সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
লকডাউনের নিয়মকানুন একটু আলগা হতেই ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়েছিল মৃত্যুঞ্জয়। সাবেকি এজমালি বসতবাড়ি ছেড়ে নতুন সংসার পেতেছে সে শহরতলির ‘ময়ূরপঙ্খী’ আবাসনে। সংসার বলতে অবশ্য তেমন বড়সড় কিছু নয়, নিজেকে ধরে মাত্র তিনজন মানুষ— বছর পনেরো পুরনো এক বউ মঞ্জুলা, তেরো বছরের কন্যা মধুরিমা, আর সে নিজে। বটুক দত্ত লেনের পুরনো বাড়িতে মাঝেমধ্যে যেতে হয় বটে, তবে তা যেন অনেকটা জমিদারি পরিদর্শনের কায়দায়। বটুক দত্ত লেনের বাড়িতে এখনও মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা, মা, দাদারা থাকেন। নিজের ভাগের ঘরটা দেখেশুনে সাততাড়াতাড়ি ‘ময়ূরপঙ্খী’তে ফিরে আসা। আগে মাসে দুবার-তিনবার যাতায়াত ছিল সাবেক বাড়িতে, লকডাউনের কারণে সেসব বন্ধ আজ মাস তিন-চার। কবে যে এই অবস্থার মুক্তি ঘটবে, কে জানে!
আজ বাইরে বেরোতে পেরে মৃত্যুঞ্জয়ের বেশ ভালো লাগে। মুখে মুখোশ এঁটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে পরখ করে নেয় সে। মঞ্জুলা এখন ঠাকুরঘরে ব্যস্ত। ঘণ্টাখানেকের জন্য নিশ্চিন্ত। একবার উঁকি মেরে গিন্নিকে দেখে নেয় সে। সবে আসন পরিষ্কারের পর্ব চলছে। মঞ্জুলাকে এমন নবকলেবর দেখানো গেল না বলে একটু হতাশ হয় মৃত্যুঞ্জয়। মেয়ে এখনও ওঠেনি ভেবে সেদিকে নজর মেলতেই দেখে মেয়ে তার মুঠোফোনে চ্যাটিং-এ ব্যস্ত। আলতো করে দরজা ফাঁক করে বাবার প্রভাতী নজরদারির দৃশ্যটা নজরে পড়ে না তিন্নির। তিন্নি মধুরিমার ডাক নাম। সদর দরজায় তালা লাগিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বেরিয়ে পড়ে।
আবাসনের লাগোয়া গলি ছেড়ে সদরপথে পা দিতেই অখিলবাবুর সঙ্গে দেখা। ব্যাগ দোলাতে দোলাতে তিনিও চলেছেন বাজারপথে। একটু হেঁকে কথা বলার অভ্যাস অখিলের। মৃত্যুঞ্জয়ের দেখা পেতেই বলে ওঠেন— “কী হে মৃত্যুন! কেমন আছ? কতদিন পর রাস্তায় বেরিয়ে মানুষের মুখ দেখছি। মঞ্জুলা, তিন্নি সবাই ভালো আছে তো?”
