অনলাইন শিক্ষা: শিক্ষাসংহার ও কিছু বিকল্প প্রস্তাব

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

 


প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পরিবেশবিদ

 

 

 

Political myopia is the only explanation for the opinion existing among certain school workers that this is NO TIME to bother about studying and that the demands of education for all may be deferred to another time. On the contrary, the struggle for education for all is the political fighting task of the day for all public education workers.

–Franz Fanon, The Wretched of the Earth

অনলাইন “শিক্ষা” এবং পরীক্ষা না নেওয়া বা বিচিত্র কায়দায় মুল্যায়ন পদ্ধতি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ল। আমাদের রাজ্য, আমাদের দেশ, বস্তুত সারা পৃথিবীর এই বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে বিপুল তথ্য আমাদের হাতে জমা হল, তার ভিত্তিতে আমাদের দুঃখের সঙ্গে সিদ্ধান্তে আসতে হচ্ছে যে অনলাইন শিখনপদ্ধতি, সেই পদ্ধতিতে পাঠদান, অনলাইন পরীক্ষাপদ্ধতি এবং আজকের দিনে, অন্তত আমাদের রাজ্যে যে অলিখিত “খোলা-বই পরীক্ষা” পর্ষদ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রত্যক্ষ মদতে চলছে, তার সার্বিক ব্যর্থতা এখন প্রকাশ্যে এসে গেছে। তাই শিক্ষাসংহারের এই ভয়ানক ব্যবস্থার কেন বিরোধিতা করা উচিত, সেই বিষয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

মূলত তিনটি দিক থেকে আমরা উপরিউক্ত  বিষয়গুলির বিরোধিতা করি।

বিরোধিতার প্রথম স্তরটি আসছে শিখনপদ্ধতি বা “পেডাগজি” ও শিক্ষাবিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে।

আবহমান কাল থেকে শিক্ষক ও পড়ুয়া, তাঁরা পরস্পরের কাছাকাছি থেকে, নিবিড় ব্যক্তিগত সংযোগের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণের কাজ সম্পন্ন করবেন— সমাজবদ্ধতার আদিকাল থেকেই এই পদ্ধতিতেই মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে এসেছে। এই পদ্ধতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আজকের বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাকে সর্বজনীন চরিত্র দেওয়ার জন্য ক্রমে ক্রমে এসেছে পাঠক্রম, শিক্ষাক্রম, শিক্ষার বিভিন্ন স্তর, শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় এবং এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এসেছে সংলগ্ন বিষয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকের ধারণা। এমনকি শিক্ষকদের শিক্ষাদান প্রণালী শেখানোর জন্য এসেছে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান। আজকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান পদ্ধতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পড়ুয়া ও শিক্ষকের মধ্যে সংযোগের বিষয়টি সারা পৃথিবীর সব শিক্ষাপদ্ধতির সাধারণ ভিত্তি, যাকে আমাদের কর্তাব্যক্তিরা ব্যবস্থাপনাবিদ্যার ধাঁচে নাম দিয়েছেন “এফ২এফ”, যা আসলে “ফেস টু ফেস”-কে একটু কায়দা করে উপস্থাপিত করা!

সময়ের সঙ্গে শিক্ষাদান পদ্ধতিকে যথাযথ ও সুপ্রযুক্ত করার জন্য এই শিক্ষক-পড়ুয়ার সংযোগকে আরও ভালো করে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এসেছে নান ধরনের সহায়ক পদ্ধতি, যা মূলত সমসাময়িক প্রযুক্তি-নির্ভর। যেমন, এক সময় যত এগিয়েছে, চক ও বোর্ড প্রণালীতে শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য এসেছে লেখচিত্র আঁকার বোর্ড, মানচিত্র টাঙানোর ব্যবস্থা, মডেল প্রদর্শন ইত্যাদি। এই সবগুলিকেই বলা যেতে পারে স্থাণু পদ্ধতি, স্থির বস্তুর সাহায্যে শিক্ষাদাতা ও পড়ুয়াদের মধ্যে সংযোগকে নিবিড়তর করার আকাঙ্ক্ষায়। পরবর্তীকালে এসেছে ছবি দেখানো, সহায়ক বই এবং আজকে এসেছে মাল্টিমিডিয়া এবং তাকে ব্যবহার করে অনলাইন শিখন পদ্ধতি। কিন্তু এগুলি সবই সহায়ক পদ্ধতি, তা মোটেই শিক্ষক-পড়ুয়া-কেন্দ্রিক মূল শিক্ষাদান পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপিত করে না, বা যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছিল, এই সহায়ক প্রণালীগুলি তার কোনও সুসংহত বিকল্প নয়।

প্রশ্ন উঠবে, কেন এইসব “আধুনিক পদ্ধতি”-কে এককথায় নাকচ করার কথা বলা হচ্ছে। যুক্তিগুলো সহজ এবং সময় দ্বারা পরীক্ষিত যুক্তি।

প্রথম যুক্তিটি খানিকটা এই ধরনের। এক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক পড়ুয়ার জন্য একইরকম সুযোগ তৈরি করে শিক্ষাদান পদ্ধতি নির্মাণ সম্ভব। সকল শিক্ষার্থী একটি সাধারণ শিক্ষা পরিকাঠামো অন্যান্য আর সকল পড়ুয়াদের মতো একইরকমভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, ফলে শিক্ষায় সামাজিক বৈষম্যের ছাপ অনেকটা হ্রাস পায়। এখানে সমান সুযোগ কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণের জন্য পড়ুয়াদের প্রত্যেককে তাঁর নিজের খরচায়, তাঁর নিজের জন্য পরিকাঠামো নির্মাণ করে নিতে হয়, যা সম্পূর্ণতই আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর, যে কাঠামো পরিনির্মাণের জন্য পড়ুয়াকে তৃতীয় কোনও পরিষেবা প্রদানকারীর ওপর আর্থিক মূল্যের ভিত্তিতে আবশ্যিকভাবে নির্ভরশীল থাকতে হয়। এতে যে শুধু শিক্ষায় সাম্য বিঘ্নিত হয় তাই নয়, সমাজে বিদ্যমান আর্থিক সহ অন্যান্য অসাম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে তা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে, যা শিক্ষাবিজ্ঞান-বিরোধী একটি প্রকল্প।

অপর যুক্তিটি কম ওজনদার নয়। অনলাইন প্রক্রিয়ায় শিক্ষাদান পদ্ধতি একান্তই প্রযুক্তি-নির্ভর হওয়ায় শিক্ষক ও পড়ুয়া, এই উভয়পক্ষকেই সেই প্রযুক্তিটিতে স্বচ্ছন্দ হতে হয়, যা শিক্ষকদের পক্ষে যেমন, পড়ুয়াদের পক্ষেও তেমনি এমন একটি বাড়তি দক্ষতা দাবি করে যার কোনও সুসংহত প্রশিক্ষণ এই অনলাইন পদ্ধতি আচমকা চালু হওয়ার আগে দু পক্ষের কাউকেই দেওয়া হয়নি। মনে রাখতে হবে আমাদের বিএড শিক্ষায় এই অনলাইন প্রশিক্ষণের কোনও ব্যবস্থাই নেই। বস্তুত, এই প্রণালীতে পাঠদান মসৃণ করার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোনও বাস্তব অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণের কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাও নেই। আমাদের এখানে সময়ে সময়ে পাঠক্রম পরিবর্তনের ফলে যখন শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যবস্তুর পরিবর্তনের সঙ্গে পাঠদান পদ্ধতির পরিবর্তন আবশ্যিক হয়ে পড়ে, তখন সেই সাবেকি পদ্ধতির জন্যও শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক বা এনসিএফ অনুসারী যে নতুন শিক্ষাক্রম বিদ্যালয় স্তরে বর্তমানে চালু আছে, তার ফলে সাবেকি শ্রেণিকক্ষভিত্তিক পাঠদান প্রণালীতে যে যে পরিবর্তনের সুপারিশ ছিল, তার পাঁচ শতাংশও এখনও পশ্চিমবঙ্গে রূপায়িত হয়নি। শিক্ষকদের জন্য সব বিষয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতির বাস্তবসম্মত ম্যানুয়াল আজও তৈরি হয়নি, যতটুকু হয়েছে তার ক্রমাগত মাজাঘষা করা হয়নি, সব কটি বিষয়ের জন্য শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার নতুন বিষয়গুলি প্রাঞ্জল করার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ সংঘটিত করা যায়নি, শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য যে পাঠক্রম আছে, তা স্কুলশিক্ষকদের জন্য একরকম বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও সেখানে মূলত শ্রেণিকক্ষভিত্তিক পরিবর্তন প্রয়োজনীয় মাত্রায় অন্তর্ভূক্ত করা যায়নি, অনলাইনের প্রশিক্ষণের তো কোনও প্রশ্নই নেই। শিক্ষাদান পদ্ধতির এইরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় গোটা রাজ্যের শিক্ষা ও পাঠদানে অনলাইন পদ্ধতির রূপায়ণ শিক্ষার সামগ্রিক উদ্দেশ্যের বিপরীতে কাজ করবে।

