সই সম্পূর্ণা
ঠাগমাবুড়ির একটা তোরঙ্গ ছিল। মরচে রঙা। খুলতে গেলেই ক্যাঁচকোঁচ। তালা ঝুলত পুঁচকে একটা…. কেউ খোলেনি! বুড়িটা মরে যাবার পাঁচ বছর পরেও না। দশ বছর পরেও না। আমি খুলেছিলাম। স্কুল না যাওয়া একটা নিরিবিলি দুপুরে। তার ঘুরিয়ে তালাটা একটু নাড়াচাড়া করতেই খুলে এল। ভয় লাগছিল খুব। কিন্তু কৌতূহল তো! বাগে আনা মুশকিল… তোরঙ্গটার একটা জাদু ছিল কেউ জানত না এতদিন। এমনকি ঠাগমাবুড়ি নিজেও না। ওতে সময় ধরা যেত। দাসপুকুরের বড় কালো গভীর জলটার কাছে গিয়ে দেখো, কেমন সময় টলটল করে…. পা ডোবালে ঠাণ্ডা সময়টা শিরদাঁড়া বেয়ে ওঠে, এক আঁজলা তুলে নিয়ে মুখে বোলাতেই স্পষ্ট বোঝা যায় ছুঁয়ে দিয়ে গেল, আর চোখ মেললেই গা ছমছম করিয়ে আশপাশের গাছগুলো যেন গুড়ি মেরে কাছে এগিয়ে আসতে থাকে সময়ের গপ্প বলবে বলে, তখন টপ করে পা তুলে নিয়ে ভেজা সময়কে মুখে মিলিয়ে দিতে দিতে মেমসায়েবের বাগানবাড়ির আনাচেকানাচে এখনও যে কিছুটা সময় গা ঢাকা দিয়ে আছে তার খোঁজে বেরোতে হয়! মেমসায়েবের কবরটার ওপরে পুরু করে সময়ের আস্তরণ, মেমবুড়ি নাকি এখনও বেরোয় থলি নিয়ে… হয়তো কুড়িয়ে বাড়িয়ে যতটুকু পাওয়া যায় সময়কে ভরতে… হ্যাঁ হ্যাঁ, কবর থেকেই বেরিয়ে আসে! ওইতো পরিষ্কার লম্বা লম্বা ফাটল কবর চিরে দিয়েছে! হাসপাতাল বানিয়েছিল গো সায়েব মেমসায়েবে মিলে। পথের কুকুরদের হাসপাতাল। জঙ্গল জঙ্গল অন্ধকার হয়ে থাকা ও বাড়ি থেকে সময় খালি খসেই যায়। পুকুরটা বুজিয়ে দিল জমির দালালে। নতুন সময় পাতবে নাকি লোকে! ওখানেই বংশানুক্রমে টিকে থাকা রোডেশিয়ানগুলো টিমটিমে বালবের আলোয় দাঁড়িয়ে হউউউউউ করে ডেকে ওঠে সময়কে খানখান করে! সে গল্প নয় আরেকদিন হবে। এদিকে কিন্তু ঠাগমাবুড়ির তোরঙ্গটা সময়কে একটুও ভাঙে না! জমিয়ে রাখে। দেশভাগ না হওয়া সময়ের সাথে সেখানে বাবার প্রথম কবিতার খাতা… ছোটপিসির প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে কিনে দেওয়া শাড়ির রসিদের সাথে ওর মেডিকেল কলেজে আগুনে পুড়ে যাওয়ার ডেথ সার্টিফিকেট, ঠাকুরদাদার খুলনা থেকে পাঠানো চিঠি দিয়ে বুকমার্ক করা মামাদাদুর দেওয়া গীতাঞ্জলি, বিয়ের চিঠি, কে যেন কাকে খুব আশীব্বাদ করে সোনার দুল পাঠিয়েছিল… আশীব্বাদটুকু তোরঙ্গতে রেখে সে মনে হয় দুল নিয়ে চলে গেছে লাল চেলী পরে, শাড়ির ভাঁজে রাখা গুঁড়ো হয়ে যাওয়া প্রসাদী ফুল… ছোট্ট ছোট্ট ঠাকুরের জামা, সিগারেটের কোটোয় রাখা খুচরো পয়সা… দেশ পত্রিকা, হরলিক্স, ধূপকাঠি, খোঁপার কাঁটা, চৈতন্য ভাগবত, মহাভারত, চলন্তিকা, রুপোর গোট, পুরনো ঘি, ডেকাড্রনের অ্যাম্পুল সিরিঞ্জ, ঘুমের ওষুধের শিশি, ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবির অ্যালবাম… বাতিল জামাকাপড়ের স্তূপ… স্টিলের বাসন, কাঁসার বাসন, তামার কোশাকুশি, পুরীর কড়ি, ঝিনুকের ঝাঁপি, টিপ পরানো পারা ওঠা হাত আয়না, জপের মালা-থলি, হারিয়ে যাওয়া চাবি, ছুঁচসুতো, আধবোনা আসন, আট মৃত সন্তানের রেখে যাওয়া স্মৃতি, গানের খাতা, কাজললতা, বাবার পোষাকের একটা স্টার বড় যত্নে মোড়া, ঠাকুরদাদার চশমা আর গুড়াকুর ডিব্বে, ন্যাপথলিনের গন্ধ… স্কুল কামাই করি দিনের পর দিন ওতে মজে… একটু সরিয়ে জায়গা হয়ে যায় আমার পুতুলের, ফেল করা অংক খাতার, নাচের সার্টিফিকেট, রঙ তুলি, ঝুটো গয়নার বাক্সের… টাইম মেশিনটা এখন আমার হাতে। বলে গেছে যা কিছু বিশেষ তা ফুরোয় না। আমাদের সাথে চলে আজীবন… আমরণ…