অন্য সময় হলে হয়তো সংক্ষিপ্ততম উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইত মৃত্যুঞ্জয়। কিন্তু আজ সে পথে না গিয়ে পথচলতি নানা গল্পে মেতে ওঠে দুজনে। অনেকদিন পর মনখোলা কথাবার্তায় মেতে উঠতে বেশ ভালো লাগে। হালকা গল্প করতে করতে একসময় ওরা পৌঁছে যায় বাজারের দোরগোড়ায়। এখনও তেমন গুছিয়ে উঠতে পারেনি দোকানিরা। বাজারের মুখেই বলাইদার চায়ের দোকান। শহরতলির এই অংশটা আজকের মত জমজমাট হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই বলাই পাল এখানে চায়ের দোকান খুলে ব্যবসা করছে। অনেকদিন পর মৃত্যুঞ্জয়কে বাজারে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হয় বলাই। বলাইদাকে দেখে দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের চায়ের নেশাটা বেশ চাগিয়ে ওঠে।
অন্যদিনের মতো বিছানায় গা এলিয়ে থাকা হয় না তিন্নির। স্কুলে অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়েছে। অতিমারির কারণে রাতারাতি চেনা জগৎটা কেমন অচেনা হয়ে উঠল। প্রথম প্রথম এই গৃহবন্দি হয়ে থাকাটা বেশ পছন্দ হয়েছিল তিন্নির— রোজ নতুন নতুন রান্না নিয়ে মা-মেয়েতে বেশ মেতে উঠেছিল। ডালগোনা কফি, বেবি নান, চিকেন বাটার মশলা, আরও কতরকম রেসিপি। সেই উৎসাহে এখন অবশ্য খানিকটা ভাটা পড়েছে। এমন অবস্থা যে এতদিন টিঁকে যাবে তা হয়তো কেউই আগাম আন্দাজ করতে পারেনি। টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে অলস ভঙ্গিতে হাত চালাচ্ছিল তিন্নি। ঠাকুরঘর থেকে তা নজরে পড়তেই মঞ্জুলা হাঁক পাড়ে— এটা কী হচ্ছে তিন্নি? তুমি বেহালার ছড় টানছ নাকি? তাড়াতাড়ি করো! এক্ষুনি তোমার অনলাইনে ক্লাস শুরু হবে। ফ্রিজের উপরে খাবার রেখেছি। এখন ওটা খেয়ে নাও। আমি উঠে দেখছি।
মা এমনিতে খুব নরমসরম। তবে মাঝেমধ্যেই এমন তিরিক্ষি হয়ে যায় যে তিন্নি তাল মেলাতে পারে না। তিন্নির হাত এখন ঝালা পর্বের ছড় টানার মতো দ্রুত চলতে থাকে।
আজ বেস্পতিবার। ঠাকুরঘরে খানিকটা বেশি সময় কাটবে মঞ্জুলার। বটুক দত্ত লেনের বাড়িতে থাকতে ঠাকুরঘরের কাজ সামলাতে হয়নি কখনও। মাথার ওপর তখন অনেকেই ছিলেন— শাশুড়ি-মা, বড় দুই জা। মঞ্জুলা বাড়ির ছোট বউ। তাই বিয়ের পর থেকে তাকে অনেকটাই আগলে রেখেছিল ও-বাড়ির বড়রা। এখন আলাদা সংসারের পাট পেতেছে সে, তাই সব কাজ তাকেই সামলাতে হয়। তিন্নিকে তাড়া দিয়ে ঘরে পাঠিয়েছে, এবার হাতের কাজগুলো গুছিয়ে ফেলা। আজ অনলাইনে স্কুলের মেয়েদের ডাউট ক্লিয়ারিং-এর ক্লাস নিতে হবে মঞ্জুলাকে। একটু একটু করে এই নতুন ব্যবস্থাতেও বেশ সড়গড় হয়ে উঠছে সে। ধূপ জ্বালিয়ে, আরতি করে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে শুরু করে মঞ্জুলা— ‘দোলপূর্ণিমা নিশি, নির্মল আকাশ…।’ পয়ারের মনদোলানো ছন্দে গমগম করতে থাকে গোটা ফ্ল্যাট।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে তিন্নি। আজ প্রথমেই ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস। তিথি আন্টি বাংলা ক্লাস নেবেন। তিন্নির অবশ্য সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে বাংলা নেওয়ার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। সে চেয়েছিল হিন্দি নিতে। মঞ্জুলারও সায় ছিল এই ব্যবস্থায়। এ রাজ্যের বাইরে বাংলায় কথা বলার লোক কই! তিন্নির বন্ধুদের অনেকেই বাংলা ছেড়ে হিন্দিকেই আঁকড়ে ধরেছে। মৃত্যুঞ্জয় অবশ্য মা-মেয়ের ভাবনায় বাধ সেধেছে। বাঙালির মেয়ে বাংলায় পড়াশোনা করে বাংলা পড়বে না এমনটা ভাবতেই পারে না মৃত্যুঞ্জয়। তার স্কুলজীবনের বাংলা ক্লাসের কথা মনে পড়ে যায়। মৃত্যুঞ্জয়দের স্কুলে বাংলা সাহিত্য বিভাগে ছিলেন তিন দিকপাল শিক্ষক— মণীশবাবু, ননীগোপালবাবু আর নন্দদুলালবাবু। তিনজনের পড়ানোর স্টাইল ছিল একদম আলাদা। বাচনভঙ্গি, স্বরক্ষেপ, উপমার ব্যবহার, নিরলস রস সিঞ্চনে এই মানুষগুলি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নিজের নিজের নিজস্বতা বজায় রেখেই ছেলেদের মজিয়ে রাখতেন এই ত্রয়ী— ছেলেদের ভাষায় থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারে ভাষা-সাহিত্যের প্রতি তার এই অনুরাগের পেছনে স্কুলজীবনের ওই ক্লাসগুলোর খুব বড় ভূমিকা রয়েছে। তার আত্মজা মাতৃভাষা চর্চায় মজবে না— এই কথাটা মেনে নেওয়া মৃত্যুঞ্জয়ের পক্ষে খুব কষ্টের ছিল। অবশ্য এখন অনেক অপছন্দের বিষয়ই মেনে নিতে হয় তাকে। সাংসারিক জীবনে এমনটাই নাকি দস্তুর!