পাশাপাশি এটাও বোঝা দরকার যে সারা দেশের মতো আমাদের রাজ্যেও বিভিন্ন স্তরে শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে এক বিপুল বৈচিত্র্য। স্কুল স্তরে রয়েছে অন্তত চারটি ভিন্ন কর্তৃপক্ষ (রাজ্য বোর্ড, বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যম ছাড়াও অন্যান্য ভাষাভিত্তিক মাধ্যম, এমনকি একই বিদ্যালয়ে সমান্তরালে দুটি মাধ্যমের শিক্ষাক্রম চলে, দুটি ইংরাজি মাধ্যমের বোর্ড, আইসিএসসি, সিবিএসসি; এছাড়া রয়েছে রাজ্য মাদ্রাসা বোর্ড, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্কুল, আরবি মাধ্যমের স্কুল, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং আরও হরেক রকমের ধর্মীয় সংরক্ষণের নিজস্ব স্কুল ইত্যাদি), প্রত্যেকের একই স্তরের শিক্ষার জন্য নিজস্ব পাঠক্রম, শিক্ষাদানব্যবস্থা, পরীক্ষাব্যবস্থা, সময়সীমা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নিজস্ব পাঠ্যপুস্তক। স্কুলশিক্ষার পর স্নাতক স্তরের পেশাগত পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য রাজ্য স্তর বা জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার জন্য যে পাঠক্রম, তার সঙ্গে সারা দেশের ১২ ক্লাসের প্রায় কোনও পাঠক্রমের মিল নেই। ফলে এই পরীক্ষাগুলির জন্য প্রায় সমান্তরাল “কোচিং ব্যবস্থা”। অনলাইন পাঠদান পদ্ধতিতে এই বিপুল বৈচিত্র্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে শিক্ষাদান কার্যত অসম্ভব বিষয়।

এরপর যোগ করা যাক মূল্যায়নের পদ্ধতির বিষয়টি। স্কুল স্তরে মূল্যায়নের পদ্ধতিও পালটে গেছে খাতায়কলমে। এখন বোধমূলক ও জ্ঞানমূলক, এই দুধরনের শিক্ষা আহরণের ওপর আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার কথা এবং সেই মর্মে সুসংহত নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে তিন-চার ভাগে অন্যান্য শ্রেণিতে এবং দশ ও বারো ক্লাসে শেষ বছরেও বিভিন্ন বোর্ডে এই মূল্যায়ন পাঠাতে হয়, যে নম্বর শেষ পরীক্ষার নম্বরের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়। এর মধ্যে থাকে প্রকল্প রচনা থেকে শুরু করে গোষ্ঠীবদ্ধ কাজ, যার মূল্যায়ন কীভাবে অনলাইন পদ্ধতিতে হবে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সেই বিষয়টি নিয়ে মান্য ও সর্বজনগ্রাহ্য কোনও সুপারিশ নেই। এমতাবস্থায় পড়ুয়াদের গড় নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা যেমন বাড়ে, তেমনই এই অপ্রত্যাশিত সঙ্কট থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়ার তাড়নায় শিক্ষা দপ্তর মূল্যায়নের অপ্রমাণিত এমন সব পদ্ধতি গ্রহণ করতে স্কুলগুলিকে বাধ্য করতে পারে, যার ফলে নতুন শিক্ষাপদ্ধতির অবমূল্যায়ন ঘটা প্রায় অবধারিত। মনে রাখা দরকার যে পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলের মাধ্যমিক স্তরের পড়ুয়ারাই সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। এই স্তরে শিক্ষার খামতি পড়ুয়াদের তাদের সমগ্র শিক্ষাজীবনে বহন করে চলতে হবে। এই লকডাউন পর্বে সবচেয়ে দুর্গতিতে পড়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। এই স্তরের সব পড়ুয়ারা, এই সুসংহত নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়নের আওতায় আসত। গত বছরে এরা একটা অংশে বিদ্যালয়ে শিক্ষকের নিবিড় সংযোগের মাধ্যমে মূল্যায়ন-পদ্ধতির মধ্য দিয়ে গেছে, আবার একটা অংশ যাবে এই তথাকথিত অনলাইন পদ্ধতির মাধ্যমে, যার জন্য মূল্যায়নের কোনও মাপকাঠি নেই। এই বছরে শিক্ষা নিয়ে চলেছে মাৎস্যন্যায়, মর্জিমতো পাঠক্রম ছেঁটে দেওয়া, স্বল্প পাঠক্রমের ওপর পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত মূল্যায়ন পদ্ধতির অবনমন ঘটাবে সন্দেহ নেই। এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা এগারো ক্লাসে পরীক্ষা দেয়নি, যেমন এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা নবম শ্রেণিতে পরীক্ষা দেয়নি। আমাদের শিক্ষাকর্তাদের বোধহয় এই সামান্য তথ্যগুলিও মাথায় নেই!

গত বছরে বারো ক্লাস পরীক্ষার কয়েকটি পত্রের পরীক্ষা হওয়ার পর লকডাউনের ফলে বাকি পরীক্ষা বাতিল হয়। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আগের পরীক্ষা বা যে পত্রগুলির লিখিত পরীক্ষা হয়েছে, তার কোনও অংশ থেকে নম্বর নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে ফল প্রকাশ করে দেওয়া হয়, যা পড়ুয়াদের প্রতি চূড়ান্ত অন্যায় করা সন্দেহ নেই।

