শুভম চক্রবর্তী

সাতটি কবিতা -- শুভম চক্রবর্তী

সাতটি কবিতা

 

পুরনো সেই দিনের কথা

অনেক পুরনো দিন আমাদের ভেতরে শুয়েছে। গুটিয়ে সাপের মতো ফণা নিচু করে ইঁদারাতে। খাবলে খাবলে জল তুলছে, কাদা মাখছে প্রাকৃতজনেরা। ঝড় ও আঁধার নিয়ে একটি মোমবাতি একা জ্বলে আছে খাদের কিনারে, ঠেকা লেগে। হাওয়ায়, তুমুল বেগে মাঝেমাঝে তার শিখা কাঁপে। কাঁপে নির্জ্ঞান। কাঁপে বিবস্ত্র মাতৃকাগণ কাগজের কিঞ্চিৎ ওপরে। দলনেমথনে তার পিণ্ডাকার সুগন্ধী মহিমা ফেনা তোলে। ফেনা দ্রুত ছুটে গিয়ে লাগে, সাগরনিষ্কৃতি হয়ে তটে। মুহূর্তে কত কী ঘটে যায়। তুমি আমি সদাশিব। অনন্য লিবিডো ছেঁকেছেঁনে মধু জড়ো করে রাখি, মধুপর্ক, পাথুরে বাটিতে। যেন আদিম উপমা কোনও সড়সড়িয়ে পাশ ফিরছে বহুদিন পরে। খোঁদলে খোলস-দাগ আঁকা থাকছে চকিত নির্জ্ঞানে।

 

ছাঁচতলায় পাতাবাহার গজিয়েছে

ছাঁচতলায় পাতাবাহার গজিয়েছে। পাতার বাহার তুমি গজাও কবিতা। এ-সময় ঠোঁটের ভেতরে, নাড়িভুঁড়িমাখা এক প্যান্ডোরার বাক্সের ভেতরে, লিপস্টিপ ঠোঁট উঁচু করে আছে, হাওয়ার কার্নিশে বোবা মণীষার সঙ্গে দেখা হয়, মাংসের সঙ্গে দেখা হয়, উবুরছান্তি সোঁদা দুপুরবেলার সঙ্গে ফাঁকতালে দেখা হয়ে যায়। ছাঁততলায় পাতাবাহার গজিয়েছে। গোঁজ গেদে বাঁধা হয়েছে বাছুর আর তার তিড়িংবিড়িং লম্ফঝম্প, খোলা নিসর্গে। খোলা পিঠে একটি প্রজাপতি এসে বসল এইমাত্র, তার ম্যাজিকরিয়াল প্রেক্ষাপট, বুনোগন্ধী দ্যোতনা। একা ঘরে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে গিয়ে দুপুরবেলায় হিসহিসিয়ে কথা চালাচালি আমরা অনুমান করেছি মাত্র। অনুমান করেছি অচেনা বাড়িতে তালিমবিহীন চর্চায় বসন্তের বিলাপ এত দীর্ঘতম কেন। অনুমান করেছি ভাড়া বাড়িতে অনুচ্চস্বর কলকাকলির মূলে কোনও ঐশী প্রেরণার লিঙ্গ বেরিয়ে এসেছিল কি-না প্যান্ট ফেটে। আপাতত নিজের সর্পিল খুঁজে দেখছি এই ভ্রম এই উগড়ানো ক্বাথ  বাইরেও সঞ্চারিত হয়েছে কি-না। বাইরে ছাঁচতলায় পাতাবাহার গজিয়েছে। আমার কবিতা তুমি গজাও পাতাবাহার অথবা আমার পাতাবাহার তুমি গজাও কবিতা।

 

ঘোলাজলে, ঘিলুর ভিতরে

আলো কমে আসিতেছে নাকি ক্রমে আসিতেছে বুঝতে পারি না। অবিমিশ্র আলো নেই, অবিমিশ্র অন্ধকারও নেই। কোটরে, দু চোখে শুধু পাখালির কিচিরমিচির। হাতে গড়া ডানা। হালকা অথচ ভারী সামাজিক তর্জনগর্জন। চোকলা খসে যাওয়া সব মৃত চুনসুরকির দেওয়াল। ভেতরে ভ্যাপসা মতো নিদারুণ বহু-নির্ণয়ের পলকা ফাঁপা তাস ওড়ে, ঘোলাজলে, ঘিলুর ভিতরে। আর বাইরে আছে চাঁদ। শ্বাস ঘন হয়ে এলে গাব দিয়ে তাকেই সেঁটেছি। আলো আছে, আলো নেই সেই এক দেওয়ালে দেওয়ালে।