আজ ব্যাগভর্তি বাজার করেছে মৃত্যুঞ্জয়। ‘খোলা মনের পসরা’— কথাটা বেশ মনে ধরে। বিধিনিয়মের রাশ খানিকটা আলগা হয়েছে বটে, তবে এখনও অফিস-কাছাড়িতে হাজিরা স্বাভাবিক হয়নি। আর কি স্বাভাবিক হবে পৃথিবীর জীবন? বাড়ির পথে চলতে চলতে এই কথাগুলোই গভীর গোপন ব্যথার মতো চিন চিন করে বুকের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। রংবাহারি মুখোশে মুখ ঢাকা মানুষজনকে কেমন অচেনা লাগে। মুখের সঙ্গে মনও কি ঢাকা পড়ে গেল মুখোশে? ভাবনার ভারে ভারী হয়ে ওঠা শরীরটাকে বাড়ির পথে এগিয়ে নিয়ে যায় মৃত্যুঞ্জয়।
–মা! বাপি কোথায় গেল গো? আই নিড হিম জাস্ট নাউ। তিন্নির চোখা প্রশ্ন।
–কোথায় আবার যাবে! বাজারে গিয়েছে নিশ্চয়ই। মঞ্জুলা হালকা চালে উত্তর দেয়।
সাতসকালে মেয়ের কেন হঠাৎ করে বাবাকে দরকার হল? নিশ্চয়ই কোনও নতুন আবদার করবে।
–কেন? বাবাকে হঠাৎ দরকার কেন? এই তো সবে বেঙ্গলি ক্লাস হল। কী বললেন তিথি আন্টি? কোনও অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন নাকি? ব্রেকফাস্তের জন্য ময়দা মাখতে মাখতে মঞ্জুলা মেয়েকে জিজ্ঞেস করে।
–এই দেখো না! তিথি আন্টি একটা লাইন দিয়ে বলেছেন এটার ভা-ব স-ম্প্রসারণ করো! কেমন একটা ফানি লাইন! দেখো…
–না বাপু! তোমাদের ওই তিথি আন্টির প্যাঁচালো প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। এ জন্যই বলেছিলাম বেঙ্গলি নেওয়ার দরকার নেই, হিন্দি নাও। তা তোমার বাপি সে-কথা শুনলে তো! বাঙালির মেয়ে, বাংলা শিখবে না!— যত সব পুরনো বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট!