এতক্ষণ স্কুল স্তরের যে সমস্যাগুলির কথা বলা হল, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে তা আরও তীব্রভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। এই স্তরের শিক্ষাক্রমের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মত, তার ওপর আছে “চয়েস-বেসড ক্রেডিট সিস্টেম” বা সিবিসিএস, যেখানে পড়ুয়া তার বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা সংশ্লিষ্ট নয়, এমন একগুচ্ছ পাঠক্রম থেকে কয়েকটি বেছে নেবে। এই পাঠক্রমটি এখনও স্থিত বা সময় দ্বারা পরীক্ষিত একটি পাঠক্রম হিসেবে না পেয়েছে মান্যতা, না সেটি শিক্ষক ও পড়ুয়া মহলে সমাদৃত হওয়ার মতো অবস্থানে পৌঁছেছে। কয়েকটি সেমেস্টারে তা হয়ত এইবারই দ্বিতীয়বারের জন্য পরীক্ষিত হচ্ছে বা হতে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করে এই পাঠক্রমগুলির বৈচিত্র্য বিপুল। অনেক পাঠ্য বিষয়ের জন্য সুসংহত পাঠ্যবইয়ের অভাব। অনেক বিষয়ে শিক্ষক ও পড়ুয়ার নিবিড় সংযোগ ব্যাতীত পাঠদান বাস্তবত অসম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমন একটি পাঠক্রম হল “চিত্রকলার ইতিহাস ও সেটিকে কীভাবে বিশ্লেষণ ও উপভোগ করতে হবে”। এই পাঠক্রমে পাঠদানের জন্য বিভিন্ন ধ্রুপদী চিত্র দেখা, তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা সরাসরি পড়ুয়া-শিক্ষক সংযোগ ব্যতীত কার্যত অসম্ভব। এছাড়া রয়েছে প্রকল্প-ভিত্তিক কাজ ও তার মূল্যায়ন, যা অনলাইনে করার মধ্যে ঝুঁকি রয়েছে। অসৎ পড়ুয়া অবৈধ উপায়ে পরীক্ষা বা মৌখিক পরীক্ষায় উত্তর করলে তা আটকানোর প্রযুক্তিগত কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রায় নেই।

বিজ্ঞান, চিকিৎসা, কারিগরি প্রভৃতি বিষয়ে পরীক্ষাগারভিত্তিক মূল্যায়ন পুরো পাঠক্রমের প্রায় অর্ধেক। এছাড়া রয়েছে প্রকল্পভিত্তিক কাজ, যা অনেকক্ষেত্রেই দলগতভাবে করতে হয়। এম-টেক পাঠক্রমের শেষ পর্যায়টি একান্তই প্রকল্প এবং হাতে-কলম ভিত্তিক। এই সব পত্রের অন লাইন মূল্যায়ন কীভাবে করতে হবে তার কোনও প্রণালী এখনও জানা নেই। এই একই কথা খাটে বিজ্ঞানের নানান বিষয়ের পরীক্ষাগারভিত্তিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও। এ ছাড়া ক্ষেত্র সমীক্ষা, পুরাতাত্ত্বিক খনন-স্থানে শিক্ষানবিশি, ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচিত স্থান থেকে “ইন সিটু” শিক্ষা, এর প্রতিটিই সময়-পরীক্ষিত শিখন প্রণালীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যা কোনওভাবেই অনলাইন মারফৎ শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব। যে বিষয়ের শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনলাইন অনুপযুক্ত, সেই বিষয়ের জন্য আবশ্যিক দূরত্ববিধি মেনে কীভাবেই বা শিক্ষা বা পাঠদান, আর কীভাবেই বা পরীক্ষাগ্রহণ বা মূল্যায়ন সম্ভব, তার কোনও গ্রহণযোগ্য জবাব শিক্ষামন্ত্রক থেকে পাওয়া যায়নি। আর চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষায় হাসপাতালে লেগে পড়ে থেকে রোগীর সংস্পর্শে না এসে “রিমোট পদ্ধতি” গ্রহণ করে শিক্ষা কীভাবে সম্পূর্ণ হতে পারে সে বিষয়েও কোনও ব্যাখ্যা নেই।

মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে মাৎস্যন্যায় কহতব্য নয়। চূড়ান্ত স্তর বা মধ্যবর্তী স্তরের মূল্যায়ন নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তার চেয়ে অবাস্তব আর কিছু হতে পারে না। একটি বিকল্প হিসেবে উঠে আসছে যে আগের স্তরের পরীক্ষার ফলের কিছু অংশের সঙ্গে অনলাইন মূল্যায়নের কিছু অংশ জুড়ে চূড়ান্ত মূল্যায়ন এবং সেই ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া। যেখানে “বেস্ট অফ থ্রি” পদ্ধতি চলে এবং যেখানে সেটা চলে না, এই দুই পদ্ধতির পড়ুয়াদের মূল্যায়নের মধ্যে খামতি থেকে যাবে যার পরিমাণ বিরাট। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়ে কোনও অধীত জ্ঞান নেই, সেই স্তরে আগের স্তরের অধীত জ্ঞানের জন্য দুবার নম্বর পাওয়া খুবই অনৈতিক কাজ। একই পাঠক্রমের বিভিন্ন স্তরের পাঠের মধ্যে বিষয়বস্তুর গভীরতা, জটিলতা বিভিন্ন। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ বিষয় নিতে হয় চূড়ান্ত স্তরে। সাধারণ বিষয়ে অধীত জ্ঞানের ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ নম্বর দেওয়া আসলে বিশেষ বিষয়ের জ্ঞানের কোনও প্রকৃত মূল্যায়ন না হওয়ারই সামিল। অন্য একটি বিকল্প বলে যা বলা হচ্ছে তা হল পরীক্ষা ব্যতিরেকে উত্তীর্ণ বলে ঘোষণা করা, অর্থাৎ আটক পদ্ধতি পরিহার করা হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আটক পদ্ধতি পরিহার করার বিষময় ফল নিয়ে শিক্ষাব্রতী এবং অভিভাবকরা অনেকদিন ধরেই সরব। মনে রাখতে হবে আমাদের রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় এই আটকব্যবস্থা তুলে দেওয়ার নিরীক্ষাটি চলেছিল স্কুলের মাধ্যমিক স্তরের মধ্যবর্তী ক্লাসগুলিতে, যেখানে পরবর্তী স্তরে “রেমিডিয়াল”-এর সুযোগ ছিল। কিন্তু তৎসত্ত্বেও পুরো পরীক্ষাটি বিরাট ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রায় এক দশকের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা কী কারণে বাতিল করা হচ্ছে তা জানা নেই। আর এখানে তো সুপারিশ হল চূড়ান্ত স্তরে আটক তুলে দেওয়া, যেখানে “রেমিডিয়াল”-এর কোনও সুযোগই নেই। এই ভয়াবহ নীতি যদি বারো ক্লাস এবং স্নাতক স্তরে চালু হয় তবে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে তা সামাল দেওয়া এক কথায় অসম্ভব। এই দুটি স্তর পেরোনোর পর সূক্ষ্ম ছাঁকনির মাধ্যমে এবং আগের স্তরে পাওয়া নম্বরের ভিত্তিতে পড়ুয়ারা মেধাতালিকা-ভিত্তিক বিষয় চয়ন করে থাকে। বর্তমানের সুপারিশ যদি মানতে হয়, তবে কোন স্তরে পাওয়া নম্বরের ভিত্তিতে এই মেধাতালিকা তৈরির কাজ হবে? রাজ্য বোর্ডে দশ ক্লাসের পরীক্ষাটি বোর্ড পরীক্ষা, অন্যান্য অনেক বোর্ডের ক্ষেত্রে তা অন্যান্য শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার সমতুল। একটি সাধারণ মূল্যমানের নিরিখে কীভাবে এই বিশেষ বিচার হবে? সেই একই কথা খাটে এগারো ক্লাসের ক্ষেত্রেও। স্নাতক স্তরেও এই নিয়ে জটিলতা কম নেই। তাই আটক পদ্ধতি তুলে দিয়ে পরীক্ষা না নেওয়া এবং পূর্বের সর্বতোভাবে অসম মূল্যায়নের ভিত্তিতে ছাড়পত্র দেওয়ায় শিক্ষার চূড়ান্ত অবনমন ঘটাবে।