 

গ্রীষ্মদুপুরের চন্দ্রিমায়

ফ্যান শুধু গরম হাওয়াই টানে। ধারণার দিক থেকে উড়ে আসা টক টক হাওয়া। ভোজবাড়ির এঁটো পাতা, উচ্ছিষ্ট মাছের কাঁটাগুলি। সারাক্ষণ উড়ে উড়ে দিনমানে ঘটাল গোধূলি।  উল্টো করে রোদে মেলা আমাদের জামাকাপড়েরা। চুপসে যাওয়া আমসি আর পুরাতন খবরকাগজ। একটি নৃতত্ত্ব খোঁজ দিতে পারে বরং তোমাকে। আর কিছু বলার নেই। আর কিছু লেখার নেই৷ সবকিছু বলা, লেখা থাকে।

 

আলো ঝিলমিলায়

আমার টিনের ঘরে জাগতিকতার পাখা নড়ে। ফ্রিজের ওপর রাখা কৌটোভরা মুড়ির যোগান। আচারের বয়াম কটা গুড়, লঙ্কা, মায়া দিয়ে ঠাসা। বাইরে প্রশস্ত খাট অল্প ঝোঁকা নাইলন দড়ির। এবং একটি ছবি যা মূলত একই খাটের ভিন্নতর সংজ্ঞায়ন। কাগজে এলানো। পাশেই পুকুরে, জলে, বুড়বুড়ি বৃত্তাকারে বেড়ে, জলেই মিলিয়ে যায়, মুহূর্তজীবীর মায়া নিয়ে। একটি দুটি পাখি শুধু ছটফটায় এমন পতনে, একটি দুটি গ্রামীণতা উবু হয়ে বসে থালা মাজে। যাতে সে ঝকঝকে হয়। আর আলো ঠিকরে গিয়ে লাগে, জাগতিকতার পাখা নড়ে, থামে, কাঁপে, কিছু ঝিলমিলায় আমাদের ঘরে আর মায়াভরা উঠোনে উঠোনে।

 

সাদা সাদা দিগন্ত অবধি

পেয়েছি রগুড়ে ভঙ্গি উঠোনে ভাজানো চাল দেখে। এবার যে মুড়ি হবে। ফুটফুটে, ধবল মুড়িরা। মাটির সরায় আর ঝাঁটার কাঠির দেহে চেপে, ফুটে উঠবে সাদা সাদা দিগন্ত অবধি। খিদের ধারণা নিয়ে এর বেশি কতদূর যাব। বালি দিয়ে মুড়ি ভাজা।  ফট শব্দে ফেটে যাওয়া তালু। আকাশ ফাটিয়ে কবে উড়ে যাবে ব্রহ্মাণ্ড পেরিয়ে। এতটা জানি না আমি। বেশ কিছু কম জেনে আছি। মুড়ির মতন এই জগতের অবতল পিঠে। সূর্য নিভে গেলে জানি চুপসে মিশে যাবে। আমার রগুড়ে ভঙ্গি তাই দীর্ঘস্থায়ী কিছু নয়।

 

আউটসাইডার

কিছুই জানি না আমি বর্গা আর কড়ি। যুবতী জানি না আর জানি না থুত্থুড়ি। আমিও অজানা আর আমার অজানা। এতই বিস্তৃত সে যে, কোনওমতে তার, টিকিমাত্র ছুঁতে পারা অলঙ্ঘ্য পাহাড়। সেই পাহাড়ের নিচে বুঁদ হয়ে বসি। ছিলিমে জ্বালাই আগ ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘে। ডানা মেলে কত পাখি উড়ে গেল একা। আমার একাকী তার হিসেব জানে না। আমার চোখের মধ্যে ঢুকে পড়ে বালি। জলের ঝাপটা তুমি আমার অজানা। আমার পায়ের তলে বিঁধে যাওয়া কাঁটা। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা আমার অজানা। বইয়ের মলাটে খুঁজি সেরকমই ছবি। যে-ছবি দেখেছি আগে অথবা যে-ছবি দেখামাত্র পুরনো জানিয়া দূরে ঠেলে তাকেও জানি না এই স্বীকারোক্তি করি। কিছুই জানি না আমি, আমিও জানি না। যুবতী ইত্যাদি আর প্রভৃতি থুত্থুড়ি।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...