মঞ্জুলার গলা থেকে একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে। রাগে গজগজ করতে থাকে।
টুং টাং— সুরেলা শব্দে ডোরবেল বেজে উঠতেই তিন্নি ছুটে এসে দরজা খোলে। মেয়ের এই তৎপরতায় বেশ অবাক হয় মৃত্যুঞ্জয়, তবে মুখে কিছু বলে না। হাতের ব্যাগ দুটো দরজার পাশে নামিয়ে রাখতে রাখতে খুশিমাখা গলায় সে বলে— মঞ্জু! আজ অনেক বাজার করে আনলাম। এতদিন তো ঝোলানো ব্যাগের দড়ি টেনে টেনে হাত ব্যথা করেছ, নাও এবার হাত খুলে পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করো। আঃ! কতদিন পর বাজার গেলাম। সবাই একেবারে চাকের মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরেছিল।
–যা ভেবেছি তাই! মাথায় করে হনুমানের মতো গন্ধমাদন পাহাড় বয়ে নিয়ে এসেছে। আমার তো এই হেঁসেল সামলানো ছাড়া আর কোনও কাজকর্ম নেই! এখন সোজা বাথরুমে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে নাও। বাইরের জামাকাপড়ে আর ঘরে ঢুকতে হবে না। মঞ্জুলার কড়া ফরমান।
গরম গরম নরম পরোটার টুকরো মুখে পুরতে পুরতে মৃত্যুঞ্জয় বলে ওঠে— বাহ! এ তো চমৎকার কথা! মাধবী মধুপে হল মিতালি, এই বুঝি জীবনে…। তিন্নি! লিখে ফেল…
–আর আদিখ্যেতা কোরো না তো! অ্যাডোলেসেন্সের সময়। এখন এ সমস্ত ভালগার কথাবার্তার কী রিপারকেশন হবে তা একবার ভেবে দেখেছ? মালতী না মাধবীর সঙ্গে মধুর মিতালি! এমন কথা এখন থেকে কানে গেলে পরে আর মেয়েকে সামলাতে পারবে ভেবেছ! মাধবী আর মধুর প্রেম নিয়ে পড়েছেন!! যতসব আদিখ্যেতা!— মঞ্জুলার স্বরে আমফানের আভাস।
স্ত্রীর কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে মৃত্যুঞ্জয়। মঞ্জুলাকে বলে— আরে! ওটা মধু নয়, ম…। স্বামীর কথা শেষ হওয়ার আগেই মঞ্জুলা রেগে গিয়ে হনহনিয়ে তিন্নির ঘরে ঢুকে যায়। পরোটার বাকি টুকরোগুলো মুখে ঢোকাতে ঢোকাতে মৃত্যুঞ্জয় তার ভারী গলায় গেয়ে ওঠে— মাধবী মধুপে হল মিতালি…
বিতর্কটা ইতিমধ্যেই অন্য খাতে বাঁক নিয়েছে। মঞ্জুলা এখনও শান্ত হতে পারেনি। চায়ের কাপটা ঠক করে মৃত্যুঞ্জয়ের সামনে নামিয়ে রেখে বলে— বাবাদের কি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে কোনও হুঁশ থাকতে নেই? টুয়েন্টি মার্কসের অ্যাসাইনমেন্ট, অথচ এমন একটা বিষয় নিয়ে লিখতে দিয়েছেন যে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝার জো নেই। এজন্যই বলেছিলাম সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে বেঙ্গলি অপ্ট কোরো না। আমার কথা তো শুনলেই না, কেবল মাদার টাং-মাদার টাং করে হেদিয়ে মরলে। যত্তসব!
মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারে এখন এই ভাব সম্প্রসারণ প্রসঙ্গ তুললেই আরেক প্রস্থ ঝড়ের দমক সইতে হবে। তাই ও পথে না হেঁটে বলে— আচ্ছা মঞ্জু, গানটা কে গেয়েছিল বলো তো? আমি একটু কনফিউশনে আছি। খুব সম্ভবত গানটা আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া। এই অবসরে গানটা সে আবারও দু কলি গেয়ে ওঠে।
–কী করে যে তোমার এখন গান আসে জানি না! দেখছ মা-মেয়েতে মিলে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছি, আর তুমি টেবিলে তাল ঢুকে মাধবী মালতি করছ! ডিসগাস্টিং! মঞ্জুর কণ্ঠে ধানিলঙ্কার ঝাঁঝ।
গলার স্বরটাকে যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলে ওঠে— মনে পড়েছে, মনে পড়েছে! গানটা দেয়ানেয়া ছবিতে ছিল আরতির কণ্ঠে, তনুজার লিপে। কথা, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। আর সুর, সুর… হ্যাঁ, শ্যামল মিত্র! ওহ! যেমন গান, তেমনই গ্রেসফুল অ্যাক্ট্রেস। ওহ! ওই সময় তনুজাকে দেখতে কী গর্জিয়াস ছিল! মঞ্জু! তুমি দেখেছ দেয়া… তুমি চলে গেছ?