শিক্ষাবিজ্ঞান এবং শিখন পদ্ধতি, এই দুই দিক থেকেই কী শিক্ষাদান, কী মূল্যায়ন, শিক্ষার এই দুটি মূল্যবান স্তম্ভের নিরিখে কেবলমাত্র অনলাইন বা শিক্ষক-পড়ুয়া নিবিড় সংযোগকে জরুরি অবস্থার দোহাই পেড়ে অনলাইন দিয়ে প্রতিস্থাপন করা একেবারেই অকার্যকর ও শিক্ষাবিরোধী একটি পদক্ষেপ।

এই পদ্ধতির সঙ্গে একটি আর্থসামাজিক দিকও যুক্ত আছে।

আমাদের দেশে সামাজিক বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে কোন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ কী কী সামাজিক ও আর্থিক সুবিধা রাষ্ট্রের কাছে থেকে পেতে অধিকারী, বা তাঁর “এনটাইটেলমেন্ট”-এর প্রশ্নটি রাষ্ট্র ব্যক্তির সামাজিক ও আর্থিক বর্গের ভিত্তিতে নির্ধারণ করে থাকে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ পরিবারের ক্ষেত্রে এই তথাকথিত “এনটাইটেলমেন্ট”-এর পরিসর খুবই সীমিত। শিক্ষাক্ষেত্রেও এই খণ্ডিত পরিসরের প্রতিফলন হল শিক্ষায় বিশেষ সামাজিক বর্গের বিশেষ অধিকার। এর অবধারিত ফল শিক্ষাসঙ্কোচন। এর ফলে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমরা সমাজে এখনই দেখতে পাচ্ছি, তার কয়েকটার উল্লেখ করা যাক।

দরিদ্র অভিভাবকের পক্ষে ক্রমবর্ধমান শিক্ষার খরচ জোগানোর অপারগতা, স্কুলছুট এবং শিক্ষার নামে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার প্রসার এই করোনাকালে প্রবলভাবে সামনে এসেছে। সাবেকি স্কুলেই পড়ুয়া পিছু প্রয়োজনীয় শিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার উপকরণের ভয়াবহ আকাল। যে স্কুলে দরিদ্র ঘরের পড়ুয়ার আপেক্ষিক সংখ্যা যত বেশি, সেই সব স্কুলগুলি পরিকাঠামো, প্রশাসন ও অন্যান্য শিক্ষাগত দিক থাকে তত বেশি অক্ষম অবস্থায় দিন যাপন করছে। শিক্ষা প্রশাসনের এক বৃহৎ সময় চলে যায় মিড-ডে মিল এবং কন্যাশ্রী জাতীয় প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার কাজে। আসল শিক্ষার জন্য সময়ের টানাটানি পড়ে।

৮০ শতাংশ (সরকারি ও সরকার-পোষিত) স্কুলের এই হল বাস্তব চিত্র। এই স্কুলগুলিকে সর্বশিক্ষা মিশন বা সমতুল্য নানান প্রকল্পের মাধ্যমে “আইসিটি-সক্ষম” করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল অতীতে, কিন্তু দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, নজরদারি ও বাস্তবোধের ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে তা প্রায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। স্কুল স্তরে সরকার যখন এই অনলাইনের সুপারিশ হাজির করে, তখন সরকারের কাছে এই “আইসিটি-সক্ষমতা”-র কাজের স্পষ্টই অতিরঞ্জিত রিপোর্ট ছিল। ভুল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এই অবাস্তব পরিকল্পনা তাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে সরকার এখন তাঁর নিজের কাজের ক্ষেত্রটি এবং তাঁর দায় শিক্ষক ও পড়ুয়াদের ঘাড়ে চালান করে দিয়েছে। প্রথমত, এই অনলাইন ক্লাস এবং মূল্যায়নের জন্য শিক্ষককে তাঁর নিজস্ব “আইসিটি” পরিকাঠামো ব্যবহার করতে হবে, যার যাবতীয় আর্থিক ব্যয়ভার এখন বহন করবেন শিক্ষক। অন্যদিকে, পড়ুয়ার বাড়িই এই অনলাইন ক্লাসের প্রক্রিয়ায় স্কুলের শ্রেণিকক্ষের প্রসারিত অংশ হয়ে উঠল। এখন এই প্রসারিত শ্রেণিকক্ষের পরিকাঠামো নির্মাণের যাবতীয় দায় বর্তাল পড়ুয়ার, আসলে তার অভিভাবকের ওপর। আর্থিকভাবে পেছিয়ে থাকা পড়ুয়াদের পক্ষে এই পরিকাঠামো নির্মাণ আর্থিক কারণেই অসম্ভব। এর ফলে স্কুল তার দায় এড়াল, আর্থিকভাবে লাভবান হল এবং স্কুলের পরিষেবা বাবদ যাবতীয় পাওনা মেটানো সত্ত্বেও পড়ুয়ার অভিভাবককে তার বাড়িতে স্কুলের পরিমণ্ডল গড়ার দায় চাপিয়ে দেওয়া হল।

আর্থিক দায় ছাড়াও অনলাইন ক্লাসের ফলে অভিভাবকদের ওপর স্কুল তার ওপর ন্যস্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সুকৌশলে অভিভাবকদের ওপর চাপিয়ে দিল। প্রথমত, এই অনলাইন ক্লাসে পড়ুয়া যাতে মনোযোগী হয়, তার জন্য এখন অভিভাবককে পড়ুয়ার সঙ্গে অনেক বেশি সময় কাটাতে হবে, যেটি কাজে নিযুক্ত অভিভাবককদের পক্ষে অসম্ভব। আগে ক্লাসে এই জাতীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায় ও দায়িত্ব বর্তাত শিক্ষক ও স্কুল প্রশাসনের ওপর, ফলে স্কুলের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের অদূর ভবিষ্যতে ছাঁটাই অবশ্যম্ভাবী। পরবর্তী ক্ষেত্রে স্কুলপিছু শিক্ষকের সংখ্যাও কমবে। দ্বিতীয়ত, অনলাইন মূল্যায়নকে মসৃণ করতে ব্যাপকহারে “হোম অ্যাসাইনমেন্ট” দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ব্যক্তি পড়ুয়ার কোনও অসুবিধা হলে আগে হয় শ্রেণিকক্ষে বা স্কুলের অন্য সময়ে শিক্ষকের প্রত্যক্ষ সাহচর্যে সেই অসুবিধা কাটানোর যে পথটি ছিল, অনলাইনে সেই পথটি রুদ্ধ। ফলে সেই দায় ও দায়িত্ব এখন বর্তাচ্ছে হয় অভিভাবকের ওপর বা বাড়তি অর্থ খরচ করে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করে তার ওপর দায় চাপিয়ে। দুটি প্রকল্পই আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলির জন্য বিপদের কারণ।

এরপর রয়েছে এই অনলাইন ক্লাসে যোগদানের জন্য যথাযথ ও প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্য। উপকরণগুলি দুষ্প্রাপ্য না হলেও যথেষ্ট দুর্মূল্য, যা ভারতের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পড়ুয়াদের নাগালের বাইরে। এই অনলাইন ক্লাসে যোগদান করতে না পারার দুশ্চিন্তায় আমাদের রাজ্য সহ সারা দেশে এখনই বেশ কয়েকজন পড়ুয়া আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। এই বিষয়টি এখন আর তাই মোটেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো তুচ্ছ বিষয় নয়।

তথ্য, অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা এবং তত্ত্বের দিক থেকে দেখলে এ কথা স্পষ্ট যে, এই অনলাইন শিক্ষা দেশের বেশিরভাগ পড়ুয়ার ক্ষেত্রেই অকার্যকর, অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিশ্চিতভাবে হানিকর।

