমিতা ভালোবাসে…
আর, নিজের জন্য কিনলেন কয়েকটা কমলালেবু।
ফিরতি পথে আবার রাস্তা পেরিয়ে ট্রামলাইন। দাঁড়ালেন। ম্লান অন্ধকারে অচেনা কোলাহলময় শহর। অস্পষ্ট হেডলাইট। ট্রাম আসছে…
কেউ দেখছে না তো?
অবিনাশবাবু হেরো লোকের হাসি গোপন করলেন। তারপর পা বাড়ালেন।
কবিতার মতো হেঁটে যাওয়া তিনটে গল্প। ভালোবাসলাম।