চোখ খুলে মঞ্জুকে না দেখতে পেয়ে বেশ হতাশ হয় মৃত্যুঞ্জয়। বুঝতে পারে দাম্পত্য জীবনের সব সুর সবসময় এক সরগমে বাঁধা থাকে না।
তিন্নির আজ নাজেহাল দশা। কী করবে তা ভাবতে ভাবতেই বুঝি দিনকাবার। নিজের স্কুলের ব্যাকরণ বই ছাড়াও বেশ কয়েকটা ব্যাকরণ বই তোলপাড় করে খুঁজেছে সে, কিন্তু কোথাও মাধবী আর মধুপের দেখা পায়নি— মিতালি তো কোন ছাড়! গুগল আঙ্কেলের সার্চ ইঞ্জিন ঘেঁটেঘুঁটে ঘোল, কিন্তু ওই লাইনের দেখা নাই রে, লাইনের দেখা নাই। যতবার খোঁজার চেষ্টা করেছে ততবারই কানে ভেসে আসছে গানের চেনা কলিগুলো। খাটের ওপর পড়ে রয়েছে সকালের জলখাবার। গরম গরম তুলতুলে পরোটাগুলো এখন ঠান্ডা হয়ে জুতোর শুকতলার চেহারা নিয়েছে। অবশ্য সেদিকে তিন্নির ভ্রূক্ষেপ নেই। হাতে ধরা মুঠোফোনের বোতামগুলো টিপে টিপে আঙুল ব্যথা হয়ে গেলেও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। বারংবার একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দ কানে ভেসে এসেছে— অল লাইনস আর বিজি।
–ধুত্তোর! যখনই দরকার তখনই লাইনগুলো ব্যস্ত হয়ে থাকে। হোয়াট টু ডু নাউ মম? টুয়েন্টি মার্কসের অ্যাসাইনমেন্ট! নট এ ম্যাটার অফ জোক! খাটের একপাশে বসে থাকা মঞ্জুলাকে তীব্র কণ্ঠে প্রশ্ন করে তিন্নি।
মঞ্জুলাও হাত গুটিয়ে বসে নেই। নিজের চেনাপরিচিত অভিভাবিকা-বান্ধবীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে চলেছে সেই থেকে। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে জেগে ওঠে তিন্নির ফোন। স্ক্রিনের ওপরে ফুটে উঠেছে মেঘরঞ্জনীর নাম। তিন্নির প্রিয় পাঁচ বান্ধবীর একজন।
–হাই মেঘা! কতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি জানিস?… বেঙ্গলি অ্যাসাইনমেন্টটা করেছিস?… হয়নি?… তোরা সবাই মিলে প্রোটেস্ট করেছিস? ইটস ট্রু?… হোয়াট আ টপিক ইয়ার! আমার বাপি বলল এটা একটা গানের কলি। মাই বাপি নোজ দ্য সং।… তিথি ম্যাম রাজি হয়েছেন এটা চেঞ্জ করে দিতে?… ইটস গ্রেট!… ঐন্দ্রিলা, সুলগ্না, সোহিনী সবাই ফেসিং দ্য সেম প্রবলেম?… তুই আমাকে জানাস… বাই! খানিকটা স্বস্তির হাসি হাসে তিন্নি।
অনেকক্ষণ পরে মেয়ের মুখে চলকে ওঠা হাসি দেখে মনে মনে খুশি হয় মঞ্জুলা। যাক শেষ পর্যন্ত লোহা নুইয়েছে তাহলে! পড়ে থাকা পরোটাগুলো তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলতে বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় মঞ্জুলা।
ডাইনিং স্পেস এখনও এক ঠায় বসে আছে মৃত্যুঞ্জয়। একমনে খবরের কাগজ পড়ছে।
–কী, সঙ্কট কেটে গেল? তিন্নিকে লাইনটার মানে বুঝিয়ে দিয়ে এলে? ও লিখছে? মঞ্জুলাকে ঘর থেকে বেরোতে দেখে মৃত্যুঞ্জয় পরপর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় তাকে।
–ম্যাম হ্যাজ এগ্রিড টু চেঞ্জ দ্য টপিক। একটা নতুন বিষয় দেবেন বলেছেন। ঠান্ডা গলায় বলে মঞ্জুলা।
এমন সময় তিন্নির ফোন বেজে ওঠে। খাটের ওপর রাখা মুঠোফোনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেয়ে। মা-ও ছুটে যায় রান্নাঘর থেকে। দুজোড়া উদগ্রীব চোখের সামনে স্ক্রিনের উপর ভেসে ওঠে নতুন বিষয়— ভুলগুলো সব আন রে বাছা বাছা। বুকভাঙা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মা-মেয়ের বুক থেকে। দুজনে বিস্ফারিত নয়নে মনে মনে বলে, সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বেঙ্গলি নিয়ে বড্ড ভুল হয়েছে!
Ses ta onoboddyo!
lekhar goti jeno puro onami sundor jhorna!!