সর্বোপরি, বিষয়টির একটি রাজনৈতিক দিক আছে।

শিক্ষায় শ্রেণিবিভাজন নিশ্চিত করার জন্য ভারত সরকারের উদ্যোগ শুরু হয়েছে সেই ইউপিএ-১ সময়কালে। ২০০০ সালে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে পণ্য বলে ঘোষণা করে গ্যাট চুক্তির মতো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য যে গ্যাটস (জিএটিএস) চুক্তি, তাতে ভারত সরকার সই দেয়। ভারতের যে রাজ্যটি এই “সুবিধা” গ্রহণের কথা সর্বাগ্রে ঘোষণা করে এবং এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলি রূপায়ণের স্পষ্ট পদক্ষেপ করে, সেই রাজ্য এবং সরকারটি হল পশ্চিমবাংলার সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। কেন্দ্রীয় স্তরে এই বিষয়ে রূপরেখা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুই বড় বাণিজ্যিক সংস্থার কর্ণধার, বিড়লা ও আম্বানি গোষ্ঠীর ওপর। তাঁদের পেশ করা রিপোর্টের সুপারিশ ছিল— ক. পুরো শিক্ষাব্যবস্থার বেসরকারিকরণ; খ. শিক্ষায় বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সরকারি নজরদারি-ব্যবস্থার অবসান; গ. শিক্ষায় উৎকর্ষের মাপকাঠি বৌদ্ধিক অর্জনের পরিবর্তে অর্থকরী অর্জনকেই ধরা হবে; ঘ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সম্পর্ক হবে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের মতো, কিন্তু সেখানে যৌথ দরকষাকষি বা ট্রেড ইউনিয়নের কোনও অধিকার স্বীকৃত হবে না; ঙ. একই স্তরের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পাঠক্রম তৈরি করতে পারবে এবং প্রতিষ্ঠান তার নিজের মত করে মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্মাণ করতে পারবে; ইত্যাদি। এই মডেলে অনলাইন শিখন পদ্ধতিটিই হবে মুখ্য শিক্ষাদানের উপাদান, সহায়ক উপাদান নয়। এই পদ্ধতির ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যা ইচ্ছে পাঠক্রম, যে কোনও ব্যক্তিকে দিয়ে এমনকি একটিমাত্র ঘর থেকে একটি গোটা বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারবে, যার মূল ব্যবসা হবে কেবল ডিগ্রি বিতরণ করা। এই বিষয়ে দুটি উদাহরণই যথেষ্ট। এক. ধীরুভাই আম্বানি বিশ্ববিদ্যালয় যা পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত হলেও, আজকের ভাষায় ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে, কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদত্ত ডিগ্রি ভারতের সর্বত্র স্বীকৃত, কেননা পশ্চিমবঙ্গ সরকার (বাম আমলের সরকার) বিধানসভায় আইন করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজ্যস্তরে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তা জাতীয় স্তরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমতুল্য বলে ঘোষিত হয়েছে। দুই. পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় বেসরকারি কারিগরি কলেজগুলিকে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি নামক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এনে এই বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষা বিষয়ে এক ধরনের সমতা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এই রাজ্যেরই বহু বছর ধরে চলে আসা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু দিক থেকেই সমতা নেই, অথচ এই দুই ব্যবস্থা থেকে কারিগরি ক্ষেত্রে মানক সংস্থা, এআইসিটিই নির্ধারিত ডিগ্রিই প্রদান করা হচ্ছে। যেখানে সময়-পরীক্ষিত সাবেকি পদ্ধতির ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থায় বিস্তর ফারাক রয়েছে, সেখানে এই আচমকা অনলাইন পদ্ধতিতে সমতা থাকবে, এমনটা মেনে নেওয়া কঠিন।

এইবার আসা যাক আপাতদৃষ্টিতে “আপাতত সমাধান-অযোগ্য” সঙ্কটের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমাদের কাছে কোনও বিকল্প প্রস্তাব আছে কিনা। আমাদের বিকল্পের রূপরেখা এখন পেশ করা যাক।

আমরা বর্তমানে যে “জাতীয় জরুরি অবস্থা”-র কথা শুনছি, সেই জরুরি অবস্থা কোন জাতের এবং কোন ধরনের কাজের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে? প্রথমত সমস্যাটি প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনার, সমন্বয়সাধনের এবং সর্বোপরি তা মূলত একটি জনস্বাস্থ্য ও এপিডেমিওলজিক্যাল সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়। এই সমস্যাটি সর্বব্যাপী হওয়ার পেছনে রয়েছে সমস্যা চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে প্রশাসকদের ব্যর্থতা, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের মানসিকতা, জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে ক্রমাগত অবহেলা, স্বাস্থ্যখাতে ক্রমাগত ব্যয়-সঙ্কোচন ইত্যাদি এবং এই কাজগুলি করার ক্ষেত্রে এই জরুরি অবস্থা কোন প্রভাব বিস্তার করেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রুজি-রুটি এবং পরিবহনের মতো সত্যিকারের জরুরি বিষয়গুলি সমাজজীবন থেকে নির্বাসন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বারে বারে “করোনা বিপদ”, “সোশাল ডিসট্যান্সিং”, “লকডাউন”, “কোয়ারেন্টাইন” ইত্যাদি নিদানের কথা শুনছি। অবিবেচনাপ্রসূত সামাজিক পদক্ষেপ করার কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যের জন্ম হয়েছে, তা আক্ষরিক অর্থেই “ম্যান-মেড”, আর তার সমাধানও “ম্যন-মেড” হবে। গুণমান বজায় রেখেই বর্তমান অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে মসৃণ উপায়ে চালিয়ে নেওয়া যায়, এখানে আমরা তার কিছু কিছু সুপারিশ উপস্থিত করছি।

প্রথমেই কয়েকটি কথা জোরের সঙ্গে বলে নিই। ক. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল শিক্ষাদান করা, বিশেষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া নয়। [আমাদের দেশের শিক্ষাকমিশনগুলি স্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে Educational institutions of our country was not meant for training, but Education, which is a rather different and a more important function]; খ. কোনও অবস্থাতেই, কোনওরকম জরুরি অবস্থার দোহাই দিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি তাদের “Education”-এর মৌলিক দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারে না।

সাবেকি পদ্ধতিতে, অর্থাৎ শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মুখোমুখি বসে শিক্ষা চালাতে গেলে পড়ুয়া, শিক্ষক এবং পড়ুয়াদের পরিবারের মানুষদের প্রাণসংশয় হতে পারে, এমন অবস্থার মুখোমুখি আমরা অনতি-অতীতে যে হইনি এমন নয়। এই  বিষয়ে সমগ্র মানবজাতি এবং আমাদের দেশ এবং আমাদের রাজ্যের প্রশাসকদের অভিজ্ঞতার ঝুলিটি সমৃদ্ধ। কিন্তু শিক্ষাকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার চেয়ে কম “গুরুত্বপূর্ণ” একটি বিষয় বলে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে প্রচারের জন্য যে পরিমাণ সময়, রসদ ও মানবসম্পদের অপচয় করছি তা এককথায় তুলনাহীন। আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ১৯৪৩-এর মন্বন্তর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সঙ্গে শিক্ষা বিষয়ক ক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থা সব দিক থেকে তুলনীয়, যদিও এই দুটি বিপর্যয়ের ব্যাপ্তি, মানবিক ট্রাজেডির পাশে বর্তমান অবস্থা তীব্রতার দিক থেকে অনেক কম। এই দুই ভয়ানক ও ব্যাপক বিপর্যয়ের সময়েও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চলেছে, তার গুণমানের তেমন কোনও অবনমন হয়নি।

প্রথমে আমরা বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতা নিয়ে এবং সেই সময়ে কীভাবে প্রকৃত শিক্ষাদান পদ্ধতি চলেছিল, সেই কথাগুলি স্মরণ করি। অল্প জায়গার বেশি মানুষ এক জড়ো হলে শত্রুপক্ষের বোমারু বিমানের পক্ষে লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিতকরণের কাজ সহজ হয়ে যায়। এই বিষয়ে আমরা অতীতে বা সাম্প্রতিক কালে ইজরায়েলের গাজা আক্রমণের কথা ভাবতে পারি। বোমার আঘাতে সেখানে স্কুলের পর স্কুল ধ্বংস হয়েছে এবং সেই সব স্কুলের ৯৮ শতাংশ পড়ুয়া এক নিমেষে এবং বাকিরা কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যে নিহত হয়েছে। এই কারণে এক স্থানে না জমায়েত করে মানুষকে ছড়িয়ে দিয়ে এই বিপদের পরিমাণ কমানোর নিদান আসে এবং বিপদের নিরিখে ইংল্যান্ড-এ ত্রি-স্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেমন করোনা আক্রান্ত হওয়ার নিরিখে তথাকথিত “সোশাল ডিসট্যান্সিং”-এর নিরিখে আমরা, এখনই আমাদের দেশে ত্রি-স্তর ব্যবস্থা, লাল-কমলা-সবুজ অঞ্চল চিহ্নিত করেছি। কিন্তু এটা করেই আমরা ক্ষান্ত হয়েছি, কিন্তু ইংল্যান্ড এরপর যা যা করেছিল তা নিম্নরূপ:

১) তারা লাল ও কমলা অঞ্চল থেকে সবুজ অঞ্চলে বিদ্যাশিক্ষা কেন্দ্রের অনেকগুলিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদের ঠিকানার ভিত্তিতে আমাদের রাজ্যে আজকে যেমন তাদের “মিড-ডে মিল” বিতরণ করা হচ্ছে এই করোনাকালেও, ঠিক তেমনিভাবে ইংল্যান্ড তাদের ঠিকানার ওপর ভিত্তি করে সেইসব পড়ুয়াদের অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানে সাবেকি ঢং-এ শিক্ষাদান চালিয়ে যায়। এই একই ব্যবস্থা সবুজ ও কমলা অঞ্চলের সংযোগস্থল জুড়ে বিস্তৃত করা হয়।

২) দূরবর্তী গ্রামীণ এলাকায় (এ ক্ষেত্রে বীরভূম, বাঁকুড়া, কার্শিয়াং, কালিম্পং ও দার্জিলিং অঞ্চলে) বিদ্যাশিক্ষাকেন্দ্র সরানো যেতে পারত। শহরের ব্যস্ততম অংশ, বিবাদি বাগ থেকে হাওড়ায় মহাকরণ তো এই আমলেই সরানো হয়েছে রাজ্যের সাধারণ মানুষকে অশেষ দুর্গতির মধ্যে ফেলে।

৩) এইসব এলাকার কিছু কিছু গ্রামকে দিয়ে স্কুল বা কলেজ সাময়িকভাবে “দত্তক” নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারত। বস্তুত, ইংল্যান্ডের নরফোক অঞ্চলের উদাহরণ এক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। এই অঞ্চলে লন্ডন শহরের ঘিঞ্জি অঞ্চলের বেশ কয়েকটি বড় বড় বিদ্যালয়কে সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৫০০ জন পড়ুয়া এই সাময়িক বিদ্যালয়ে আসে। পাশাপাশি ২৩টি গ্রামে এদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ২৩টি বিদ্যালয়ে দুই, ক্ষেত্র বিশেষে তিনটি শিফটে বিদ্যালয় চলে। যে পড়ুয়ারা নানা বাধ্যবাধ্যকতায় এই শিফটে ক্লাস করতে পারল না, তাদের জন্য হোম টিচিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

এই বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকাঠামো আমাদের রাজ্যেও আছে, আমরা সেই পরিকাঠামো ব্যবহার করে অন্য কাজ করি। কন্যাশ্রীর বিভিন্ন প্রোগ্রামে প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে জেলা থেকে সদর শহর, ক্ষেত্রবিশেষে কলকাতায় টেনে আনি এবং এদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সরকার স্কুলশিক্ষা মন্ত্রকের মাধ্যমে করে থাকে। আমাদের রাজ্যে বর্তমানে ২২টি “এডুকেশন জেলা” রয়েছে এবং এইরকম প্রতিটি জেলা পিছু গড়ে ৫০০টি বিদ্যালয় পড়ে। জেলার ১০ শতাংশ বিদ্যালয় এইসব শিক্ষাবর্হিভূত কাজে প্রতি শ্রেণির সেকশান পিছু ১০ জন করে পড়ুয়া ও দুজন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা পাঠালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১১ হাজার! এই কাণ্ড চলে মাসে গড়ে দুবার। এটি পরিচালনা করে স্কুলশিক্ষা দপ্তর, এর জন্য অফিসার সহ অন্যান্য পরিকাঠামো বিদ্যমান। এই কাঠামো ব্যবহার করে এই বিকল্প পরীক্ষার চেষ্টা অবিলম্বে করা উচিত। বছরের বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন ও অন্যান্য শিক্ষাবর্হিভূত কাজে শিক্ষকদের কাজে লাগানোর পরিবর্তে শিক্ষকদের শিক্ষা বিষয়ক কাজে নিযুক্ত করা সামাজিক দিক থেকে অনেক বেশি যুক্তিপূর্ণ। যুব আবাসগুলিকেও এই কাজে লাগানো যেতে পারে। টাকার সংস্থান হতে পারে এমপি-ল্যাড/এমএলএ-ল্যাড বা মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে। আমরা তো বিষমদে মৃত নেশাড়ুদের ফি বছর বেশ কয়েক লক্ষ টাকা খয়রাতি দিয়ে থাকি, অর্থাৎ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য সরকারের ভাঁড়ারে টাকা মজুত আছে। যাঁরা স্কুল সার্ভিস বা কলেজ সার্ভিস কমিশনে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন এবং নিয়োগপত্রের অপেক্ষায় রয়েছেন, তাঁদের ঠিকানা ধরে ধরে এইসব সাময়িক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের জন্য পাঠানো যেতে পারে এবং তাঁদের চাকুরিজীবনে এই সময়কালকে যোগ করার জন্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞপ্তি জারি করা খুব কঠিন কাজ নয়, বিশেষত এই সময়ে, যখন অধিকাংশ কাজই হচ্ছে স্বেচ্ছা-প্রণোদনায়।

প্রশ্ন উঠবে তথাকথিত “সোশাল ডিস্ট্যান্সিং”-এর। বড় “পাবলিক প্লেস” (মন্দির, মসজিদ, গির্জা তো আমরা খুলেই দিয়েছি, ফলে সেগুলি করোনা বিধি মেনেই চালু আছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে), পুজোবাড়ি, কলকাতার জন্য ময়দান, রেস কোর্স, বড় পার্কগুলি ব্যবহার করা যায়। এখানে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানা সম্ভব। বাস নিয়ে আসবে এবং দিয়ে আসবে। এইভাবে পুরো পাঠক্রম শেষ হওয়ার পর এভাবেই পরীক্ষা হবে। জেলায় এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় গোটা কয়েক এসএসসি পরীক্ষা আমরা নিয়েছি, এর জন্য বিশেষ ট্রেন, বাস ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনও অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা চালু রাখার জন্য বিশেষ পরিবহন চালু আছে। মুশকিল হল, শিক্ষাকে আমরা আর অত্যাবশ্যকীয় বিষয় বলে মনে করছি না। কলকাতায় জাপানি বোমার ভয়ে যুদ্ধের সময় কলকাতার বিভিন্ন কলেজগুলি বাংলার প্রত্যন্ত জেলাগুলিতে ছড়িয়ে গিয়েছিল, যেমন বিদ্যাসাগর কলেজ, তৎকালীন রিপন কলেজ। নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজ, সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ যুদ্ধের পর আর উঠে যায়নি, স্থানীয় মানুষ সেই কলেজ চালানোর জন্য অর্থ ও অন্যান্য সংস্থান করেছিলেন।

এইবার আসা যাক যুদ্ধকালীন রাশিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির অভিজ্ঞতায়। এই দেশগুলিতে শিক্ষকদের যুদ্ধে যেতে হয়েছিল, ফলে বিদ্যালয়ে শিক্ষকের আকাল সামাল দেওয়ার জন্য তারা পড়ুয়াদের “টিচিং মেটিরিয়াল” ধরিয়ে দেয়। ইউরোপের অভিজ্ঞতা এই বিষয়ে খুব খারাপ। সেখানে দেখা যায় যে, যারা পড়াশুনায় অপেক্ষাকৃত “পিছিয়ে থাকা” বলে চিহ্নিত হয়েছে, তারা এই ব্যবস্থার সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না, ফলে তারা ক্লাস থেকে ছুট হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পরেই দেখা যাচ্ছে যে যারা এই সব “টিচিং মেটিরিয়াল” ছাড়াই শিখতে পারত, কেবল তারাই রয়ে যাচ্ছে এবং তারা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে যাচ্ছে। এদের সংখ্যা মোট পড়ুয়ার তুলনায় অনেক কম। বেসরকারি স্কুলব্যবস্থা এই পদ্ধতিকে সফল বিকল্প পদ্ধতি বলে প্রচার শুরু করে, কিন্তু তারা এই ব্যবস্থায় যে বিপুল পড়ুয়া স্কুলছুট হয়ে গেল তার হিসেব দেয়নি, যা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গবেষকরা খুঁজে বের করেন।

রাশিয়া এই খুঁতটি দ্রুত ধরে ফেলে এবং অন্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে স্বাভাবিক ক্লাসে প্রত্যাবর্তন করে। যেমন ভূগোলের জন্য অবসরপ্রাপ্ত ভূবিজ্ঞানী বা রসায়নের জন্য বিশ্রামরত ও যুদ্ধে আহত কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করে। এতে শিক্ষাব্যবস্থা অনেক বেশি জোরদার হয়।

কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় “ইভাক্যুয়েশন”-এর সঙ্গে তুলনা করা অবধারিতভাবেই আসবে। যুদ্ধের আগে যেমন কোনও দেশেই এই প্রক্রিয়া বড় মাত্রায় কীভাবে চালানো হবে তার কোনও লিপিবদ্ধ প্রণালী ছিল না, তেমনি আজকেও করোনার সময়ে অবকাশে কীভাবে পাঠানো হবে তার কোনও পরিকল্পনা থাকার কথা নয়। আমাদের এই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য আগের অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে নেওয়া জরুরি। এই বিষয়টিকে কোয়ারেন্টাইন-শিক্ষা বলা যেতে পারে।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনঃস্থাপন করে এই সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব।

যাঁরা এই স্থান নির্বাচনে যাবেন, তাঁরা শুধু স্থান নির্বাচন করবেন এমন নয়, তাঁরা পুনঃস্থাপনেও সহায়তা করবেন। এই দায়িত্ব অবশ্যই প্রশাসনের, শিক্ষক বা অভিভাবকদের নয়। এই কাজে ব্যবহার করতে হবে প্রশাসকদের, যাঁদের বেছে নেওয়ার সময় দেশের জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ পাওয়ার কথা। যেমন আমাদের রাজ্যে রয়েছে সল্টলেকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটুট এবং জাতীয় স্তরে রয়েছে আইএএস ট্রেনিং সেন্টার এবং এই কারণেই তাঁদের সমতুল্য চাকরির চেয়ে অনেক বেশি সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়। প্রথম দফায় স্থাপিত এবং চালু হওয়া স্কুলকে “ফোর-রানার” স্কুল হিসেবে ধরে নিয়ে সেই স্কুলের বিভিন্ন পরিকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে আশপাশে “ক্লাস্টার স্কুল” নির্মাণ করা যায়। বস্তুত এক সময়ে সর্বশিক্ষা মিশন এবং ন্যাশানাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্কে প্রায় এই ব্যবস্থার মতো করেই “ক্লাস্টারিং”-এর সুপারিশ ছিল যা পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্য সরকার মেনে নিয়েছিল। সর্বশিক্ষা মিশনের সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রত্যন্ত “এডুকেশন ডিস্ট্রিট”-গুলিতে এই মডেল বেশ কিছু বছর চালিয়েছে।

আমাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়:

(১) প্রতিটি শ্রেণিতে পুরো পাঠক্রম শেষ করা, তার জন্য যদি শিক্ষাবর্ষ প্রসারিত করতে হয় তো তা করতে হবে; (২) প্রতিটি শ্রেণির জন্য নির্ধারিত পরীক্ষা যথানিয়মে গ্রহণ করা, পরীক্ষা না নিয়ে বা আগের পরীক্ষায় পাওয়া নম্বরের ভিত্তিতে বা তথাকথিত “ইন্টারন্যাল অ্যাসেসমেন্ট”-এর ভিত্তিতে মূলায়ন না করা।

এই দুটি বিষয়ে আমাদের নির্দিষ্ট বিকল্প নিম্নরূপ:

স্কুলের বা অন্যান্য শিক্ষাক্রমের শিক্ষাবর্ষের নমনীয় প্রসারণ। শিক্ষাবিজ্ঞানের এমন কোনও তত্ত্ব নেই যেখানে গবেষণা করে দেখানো হয়েছে যে শিক্ষাক্রম হিসেবে এক ক্যালেন্ডার বর্ষ সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। যেখানে যেখানে মার্চ ২০২০তে সেশন শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে প্রথম চার মাসের পাঠক্রম শেষ করাতে অগ্রাধিকার দেওয়া, অন্যদের ক্ষেত্রেও এই একই ধাপ নেওয়া। শেষ ধাপে গিয়ে সবাইকে এক মাস রেমিডিয়াল ক্লাস দিয়ে করোনা-কাণ্ড না হলে যেভাবে পরীক্ষা হত, ঠিক সেইভাবেই পরীক্ষা নেওয়া। এতে যদি চালু সেশন ১৬ বা ১৮ মাস হয় তাতে কিছু যায় আসে না। কোনও জাতীয় জরুরি অবস্থা ছাড়াই, কেবল নির্বাচন সম্পন্ন করার অপারগতা ও পরীক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার চূড়ান্ত গাফিলতির জন্য ১৯৭২ সালে যাঁরা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিলেন, তাঁরা ১৯৭৫-এর পরিবর্তে ১৯৭৬ সালের শেষে স্নাতক ডিগ্রি পেয়েছিলেন। কোনও জরুরি অবস্থা ছাড়াই সারা রাজ্যের সমস্ত পড়ুয়ারা শিক্ষা দপ্তরের এই মাৎস্যন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন। শিক্ষাবর্ষ বেড়ে যাওয়ায় কিন্তু কেউই সরব হননি!

যে পাঠক্রম চালু আছে, তাকেই বজায় রাখতে হবে, পাঠক্রম সংক্ষেপিত করা যাবে না।

কম্পেন্সেটরি ও রেমিডিয়াল ক্লাস করাতে হবে। এ বিষয়ে এসসিইআরটি সহ অন্যান্য পরিকাঠামো ব্যবহার করা যেতে পারে।

যেসব স্কুলে হলঘর রয়েছে, সেখানে বিদায়ী বর্ষের জন্য দু শিফটে ক্লাসের বন্দোবস্ত করা যায়। সর্বশিক্ষা মিশনের আর্থিক সাহায্যে, সরকারি হিসেবে এডুকেশনাল ডিস্ট্রিক্টের ৯৫ শতাংশ স্কুলে এই সামর্থ গড়ে উঠেছে।

আমাদের রাজ্যে শ্রেণি পিছু গড় পড়ুয়ার সংখ্যা ৪৫ বা তার আশপাশে (২০১৮ সালের সমীক্ষা, প্রথম সংস্থা বা তার সমতুল্য সংস্থা দ্বারা করা)। দুটি শিফটে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে “রি-লোকেটেড” স্কুলে এই ক্লাস করানো সম্ভব।

স্কুলের শিক্ষাদানের দিন এবং পাঠদানের সময় পুনঃসংগঠিত (re-organised) করা, যা অনলাইন বলে এখন যা চলছে, তার ফলে এমনিতেই ঘটে গেছে।

বিশেষ রুটিন ব্যবস্থার প্রবর্তন (special time table)।

এক একটি ক্লাসের সময় কমানো, কিন্তু রেমিডিয়াল দেওয়া। শিফটে ক্লাসের সংখ্যা বাড়ানো (যেমন ৪০ মিনিটের বদলে ৩০ মিনিটের ক্লাস, তিনটির বদলে চারটি ক্লাস)।

এক্ষেত্রে রাশিয়াতে ঘটা একটি বাস্তব ক্লাসের উদাহরণ টানা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

৩ শতাংশ স্কুলবাড়ি, ২০ শতাংশ অন্যান্য প্রশাসনিক ভবন, ৫০ শতাংশ সাময়িক স্কুলের স্থান, বাকিটা খোলা পার্ক— যেখানে যেখানে তিন কিমি-র মধ্যে তিন থেকে চারজন যে কোনও স্কুলের শিক্ষক (এক বা একাধিক) থাকেন, সেখানে “ব্রাঞ্চ স্কুল” খোলা যেতে পারে, যেখানে একই শ্রেণির ১২ থেকে ১৫ জন পড়ুয়া তিন থেকে চারটি লেসন একদিনে নিতে পারে। আমাদের এক একটি বোর্ডের পাঠক্রম একদম এক, কোনও কোনও বোর্ডে বিভিন্ন শ্রেণিতে একই পাঠ্যবই পড়ানো বাধ্যতামূলক, এবং বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়ারা একই বোর্ডের স্কুলে একটিমাত্র সাধারণ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে থাকে। তাই কোথায় পড়ছে, কার কাছে পড়ছে, তার মধ্যে এখনই বৈচিত্র্য রয়েছে, এই ব্যবস্থায় তাই এমন কিছু ধরে নেওয়া হয়নি, যা বর্তমান ব্যবস্থায় অনুশীলন করা হয় না। বরং অনলাইন পাঠদান প্রক্রিয়া বলে ২০১৯ পর্যন্ত কোনও স্কুল বোর্ড কোনও ক্লাসের জন্য স্বীকার করেনি। তাই যে এসব বিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা আমরা বললাম সেগুলি করা সম্ভব যদি আমরা মানসিক বাধা কাটাতে পারি, এবং সেগুলি শিফটে চালানোও সম্ভব।

এইরকম শিফট ভাবা যেতে পারে: (রাশিয়াতে এই মডেল সফল)

৪২.২ শতাংশ (শহরে) প্রথম শিফট
৩৮.২ শতাংশ (ঐ) দ্বিতীয় শিফট
১১.৬ শতাংশ (ঐ) তৃতীয় শিফট
২৫.৪ শতাংশ (গ্রামীণ) দ্বিতীয় শিফট

প্রয়োজনে চতুর্থ শিফট চলতে পারে। রাত ৯টায় শেষ হতে পারে। গ্রামের দিকে এখনই মোবাইল সিগন্যালের অসুবিধার জন্য স্কুল-কলেজের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের অনলাইন ক্লাস এই সময়েই হয়।

শিফট চালানোর জন্য রুটিনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন স্থানীয় সুবিধা-অসুবিধার কথা ভেবে করে নেওয়া যায়।

আগের দিনের পড়ার পুনরাবৃত্তির জন্য ৫ মিনিট সময় রাখা যেতে পারে।

ভাষাশিক্ষা, সাহিত্য ও গণিতের জন্য বেশি ক্লাস দেওয়া, যেহেতু ক্লাসের সময় কমে যাচ্ছে।

অঞ্চলভিত্তিক সার্কুলেটিং লাইব্রেরির ব্যবস্থা করা।

স্কুলবোর্ডের ভাণ্ডারে যে বাড়তি বই আছে, সেগুলি এই লাইব্রেরিতে দিয়ে দেওয়া।

অঞ্চলভিত্তিক বিশেষ “হোমওয়ার্ক” রুম, যেখানে শিক্ষাসহায়ক ও ক্ষুদ্র লাইব্রেরির ব্যবস্থা থাকবে। এই করোনাকালে বেশ কিছু শিক্ষাব্রতী শিক্ষক ও গবেষক, যাঁরা লকডাউনের ফলে তাঁদের নিজস্ব বাসস্থানের অঞ্চলে আটকে পড়েছেন, তাঁরা এই “হোম-ওয়ার্ক” ব্যবস্থা অনেকদিন চালিয়েছেন। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত প্রান্তে এরকম গ্রন্থাগার ও “হোম-ওয়ার্ক” রুমের ব্যবস্থা করার পর তার উপযোগিতা বুঝতে পেরে এখন স্থানীয় মানুষরাই উদ্যোগ নিয়ে সেই ব্যবস্থা চালু রেখেছেন।

এখন প্রয়োজন ঘাটতির সমস্যার সমাধানের দিকে নজর না দিয়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়া ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ-জনিত সঙ্কটের মোকাবিলা করা।

বারো ক্লাস এবং স্নাতক স্তরের চূড়ান্ত সেমেস্টারের জন্য মোবাইল স্কুল, যা ভ্যান থেকে চালানো যায়, তার ব্যবস্থা করা। বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিউজিয়ামের এই পরিকাঠামো আছে, এই পরিকাঠামো সহজেই নির্মাণ করে নেওয়া যায়।

তাই শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে পড়ুয়া ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে দাবি উঠুক:

১) বিদ্যাশিক্ষার প্রতিটি স্তরে (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর) শিক্ষাদান প্রক্রিয়া পুরো পাঠক্রম মোতাবেক সম্পূর্ণ করতে হবে।

২) প্রয়োজনমতো রেমিডিয়ালের ব্যবস্থা করতে হবে। কেমনভাবে সম্ভব, তার রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।

৩) শিক্ষাবর্ষকে প্রয়োজনমতো প্রসারিত করতে হবে।

৪) শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষাবিষয়ক সক্রিয়তার সুযোগ রাখতে হবে এবং সেই সক্রিয়তাকে মূল্যায়নের সময় প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিতে হবে।

৫) অন্যান্য সামাজিক ও আর্থিক সুবিধা (রেশন, বিদ্যুৎ, ১০০ দিনের কাজে দিনের মজুরি দিনে দেওয়া ইত্যাদি) বজায় রাখতে হবে।

৬) দুর্নীতি দমনে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে।

করোনাকালে সারা রাজ্য জুড়ে যদি আট দফায় ৭ কোটি মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য ব্যবস্থা করা যায়, যার পুরোটাই সরকারি উদ্যোগ মারফত সম্পন্ন করা হয়, তাহলে সব মিলিয়ে রাজ্যের ৯০ লক্ষ থেকে এক কোটি পড়ুয়ার জন্য বিকল্প উদ্যোগ কেন নেওয়া হবে না, তা করদাতা জনগণের জানার হক অবশ্যই আছে। পরবর্তী কোনও এক অবসরে আমরা উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং কারিগরি শিক্ষা নিয়ে কী বিকল্প হতে পারে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...